#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৪২)
নুসরাত জাহান লিজা
জয়নুল স্ত্রীর কাছ থেকে বিস্তারিত শুনেছেন। ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়েছেন কবীরের প্রতি। তিনি ভীষণ ঠান্ডা মাথার মানুষ। রাগ হলেও সহজে মাথা গরম করেন না। প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন, তার জন্য তাকে যে পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, তার হিসেব তার কাছেও নেই। কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি প্রখর ব্যবসায়িক বুদ্ধি আর যে কোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখার ধৈর্য তাকে এই পর্যন্ত এনেছে। সাথে প্রিয়জনের সাপোর্ট।
জীবনের বন্ধুর পথে অসংখ্যবার তিনি হোঁচট খেয়েছেন, পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়েছেন দ্বিগুণ স্পৃহা নিয়ে। জীবনযুদ্ধের একজন পোড় খাওয়া সৈনিক তিনি। তার সন্তানের দিকে কেউ হাত বাড়াবে আর তিনি বসে বসে দেখবেন তা কোনোদিন হতে দেবেন না। ছেলের গায়ে আঘাত আসার আগে তিনি মাঝে দূর্ভেদ্য পাঁচিল হয়ে অবশ্যই দাঁড়াবেন।
ছেলের প্রতি তার অভিমান আছে, অনুযোগ আছে, কিন্তু তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় কেউ তার অস্তিত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ করবে, এতটা সহনশীল মানুষ তিনি নন। তিনি সাথে সাথে তার পার্সোনাল সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলেন সেরা উকিলকে নিয়োগ দিতে। প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে বললেন। তিনি নিজে সরাসরি তদারকি করবেন বিষয়টা।
***
রাফিদ আর তপা মলিনার কাছ থেকে সমস্ত ঘটনা শুনল। তপা মলিনাকে বলল,
“নীলার স্কুল থেকে আমি দুদিনের ছুটি নিয়ে দেব। দুইদিন তোমাদের বাসা থেকে বের হবার দরকার নেই।”
রাফিদ প্রথমে এতে সম্মত হলো, কিন্তু পরক্ষণেই ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হলো। সে বলল,
“কিন্তু মলিনা কাল না গেলে ওরা বসে থাকবে না। অন্যভাবে চেষ্টা করবে। আমাদের বিকল্প পথ দেখতে হবে।”
তপা বলল, “আমি সেটাও ভেবেছি। কিন্তু আমাদের জন্য ওদের রিস্ক নেয়াটা…”
“আমি বিষয়টা অন্যভাবে হ্যান্ডেল করব ভাবছি।”
তপা এগিয়ে এসে বলল, “কীভাবে?”
রাফিদ কিছুক্ষণ পায়চারি করল, এরপর তপার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার জার্নালিস্ট ফ্রেন্ড আছে, সিলেটেই৷ সবুজ ভাইয়ের কাছ থেকে সাহায্য নেব। তার মাধ্যমে পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য পেতে পারি৷”
পরিকল্পনাটা শেয়ার করল তপার সাথে। তপা বলল, “এটা এক্সিকিউশন রিস্কি হতে পারে।”
“আমি ওদের সাথে কথা বলি, কতটা সাহায্য পাওয়া যাবে সেটার উপরে ডিপেন্ড করছে সবটা।”
রাফিদ দুজনের সাথেই সময় নিয়ে কথা বলল। তারা সাহায্য করতে রাজি হলো। তাদের সাথে পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করল হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপ কলে।
এরপর মলিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার ফোনে রেকর্ড করতে পারবে?”
“পারমু ভাইজান।”
“গুড। আজ যেভাবে সাহস করে কথা বলেছ, সেভাবেই ওকে আবার কথাগুলো বলাবে, এমন ভাব করবে যেন, মনে হয় তুমি নিশ্চয়তা চাইছ। পুরো কথা তোমার ফোনে রেকর্ড হবে। সাবধানে থাকবে। হাঁটবার সময় কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখবে সবসময়। সামনে পেছনে তাকিয়ে ওর সন্দেহ জাগাবে না। পুলিশ, সাংবাদিক সবাই একটু দূরত্ব রেখে তোমার আশেপাশেই থাকবে। একদম ভয় পাবে না। আমিও থাকব ওদের সাথে। বুঝতে পেরেছ? পুরো বিষয়টা তোমার উপরে মলিনা। পারবে তো সাহস রাখতে? অবশ্য যদি ভয় করে তাহলে আমরা এই পিছিয়ে আসব। অন্যভাবে দেখতে হবে।”
মলিনা ভয় পেয়েছে, সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবুও সে গলায় জোর এনে বলল, “আমি পারব ভাইজান। ডর করতাসে৷ কিন্তু আমি এইটা করতে চাই। মানুষ হিসেবে জীবনে দাম পাই নাই কারোর কাছ থেইকা। তাই নিজের মন হইয়া গেছে ছোট। একবার নিজেরে মানুষ মনে করবার চাই।”
এবার তপা অভয় দিয়ে বলল, “মলিনা, তুমি ভীষণ ভালো মেয়ে। এই স্বার্থপর দুনিয়ায় তুমি অত্যন্ত নিঃস্বার্থ থাকার সাহস দেখিয়েছ। নিজেকে বিকিয়ে দাওনি। এটার জন্য অসম্ভব মনের জোর প্রয়োজন, যেটা তোমার আছে। তুমি যা করেছ এখন পর্যন্ত সেটাই অনেক। নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করার আর কিছু নেই৷ তুমি কোনটা চাও, এখনো ভেবে নাও।”
তপার কথায় মলিনার চোখে পানি চলে এলো। এভাবে কেউ ওকে মূল্যায়ন করেনি। ওই লোকটার সাথে একবার সে কথা বলেছে, আরেকবার নাহয় বলবে। তাই বলল,
“আপা, আমি আপনেগো উপকারে আসতে পারলে খুশি হমু। আপনের কাছ থাইক্যা ম্যালাকিছু শিখি আমি৷ আপনে জীবনের মায়া না কইরা নীলারে বাঁচাইছেন। নীলারে দেখলে মনে হয় আমি ওর নিজের মা। আপনের জন্যে আমি এইটুক করবার পামু না।”
তপা নীলার হাত ধরে বলল, “তুমি শিওর?”
“হ আপা।”
তপা মৃদু হেসে তপার মাথায় হাত রেখে বলল, “আমি জানি তুমি পারবে, শুধু চোখ কান খোলা রাখবে।”
রাফিদ অভয় দিল, “এই প্ল্যানটা আমার। তোমার আর নীলার নিরাপত্তা আমার রেসপনসেবলিটি। আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি হতে দেব না, এই ভাইকে এটুকু ভরসা করতে পারবে?”
মলিনা এবার খানিকটা ভীত কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল, “ভরসা আছে বইলাই রাজি হইসি।”
রাফিদ এবার বলল, “মলিনা, যেভাবে প্রতিদিন যাও, সেভাবে রিকশা নিয়ে চলে যাবে। তখন যদি কথা বলতে আসে, বলবে তুমি একা ওর সাথে কথা বলতে চাও। আগে নীলাকে নিরাপদে স্কুলে নামিয়ে দেবে। স্কুলের ভেতরে থাকতেই তোমার মোবাইলের রেকর্ডার অন করবে। মনে থাকবে?”
“থাকবে।”
মলিনাকে পরিকল্পনার আরও খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিল ওরা, রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো নিয়েও বলল। ওই লোককে হাতেনাতে ধরার পাশাপাশি কবীরের পরিকল্পনা রেকর্ড হবে, সেটা প্রমাণ হিসেবে থাকবে।
পরেরদিন সূর্য উঠল স্বাভাবিক নিয়মেই৷ নতুন একটা দিন শুরু হলো। তবে ওদের জন্য দিনটা অন্যরকম। সব ঠিকঠাক হবে তো!
সকালে রাফিদ আরেকবার মলিনাকে জিজ্ঞেস করল, “সারারাত ভাবার সময় পেয়েছ৷ এখনও চাইলে পিছিয়ে যেতে পারো।”
“আমি ভাইব্যা দেখছি, এইটা না করলে নীলার ক্ষতি করতে পারে অন্যভাবে। নীলার জন্য হইলেও এইটুক আমি করব।”
তপা বুঝল মলিনা নীলাকে ভীষণ ভালোবাসে৷
তপাও ওদের সাথে যেতে চাইছিল, রাফিদ বলল, “তপা, তুমি দর্পণের সাথে বাসায় থাকো। ওদের প্ল্যান ভেস্তে যাবার খবর পেতে দেরি হবে না। এখানেও নিরাপত্তা প্রয়োজন। তাছাড়া তুমি সাথে থাকলে ওই লোকটার সন্দেহ হবে।”
তপা রাফিদকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সাবধানে থেকো।”
“দোয়া করো তপা, আমাদের আজ সেটাই বেশি প্রয়োজন।”
মলিনা বেরুবার কিছুক্ষণ পরে রাফিদ বেরোল, বেরুবার আগে দর্পণের কপালে একবার চুমু খেল। মনে মনে বলল,
“সবটা তোর জন্য বাবা।”
……..
(ক্রমশ)
#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৪৩)
নুসরাত জাহান লিজা
মলিনা নীলাকে নামিয়ে দিয়ে দুরুদুরু বুকে হেঁটে গলিতে ঢুকল। যতই সাহস রাখার চেষ্টা করুক, তবুও ভয়ের তীব্র একটা স্রোতকে সে উপেক্ষা করতে পারছে না। প্রাণপণে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকতে। ওর হ্যান্ডব্যাগের মধ্যে মোবাইলে রেকর্ডার অন করা আছে।
আজ লোকটা সামনে থেকে বেরিয়ে এলো। টাকা নেবার আগে মলিনার কাজ সন্দেহের উদ্রেক না করে লোকটার মুখ খোলানো।
“ট্যাকা আনছেন?”
“হ।”
“এহন আবার কন তো আমার কাম ঠিক কী? কাইল আপনের হাতে ছু রি দেইখা ডরাইছিলাম। বিস্তারিত শোনা থাকল।”
“সাহেব চান, তোমার একটা স্বাক্ষী। কোর্টে যাবা, বলবা, তোমার ম্যাডাম নতুন বিয়া করছে, বাচ্চার দায়িত্ব নিয়ে নতুন সংসারে অশান্তি। সে মাইরধরও করে।” আজ সম্বোধনে উন্নতি হয়েছে, হয়তো মলিনাকে নিজের দলের ভাবতে শুরু করেছে।
“এইটুকু কামের জন্য লাখ ট্যাকা পামু? যাই হইক, বড় লোকের কাজ কারবার।” মনে মনে বলল, “পশু একটা। দর্পণ তো হ্যার সন্তান। তারে নিতে কী করতাসে।”
“হুম। তোমারে আমি ঢাকা নিয়া যাব। তোমার ম্যাডামরা যেদিন যাব, সেইদিনই। যারে ইশকুলে নিয়া যাও। ওরেও নিবা।”
“ওরে ক্যান নিব?”
“এইখানে একলা কই রাইখা যাইবা?”
লোকটার মুখে একটা হিংস্রতা ফুটে উঠে মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। মলিনার একটা হিসেব মিলে গেল। এই লোক যতই এই কাজের জন্য আসুক, নীলার পেছনেও অবশ্যই পড়ে আছে। সে নীলার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না।
“হুম। দ্যাহা যাক৷ কয়দিন থাকা লাগবে?” পেছনে রাফিদসহ তিনজনকে আসতে দেখল মলিনা, সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে করতেই নজর নিজের দিকে ধরে রাখার জন্য কথা চালিয়ে যাচ্ছে।
“তা জানি না। তবে বেঈমানী করার চেষ্টা করবা না৷ তাইলা পস্তাইবা।”
“লাখ ট্যাকা নিয়া বেঈমানী করব? এমুন মানুষ আমি না। আচ্ছা, একটা কথা, মানুষটা ছেলেরে কাছে নেওনের লাইগা এত্ত কষ্ট করতাছে, ভালোই টান আছে, তাই না?”
“টান? আমার যেইটুক কথা হইসে সেইরকম মনে হয় নাই। হ্যার বউ বেশি উড়তাছিল, তাই পাখনা কাইট্যা দেওনের ব্যবস্থা। মাইয়া মাইনসের এত্ত উড়ন ভালা না। ওই মাইয়্যার লাইগা ফজলু ভাই জেলে…”
এটুকু বলে থামল সে, বেশি বলা হয়ে যাচ্ছে। তপার প্রতি যে এর আগে থেকেই রাগ তাও প্রকাশ করে ফেলছিল ভেবেই চুপ করে গেল। ওই মহিলার জন্যই ওর রিজিকে টান পড়েছে। তার প্রতিশোধ নেবার এমন সুবর্ণ সুযোগ, সাথে বড় অঙ্কের টাকাও জুটবে, মুহূর্তের জন্য মনোযোগ টলে গিয়েছিল, হঠাৎ মনে হলো পেছনে কেউ আছে, পুরো বিষয়টা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল৷ ছুরি বের করে মলিনাকে আক্রমণ করতেই যাচ্ছিল, রাফিদ পেছন থেকে মলিনাকে ধাক্কা দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দিল।
ততক্ষণে লোকটার মাথায় ধাতব নল ঠেকিয়েছে পুলিশ। পুরো বিষয়টা কাভার করেছে রাফিদের জার্নালিস্ট ফ্রেন্ড। একবার সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ হয়ে গেলে ক্ষমতার দাপট দেখানোটা কঠিন হয়ে পড়ে বৈকি। এইজন্য ব্যবস্থাটা করা।
মলিনা কিছুটা দূরে ছিটকে পড়েছিল, রাফিদ এগিয়ে গিয়ে উঠতে সাহায্য করল, “তুমি ঠিক আছো?”
“হ ভাইজান।”
রাফিদ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, আর কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে মলিনার একটা ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। তখন রাফিদ নিজেকে ক্ষমা করতে পারত না। সন্তর্পণে চেপে রাখা শ্বাস ছাড়ল সে। মনে মনে দোয়া করল, এবারের মতো পরের সবগুলো পদক্ষেপে আল্লাহর সাহায্য কামনা করল।
“তুমি ভীষণ সাহস দেখিয়েছ মলিনা। আমার ভীষণ গর্ব হচ্ছে।”
মলিনা ভয় পেয়েছিল, এখন হাসছে, আশ্চর্য তবুও চোখে জল এসে পড়েছে। এমন সম্মান সে কখনো পায়নি, নিজেকে কেমন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। একটুও হীনমন্যতা কাজ করছে না। জীবনে ভালো কিছু করার মধ্যে যে এত আনন্দ, তা আজকের আগে উপলব্ধি করেনি মলিনা। এই আনন্দ না নিয়ে যারা কুচিন্তাকে প্রাধান্য দেয়, তারা নেহায়েতই বোকা, ভাবল সে।
***
কবীর খবর পেল কিছুক্ষণ পরেই, জানল যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সে ধরা পরে গেছে পুলিশের হাতে৷ সোস্যাল মিডিয়ায় মলিনার বিবৃতি দেয়া নিউজটা ঘুরছে।
প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলো কবীর। সব সাধু লোকজন কোত্থেকে জুটিয়েছে তপা! সামান্য একজন গৃহকর্মীর এমন ঔদ্ধত্য ওকে বেশ বিস্মিতই করেছিল। টাকা থাকলে সব কেনা যায় এই ধারণা পোষণ করত সে। আজ সেই ধারণা কিঞ্চিৎ ভুল হয়ে গেল।
তাছাড়া রাফিদকে সে নিতান্তই একজন ভবঘুরে যুবক হিসেবে দেখেছিল, ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হয়নি। এখন উকিলের নিয়োগ দেয়া দেখে টনক নড়ায় ওর বাবার পরিচয় জেনে মেজাজ আরও তিরিক্ষি হয়েছে। এবার হিসেব মিলেছে, আপাতত বাপে তাড়ানো ছেলে হলেও, মরা হাতি লাখ টাকা প্রবাদের মতো বেশ দামী তো৷ নইলে ওই মেয়ের চোখে পড়ে। রাফিদকে এখন আরও বোকা বলে মনে হলো ওর।
এই ব্লান্ডার সামাল দিতে হবে। নিজের পরিকল্পনার উপরে ওর বেশ আত্মবিশ্বাস ছিল, তাই বিকল্প পরিকল্পনা করেনি। লাখ টাকার টোপ একটা কাজের মেয়ে এড়িয়ে যাবে, এই ভাবনা ওর মাথায় একবারও আসেনি।
ওই মহিলার কথা বিশ্বাস করলে এই কেসের ভিত্তি এমনিতেই নড়বড়ে হয়ে যাবে। এটা সে কিছুতেই হতে দিতে পারবে না, মেনে নিতে পারবে না৷
তুহিনকে কল দিল সে, ধরল না। এর স্পর্ধা দেখে সে হাতের কাচের বোতল ছুঁড়ে ভেঙে ফেলল, তবুও মাথায় চড়ে বসা রাগটা কিছুতেই নামছে না।
অতিরিক্ত রেগে গিয়ে মানুষ বেশিরভাগ সময় ভুল সিদ্ধান্তই যে নেয়, এই বেসিকটুকুও ভুলে গেল কবীর।
***
তপা কবীরের নামে পাল্টা মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভয়ভীতি আর টাকার বিনিময়ে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেবার ব্যবস্থা করার জন্য। আগেরবার গায়ে ছেঁটানো কাঁদা নিয়েই চলে এসেছিল। ওসব পাত্তা দেয়নি। বারবার ওর পরিবারের উপরে আঘাত হানবে, আর সে বসে থাকবে তা হতে পারে না।
রাফিদও মান হানির মামলা করবে, ওর নামে মিথ্যা অভিযোগ আনার প্রতিবাদে। আজ ঢাকায় রওনা দিচ্ছে ওরা। তপা তুহিনের জন্য আর রাফিদ বাবার জন্য কেউই বাসায় উঠল না। হোটেলে উঠল। মলিনা যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষী, তাই ওদেরকেউ এনেছে।
ওদিকে ওরা কেউ না জানলেও জয়নুলের হাতে কবীরের কিছু এমন কাজের অকাট্য প্রমাণ চলে এসেছে যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি নিজ দায়িত্বে এসব প্রমাণ তুলে দিলেন জায়গামতো। তারা সেসব নিয়ে আরও তদন্ত করে এরপর ব্যবস্থা নেবে। ভীষণ কনফিডেনশিয়াল।
কবীরের ঠিক করা লোকের বয়ান, মলিনার কাছে থাকা রেকর্ডের পরে মামলা জেতা এমনিতেই সহজ হয়ে গিয়েছিল।
কবীরের ভেতরে যাই হোক, সামনা-সামনি দম্ভ ভরা গা জ্বালানো হাসি এখনো মুখে৷ রাফিদের কোলে দর্পণকে দেখে বলল,
“বাবার কোলে এসো তো?”
দর্পণ রাফিদকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল, “দাফেত বাবা।”
সশব্দে হাসল কবীর, “আমার ছেলের বাবা হয়ে গেছ, ভালোই তো। কাক তা দিলেই কোকিলের বাচ্চা কাকের বাচ্চা হয়ে যায় না…..”
এই পর্যন্ত শুনেই রাফিদ চোয়াল শক্ত করে পিছিয়ে গেল, “জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। তোমার নোংরা নজর ভুল করেই আমাদের সন্তানের উপরে আরেকবারও দেবার চেষ্টা করবে না। আমি দর্পণের বাবা, তুমি অন্তত কারো বাবা হবার যোগ্য নও। যে বাবা সন্তানের ক্ষতি চায়..”
“ভুলে যেও না ওকে জন্ম আমি দিয়েছি, তোমার রোমিওগিরি কয়দিন চলে দেখা যাবে।”
এবার তপা এগিয়ে এলো, “নিজেকে দিয়ে অন্যের বিচার করা তোমাকে মানায় কবীর। যারা নিজেরা পাঁকে নেমে আছে, তারা অন্যকেও কর্দমাক্ত মনে করে। ভালো চিন্তা তারা করতে পারে না।”
ওরা চলে যাচ্ছে, রাফিদের বুকে পরম নিশ্চিন্তে মুখ গুঁজে আছে দর্পণ৷ রাফিদের একটা হাতে তপার হাত মুঠো করে ধরা। সুন্দর একটা ছবি, কিন্তু কবীরের চোখে এর চাইতে বিষাক্ত ছবি যেন আর হতেই পারে না। ওই সুখী ছবিটা তো ওর হারের প্রতিচ্ছবি। সে হার মেনে নিতে পারে না।
***
জয়নুল আর শিরীনের সাথে দেখা হলো, আজ তারাও এসেছেন। শিরীন রাফিদকে জড়িয়ে ধরল, তার চোখ ছলছল করছিল৷ রাফিদেরও।
জয়নুল একটু পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তপা গিয়ে সালাম দিল।
“আসসালামু আলাইকুম বাবা।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো মা?”
তপা হেসে বলল, “ভালো।”
“আপনি আমাদের জন্য উকিলের ব্যবস্থা করেছিলেন। আমি কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব বুঝতে পারছি না।”
“নিজেদের মধ্যে এসব কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথাবার্তা আসছে কেন মা?”
“স্যরি বাবা।”
দর্পণকে দেখিয়ে বললেন, “একবার নিতে পারি?”
“অবশ্যই।”
তপা দর্পণের কানে আস্তে করে বলল, “দাদু।”
দর্পণ তার কোলে উঠেই বলল, “দাদু।”
জয়নুলের ভারি আনন্দ হলো। এই ছেলেটা কী আদুরে!
রাফিদ তখনও দূরে দাঁড়িয়ে আছে, একসময় দোটানা ফেলে সামনে এগিয়ে এলো, “কেমন আছো রাফিদ?”
জয়নুলই আগে কথা বললেন। রাফিদ চোখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভালো। তুমি কেমন আছো বাবা?”
“ভালো। বাড়ি ছেড়ে হোটেলে উঠলে কেন?”
“ওই বাড়ি থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। তাই।”
“এখন এসো।”
“আমি এখনো নিজেকে প্রমাণ করতে পারিনি। তোমার ছত্রছায়ার বাইরে গিয়ে নিজের চেষ্টায় কিছু করতে চাই।”
“ওকে, তবে যাও। গুড লাক।”
“থ্যাংক ইউ।”
দুজনের গলাই কম্পিত, তবুও মুখে তার প্রকাশ নেই। যেন স্বাভাবিক গলায় কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদনের কাজ চলছে। তপা আর শিরীন তাকিয়ে আছে দুইজনের দিকে।
ওরা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। আজই রওনা দেবে সিলেটে। তপার আগামীকাল অফিস করতে হবে।
জয়নুল ছেলের যাওয়া দেখলেন, তবে এবার তিনি বিশ্বাস করেন, তার ছেলে হয়তো সত্যিই তার ছত্রছায়ার বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারবে। এই প্রথমবার যে তিনি রাফিদের সক্ষমতাকে অন্য চোখে বিচার করার চেষ্টা করলেন।
………..
ক্রমশ