নিভৃত দহনে পর্ব-৪৪+৪৫

0
19
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৪৪)
নুসরাত জাহান লিজা

সময়ের বহমান আবর্তে পেছনে পড়ে যায় পুরোনো অতীত। অপেক্ষমাণ ভবিষ্যত হাতছানি দিয়ে ডাকে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে। তীব্র অনিশ্চয়তা সত্বেও মানুষ তবুও এগিয়ে যায় ভবিষ্যতের পথে। একরাশ স্বপ্ন নিয়ে, বুকে ঝাঁপিতে জমে থাকে স্মৃতির ধূলো। কোনো এক শ্রান্ত অবসরে সেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে মানুষ সুখ-দুঃখের, আনন্দ বিষাদের হিসেব মেলাতে বসে। এক অদ্ভুত নস্টালজিয়া পেয়ে বসে। ভাবালু মন স্মৃতি খুঁড়তে পছন্দ করে। এটাই মানব জীবনের শাশ্বত প্রবৃত্তি।

রাফিদ আর তপাও সুন্দর বর্তমানে বেঁচে এগিয়ে যাচ্ছে ভবিতব্যের পথে। সে পথের বাঁকে কী আছে তারা কেউই জানে না। তবে বর্তমানে বাঁচছে। সুখটুকু লুফে নিচ্ছে, উজাড় করে ভালোবাসছে পরস্পরকে, সাথে ওদের মধ্যমনি দর্পণকে।

কেস জেতার পরে তিনমাস অতিবাহিত হয়েছে। অনেককিছু ঘটে গেছে ওদের জীবনে। রাফিদ তপাকে দেখে কী পরিশ্রম করে রোজগার করে। মাসের শেষে বেশ টানাটানি পড়ে যায়। তপা বুঝতে না দিলেও সে ঠিকই বুঝতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তপার তিন লাখ টাকার মধ্যে এক লাখ তো মায়ের একাউন্টে জমা রেখেছিল। তিনি সেটার কিছু অংশ তপার চিকিৎসার জন্য দিয়েছিলেন। ঘরে একটা বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে ফার্নিচারসহ আনুসঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে বেশ বড় অঙ্কের খরচ হয়েছে। বাকিটাও ওর চিকিৎসায় চলে গেছে।

মাকে টাকা পাঠায় নিয়মিত, সেটা সে বন্ধ করতে চায় না। নীলাকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করেছে। দায়িত্ব যখন নিয়েছে, সে চায় সেটা ভালোভাবে হোক। এরজন্য খরচও কম নয়। দর্পণ একটু একটু করে বড় হচ্ছে। মলিনাকে মাস শেষে প্রাপ্য টাকা দিতে হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগামী স্রোতের সাথে মিলিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয় তপাকে।

রাফিদ এরমধ্যে তিনটা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছে। একটাতেও ডাক পায়নি। সরকারি চাকরির যে পড়াশোনা তা এখন আর নতুন করে সম্ভব নয়। আবার যেন তপার সাথে কনফ্লিক্ট না হয়, তাই সিলেটের মধ্যে হয় এমন চাকরি হলে ভালো হয়।

সমস্ত পরিস্থিতি দেখে সে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে। নিজেকে ভীষণ ইউজলেস মনে হচ্ছে। বাবা হয়তো ঠিকই বলেন, এমন একটা ভাবনা ওর মাথায় জাঁকিয়ে বসতে চাইছে। রাফিদ হাল ছাড়ছে না। কিন্তু ওর পূর্বের চাকরি ছাড়ার রেকর্ডের জন্যই মূলত কেউ নিতে চাইছে না। যে মন মর্জি মতো কাজ করে, এমন এমপ্লয়ি তাদের প্রয়োজন নেই।

রাফিদ ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে গুটিয়ে যাচ্ছে। তপা আর দর্পণের জন্য ওরও তো কিছু কিনতে ইচ্ছে করে, একটা ছোট্ট উপহার কেনার জন্য টাকা হাতে নেই। তপা স্যালারি পেয়েই একটা অঙ্ক রাফিদের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু সেটা তো ওর নিজের দেয়া হলো মা। মেল ইগো ওর মধ্যে নেই। তবুও তপার পাশে দাঁড়িয়ে এই সংসারের হাল ধরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। ওর চির গর্বের জায়গা আত্মবিশ্বাস সেটাও যেন টলে যাচ্ছে।

তপা গতকিছুদিন ধরে ওকে লক্ষ্য করছে, প্রাণবন্ত মানুষ হুট করে যদি নিজেকে এতটুকুও গুটিয়ে নেয়, সেটা ধরা পড়ে যায়৷ সে অপেক্ষা করছিল রাফিদ নিজে থেকেই হয়তো ওর সমস্যাটা শেয়ার করবে। কিন্তু এখনো অব্দি করছে না।

প্রতিবার ইন্টারভিউ দেবার আগে ভীষণ উৎসাহ নিয়ে যায়, তপা ওর ড্রেস আয়রন করে দেয় যত্ন করে। ফেরার পরে মুখ আমসি হয়ে থাকে।

দর্পণ ঘুমিয়ে পড়লে তপা রাফিদকে বলল, “চলো, বারান্দায় বসি। আজ পূর্নিমা।”

রাফিদ চমকে তাকাল, প্রতিবার পূর্ণিমা রাফিদ নিজেই স্বরণ রাখে ক্যালেন্ডার দেখে৷ এবার খেয়ালই ছিল না।

“আজ পূর্ণিমা? এবার আমি মিস করে গেছি।”

“সমস্যা নেই, আমি মনে রেখেছি। চলো।”

রাফিদ উৎসাহী গলায় বলল, “তুমি বসো, আমি চা করে আনি।”

“চা হয়ে এসেছে। তুমি গিয়ে বসো রাফিদ। আমি নিয়ে আসছি।”

রাফিদ বারান্দায় এসে দেখল আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। অকৃপণ জোছনা তার স্নিগ্ধ আলো ঢেলে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে। ভিজিয়ে দিচ্ছে সমস্ত পৃথিবীকে।

তপা ফিরে এলো কিছুক্ষণের মধ্যে, রাফিদের হাতে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল। এলাচ দিয়ে ঘণ দুধের চা। জোছনায় ভিজে এই চায়ের সাথে পাশে প্রিয়জনের সান্নিধ্য, এমন অপূর্ব প্রেমময় মুহূর্ত ওদের জীবনে প্রায়ই আসে। আজকের রাতটা আলাদা বলেই মনে হচ্ছে।

“তুমি বোধহয় কিছু বলতে চাও তপা।”

“হ্যাঁ। তোমার কী হয়েছে রাফিদ? আমাকে বলবে?”

“কই, কিছু না তো।”

“রাফিদ, আমাদের বিয়ের প্রায় ছয় মাস হয়ে গেছে। আমি তোমাকে বুঝতে পারি। তুমি কোনো কারণে আপসেট? অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাও না। প্রকৃতি তোমাকে কতটা টানে সেটা আমি জানি। একবার ঘুরে এসো। তোমার ভালো লাগবে। একঘেয়েমি কেটে যাবে।”

রাফিদ চায়ের কাপে চুমুক দিল আয়েশ করে, এরপর খানিকটা সময় নিয়ে মুখ খুলল, “তপা, তুমি ভুল বুঝছ। তোমার সাথে বিয়ের পরের সময়টায় আমার মধ্যে একবারের জন্যও একঘেয়েমি আসেনি। দর্পণের সাথে, তোমার সাথে সেটা আসার সুযোগ নেই।”

“বাসার জন্য মন খারাপ?”

“সেটা কিছুটা আছে। কিন্তু আমার সমস্যাটা অন্য।”

“সেটাই জানতে চাইছি। রাফিদ, দাম্পত্যে শেয়ারিং জিনিসটা ভীষণ জরুরি। আমি কোনো সমস্যায় পড়লে যেমন কোনো দ্বিধা না করে তোমার সাথে শেয়ার করি, তুমিও করবে, সেটা কি আমি প্রত্যাশা করতে পারি না?”

রাফিদ জোছনার ঝাপসা অস্পষ্ট আলোয় তপার মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল, অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়। রাফিদ মিথ্যা বলতে পারে না৷ তাই কিছুটা সময় নিয়ে সত্যিটাই বলল,

“তুহিন ঠিকই বলেছিল, একজন বেকার লোককে বিয়ে করে তুমি’…”

রাফিদকে থামিয়ে দিয়ে তপা বলল, “রাফিদ, ইট’স এ রিয়েল ওয়ার্ল্ড। এখানে ফ্যান্টাসির জায়গা খুব একটা নেই। জীবন সবসময় তোমার গ্রিপে থাকবে না। ছুটে যাবে সর্বোচ্চ গতিতে। সেই গতির সাথে আমরা সবসময় তাল রাখতে পারি না। আমরা মানুষ রোবট নই। আমাদের ক্লান্তি আসে, জীবনের ট্র‍্যাক থেকে ছিটকে গেলে আমরা আবারও উঠে দাঁড়াই। আমাকে দেখো, আমার জীবন নিয়ে খুব বেশি উচ্চাশা কোনোদিন ছিল না। পড়াশোনা করেছি, আবৃত্তি ভালোবাসতাম৷ মনে হতো জীবনে নিজের আর পরিবারের জন্য কিছু করব। একসময় বিয়ে করে সংসার পাতব। সেখানে সুখ ঘিরে থাকবে চারপাশে। সব ঠিকঠাক চলছিল, বিয়েও করলাম। তারপর ছিটকে গেলাম জীবনের রোলার কোস্টার ট্র‍্যাক থেকে। মুখ থুবড়ে পড়লাম কংক্রিটের উপরে। মেয়েদের উপরে আঙুল তোলার সবচাইতে সহজ টার্গেট হলো, তার চরিত্রের উপরে আঙুল তোলা। ডিভোর্সের পরে আমাকে কীসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, সেটা আমি জানি। অন্য কেউ জানে না। প্রতিনিয়ত মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, দূরের মানুষ, কাছের মানুষ সকলেই দেখাবার চেষ্টা করেছে, দেখো, একটা ভালো ঘর করতে পারল না। নিশ্চয়ই চরিত্র ভালো নয়। ভেতরে আরও কত কী কে জানে। দর্পণ না থাকলে আমি হয়তো এখন এখানে বসে থাকতাম না। আমি পৃথিবীর সাথে লড়াই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নিজেকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করেছি, আমাকে পারতেই হবে। আমার সন্তানের জন্য পারতে হবে। সমস্ত ক্লেদ, কটুক্তি, ধারালো কথার বাণ, কোনোকিছুতেই আমি পিছপা হইনি। আল্লাহর রহমত, কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী আর দর্পণের জন্য আমি আজ তোমার সাথে দাঁড়িয়ে আছি। তখন যদি থেমে যেতাম, নিজেকে এক্সপ্লোর করার চেষ্টা না করতাম, আমি স্রোতে ভেসে যেতাম, নাম হারা কোনো জলে ভাসা ফুলের মতো। এখন এত কিছুর পরে সুখ আবারও মুখ তুলে তাকিয়েছে আমাদের দিকে। তোমার এই ভেঙে পড়া কি আমার চাইতে বেশি যন্ত্রণার?”

রাফিদ এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তপার কথা শুনেছে। জ্বলজ্যান্ত অনুপ্রেরণা ওর সামনে আছে, আর সে কি-না এই সামান্যতেই হাল ছেড়ে দিচ্ছে।

“যে ছেলে অচেনা অজানা মানুষের জন্য নিজের বিপদকে তোয়াক্কা না করে কোনোকিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, অন্যের জন্য কিছু করার চেষ্টা করে, সবার সাহায্য করে, সে যদি এত অল্পতে হাল ছেড়ে দেয়, তবে হবে? এই রাফিদকে কিন্তু আমি চিনি না।”

রাফিদ তপার হাত দুটো শক্ত করে ধরল, এরপর বলল, “আমি এখনো তাই আছি তপা। কিন্তু জবের ক্ষেত্রে ট্র‍্যাক রেকর্ড চেক করা হয়, আমার সেখানে তথৈবচ অবস্থা।”

“তো চাকরি তো তোমার কখনো ভালো লাগে না৷ এখন কেন সেটার জন্য কষ্ট পাচ্ছ।”

“প্রয়োজনে…”

“হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলো রাফিদ। চাকরি তোমার ভালো লাগে না৷ করার দরকার নেই৷ তোমার মধ্যে অন্য অনেক পটেনশিয়ালটি আছে। যেগুলো তোমার ভালো লাগে। সেগুলো নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করো। শুধু চাকরি আর ব্যবসাই যে করতে হবে, কর্পোরেট ফিল্ডেই ক্যারিয়ার তৈরি করতে হবে, এরকম কিছু তো নয়। তোমার ভালোবাসার জায়গাগুলো নিয়ে ট্রাই করো। লাইফও মনোটোনাস হবে না, আবার এনজয়ও করলে।”

“মানে?”

“সেটা তুমি ভেবে বের করো৷ ওসব তোমার ফিল্ড। আমি শুধু তোমাকে একটা পথ দেখালাম। এবার গন্তব্যটা তোমাকেই খুঁজে বের করতে হবে। তবে এমন মুখ গোমড়া করে রাখা চলবে না। আমার হাসিখুশি পুঁচকে বরটার মুখ গোমড়া দেখলে ভালো লাগে না।”

রাফিদ হেসে ফেলে মুখে কপট অভিমান ফুটিয়ে তুলে বলল, “আমি পুঁচকে?”

“অবশ্যই। আমি তোমার চাইতে দুই বছরের বড়। ভুলে গেছ?”

“তাতে কি হয়েছে? এই পুঁচকে হাজব্যান্ডকেই তো ভালোবেসেছ।”

রাফিদের নাক টিকে দিয়ে হেসে তপা প্রশ্ন করল, “তা মাথা থেকে ভূত সরে গেছে নাকি এখনো আছে? নিজেকে প্রমাণ করতে চাইলে প্রচলিত পথে না হেঁটে নিজের কমফোর্ট জোন ধরে হাঁটতে হয় জনাব।”

রাফিদ আচমকা তপাকে জড়িয়ে ধরল, ওর বুকের উঠা পড়া তপা স্পষ্ট অনুভব করছে, “থ্যাংক ইউ, তপা। একটা বিশাল জগদ্দল পাথর তুমি আমার আমার বুক থেকে নামিয়ে দিলে আজ।”

বেশ কিছুদিন পরে আগের রাফিদকে ফিরে পেতে দেখে তপা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রাফিদের সমস্যাটা সে ধরতে পেরেছিল আগেই, চেষ্টা করে ওর নিজের মুখ থেকেই কথাগুলো আজ বের করে আনল। এটা জরুরি ছিল৷ কথা বললে অনেক জটিল সমস্যা সহজে সমাধান করা যায়, অগোচরে রাখলে কেবল দূরত্বই বাড়ে। খুব পাশে থেকেও অদৃশ্য আলোকবর্ষ দূরত্ব জায়গা করে নেয় সম্পর্কে।

“আমার কথাগুলো তুমি বুঝতে পেরেছে, তার জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ। আপরা একে অপরের পরিপূরক, পুঁচকে বর৷ এটা মনে থাকে যেন। একটা আরেকজনের অপূর্ণতাকে পূর্ণ করার নামই দাম্পত্য।”

সম্বোধনটা করল ভারিক্কি পরিস্থিতি হালকা করতে, রাফিদ রেগে যায় বললে। রাগলে ওকে চমৎকার দেখায়৷ নাকের পাঁটা ফুলে যায়, শিশুর মতো সরলতা এই ছেলের রাগের মধ্যেও মিশে থাকে। এখন ভীষণ আদুরে লাগছে দেখতে। তপা ওর ঠোঁট নামিয়ে আনল রাফিদের গালে।

এবার রাফিদ হেসে এগিয়ে গেল তপার দিকে৷ দুজনের মুখেই লেগে আছে হাসি, সে হাসি ছুঁয়েছে চোখে, মুখে মস্তিষ্কে। তপাকে কোলে তুলে নিল রাফিদ।

বারান্দায় পড়ে রইল আধখাওয়া চায়ের কাপ, চা ঠান্ডা হয়ে গেছে কবেই৷ আর রইল পৃথিবীপ্লাবী জোছনা। দূরে কিছু নিশি পাওয়া পাখি ডেকে চলছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে মাঝেমধ্যে।
………..
(ক্রমশ)

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৪৫)
নুসরাত জাহান লিজা

কবীর পড়েছে মহা আতান্তরে। এমন অবস্থা সে দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি। ওর কিছু ধামাচাপা দেয়া পাপ কীভাবে যেন আলোতে চলে এসেছে। সস্তা ম্যাটারিয়াল দিয়ে বাড়ি তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করেছে, টাকা দিয়ে সেসবের অনুমোদনও নিয়েছিল, একটা বড়সড় দূর্ঘটনা ঘটে প্রাণহানি হয়েছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসেছিল। কিছু লোকের কাছে জমি বিক্রি করেছিল, যার অনেকেই আজ অব্দি মালিকানা হাতে পায়নি। একজন খুব ঝামেলা করছিল৷ যার হদিসই পরে পাওয়া যায়নি। তার পরিবার হুমকিতে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল৷ এখন তারা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।

গার্মেন্টস ব্যবসাতেও শ্রমিকরা আন্দোলন করছে নানান দাবিদাওয়া নিয়ে। সে খোঁজ নিয়ে বের করেছে এসবের পেছনে কোন মাথা আছে, তপার শ্বশুরের নামটা পেল। দাঁতে দাঁত পিষল সে।

রূপে ভুলে একটা কালসাপকে সে বিয়ে করেছিল। এখন ছোঁবল দিচ্ছে। খুব বিষদাঁত বেরিয়েছে। মেয়ে মানুষের এইজন্য এত স্বাধীনতা সে পছন্দ করে না। ঘরের বাইরে বেরুলেই এরা নষ্ট হয়ে যায়৷ চোখ ফোটে, দাঁত বেরোয়, চরিত্রেও সমস্যা হয়। শাড়ি, গয়নার বাইরের গণ্ডিতে এদের যেতে দেয়াই উচিত নয়। একটা কালসাপ হয়ে এখন ওকেই ছোঁবল দিচ্ছে। সেও ওঁঝা। মরণকামড় খাবার আগে ওর বিষদাঁত সে অবশ্যই ভাঙবেই ভাঙবে।

***
তুহিনের বাড়ির কন্ট্রাক্ট মাঝপথে বাতিল করতে চেয়েছিল কবীর। কিন্তু চুক্তিপত্রটা উকিল দিয়ে ঠিক করা ছিল। তাই পারল না।

তবে কবীরের টাকা শোধ করেছে সে। তারজন্য সঞ্চয় থেকে বেশিরভাগ টাকা বেরিয়ে গেছে। এখন দিন আনি দিন খাই ধরনের অবস্থা। ব্যবসাতেও খুব একটা পসার নেই৷ ওর মেধা খারাপ ছিল না, টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে, শর্টকাট টাকাওয়ালা হবার উচ্চাকাঙ্খা থেকে শেষ অব্দি কিছুই হলো না৷ একজন ছা-পোষা ব্যবসায়ী হয়েই থাকতে হলো।

এখন মাঝেমাঝে পেছনে ফিরে তাকালে নিজের ভুলগুলো বড্ড চোখে পড়ে। মনে হয়, জীবনটা যদি আরেকবার নতুন করে শুরু করা যেত, হয়তো সব ভুল শুধরে নিতে পারত। কিন্তু উপলব্ধিটা বড্ড ভুল সময়ে হয়, যখন আর ফেরার পথ থাকে না।

মেয়েটা বড্ড রোগা, ইলার শরীরটাও খারাপ যায়। অনেক খরচ, বন্ধুদের কাছ থেকে মাঝেমধ্যে ধার করতে হয়, ব্যবসার কাঁচামাল কেনার জন্য। সময়মতো দেনা শোধ না করতে পারলে সেই পথও বন্ধ হয়ে যাবে। চোখে অন্ধকার দেখে সে ভবিষ্যতের চিন্তায়।

জহুরা এসে ছেলের পাশে বসলেন, “তোর বাবার পেনশনের টাকায় আমার চলে যায়। কিছু থাকেও। তপাও মাসে মাসে টাকা পাঠায়। ওকে না করলেও শোনে না। ওই টাকাটা জমেছে। তুই আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিছু ঋণ শোধ কর।”

তুহিন মায়ের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তপার টাকার করুণা ওকে নিতে হচ্ছে, এরচাইতে বড় লজ্জার ওর জন্য আর কী হতে পারে! যাকে সে চরম ভাবে ঠকিয়েছে উত্তরাধিকার থেকে। নিজের উপরে করুণা হয় তুহিনের। কিন্তু এখন অন্য উপায়ও নেই।

নিজের ইগো, নিজের গর্ব সব আজ জলের তোড়ে কোথায় বিলীন গেছে!

***
সোমা অনেক ভেবেছে, এরমধ্যে একটা সুখবর পেল, সে মা হতে চলেছে। এই খবরে রবীনের পরিবারের সবার সাথে যে দূরত্ব সেটা কমে গেল। সোমা এবার নির্দ্বিধায় চাকরিটা ছেড়ে দিল। অনাগত শিশু ওর প্রথম প্রায়োরিটি হয়ে উঠল। শাশুড়ি খুশি হয়েছেন সবচাইতে বেশি,

তিনি সোমাকে পাশে বসিয়ে বললেন, “তুমি হয়তো আমাকে সেভাবে পছন্দ করো না। আমারও যতটা সাপোর্ট তোমাকে দেয়া দরকার ছিল দিতে পারিনি। সেটা তুমি সংসারী নও বলে। তবে এখন থেকে আমি তোমার দায়িত্ব নিলাম, আমার ছেলে আমার যতটা, তুমিও ততটাই। যে আসছে, সে সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসুক।”

সোমা জানে সবটাই ওর অনাগত সন্তানের জন্য। তবুও এই দূরত্বে সে নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছিল। শুরুটা তো হলো। হয়তো একদিন তার জন্যও তার মনে সত্যিকারের স্নেহের চাষ হবে!

সায়েদা ভীষণ খুশি হলেন। তার শরীর দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। তিনি শেষের অপেক্ষা করছেন। সোমার শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ নিয়ে কখনো মা’কে কিছু বলেনি। তিনি দুই হাত তুলে মেয়ের জন্য প্রাণভরে দোয়া করলেন৷

***
রাফিদ চাকরির চিন্তা ছেড়ে দিয়েছে, কিছুদিন কেবল ভেবেছে কী করা যায়! প্রথমে গিটার শেখাবার স্কুল খুলল৷ দুইজন ভর্তি হলো। একজন কয়েকদিন পরেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলল, অন্যজনও ছেড়ে দিল। এটা বন্ধ হয়ে গেল।

রাফিদ হতাশ হয়ে বারান্দায় গিটার নিয়ে বসেছিল, আর টুঙটাং বাজাচ্ছিল। দর্পণ এসে বলল, “দাফেত বাবা, ব্যাট।”

অর্থ্যাৎ ক্রিকেট খেলার আমন্ত্রণ, কাঠেরর ব্যাট ধরতে পারে না বলে প্লাস্টিকের ব্যাট কিনে দিয়েছে। সেটা নিয়েই খেলতে চলে এসেছে।

রাফিদের মনে জমা মেঘ কিছুক্ষণের জন্য মিলিয়ে গেল, এত চমৎকার হাসি দেখলে হতাশার আর জায়গা থাকে। সে উঠে ছেলের সাথে ক্রিকেট খেলতে চলে গেল।

সমস্যা হলো, বল ব্যাটে লাগাতে পারছে না দর্পণ, তবুও বিপুল উৎসাহে চেষ্টা করে যাচ্ছে। নাছোড়বান্দা, সে লাগিয়েই ছাড়বে।

অবশেষে অনেকক্ষণ পরে একবার ব্যাট লাগতেই কী যে উৎসাহ দর্পণের। সে আরও বল করতে বলছে। একসময় বেশিরভাগ বলই সে লাগাতে সমর্থ্য হলো।

রাফিদ শিখল, ছোট্ট দর্পণের কাছ থেকে। হাল ছেড়ে দিতে নেই৷ লেগে থাকলে একসময় না একসময় সফলতা এসে ধরা দেয় হাতের মুঠোয়। কে বলেছে মানুষ কেবল বড়দের কাছ থেকে শেখে, এই যে অবোধ্য শিশু, শেখার মনোভাব থাকলে তার কাছ থেকেও কত বড় শিক্ষা পাওয়া যায়!

রাফিদ দর্পণকে কোলে তুলে নিল, “আজ ফাটিয়ে দিয়েছে দর্পণ বাবা। এখন আমরা গোসল করব, ঠিক আছে?”

দর্পণ মাথা দু’দিকে নাড়ায়, “না, না। গোসল না।”

“আম্মু মারবে নইলে।”

“না। আম্মু ভালো।”

“আর আমি?”

“ভালো।”

“আর দর্পণ সোনা?”

“ভালো।”

“ভালো হলে তো গোসল করতে হবে। নইলে তো মানুষ পঁচা বলবে সোনা। ভালো ছেলে হবে না?”

এবার রাজি হলো দর্পণ, “লক্ষ্মী সোনা।”

***
রাফিদের সাথে কথা না হলেও তপার সাথে এখন নিয়মিত কথা হয় জয়নুলের। তিনি অনুরোধ করেছেন, তার বিষয়ে রাফিদকে যেন না জানানো হয়।

তিনি হঠাৎ বললেন, “আমি যদি রাফিদের চাকরির ব্যবস্থা করে দিই?”

তপা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল, “বাবা, আপনি ওকে ভীষণ ভালোবাসেন আমি জানি। সেজন্যই পাশে দাঁড়াতে চান। তবে এখন আপনি যদি ব্যবস্থা করে দেন, ও জানতে পারলে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। একটু স্ট্রাগল করে হলেও যদি নিজে কিছু করতে পারে, এতে ওর আত্মবিশ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। আমি অনুরোধ করব, ওর উপরে একবার বিশ্বাস রাখুন বাবা। আমার বিশ্বাস রাফিদ ঠিকই একটা কিছু করবে।”

“তোমাদের জন্য আমার অনেক দোয়া রইল মা।”

রাফিদের প্রতি দু’জনেই দু’জনের ভালোবাসার প্রগাঢ়তা অনুভব করতে পারল, নিঃস্বার্থ, অপার্থিব ভালোবাসা।

***
রাফিদ প্রচুর ভ্রমণ করেছে, দেশে, দেশের বাইরে। সেসবের ভিডিও করা ছিল অনেক। সেসব দেখছিল। হঠাৎ করে মনে হলো এগুলো আপলোড করলে কেমন হয়!

সে কিছু ভিডিও এডিট করল, বেশ সময় নিয়ে। ভয়েসওভার দিয়ে সেই সময়ের স্মৃতির সাথে জায়গাগুলোর বিবরণ দিল। তিনদিন সময় নিয়ে কাজটা করল। এরপর ওর ফেসবুকের যে ফটোগ্রাফির পেইজ ছিল সেখানে আপলোড করে দিল।।
………..
(ক্রমশ)