নিভৃত দহনে পর্ব-৪৭

0
15
নিভৃত দহনে পর্ব-০১
নিভৃত দহনে

#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৪৭)
নুসরাত জাহান লিজা

তপা কবীরের খবর শুনল, ওর ভেতরে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো না। অথচ একটা সময় এই লোকটাকে সে সর্বান্তকরণে ভালোবেসেছিল। সময়ের আবর্তে সেটা কবেই বদলে গেছে প্রবল ঘৃণায়। এখন সেটাও নেই, ওই লোকটা ওর জীবনে পুরোপুরি অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। ঘৃণা ধরে রাখলেও তো সে ওর কোথাও থেকে যাবে, তাই তাও মুছে দিয়েছে।

লোকটার জন্যই সে দর্পণের মতো পরশ পাথর পেয়েছিল, তাই সেই সময়টা একেবারে মুছেও ফেলা যায় না।

প্রায় ছয় মাস ধরে কেস চলল, কবীরের কুকীর্তি ফলাও করে প্রচারিত হলো সংবাদপত্রের পাতায়, অনলাইন পোর্টালগুলোতে। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের মধ্যে অপ-সাংবাদিকতার চর্চা বেশ চলে। তাই কবীরের প্রাক্তন স্ত্রী হিসেবে তপাও এলো সেসব চর্চায়, তপার বর্তমান স্বামী, তার শিল্পপতি শ্বশুরও।

নেতিবাচক জিনিস আরেকটু রগরগেভাবে উপস্থাপন করলে সেসবের কাটতিও বেশি হয়। তাই তারা বেশ রসালো মনগড়া কথাও লিখল।

এরমধ্যে একদল হুজুগে জনতা আছে, যারা কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া গসিপ দেখেই জাজমেন্টে বসে যায়৷

তপা, রাফিদ কেউই এসব পাত্তা দিল না। তারা পরস্পরকে চেনে, সম্মান করে, ভালোবাসে, বাইরের অপরিচিত দুনিয়া কী বলল তাতে কী-ইবা যায় আসে।

মিডিয়া হাইপের কারণে বা জনরোষের কারণেই হোক, কবীরের বিচার দ্রুত শুরু হয়েছিল। সাত মাস পরে রায় হলো, গুম, জালিয়াতিসহ অসংখ্য তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তার সাত বছরের জেল হলো।

কবীরের সাথে তার পরিবারের সম্পর্ক ভালো ছিল না, তার বাবা দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলেন। কবীর আপিল করেছে।

এরমধ্যে কবীরের মা একদিন তপাকে কল দিয়ে অনুরোধ করলেন, তার শরীর খুব খারাপ, একবার দর্পণকে চোখের দেখা দেখতে চান।

তপা প্রথমে নিষেধ করেছিল, পরে ভেবে দেখল, এটা ঠিক নয়। একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের অনুনয় সে ফেলতে পারল না। তাছাড়া এই একজন ভদ্রমহিলা ওর প্রতি কিছুটা হলেও সহানুভূতিশীল আচরণ করেছেন সেসময়। অধিকারও রয়েছে দেখার।

তিনি কল দেবার পরেরদিন ওর ফিল্ড ভিজিট ছিল, তার পরেরদিন শুক্রবারে সে রওনা হলো দর্পণ আর রাফিদকে নিয়ে।

যেজন্য ওদের আসা, তা অবশ্য সফল হলো না৷ তিনি সেদিন সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে মারা গেছেন। কবীরের সাথে দেখা হলো, মায়ের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় ওকে প্যারোলে মুক্তি দেয়া হয়েছে দু’দিনের জন্য।

তপার মন খারাপ হয়ে গেল, একজনের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারল না বলে।

ঘর ভর্তি ওদের অনেক আত্মীয়স্বজন এসেছে। শোকাবহ পরিবেশ, তপাকে দেখে অনেকের মধ্যে কানাঘুষা, ফিসফাস শুরু হয়েছে এমন পরিস্থিতির মধ্যেও। তপারা ফিরে আসছিল, গেটের সামনে আসতেই পেছন থেকে কবীর ডাকল। বাইরে পুলিশি পাহারা।

কবীর এসে বলল, “কী মনে করে এসেছ? আমার হার দেখে উল্লাস করতে?”

তপা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আমি কারোর ক্ষতিতে উল্লাস করি না কবীর। সে নরপশু হলেও নয়।”

“তোমাকে আমার খুব ভালো করে চেনা আছে।”

“কবীর, কারো চোখে সামনের মানুষটা কেমন তা নির্ভর করে তার দৃষ্টিভঙ্গির উপরে৷ তোমার দৃষ্টিভঙ্গি ভীষণ টক্সিক। তাই তুমি সবাইকে সেভাবেই ভাবো। সেটা তোমার ভাবনার সীমাবদ্ধতা।”

রাফিদের কোলে দর্পণকে দেখে কবীর ক্যাটক্যাটে হেসে বলল, “আমার ছেলের বাবা হয়ে গেছ, আমার বউয়ের হাজব্যান্ড। অন্যের বাতিল জিনিস ব্যবহার করতে তোমার জুড়ি মেলা ভার।”

রাফিদের হাত মুঠো হয়ে এসেছে প্রবল রাগে, তবে জায়গাটা সমীচীন নয়, সে শীতল দৃঢ় গলায় বলল, “মানুষকে তুমি পণ্যের চাইতে বেশিকিছু ভাবতে পারো না, তাই না? এভাবে কারা চিন্তা করে জানো? শব্দটা মুখে বলতে বাঁধছে, কিন্তু আমি জানি তুমি বুঝতে পেরেছ৷”

কথার চপেটাঘাতে কবীরের মুখ হিংস্র হলো, খানিকটা থেমে রাফিদ বলল, “তোমার প্রতি আমার ভীষণ করুণা হচ্ছে, একটা উপদেশ দেই, যদিও অপাত্রে দান হচ্ছে তবুও বলি, অমৃত আর গরলের মধ্যে তুমি কোনটা বেছে নেবে সেটা তোমার সিদ্ধান্ত ছিল। অমৃত নাড়াচাড়া করলে তোমার গায়ে বড়জোর তাই ছলকে পড়তে পারে, আর বিষ নিয়ে নাড়াচাড়া করলে সবচাইতে ভালো হলেও গায়ে হেমলক বিষ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তোমার গায়ে সেটাই পড়েছে।”

রাফিদের ইচ্ছে করছিল কবীরকে উত্তমমধ্যম দিতে। কিন্তু এমন একটা শোকাবহ পরিবেশে সে সহবত জ্ঞান হারাতে পারে না। তাই বেঁচে গেল।

সামনে সিকিউরিটি না থাকলে হয়তো কবীরও সেটাই করত, ওর মাথায় খু ন চেপে গিয়েছিল।

চেয়েছিল অন্তত কথার আঘাতে ওদের বিদ্ধ করতে, কিন্তু ঢিল ছুঁড়লে পাটকেল খেতেই হয়। প্রকৃতির নিয়ম।

“তুমি একজন সুপ্যারিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা সাইকোপ্যাথ কবীর। জেলে বসে অন্তত নিজের ভুলগুলো বুঝে নিজেকে শুধরে নিতে চেষ্টা কোরো।”

তপা কথাটা বলেই ওদের নিয়ে বেরিয়ে এলো। দমবন্ধ হয়ে আসছিল সেখানে।

***
জহুরার শরীরটাও ভালো নেই। তাই ওরা তুহিনের ভাড়া বাসায় এলো।

তুহিন মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছে। রাফিদ হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন ভাইয়া?”

তুহিনের মনে অনুশোচনা, সে বলল, “তোমাকে অনেক বাজে কথা শুনিয়েছিলাম৷ সেজন্য স্যরি রাফিদ।”

“এভাবে বলবেন না প্লিজ। হ্যাঁ আপনার কথায় আমার খুব খারাপ লেগেছিল, কিন্তু ওই কথাগুলো আমাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। জীবনে কখনো কখনো একটা ধাক্কার প্রয়োজন হয়। যাতে নিজেকে ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড থেকে বেরিয়ে বাস্তবের আয়নায় দেখা যায়৷ আপনি সেই কাজটা আমার জন্য করেছিলেন৷ তাই আপনার প্রতি আমার রাগ নেই।”

বলার সময় বাবার মুখটা ভেসে উঠক রাফিদের মানসপটে, তপাকে দেখে সে দর্পণকে সবসময় প্রশ্রয় দেয় না। সে জিজ্ঞেস করলে বলে, “সব আবদার সাথে সাথে পূরণ করতে নেই৷ তাতে পৃথিবীটাকে নিজের হাতের মুঠোয় ভাবতে শুরু করবে। সফলতা ব্যর্থতা মিলিয়ে মানুষের জীবন। সুপ্যারিওরিটি কমপ্লেক্স তৈরি হবে। সেটা ভীষণ ভয়াবহ।”

বাবাও কি তবে ওকে একটা ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন! এভাবে!

তুহিন তপার পাশে এসে বসল, “আমি জানি আমি ভাই হিসেবে অযোগ্য। ক্ষমারও যোগ্য নই। তবুও তোর কাছে ক্ষমা চাইছি মন থেকে।”

তপা একবার তুহিনের দিকে তাকালো, “আমি রাফিদের মতো উদার নই। একসময় আমাদের খুব সহজ একটা সম্পর্ক ছিল, সরল মিষ্টি ভাইবোনের সম্পর্ক। তুমি বদলে যেতে লাগলে সময়ের সাথে। ছোটবেলায় আমরা চকলেট পর্যন্ত ভাগাভাগি করে খেতাম। তুমি আমার জন্মদিনে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে প্রিয় বই উপহার দিতে। কেন বদলে গেলে? মানুষের মন কাচের মতো, টুকরো হয়ে গেলে যতই জোড়া লাগাবার চেষ্টা করা হোক না কেন, দাগ থেকেই যায়। তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম মন থেকে। কিন্তু ওই সুন্দর সহজ সম্পর্কটা কি আর কোনোদিনও সম্ভব?”

বলতে বলতে তপার গলা কেঁপে গেল, চোখ ভিজে আসছিল, সে প্রাণপনে সেটা চাপা দিল।

ইলা রান্না করেছে ওদের জন্য। ওদের খাবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু জহুরার কাতর মুখ দেখে এড়াতে পারল না।

কিন্তু থাকল না, তপা বলল, “একবার মা বাবাকে দেখতে যাবে?”

রাফিদ শিরীনকে কল দিল, “মা, বাসায় তুমি একাই আছো?”

“হ্যাঁ কেন?”

“আমি একবার তোমাকে দেখব মা।”

শিরীন কান্না বিজড়িত গলায় বলল, “এতদিন পরে মাকে দেখতে ইচ্ছে করল বুঝি? মায়ের কাছে ফোন করে আসতে হয় বুঝি?”

রাফিদের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। চোখ ভিজে আসছে।
………..
চলবে।