নিভৃত দহনে পর্ব-৩৮+৩৯

0
44
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৩৮)
নুসরাত জাহান লিজা

তুহিন আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ আগেই বাসায় ফিরে এসেছে। ইলা বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করল,

“আজ এত দ্রুত ফিরলে যে?”

“হুম।”

উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না বলে এড়িয়ে ভেতরে চলে এলো। জহুরার কোলে নিজের মেয়েকে দেখে কোলে নিল।

“তোর কি শরীর খারাপ?”

“না মা।”

আবারও গুম হয়ে গেল, মেয়েকে কোলে নিয়েই নিজের ঘরে এসে বিছানায় বসল। একটু রোগা শরীর হলেও গলায় ভীষণ জোর মেয়ের। বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে। তুহিনের মনে হলো, কেউ যদি ওর কাছ থেকে মেয়েকে নিয়ে যেতে চায়, ওর কেমন লাগবে! ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মেয়ে কেঁদে উঠল, ব্যথা পেয়েছে ভেবে সতর্ক হলো সে।

তপা কী করে দর্পণকে আগলে রাখে সে দেখেছে। বোনের সাথে ওর এক আলোকবর্ষ দূরত্ব। ওদের মানসিকতাতেও বিস্তর ফারাক৷ বোনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই সে পছন্দ করে না৷ নিজের স্বার্থ চিন্তা করে ঠকিয়েছেও। তবুও এত বড় ক্ষতি জেনে বুঝে সে কখনো করতে পারবে না।

একদিন নিজের মেয়ে বড় হবে, ভালো-মন্দ বুঝতে শিখবে। ভালোবাসতে শিখবে, ঘৃণা করতে শিখবে। নিজের মেয়ের চোখে সে ঘৃণা কী করে দেখবে!

ইলা ভেতরে এসে জিজ্ঞেস করল, “কোনো সমস্যা হয়েছে? বিজনেসের কোনো প্রবলেম?”

তুহিন বাইরের বিষয় নিয়ে ইলার সাথে তেমন কথা বলে না। ওর মনে হয় এসব বিষয় বুঝবে না। শুধু শুধু বলে লাভ কী! জটিল বিষয়গুলো ছেলেদের জন্য কেবল। ইলাও এখন আর কোনো প্রশ্ন করে না।

আজ কী মনে করে বলল, “বসো। বলছি।”

ইলা সব শুনে বলল, “তুমি কী সিদ্ধান্ত নিলে?”

“আমার কী করা উচিৎ?”

তুহিন এই প্রথম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে স্ত্রীর পরামর্শ চাইল।

“তুহিন, উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা ভালো। কিন্তু অতি উচ্চাকাঙ্খা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটা মানুষকে লোভী হতে প্ররোচিত করে। তপাকে আমিও যে খুব একটা পছন্দ করি তা না। কারণ ও আমাকে সেভাবে ভাবে না। তবে ইদানিং আমার ওর প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা কাজ করে। পরে কখনো দেখা হলে আগে যা যা বলেছি তার জন্য স্যরিও বলতে চাই।”

কিছুটা থেমে আবারও ইলা বলতে শুরু করল, “কবীরের সাথে তোমার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তপার জন্যই। যখন সম্পর্কটা আর টেকেনি, তখনই তোমার সরে আসা উচিত ছিল। তাহলে আজকের এই দিনটা দেখতে হতো না। তপা যখন ডিভোর্সের জন্য উঠেপড়ে লাগল, আমার মনে হতো, কেন শুধু শুধু ওমন বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে আসছে! যেচেপড়ে পাঁকে কে নামে! যতই স্বাধীনচেতা মেয়ে হোক, কেউই শখ করে ঘর ভাঙতে চায় না তুহিন। এটা আমি এখন উপলব্ধি করি। কবীরকে ও খুব কাছ থেকে দেখেছে। সে কেমন সেটা ওর চাইতে ভালো আর কে জানবে। আমাদের উচিত ছিল তপাকে বিশ্বাস করা।”

তুহিন ইলার দিকে আজ প্রথমবার অন্যরকম চোখে তাকাল। ইলা বরাবরই সংসার ঘেঁষা মেয়ে। শাড়ি, গহনা, রান্নাবান্না আর আসবাবপত্রের বাইরে তেমন কোনো কথা সে বলে না। সময় দেয়া নিয়ে ঝগড়া করে, আজ কেমন অন্যরকম সুরে কথা বলছে। ইলা কি বদলে গেছে নাকি আগে থেকেই এমন ছিল, তুহিনই দেখতে পায়নি, কিংবা দেখার চেষ্টাই করেনি!

“এখন এমন উভয় সংকটে পড়েছ। বাড়ির কাজ কবীরের ডেভলপার করে দিচ্ছে। অন্য ক্ষতিও করতে পারে।”

তুহিনের চোখে তপার দৃঢ়চেতা মুখটা ভেসে উঠল। বাবার আদর্শের কথা মনে পড়ল। মনে হলো তপা তো ওর নিজেরই বোন। একই ঔরসে ওদের জন্ম। তপা যদি এতটা সাহস দেখাতে পারে, সে কেন পারবে না!

বহুদিন পরে জীবন ওকে সত্যিকারের মনুষ্যত্বের পরিচয় দেবার সুযোগ করে দিয়েছে। জীবনে একবার মানুষ হতে পারবে না সে! নইলে মেয়ের ঘৃণা জুটবে। মনে মনে দোয়া করল, ওর মেয়ের জীবনে যেন কবীরের মতো কোনো মানুষ কখনো না আসে।

***
দর্পণের ইদানিং অভ্যাস হয়ে গেছে ঘুমানোর আগে ছাদে খোলা বাতাসে ছুটে বেড়ানো। রাতে খাবার পর থেকেই সে রাফিদকে অস্থির করে ফেলে, “তাদ দাব, দাফেত বাবা।” বলে বলে।

এখন তপাও সাথে আসে। তিনজনের জোছনা বিলাস দারুণ জমে উঠে। রাফিদ যেদিন প্রথম দেখেছিল, তপা দর্পণকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানি গান গাইছিল। পরের জোছনা ভেজা এক রাতেই সুপ্ত ইচ্ছে জেগেছিল, একটা পরিবার হয়ে যদি চাঁদ দেখা যেত! সেই স্বপ্নের বাস্তব চিত্রায়ণ যে কী ভীষণ সুন্দর!

দর্পণ ছুটে বেড়াচ্ছে, রাফিদও ছুটছে সাথে সাথে। দ্রুত দৌড়ানো শিখেছে মাত্র, ব্যালেন্স ছুটে গেলেই পড়ে একটা দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। ভীষণ দূরন্ত হয়েছে। তপা কিছুটা গলা চড়িয়ে বলছে,

“ব্যাথা পেলে কিন্তু কাঁদতে পারবি না।”

দর্পণকে এখন বকা দিলে বুঝতে পারে, এখনও বুঝে চুপ করে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে পড়ল। যেকোনো মুহূর্তে কেঁদে ফেলবে। রাফিদ ওর হাত ধরে বলল,

“এবার বাবার কোলে আয়, আমরা চাঁদ মামাকে ডাকি।”

দর্পণের নড়চড় নেই, সে অভিমান করেছে।

তপা হেসে দর্পণের গাল টেনে বলল, “গাল ফোলানো কোথায় শিখেছিস?”

রাফিদের হাত আঁকড়ে ধরে কোলে উঠার ইঙ্গিত করতেই সে কোলে তোলে নিল।

“ছোট্ট মানুষ। আস্তে আস্তে বুঝবে তো। এখনই এভাবে বলতে হয়?”

তপা বলল, “কখন বলব? পড়ে হাত পা ভাঙার পরে? ওর তো জানতে হবে যে চাইলেই সবকিছু করা যায় না, তার জন্য আদরের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে একটু শাসন করতেই হবে।”

রাফিদ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। নিজের বাবার মুখটা মনে পড়ল। বাবাও কি তবে এজন্যই ওকে…

কিন্তু তপা তো দর্পণকে আদরের পাশাপাশি ভীষণ মিষ্টি করে শাসন করে। আর বাবা কবে ওকে ভালো করে বুঝিয়ে কিছু বলেছেন, ওর মনে পড়ছে না৷ অভিমানে ম্লান হয়ে আসে রাফিদের মুখ।

“তো এখন বাবা-ছেলে দুজনেই মুখ কালো করে বসে থাকো।”

তপার কথায় রাফিদের মুখে হাসি ফুটল, দর্পণ ওর ছেলে, কথাটা তপার মুখে যতবার শুনে, নিজেকে ভীষণ পূর্ণ মনে হয় রাফিদের। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ওর একটা পরিপূর্ণ সংসার, যেখানে ঘর ভরা কেবল ভালোবাসা।

তপা ততক্ষণে দর্পণকে কোলে নিয়েছে, “রাগ করেছিস বাবা? পড়ে গেলে ব্যথা পাবি। তখন ওষুধ খেতে হবে এত্তগুলা। তখন ভালো লাগবে?”

এই ওষুধে কাজ হয়েছে, দর্পণ ওষুধ খেতে একেবারেই পছন্দ করে না।

মাথা দু’দিকে কয়েকবার নাড়িয়ে সে বলল, “পঁচা।”

“তাহলে দেখে দৌড়াতে হবে, তাই না? ওভাবে হুড়োহুড়ি করে দৌড়ানো যাবে না। মনে থাকবে?”

মাথা উপরনিচ করল দর্পণ।

“এখনো রাগ করে আছে আম্মুর উপরে?”

মাথা দু’দিকে দোলাল এবার, তপা দর্পণের গালে কপালে চুমু খেল, “তাহলে আম্মুকে আদর করে দে।”

দর্পণও তপার কপালে চুমু খেলে, রাফিদ কপট অভিমানী গলায় বলল, “একা মাকে আদর করবি, আমার আদর কই?”

দর্পণ এবার হাত ইশারা করে রাফিদকে কাছে ডাকল, এরপর একই কাজ করল। মুহূর্তটা এত অপূর্ব মনে হলো রাফিদের কাছে! এই অপূর্ব মুহূর্তের স্বাক্ষী হয়ে রইল বহুদূরের ওই চাঁদ আর অজস্র নক্ষত্র।

***
মলিনা নীলাকে স্কুলে আনা-নেয়া করে। নীলার স্কুলের টিফিনবাক্স সে ভীষণ যত্ন করে ভর্তি করে দেয়।

আজ স্কুলে দিয়ে ফিরছিল, মনে হলো যেন কেউ ওর পিছু নিয়েছে। কিন্তু ঘুরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। সে বাসায় ফিরে এলো। বিষয়টাকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো না ওর কাছে।
……………
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৩৯)
নুসরাত জাহান লিজা

শিরীনের মোবাইল বাজছিল, তিনি ঘরে নেই, জয়নুল হাতে নিয়ে দেখলেন রাফিদের কল। তার ভীষণ ইচ্ছে করছিল কলটা রিসিভ করতে। ছেলের গলাটা শুনতে। কিন্তু তিনি ধরলেন না। স্ত্রীকে ডাকলেনও না। কল কেটে যাবার পরে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলেন। রাফিদের কন্টাক নম্বরের ইনবক্সে ঢুকলেন। এক তীব্র কৌতূহল থেকে। ছেলে ভালো আছে তো! শিরীন ছেলেকে নিয়ে কথা বলেন না। তিনি নিজে থেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন না। কোথায় যেন বাঁধে!

অসংখ্য ছবি আর ভিডিও পাঠিয়েছে রাফিদ, বেশিরভাগই দর্পণের। বেশ আদুরে আর দুষ্টু ছেলে তো! অনেক সেলফিও আছে দুজনের। রাফিদের সাথে দর্পণের চমৎকার মুহূর্তে সেলফি নিয়েছে, সেগুলো মাকে পাঠিয়েছে। কেমন বাবা বাবা লাগছে রাফিদকে। সুখী সুখী মুখাবয়ব ছেলের, অবচেতনেই তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল। যে ছেলে নিজেই কিছুদিন আগে এতটুকু ছিল, সে এই কয়দিনেই কেমন বাবা হয়ে উঠেছে। দেখে ভালো লাগল তার। দায়িত্ব নিতে শিখছে কিছুটা হলেও। তবুও কিছু করার চেষ্টা করছে কী! এটাই তার আক্ষেপের জায়গা।

সহসা পদশব্দে তিনি আঁতকে উঠলেন, মুঠোফোন হাত থেকে রাখার সময় পেলেন না, তার আগেই শিরীন ভেতরে চলে এলেন। তিনি ভীষণ অপ্রস্তুত গলায় বললেন,

“তোমার কল এসেছিল, এই নাও।”

আরও দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তিনি ফিরিয়ে দিলেন, স্ত্রীর অগোচরে অন্যসময় দেখতে হবে। শিরীন কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি মেলে। তাকে পড়ে ফেলছে নাকি! তবে ভাগ্য ভালো তিনি এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না। বললেন,

“কে কল করেছিল?” বলে দেয়ালে টাঙানো ঘড়িতে সময় দেখে বললেন, “রাফিদ নিশ্চিত। খাবার দেয়া হয়েছে। তুমি শুরু করো। আমি কথা বলে আসছি।”

“একসাথেই খাওয়া যাবে। তুমি কথা শেষ করো। আমি এখানে বসছি।”

তিনি এই কথোপকথন নিজের কানে শোনার লোভ সামলাতে পারলেন না। স্ত্রীর শীতল দৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি বসলেন৷

“কেমন আছিস রাফিদ?”

“তুমি কেমন আছো মা? ওষুধ খেয়েছ তো?”

“খাবার আগেরটা খেয়েছি। পরেরগুলো খেয়ে খাব। দর্পণ ঘুমিয়েছে?”

“না, এই যে দেখো। ওর মা খাওয়াচ্ছে ওকে।”

তপা তাকে সালম দিলো। দর্পণ হাত নাড়ল তাকে দেখে।

“দাদু, কী করে?”

দর্পণ প্লেট থেকে কিছু খাবার হাতে নিয়ে তার দিকে দেখালো, তিনি হা করলেন, “এসো, এসো, খাও।”

তাকে ওর কাছে যেতে বলছে, “আমি গেলে আমাকে খাইয়ে দিবি?”

উদ্ভাসিত হাসিমুখে মাথা উপরনিচ নাড়ল দর্পণ। শিরীন হাসলেন, “অনেক আদর দাদুর জন্য।”

রাফিদ এবার নিজের দিকে ফোকাস করে বলল, “ওকে এখন ছাদে নিয়ে যেতে হবে চাঁদ দেখতে। তারপর তিনি ঘুমুবেন।”

রাফিদ এবার খানিকটা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “বাবা কেমন আছে, মা?”

শিরীন জয়নুলের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, “ভালোই আছে।”

জয়নুল সবই শুনলেন, তিনি আশা করেননি রাফিদ তার কথা জানতে চাইবে। তার ভালো লাগল ভীষণ। ইচ্ছে করল ফোনটা নিয়ে তিনি কথা বলেন, এবারও নিজের ইচ্ছেকে প্রবলভাবে দমন করলেন।

কতদিন পরে ছেলের গলার স্বর শুনলেন, একদিনের জন্য এটাও একটা প্রাপ্তি। তার ভেতরের বরফ কবেই গলে গেছে, বাইরের জমাট তিনি ধরে রেখেছেন, ছেলের ভালোর জন্য।

***
কবীর কনসালট্যান্টের সাথে কথা বলেছে। সে বলেছে, তপার কাছের কারো স্বাক্ষী বেশি কার্যকরী হবে। সেজন্যই তুহিনকে প্রস্তাব দেয়া। হারা*জা*দাটা এখন বেঁকে বসল কেন ওর বোধগম্য হচ্ছে না। শয়*তান সাধু হতে চাইছে। ওর নুন খেয়ে এখন ওকেই চিনতে চাইছে না। এর ব্যবস্থা সে অবশ্যই করবে।

কনসালটেন্ট আরেকটা বুদ্ধি বাতলে দিয়েছে। তপার গৃহকর্মী যদি রাফিদের বিপক্ষে কিছু বলে এর চাইতে ভালো আর কিছুই হয় না। তুহিন তো দূরে থাকে।

কবীর সাথে সাথে নিজামুলের সাথে যোগাযোগ করল, লোকটা ওর ডান হাত। দশ ঘাটের পানি খাওয়া লোক। নিজামুল সিলেটে ওর একজন খাস লোককে নির্দেশ দিল তপার যাবতীয় বিষয় খোঁজখবর করতে। অফিস আর বাসার ঠিকানা দিয়ে দিল।

***
মলিনাকে যে ফলো করছে তার নাম আকমল। আগে ড্রা*গ*সের কারবার করত, ফজলু ধরা পড়ার পরে ওদের র‍্যাকেটের অনেকেই ধরা পড়েছে। বাকিরা আপাতত গা ঢাকা দিয়েছে। হেফাজ ভাই ওকে ডেকে নতুন একটা কাজ দিয়েছে। একজনের গতিবিধির উপরে নজর রাখা, সময় সুযোগমতো একটু ভয় দেখিয়ে হোক, টাকার লোভ দেখিয়ে হোক, মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি করানো।

দুইদিন ফলো করতেই সে নীলাকে চিনতে পারল। এই মেয়ের জন্যই ওদের এই দূর্গতি। কাজ তো ওই মহিলাকে দিয়ে সে করিয়ে নেবেই, কিন্তু ওই পিচ্চি মেয়েটাকে সে ছাড়বে না। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে সে। মন দিয়ে তাই কাজটা করছে আকমল, নিজেত গরজেই৷

***
সোমা খুব চেষ্টা করছে মানিয়ে নিতে, তবুও কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। এখন হাঁপিয়ে উঠেছে৷ অফিসের নানা চাপ সামলে বাসাও আরেকটা চাপ সামাল দিতে হয়।

এরমধ্যে রবিনের ট্রান্সফারের নির্দেশ এসেছে। সোমা সদ্য বদলি হয়েছে, এই মুহূর্তে ওর বদলি সম্ভব হবে না। রবীনের সাথে যেতে চাইলে ওকে চাকরিটা ছাড়তে হবে। সব মিলিয়ে ভীষণ বিপর্যস্ত হয়ে আছে সে।

রবীনের মা বললেন, “ছেলেটা ওইখানে একা থাকবে? তুমি চাকরিটা ছাড়লেই তো পারো।”

কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছে না সোমা। মায়ের সাথে কথা বললে তিনি কীভাবে নেবেন! এমনিতেই তার শরীর ভালো যাচ্ছে না। তাকে এই উটকো টেনশন দেয়া কি ঠিক হবে!

এইবার রবিনও এতে মত দিয়েছে। এটাই সবচাইতে ভালো সল্যুশন। সোমার তপার কথা মনে পড়ল, ওর সাথে একবার পরামর্শ করা যেতে পারে।

***
আজ তলার ফিল্ড ভিজিটে রাফিদও এসেছে দর্পণকে নিয়ে। ওই ঘটনার পর থেকে রাফিদ ভয় পায়, কোথায় কোন বিপদ ওঁৎ পেতে থাকে! তপা একা যদি সামলাতে না পারে। তাই সাথে এসেছে। তপা কাজ করবে, সে ততক্ষণ দর্পণকে নিয়ে ঘুরবে আর ছবি তুলবে। ক্যামেরা নিয়ে এসেছে।

এনজিওর বেনিফিশিয়ারি মহিলার এসেছে। তপা কথা বলছে তাদের সাথে। রাফিদ দর্পণকে নিয়ে ওই বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। অনেক ফড়িং এদিকে। দর্পণ ফড়িংয়ের পিছু নিচ্ছে ছুটে গিয়ে। রাফিদ ভিডিও করছে মুহূর্তগুলো। একদিন দর্পণ বড় হবে, নিজের শৈশব যেন খুঁজে পার তখন, সেজন্য ধরে রাখা।

ফেরার সময় তপা জিজ্ঞেস করল, “কখনো টঙ দোকানে চা খেয়েছ রাফিদ?”

“অসংখ্যবার।”

“আমার খুব একটা খাওয়া হয়নি। বাবা মাঝেমধ্যে নিয়ে যেতেন, ওইটুকুই।”

কবীরের সাথে বিয়ের পরে তো জীবনযাত্রাই পাল্টে গেল, নিজের শখ, ইচ্ছেতে মরিচা পড়ে গিয়েছিল।

“সত্যি? চলো আজই খাবো আমরা।”

“একটু হাঁটলেই সামনে পাওয়া যাবে।” তপার বলা জায়গায় হাঁটছে ওরা।

দর্পণ আধো আধো বাক্য বলছে রাফিদের কোলে। এত খোলামেলা জায়গা সে খুব কম দেখেছে, তাই ভীষণ উপভোগ করছে।

“আমি তো অসংখ্যবার নিরুদ্দেশ হয়ে যেতাম বাসা থেকে। সারা দেশ ঘুরতাম৷ তখন টঙ দোকানে বসে চা খেয়েছি কত্তবার।”

“তোমার জীবন এখন এক জায়গায় আটকে গেছে, অনেকদিন কোথাও যাও না। তোমার খারাপ লাগে না?”

তপার প্রশ্নে রাফিদ ক্ষণকালের জন্য থমকে গেল, এরপর মৃদু হেসে বলল, “না। এখন তোমাকে আবিষ্কার করছি। দর্পণের ভালোবাসা পাচ্ছি। এটা কি কম এডভেঞ্চারাস? তবে তোমাদের নিয়ে কোথাও যেতে পারলে ভালো লাগত। তোমার সময় হোক। একটা ফ্যামিলি ট্যুর কাম হানিমুন হয়ে যাবে।”

রাফিদ বলল বটে, কিন্তু ওর কাছে এখন টাকা নেই৷ একটা কিছু করতে হবে। কিন্তু কী করবে? গতানুগতিক চাকরি ওর পোষায় না৷ তবুও চেষ্টা করতে হবে কিছু করার। ট্যুরটা ওর তরফ থেকে তপার জন্য একটা ‘গিফট’ যেন হয়।
……..
ক্রমশ