#নিভৃত_দহনে (শেষ পর্ব)
নুসরাত জাহান লিজা
তপা এই প্রথমবার রাফিদের বাসায় এলো। ভেতরে ঢুকার আগে কেন যেন বুক ঢিপঢিপ করছিল। দরজা খুলেই শিরীন ওদের দেখে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ তার চোখ ভর্তি জল অথচ মুখে এক চিলতে হাসি।
তিনি রাফিদকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন, কতদিন পরে তিনি ছেলেকে চোখের সামনে দেখলেন! রাফিদের চোখেও তখন জল, মা ছেলের এই মিলন পর্ব তপা হৃদয় দিয়ে অনুভব করল।
শিরীন নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে তপাকেও আলিঙ্গন করলেন, “এসো মা, নিজের ঘরে এসো।”
এত আন্তরিক ভঙ্গিতে কথাটা বললেন, তপার হৃদয় ছুঁয়ে গেল, সে বলল, “আপনি কেমন আছেন মা?”
“এখন খুব ভালো আছি।” বলে দর্পণকে কোলে নিলেন।
দর্পণ সবসময় তাকে ভিডিওকলে দেখেছে, আজ প্রথমবার সামনা-সামনি দেখছে, শিরীন জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে চিনিস দাদু?”
“দাদু, দাদু।”
ওদের ভেতরে নিয়ে গেলেন। বর্তমান হালচাল জিজ্ঞেস করলেন। তপা হঠাৎ বলল, “আমার উপরে আপনার রাগ নেই তো মা?”
“সে কী? কেন?”
“এই যে আমাদের বিয়ের জন্য রাফিদের সাথে এতগুলো দিন ধরে দূরত্ব…”
তপাকে শেষ করতে না দিয়ে শিরীন বললেন, “তোমার সাথে আমার ছেলেটা এত সুখে আছে, তোমার উপরে শুধু শুধু কেন রেগে থাকব মা? এসব কথা একদম ভাববে না। নইলে এবার কিন্তু সত্যিই রেগে যাব।”
তার বলার ভঙ্গিতে মুহূর্তটা সহজ হয়ে উঠল।
কিছুক্ষণ পরে রাফিদ উশখুশ শুরু করল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, “এবার আমাদের ফিরতে হবে মা।”
“ফিরে যাবি?” কাতর আর্তির মতো ভেসে এলো কথাটা।
“ফিরতে তো হবেই মা।”
“আমি রান্না বসিয়েছি, অন্তত না খেয়ে যাস না বাবু।”
একজন মায়ের এমন আর্তি সন্তানের জন্য ফেরানো দায়। ওরা তপাদের বাসায় খেয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। তবুও সম্মত হলো। এতদিন পরে মায়ের হাতে রান্নার স্বাদ পাবার লোভও হলো।
তপা শিরীনের সাথে রান্নাঘরে গেল, এটা-সেটা টুকিটাকি গল্প করছিল। রাফিদ ভাবছিল, রান্নাটা দ্রুত শেষ হোক, বাবা চলে আসার আগেই সে বেরিয়ে যাবে।
বহুদিন পরে শিরীন আজ আবার রান্না করলেন, ওদের খাওয়া ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে দেখলেন। রাফিদ দর্পণকে খাইয়ে দিচ্ছে, ছেলেকে এভাবে দেখে তার কী যে ভীষণ ভালো লাগল। তার সেদিনের সেই ছোট্ট রাফিদ কেমন বাবা হয়ে উঠেছে!
খাওয়া পর্ব শেষে ওরা বেরিয়ে আসছিল, শিরীন আবারও ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন, সদর দরজা খুলতেই রাফিদ থমকে দাঁড়াল, বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন জয়নুল।
ছেলেকে চোখের সামনে দেখে তিনি কিছুক্ষণ পৃথিবী বিস্মৃত হয়ে তাকিয়ে রইলেন অপার বিস্ময় নিয়ে।
রাফিদের ভিডিওগুলো ইদানিং বেশ ভিউ পাচ্ছে। ভরাট গলার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা লোকে ভালোবাসছে। ছেলের ভ্লগের একজন গুণমুগ্ধ দর্শক তিনি, এটা তার ছেলে জানে না।
তিনি কতবার যে ভিডিওগুলো দেখেছেন! প্রতিদিন দেখেন, দেখা ভিডিও বারবার দেখেন৷ মনে হয় ছেলে তার সাথেই আছে। রাফিদ যে কতটা ভালোবাসা নিয়ে ভ্লগ বানায়, তার আনন্দ ভিডিওতে ছেলের চোখেমুখে ঠিকরে পড়ে। সেই ভালোবাসা তিনি এখন অনুভব করতে পারেন।
সর্বশেষ ভিডিওটা রাফিদ পোস্ট করেছিল, দর্পণের সাথে, চা বাগানে। এতটা মিষ্টি আদুরেপনা ছিল সেই ভিডিওতে, যেখানে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না। ক্যামেরার পেছনে ছিল তপা। ওর গলাও শোনা গেছে। ভীষণ সুখী একটা পরিবারের ছবি।
কোনো ভালোবাসার কথা নেই, তবুও ভিডিও জুড়ে অব্যক্ত ভালোবাসা ফুটে উঠেছিল। ভিডিওটা তপা করেছিল, সুন্দর মুহূর্তটা ধরে রাখতে, ভ্লগের উদ্দেশ্যে নয়। রাফিদের কাছে ওর দর্শকেরা খুব ভালোবাসার। তাই নিজের ভীষণ প্রিয় সন্তানকে সে তাদের সাথে পরিচয় করাতে চেয়েছিল। তাছাড়া ওদের বিয়ের ছবিতে দর্পণের ছবি ছিল, অনেকে কমেন্টে ওকে দেখার আবদার করত। তাদের আবদার পূরণ করতেই পোস্ট করেছিল।
ছেলের সাফল্য দেখতে তার ভালো লাগে, একটু একটু করে জীবনকে চিনেছে, দায়িত্ব নিতে শিখেছে৷ এটাই তো তিনি চাইতেন। যদিও প্রফেশনটা তার তেমন পছন্দ হয়নি, তবুও তিনি খুশি।
রাফিদও বাবাকে দেখে হতবিহ্বল, সে নিজেকে ধাতস্থ করে কম্পিত গলায় বলল, “আসি মা।”
“কোথায় যাচ্ছ?” জলদগম্ভীর গলা জয়নুলের।
“যেখানে যাবার।”
“খুব লায়েক হয়ে গেছ মনে হচ্ছে!”
“এটা তোমার বাড়ি, আমার এখানে আসার অনুমতি নেই। তুমি বলেছিলে একদিন।”
জয়নুলের ইচ্ছে করছে রাফিদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে, কিন্তু দীর্ঘ অনভ্যাসে তিনি পারছেন না। ছেলের গোয়ার্তমি দেখে তার মুখ দিয়ে এবার বিরক্তি ঝরল,
“তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যেতেই পারো, কিন্তু ওরা প্রথমবার এসেছে, ওদের আমি এভাবে যেতে দেব না।”
বলেই তপার কাছ থেকে দর্পণকে কোলে নিয়ে তিনি সটান ভেতরে চলে এলেন, এরপর তপাকে বললেন, “তুমি ভেতরে এসো মা।”
“বাবা…”
রাফিদকে থামিয়ে দিয়ে তপাকে ইতস্তত করতে দেখে তিনি বললেন, “ওর যেতে ইচ্ছে করলে একাই যাক। তোমার অফিস তো রবিবার। আমি শনিবার তোমাকে যাবার ব্যবস্থা করে দেব।”
শিরীন এতক্ষণ বুঝতে চেষ্টা করলেন কী হচ্ছে। অভিমানে জয়নুলের সাথে তার সম্পর্কে শীতলতা জমেছিল। কিন্তু দর্পণের অভিভাবকত্বের মামলায় তাকে যেভাবে অস্থির হয়ে উঠতে দেখেছিলেন, তাতে তিনি নতুন করে ভাবতে শুরু করেছিলেন৷ এরপর সমস্ত কথা তিনি শুনেছেন৷
তারপর থেকে তাদের মধ্যে আবার কিছুটা স্বাভাবিক হয় সবকিছু। তবুও তার অভিমান পুরোপুরি যায়নি, এতটা কঠোরতা দেখাবার কী প্রয়োজন, যাতে সন্তান এতটা দূরে সরে যায়!
অভিমান জয়নুলেরও হয়েছিল স্ত্রীর প্রতি, তিনিও অনুযোগ করে বলেছিলেন, “তুমিও আমাকে বুঝতে চেষ্টা করোনি শিরীন। এতদিন পরে এসেও?”
এখন এই নাটুকেপনায় তিনি বিরক্ত হলেন, সরাসরি বলতে সমস্যা কী এই মানুষটার! তবে তিনি এটুকু বুঝলেন বরফ গলছে সম্পর্কের। তাই তিনি হস্তক্ষেপ করলেন না।
দর্পণ তার কোলে উঠে বিস্ময় নিয়ে দেখছে তাকে। আগে দেখেছে কিনা মনে করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু এখন দেখছে তার প্রিয় ‘দাফেত বাবা’র সাথে রেগে কথা বলছেন, তাই তাকে ওর পছন্দ হয়নি খুব একটা। সে বলল,
“দাফেত বাবা যাব।”
“আমি তোর দাফেত বাবার বাবা। দাদু হই।”
দর্পণ শিরীনের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “দাদু।”
রাফিদ এবার কথা বলল, “ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। ওকে দাও, আমি যাই।”
“ও যাবে না। তোমার ওকে ছাড়তে না ইচ্ছে হলে থেকে যেতে পারো।”
তপা এবার বুঝতে পেরেছে, ওর ভীষণ মজা লাগছে। এমন গুরুগম্ভীর একজন মানুষের সন্তান স্নেহ প্রকাশের অপারগতা, সাথে তাকে সান্নিধ্যে পাবার কাতরতা সে উপলব্ধি করেছে।
অপরদিকে রাফিদ জেদি শিশুর মতো নাকের পাঁটা ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল, দর্পণ এভাবে অভিমানে নাক ফোলাতে কার কাছ থেকে শিখেছে! ওর মনে হলো বাবা-ছেলের সাত সমুদ্র ব্যবধান কমাবার এই সুযোগ। নইলে এই দুইজনের কেউই নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে না। রাফিদের কাতরতা সে তো প্রতিদিন দেখে।
“রাফিদ, আমি বরং থেকেই যাই। বাবা এত করে বলছেন।”
“তুমি থাকবে?” অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে সে তপাকে বলল।
“হ্যাঁ। চলো আজ থেকে যাই৷ বড়দের কথা ফেলতে নেই।”
বলে তপা ভেতরে চলে এলো। হতভম্ব রাফিদ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
জয়নুল বললেন, “এই তো তুমি বুঝতে পেরেছ মা।”
রাফিদ তবুও দাঁড়িয়ে আছে, জয়নুল বললেন একবার স্টাডি রুমে এসো। কথা আছে।”
বলে তিনি সেদিকে গেলেন দর্পণকে তপার কাছে দিয়ে। রাফিদ বাবার পেছনে গেল। ভেতরে এসে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এখানেই ওকে চূড়ান্ত ব্যর্থতার সার্টিফিকেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে বলা হয়েছিল ভালোবাসার অপরাধে।
“কেন ডাকলে আবার?”
জয়নুল কোনোদিন যা করেননি তাই করলেন, ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে। এমন আকাঙ্ক্ষিত অথচ অপ্রত্যাশিত আচরণে সে জমে গেল, চোখের কোণে জল জমল। সে-ও প্রাণপণে আঁকড়ে ধরল বাবাকে। ছেলেবেলা থেকে সে এমন একটা মুহূর্তের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় ছিল। কোনো কথা নয়, জাগতিক কোনো ভাষা নয়, শুধুমাত্র একটা প্রগাঢ় আলিঙ্গন তাদের মধ্যে তৈরি হওয়া এক পৃথিবী দূরত্ব যেন এক নিমিষেই কেটে গেল।
জয়নুল হাজার চেষ্টা করেও তার সদা কাঠিন্যের খোলস ধরে রাখতে পারলেন না। তার চোখ ভিজে আসছে। ছেলের চোখের জলে তার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। কতক্ষণ অতিবাহিত হলো দু’জনের কেউই জানে না।
বহুক্ষণ পরে রাফিদ অস্ফুটস্বরে ভেজা গলায় বলল, “বাবা..”
“আরও আগে কেন ফিরে এলে না?”
“তুমি তো আমাকে এভাবে ডাকোনি কখনো।”
“ফিরে এসো তোমরা। বাড়িটা বড্ড শূন্য হয়ে গেছে তুমি যাবার পরে।”
“তুমি বের করে দিয়েছিলে।”
“এক কথা কতবার বলবে? সেদিন সেটা না করলে তুমি জীবনকে চিনতে পারতে? এখন যেভাবে চিনেছ?”
রাফিদ উত্তর দিল না, পিতৃ স্নেহের উষ্ণতা অনুভব করছিল।
***
সোমার মেয়ে হয়েছে। রবীন স্ত্রীর পাশে এসে বসল। প্র্যাগনেন্সিতে ওজন বেড়েছে। ওর মনে হলো মেয়েটার সৌন্দর্য যেন বেড়েছে আগের চাইতে। মুগ্ধ চোখে সে স্ত্রী আর তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা সন্তানকে দেখছে! কী অসহনীয় কষ্ট হয়েছে, কমপ্লিকেসি ছিল কিছুটা। সব ভালোই ভালোই হয়েছে।
কী যে আনন্দ হচ্ছে ওর।
সোমা বলল, “কী দেখছ?”
“আমার পৃথিবী।”
সোমা মৃদু হাসল, এই মানুষটা গোটা সময়টাতে কীভাবে ওর পাশে থেকেছে। ওর সমস্ত আবদার হাসিমুখে মিটিয়েছে। সোমা শুনেছে এই সময় নাকি অনেক পুরুষ স্ত্রীর প্রতি মুগ্ধতা হারিয়ে ফেলে। এসব নিয়ে সে খিটিমিটি করেছে অনেক। হরমোনাল চেঞ্জের জন্য উদ্ভট চিন্তা মাথায় ঢুকেছে। এসব নিয়ে অনেক জ্বালিয়েছে। মানুষটার ধৈর্য অপরিসীম। সে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। রবীনের ভালোবাসার প্রগাঢ়তা আরও বেশি উপলব্ধি করেছে সে।
“তুমি একটুও বদলাওনি রবীন।”
“কথা দিয়েছিলাম, বদলাব না।”
সোমা মুখ জুড়ে তৃপ্তির ছাপ। জীবনে আর কিছু চাইবার আছে কী!
***
নীলা যেদিন প্রথমবার মলিনাকে বলল, “আমার মায়ের চেহারা আমার মনে নাই। কোনোদিন ডাকবার পাই নাই।”
মলিনা বলল, “আমারে একবার ডাকবা আম্মা?”
নীলা স্কুলে যায়, তখন মায়ের অভাব আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারে। অনেকেই আছে ওর সাথে মিশতে চায় না৷ আবার কয়েকজনের সাথে ওর ভীষণ বন্ধুত্ব হয়েছে। ওরা মায়ের গল্প করে, তখন ওর ভীষণ কষ্ট হয়। ওর মা নেই।
মলিনা ওকে ভীষণ ভালোবাসে, এই ভালোবাসা সে উপলব্ধি করতে পারে৷ সে আপত্তি না করে বলল,
“মা।”
মলিনা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “আরেকবার ক না।”
“মা।”
“আমার আত্মাডা জুড়াইয়া গেল মা।”
দুইজন রক্তের সম্পর্কহীন মানুষ হয়ে উঠল পরমাত্মীয়। মাতৃহীন একজন মেয়ে আর নিঃসন্তান একজন মা কেমন নিজেদের অতৃপ্তি পুষিয়ে নিল পরম আবেগে, ভরসায় আর ভালোবাসায়।
***
রাফিদের কাছে দর্পণের ‘’দাফেত বাবা’ ডাকটা এত্ত মিষ্টি আর আদুরে লাগে! চোখের পলকে ছেলেটা কেমন বড় হয়ে যাচ্ছে৷ এখন সব স্পষ্ট শব্দ উচ্চারণ করতে শিখে গেছে। ওর মনে হয় এই ডাকটা যেন কখনো পরিবর্তন না হয়!
সে ওর আশঙ্কা ইতোমধ্যে তপার কাছে প্রকাশ করে ফেলেছে, “দর্পণটা কেমন বড় হয়ে যাচ্ছে।”
“হ্যাঁ। মাশাল্লাহ।”
“ওর এই সময়টা ধরে রাখতে পারলে ভালো হতো। আর কয়দিন পরে তো আমাকে ‘’দাফেত বাবা’ বলে ডাকবে না।”
তপা হেসে ফেলল, “পাগল।”
জয়নুলের শরীর এখন এত ধকল সামলাতে পারে না, তিনি হাঁপিয়ে উঠেন৷ রাফিদ অগত্যা বাধ্য হয়েছে তার পাশাপাশি ব্যবসার হাল ধরতে। তবে এরমধ্যেও সময় বের করে সে ঠিকই মাসে একটা করে হলেও ভ্লগ বানায়। এটা মনে হয় না সে ছাড়তে পারবে!
তপার প্রমোশন হয়েছে, ঢাকার ব্রাঞ্চে জয়েন করেছে। শিরীন আর জয়নুলের এখন ঘর ভরা আলো।
দর্পণের তৃতীয় জন্মদিনের আয়োজন করা হয়েছে। কিছু আত্মীয়স্বজন আর তাদের বন্ধুবান্ধব এসেছে।
দর্পণের প্রথম জন্মদিনে উপস্থিত না থাকতে পারার আক্ষেপ সে দ্বিতীয় জন্মদিনে মিটিয়ে নিয়েছিল। নিজের প্রথম উপার্জনের টাকা দিয়ে সে তপা আর ওকে ট্রিপে নিয়ে গিয়েছিল কক্সবাজারে। ছোট্ট দর্পণের সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন শুনে সে কী উল্লাস। ওর আয়োজন স্বার্থক মনে হয়েছিল।
আগত অতিথিদের মধ্যে একজন আচমকা বলল, “বাহ্, রাফিদ। তোমার প্রশংসা না করে পারা যায় না। যেভাবে তুমি একজন মেয়ের দায়িত্ব নিলে বিয়ে করে এটা সচরাচর দেখা যায় না।”
রাফিদের মেজাজের পারদ চড়ল সহসাই, “দায়িত্ব? আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছি। কেউ কাউকে দয়া বা করুণা করে নয়। একজন হাজব্যান্ড তার স্ত্রীকে ভালোবাসবে, সম্মান করবে এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? এটা তো এভাবে গ্লোরিফাই করার মতো কিছু নয়। বরং এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক বিষয়টাকে আহামরি বানিয়ে ফেলে সম্পর্ককে খাটো করবেন না প্লিজ। তাতে অপরপাশের মানুষটার ভালোবাসাকে ছোট করা হয় বলে মনে হয় আমার কাছে। ”
যে বলেছিল, সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “না মানে তুমি একজন ডিভোর্সি মেয়েকে যেভাবে …”
“আমি এমন একজনকে বিয়ে করেছি, যাকে আমি ভালোবাসি, যে আমাকে ভালোবাসে। আর ডিভোর্স হলেই সেটা তার অযোগ্যতা? সে একজন মানুষ, আমার সন্তানের মা। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখুন, ডিভোর্সি কিনা সেটা দিয়ে কারোর যোগ্যতার বিচার করতে বসবেন না। মনুষ্যত্ব দিয়ে মানুষের বিচার করতে শিখুন।”
তপা রাফিদকে রেগে যেতে দেখে ওর পাশে এসে হাতে আলতো চাপ দিল ঠাণ্ডা হবার জন্য। রাফিদ সেখান থেকে নিজের ঘরে গেল। তপাও পিছু নিল।
শিরীনের চোখে-মুখে অদ্ভুত মাতৃ গর্বের ছায়া খেলে গেল, তার ছেলেকে নিয়ে। তিনি ছেলেকে সঠিক শিক্ষা দিতে পেরেছেন৷ এবার তিনি শান্তিতে চোখ বুজতে পারবেন।
***
“এত রেগে যেতে হয়?”
তপার কথায় রাফিদ ফিরে তাকাল, “ওভাবে বলবে কেন?”
“তাতে কী এসে যায়?”
“যায় না, কিন্তু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া উচিত। তোমাকে বা দর্পণকে নিয়ে খোঁচালে সেটা আমি অন্তত চুপচাপ সহ্য করতে পারব না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তারা মানুষের যোগ্যতা অযোগ্যতার সার্টিফিকেট দিতে এসেছে।”
তপা রাফিদকে জড়িয়ে ধরল, “আজকের দিনটা দর্পণের জন্য। তাই না? ও তো কষ্ট পাবে।”
রাফিদ আচমকা শঙ্কিত গলায় বলল, “তপা, দর্পণ বড় হচ্ছে। একদিন বুঝতে শিখবে। তখন ও আমাকে যদি…”
এই পর্যন্ত বলে থেমে গেল, বাকিটুকু উচ্চারণও করতে পারল না, তপা ওর মুখে হাত চাপ দিয়ে বলল, “তুমি দর্পণের বাবা রাফিদ। দর্পণ তোমার শিক্ষায় বড় হচ্ছে। দাদির সান্নিধ্য পাচ্ছে৷ ও ঠিক তোমার মতো সত্যিকারের গুড সোল পাবে, দেখে নিও। ও তোমাকে ছাড়া ভাবতেই পারবে না কোনোদিন।”
রাফিদের চোখে বাষ্প জমছিল, হঠাৎ বাইরে থেকে আদুরে গলায় ডাক এলো, “আম্মু, দাফেত বাবা, কেক কাতব তো। কই, এসো।”
রাফিদের মুখে হাসি ফুটল। ওরা বাইরে এলো, দর্পণ এসে দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়ের হাত দুই হাতে ধরে বলল,
“দেরি কচ্ছো।”
রাফিদ নিজের কান ছুঁয়ে বলল, “স্যরি দর্পণ সোনা।”
বলে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “আমরা এখনই কেক কাটতে যাচ্ছি।”
***
পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে, যারা পৃথিবী উল্টেপাল্টে গেলেও নিজের ভুল দেখতে পায় না। কবীর সেই গোত্রের মানুষ। যত কিছুই হোক, তাদের মনে হয় সে-ই ঠিক, বাকি দুনিয়া ভুল।
জেলে বসে ওর একটাই আক্ষেপ, একটা মেয়ের কাছে সে হেরে গেল৷ এরচাইতে তার মৃত্যুও ভালো ছিল। ওর দুটো কথায় যে মেয়ে মোমের মতো গলে পড়ত, সেই মেয়ে এভাবে তাকে গো-হারা হারাবে এটা তার পৌরুষের উপরে আঘাত।
প্রতি মুহূর্তে সে হাজারবার করে মরে যায় হারের লজ্জায়।
পরিশিষ্টঃ
দর্পণের বয়স এখন পাঁচ, তপা আর রাফিদের ঘরে আরেকজন সদস্য আসছে।
দর্পণ ভীষণ খুশি। ওর একটাই অসুবিধা, এখন বাবা ওকে ওর নাম লিখতে শেখায়, ওর ইচ্ছে করে না। বাবাটা ভারি দুষ্টু হয়েছে, ওকে কীভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে লিখতে শিখিয়ে ফেলেছে। আবার পঁচা বিশ্রী ওষুধ খাওয়ায় গল্প বলতে বলতে। ওর বাবার সাথে ক্রিকেট খেলতে ভালো লাগে। আম্মু মাঝেমধ্যে একটু বকা দেয় দুষ্টুমি করলে, আবার এত্তগুলো চকলেট দেয়, ওর প্রিয় চকলেট। তখন কী মন খারাপ করে থাকা যায়!
দাদী কী সুন্দর গল্প শোনায়, ডালিমকুমারের গল্প, সে বড় হলে বাবাকে বলবে একটা পক্ষীরাজ ঘোড়া কিনে দিতে। সে পাতালপুরীর রাক্ষসকে মেরে রাজকন্যা কঙ্কাবতীকে উদ্ধার করতে যাবে!
দাদু আইনস্টাইন, সক্রেটিসের গল্প বলেন৷ সে তেমন বুঝতে পারে না, তবে আদর করে বলে যে শুনতে ভালো লাগে।
ওর নানি ছিল, উনি নাকি এখন আর নেই, ওকে আদর করত, তার জন্য মন খারাপ হয়।
“দর্পণ সোনা, আয় বাবা, তোকে একটা মজার গল্প শোনাই।”
দর্পণ ভারি বিজ্ঞের মতো ভেবে বলল, “শুনব না।”
রাফিদ ওকে কোলে নিয়ে বলল, “কেন?”
“আমি জানি, তুমি ওই পঁচা বিশ্রী ওষুধ খাওয়াবে।”
তপা হেসে ফেলল খিলখিল করে।
“ছেলে তোমাকে টেক্কা দিতে শিখেছে।”
“তুই বড় হয়ে কী হবি?”
“আমি সুপারম্যান হবো, আব্বুর মতো।”
“তাহলে তো এই ওষুধটা খেতে হবে। জ্বর এসেছে তো সোনা।”
“তাহলে ওষুধ খাব৷ পক্ষীরাজ ঘোড়া কিনে দিতে হবে কিন্তু।”
রাফিদ হেসে ওকে ওষুধ খাওয়ায়৷
তপার ভীষণ পরিপূর্ণ লাগে নিজেকে। এমন অপার্থিব সুখ ওর ভাগ্যে ছিল! এমন পৃথিবীপ্লাবী ভালোবাসা!
হৃদয়ের গহীন প্রকোষ্ঠে একেবারে নিভৃত গোপনে স্থায়ীভাবে যে দহন বাসা বেঁধেছিল, সেখানে এখন কেবলই ভালোবাসায় টইটম্বুর।
দর্পণকে ঘুম পাড়িয়ে ওরা বারান্দায় এসে বসেছে। আজ পূর্ণিমা। জোছনায় ভিজে রাফিদ গিটারে সুর তুলে গুনগুন করছে,
“তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই, সারা বছর ধরে মেঘ জমাই..
সারা বছর ধরে বৃষ্টি হোক
শুধু না ভেজে যেন তোমার চোখ
শ্রাবণে ভরে থাক ফাগুনটাই
তোমার প্রিয় ঋতু বর্ষা তাই
পুরনো ভেঙ্গে যাওয়া ছাতা সারাই
তোমার হাসি ফোটা রোদ্দুরে
মেঘ সফর হোক ঘুরে ঘুরে, ভিজুক অলিগলি রাজ সড়ক
শুধু না ভেজে যেন তোমার চোখ..
শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে যায় তপা, প্রাপ্তির আনন্দে ওর চোখে জল চলে আসে। এই মানুষটা ওকে এত ভালোবাসে কেন! এর উত্তর সে আর খুঁজতে চেষ্টা করে না। শুধু প্রাণভরে সে ভালোবাসা উপভোগ করে।
……..
(সমাপ্ত)