#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৪৬)
নুসরাত জাহান লিজা
যত সময় গড়াচ্ছে, তপা সম্পর্কের প্রতি রাফিদের নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ, একাগ্রতায় মুগ্ধ হচ্ছে। দর্পণের সত্যিকার বাবা হয়ে উঠেছে। ছেলেও হয়েছে বাবা অন্তঃপ্রাণ। তপার মাঝেমধ্যে ছেলেমানুষি হিংসেও হয় ওদের দেখে। পরক্ষণেই এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে অবচেতনেই।
প্রতি বেলায় মায়ের খোঁজ নিচ্ছে, ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছেন কি-না, তা নিয়ে কপট শাসনও করতে দেখা যায় ফোনে কথা বলার সময়। সশরীরে মা’কে দেখতে যেতে না পারার অপারগতা ওকে পোড়ায়, তপা বোঝে।
বাবার জন্য অভিমান জমে আছে, তবুও শিরীনের কাছ থেকে তার খোঁজ নিতে ভুলে না। তখন মুখাবয়বে অবর্ণনীয় বিষাদের ছাপ দেখা যায় রাফিদের সৌম্যদর্শন মুখে।
তপার কীসে খুশি, কোন রঙটা প্রিয়, প্রিয় খাবার কী, কীসে অসুবিধা হয় সব যেন আত্মস্থ করে নিয়েছে এরইমধ্যে। তপা এক পৃথিবী বিস্ময় নিয়ে সেই ভালোবাসার বৃষ্টির প্রতিটা কণা হৃদয়ে ধারণ করে। জীবনের এতবড় একটা একটা সিদ্ধান্ত আরেকবার নিতে এবার যে ভুল করেনি, এটা সে পলে পলে অনুভব করে।
রাফিদের সাথে পরিচয় না হলে ওর জীবনটা অপূর্ণই রয়ে যেত, অসমাপ্ত কোনো পাণ্ডুলিপির মতো।
তপাও প্রতি মুহূর্তে চেষ্টা করে সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে, ভালোবাসা দিয়েই। রাফিদের সদা হাস্যোজ্বল মুখে মেঘের ছায়া দেখলে ওর অস্থির লাগে। মনে হয় আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ যদি থাকত, সে এক খোঁচায় তার সমস্ত অপ্রাপ্তি হাওয়ায় মিলিয়ে দিত! মানুষের ক্ষমতা সীমিত, তাই সে তার সর্বস্ব দিয়ে পরম করুণাময়ের কাছে সাহায্য চায়, ওর এই সুখের ঘরে সুখ যেন সকালের মিষ্টি রোদের মতো সর্বক্ষণ গায়ে মেখে থাকে।
অনেকদিন থেকে রাফিদ চেষ্টা করছে। পাঁচটা ভিডিও গত তিন মাসে আপলোড করেছে। শেষ পর্যন্ত রাফিদ মনস্থির করতে পেরেছে, ট্রাভেল ভ্লগ বানাবে। এটাতেই সে আনন্দ পায়।
তপা জানে, রাফিদ কতটা ভালোবাসে কাজটা। যখন এডিটিংয়ে বসে, সে বুঁদ হয়ে যায়। ঐকান্তিক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলাফল সেভাবে আসছে না যদিও। প্রথম ভিডিওতে ভিউ হয়েছিল প্রায় দুই হাজারের মতো। পরেরটাতেও তেমনই। তৃতীয়টায় পাঁচ হাজার ছাড়িয়েছে৷ সর্বশেষ ভিডিওতে টেনেটুনে দশ হাজার। সে হাল ছাড়ছে না, তবে কিছুটা কষ্ট সে পায়।
“আমি বলি কী, তুমি যখন ভিডিওগুলো করেছিলে তখন তো ভ্লগ বানানোর কথা মাথায় রেখে করোনি। একবার নতুন করে ট্রাই করে দেখো।”
রাফিদ মৃদু হাসল, সেই হাসিতে বিষণ্ণতা, “সেটা করা যায়, কিন্তু…”
এটুকু বলে থেমে যায়, কথা পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে নিয়ে যেতে চাইছিল বুঝতে পেরে তপা বলল,
“তুমি টাকার জন্য ভাবছ তো? ভেবো না। টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
রাফিদ বিস্মিত গলায় বলল, “তুমি কীভাবে বুঝলে?”
তপা রাফিদকে বুঝতে পারে, এখনো যে সে একইরকম আছে। ভেতরে বাইরে আগাগোড়া স্বচ্ছ। নিজেকে লুকাতে শেখেনি মানুষটা।
তপার উত্তর না পেয়ে রাফিদ কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলল, “এমনিতেই অনেক খরচ হচ্ছে। তোমার উপরে কী যায় সেটা আমি জানি। এরমধ্যে আমার জন্য আবার বাড়তি একটা…”
তপার মুখে আঁধার ঘনিয়ে এলো, “রাফিদ, আমরা কিন্তু প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমাদের যা কিছু সব আমাদের, আমি তুমি এসব বলে বিভেদ করছ কেন?”
রাফিদ উঠে এসে তপার হাত ধরে বলল, “সেটা নয় তপা। নতুন করে ভিডিও বানালেই যে সেটা রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যাবে, বিষয়টা তো এমন নয়। টাকাটা হয়তো কোনো প্রয়োজনে লাগতে পারে৷ পুরোপুরি ওয়েস্ট হতে পারে এটা।”
তপা বিছানায় বসল, ঘুমন্ত দর্পণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “আপাতত তোমার স্বপ্নের চাইতে বড় প্রয়োজন আর কিছুতে নেই রাফিদ। ওয়েস্ট হলে হোক, আমি জানি তুমি কাজটা কত ভালোবাসো, প্রকৃতিকে তোমার চোখে মানুষকে চেনাবে। আজ না হোক কাল, একদিন না একদিন ভালো জিনিসের কদর হবেই।”
রাফিদের মুখে এবারও বিষণ্ণ হাসি, “তপা, সবসময় ভালো জিনিসের কদর হয় না৷ হেলাল হাফিজের মতো কবি তার প্রতিভার যোগ্য মর্যাদা কি পেয়েছিলেন? অথচ কত লোক উদ্ভট ভাঁড়ামো করে সর্বক্ষণ আলোচনায় থাকে। কেউ উদ্ভট ভিডিও বানিয়ে, কেউ ডিগবাজি দিয়ে। তাদের নিয়ে মিডিয়ার হাইপ থাকে, যেদিকে কাটতি বেশি সেদিকেই তারা ছুটবে এটাই স্বাভাবিক।”
“পুরোপুরি কদর না পেলেও হেলাল হাফিজ হেলাল হাফিজই থাকবেন৷ তার কবিতার লাইনগুলো বহুকাল পরেও মানুষের মুখে মুখে থাকবে। যারা উদ্ভট ভাঁড়ামো করে এটেনশন পেয়েছে, কিছুদিন পরে তাদের কয়জন মনে রাখবে?”
“কিন্তু দিনশেষে তারাই দেখা যায় তাদের চাহিদামতো লাইফ লিড করে। আমার নিজের রুচিবোধ আমাকে সেসব করতে সায় দেবে না। ইচ্ছেও নেই। তাই আমার ভিডিওগুলো মানুষ অব্দি পৌঁছবেও না।”
“তুমি এভাবে ভাবছ কেন রাফিদ? ভালোর কদর করার লোকের অভাব আছে নাকি, অসংখ্য ভালো মেধাবী মানুষরাও তো পাদপ্রদীপের আলোয় আছে, নেই?”
“সেটার সংখ্যা কত? আনাচে কানাচে আরও কত ট্যালেন্ট চাপা পড়ে আছে, তাদের খোঁজ কয়জন জানে? এরজন্য ট্যালেন্ট আর পরিশ্রমের পাশাপাশি আরেকটা জিনিসও লাগে অবশ্য।”
“কী?”
“পিআর। কত ট্যালেন্ট তো আছে চারপাশে, বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে, কিন্তু পিআর থাকলে তারাই লাগাতার প্রশংসা করে করে সেই ট্যালেন্ট সমঝদার মানুষ অব্দি পৌঁছে দেয়, একবার সমঝদারদের নজরে পড়লে তখন, তারাই কদর করতে শুরু করে। পসার বাড়ে। অবশ্য আরেকটা জিনিস হচ্ছে ভাগ্য, ভাগ্য থাকলে পি আরের দরকার হয় না।”
“তুমিও টিম তৈরি করো।”
“এটা খারাপ নয়, ভালোই। প্রমোশন ছাড়া তো আজকাল কিছু হয় না। সেটা সুযোগ থাকলে করাই উচিত। কিন্তু আমি ঠিক স্বাচ্ছন্দবোধ করি না। আমি চাই আমার কাজ লোকে খুঁজে দেখুক। আমার শুরুর যে অল্পকিছু সাবস্ক্রাইবার, তাদের আমি আমার হৃদয়ের গভীরে জায়গা দিয়ে রাখতে চাই। তেলা মাথায় তেল দেবার লোকের অভাব তো নেই, কিন্তু আমার মতো শূন্য একজনকে যারা সাপোর্ট করছে, তাদের হৃদয় নিঃসন্দেহে বড়। এত কম ভিউ আর সাবস্ক্রাইবার দেখেও যারা নিতান্ত অবহেলায় এড়িয়ে যায়নি, বরং উৎসাহ দেবার মতো সৌজন্যতাবোধ দেখিয়েছে, আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি এমন সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী আরও পাশে চাই। পরিশ্রমের পাশাপাশি নিজের ভাগ্যটা যাচাই করতে চাই। দেখা যাক কতজন পাশে থাকেন।”
“তো লাইমলাইটে থাকা মানুষকে যারা প্রশংসা করে সকলেই বুঝি তেলা মাথায় তেল দেয়?”
“সেটা কখন বললাম? সেখানেও অনেক সত্যিকারের ভক্ত থাকে। যারা তাদের সত্যিই মন থেকে পছন্দ করেন৷ কিন্তু এমন অনেকেই তো আছে যারা হয়তো ভিউ দিয়ে কন্টেন্টের বিচার করে, ছোট কিছুকে সাপোর্ট করতে সংকোচ হয়, লজ্জা হয়। সদিচ্ছা থাকে না।”
একটু থেমে সিদ্ধান্ত জানালো রাফিদ, “আমি নতুন করে ভিডিও করব। যেহেতু এটাই আমার প্যাশন। তবে সেটা আমার স্ট্রাগল দিয়ে হোক। যদি কোনোদিন সফল হতে পারি, এই স্ট্রাগলের দিনগুলো আমাকে ফুয়েল দেবে। স্ট্রাগলে যারা আমার শুভাকাঙ্ক্ষী হবে, তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ আমাকে পথ হারাতে দেবে না। এতে হয়তো সফলতা আসতে অনেক দেরি হবে, হয়তো আসবেই না। তবুও আমি এই পথেই হাঁটতে চাই।”
রাফিদের গলায় আশ্চর্য দৃঢ়তা। সে একরোখা, জানে তপা। এজন্যই হয়তো লোকে বেপরোয়া বলে।
“তুমি সফল হবে রাফিদ। তুমি প্রকৃতির মধ্যে শুধুই ভিজুয়াল সৌন্দর্য দেখো না। তুমি প্রকৃতিকে অনুভব করো, প্রকৃতির বিষাদ বোঝো, মানুষকে বোঝো। তোমার চোখে মানুষ প্রকৃতিকে দেখতে অবশ্যই ভালোবাসবে। একদিন তোমার অজস্র শুভাকাঙ্ক্ষী হবে, যারা তোমার ট্যালেন্টকে ভালোবাসবে। ভালোবাসতেই হবে।”
তপা কথাটা বলল রাফিদকে সাহস দেবার জন্য। সে-ও জানে ভবিতব্য সবসময় অনিশ্চিত। সামনে দাঁড়ানো এই মানুষটা এই লড়াইয়ে হয়তো অসংখ্যবার হোঁচট খাবে, তপা সবসময় খুঁটির মতো পাশে দন্ডায়মান থাকবে। ভালোবেসে, হৃদয়ের সমস্ত শুভাশিস সঙ্গে নিয়ে।
***
কবীর নেশায় চূড় হয়ে আছে। নেশার মধ্যেও তপার ঔদ্ধত্যপূর্ণ মুখটা বারবার চোখে ভাসছে। ওই অসহ্য চাহনি সে প্রথমবার কবে দেখেছিল! সে তখন প্র্যাগনেন্ট, কবীর তখন নিজের জয়ে নিমগ্ন। জানে তপার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া গেছে। ওকে ছাড়া আর কোনো গতি নেই।
সে নিশ্চিন্তে খোলস ছাড়তে শুরু করেছে। বাসাতেই গলায় ঢালতে শুরু করেছে একটু একটু করে।
“তোমার লজ্জা করে না? তুমি মদ খেয়ে আমার ঘরে আসবে না। যে আসছে ওর ক্ষতি হবে।”
ওর ঘরে দাঁড়িয়ে ওকেই নিষেধ করছে ঘরে ঢুকতে, ক্যাটক্যাটে হেসে সে বলেছিল, “আমার ঘরে আমি যা ইচ্ছা করব, মদ খাব, যা ইচ্ছা করব। আমার দয়ায় ভোগ বিলাস করছ, আবার আমাকেই হুমকি দিচ্ছ? একবারে চুপচাপ থাকবা৷ যা বলব মেনে নিবা।”
তপার মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গিয়েছিল অপমানে৷ পরমুহূর্তেই ক্রুদ্ধ গলায় বলেছিল, “মদের নেশা কাটলে তোমার সাথে কথা হবে।”
বলেই ওর মুখের উপরে রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েছিল তপা। তখন কবীরের নেশা চড়েনি, সে কথাগুলো বলেছিল সজ্ঞানে। বোকা মেয়েটার ঘোর তখনো কাটেনি। তবে তখন থেকেই প্রায়ই ওদের দ্বন্দ্বযুদ্ধ লাগত প্রায় প্রতিদিনই। একটু একটু করে আত্মবিশ্বাস ভাঙতে মজাই লাগত ওর৷
সেদিনের ওই চাহনি কবীরকে এখন খোঁচাচ্ছে। সেদিনও নতুন হাজব্যান্ডের হাত ধরে ওর চোখের দিকে সেই একইরকম দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল তপা। ওই চোখ উপড়ে দিতে পারলে শান্তি লাগত।
নেশাও এই রাগ কমাতে পারল না, রাত দুটোয় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। একজন পথচারীর গায়ে ধাক্কা লাগল প্রবলভাবে। টহল পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলো কবীর।
আগের কয়েকটা মামলার খাড়া আগে থেকেই ঝুলছিল ওর ঘাড়ে।
……….
(ক্রমশ)