#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৮+৯)
নুসরাত জাহান লিজা
সোমার বিয়ের ডামাডোল শুরু হয়ে গেছে। আর দশদিন পরেই বিয়ে। সায়েদার চিন্তার শেষ নেই। মেয়ের জন্য গহনা এনেছেন আজ, তপাকে দেখাচ্ছিলেন।
“আমি পুরোনো দিনের মানুষ। তোমরা আজকালকার। দেখো তো মা, এগুলো সেকেলে লাগছে কি-না!”
তপা হাতে নিয়ে দেখল, জেনারেশনের পার্থক্য থাকলেও তার পছন্দ সেকেলে নয়। তপার মনে পড়ল, সোমার এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সে-ও একদিন গিয়েছে। সোমার অবশ্য নিজের পছন্দ করা বর। ওর এক্সাইটমেন্ট চোখে পড়ার মতো।
তপার ক্ষেত্রে এরেঞ্জ ম্যারেজ হলেও এই পরিস্থিতি বোধহয় সব মেয়েদের জন্যই এক। তখন তপার চোখে ছিল নানান রঙের স্বপ্নের বুনন। একটা সুখী সংসারের স্বপ্ন।
কবীরকে দেখে ওর ভালোই লেগেছিল। কথা বলে মনে হয়েছিল, লোকটার সাথে সারাজীবন কাটানো যাবে! মানুষ চিনতে এত বড় ভুল কী করে করেছিল তপা! আগাগোড়া শুভঙ্করের ফাঁকি ছিল।
মা তখন এভাবে শাড়ি, গহনা, মেয়ের অনাগত ভবিষ্যত, সব নিয়ে মেতে উঠেছিলেন। তিনিও কি তপার সাথে সাথে ওর সংসারের স্বপ্ন বুনেছিলেন! হয়তো তাই!
সোমাদের বাড়িটা বেশ পুরোনো, বাড়ির বাইরের দিকের কিছু কিছু জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। সেগুলো মেরামত করে রঙ করা হচ্ছে। বাড়িতে এখন থেকেই উৎসবের আমেজ।
***
তপা আজ আবার ফিল্ড ভিজিটে এসেছে। ওর জন্ম বেড়ে উঠা ঢাকাতেই। গ্রামের বাড়িতে মাঝেমধ্যে গিয়েছে আগে, তবে সেভাবে থাকা হয়নি। ওর বাবা চলে যাবার পর সেই সুতোটাও কেটে গেছে। ওর দুই চাচা থাকতেন, বড় চাচা মারা গেছেন। ছোট চাচার সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল বাবার সাথে।
গ্রাম বলতে তপার কাছে ওইটুকুই ছিল। এখন নতুন চোখে সে এখানে গ্রামকে আবিষ্কার করছে। সোঁদা মাটির গন্ধ, ফসলি জমি, হাওড়ের জল হাওয়া সবমিলিয়ে একটা প্রশান্তি আসে।
এখানে যেসব মহিলাদের বাস, তাদের নিজেদেরও আলাদা আলাদা গল্প আছে, কষ্ট আর সংগ্রামের মধ্যে বেঁচে থাকার গল্প। এখানকার সমস্যার মধ্যে একটা বড় সমস্যা হলো, অনেক জমিতে কোনো চাষ হয় না। জমির মালিকানা যার, সে হয়তো সপরিবারে লন্ডনে থাকেন। কয়েকজন বলল, ওই জমিগুলোতেও যদি লিজ নিয়ে বা কোনোভাবে চাষাবাদ করা যেত, তবে উৎপাদন বাড়ত।
এই অঞ্চলের দুস্থ মহিলাদের কিছু কিছু শিশুদের অবস্থা জীর্ণ। তবুও মুখে উদ্ভাসিত হাসি। কিছু শিশুরা স্কুলের পরে রোজগারের সন্ধানে বের হয়। পরিস্থিতি তাদের শৈশব কেড়ে নিয়ে মানসিকভাবে বড় করে দিয়েছে।
তপা তাদের অভাব, অভিযোগের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে। এনজিও থেকে দেয়া সুবিধা নিয়ে তাদের এই মাসে কত ইনকাম হলো তার তালিকা করল। আরও কী কী হলে তাদের জন্য ভালো হয় সেই বিষয়ে মতামত নিল।
ফিরে যাবার সময় হলে হাঁটছিল, রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া গাছের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হঠাৎ রাফিদের কথা মনে পড়ল। গতবার এখানেই দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল পাগলাটে যুবকের সাথে।
তবে পাগলাটে হলেও মনটা ভীষণ স্বচ্ছ। চেনা নেই, জানা নেই একেবারে অপরিচিত একজন মানুষের জন্য কেউ এতটা করে না আজকাল। দর্পণকে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই কতটা আন্তরিকতার চাদরে মুড়ে নিয়েছিল রাফিদ।
অবচেতনেই এক চিলতে হাসি ফুটল তপার ঠোঁটে।
দর্পণ এখন আগের চাইতে সুস্থ, এটা বড় একটা স্বস্তির খবর।
***
শিরীন রাফিদের ঘরে এসে বসে আছে। এই কয়েকদিনে তিনি সুস্থ হয়ে গেছেন৷ তবে নিয়মিত ইনসুলিন ব্যবহার করতে হচ্ছে। ডায়াবেটিস একুশ ছিল এখন সতেরোতে নেমেছে। খাবার-দাবার নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। রাফিদ খুব খেয়াল রাখছে।
“তোর ছবি এখনো আমাকে দেখালি না কিন্তু।”
রাফিদ উঠে বসল, একটা সিরিজ দেখছিল নেটফ্লিক্সে। মা’কে বিছানায় নিজের পাশে বসিয়ে সিলেটে তোলা ছবির ফোল্ডার খুলল।
ফুল, পাখি, প্রজাপতি, ঝর্ণা, হাওরের ছবি আসছিল, এক পর্যায়ে দর্পণের হাসিমুখ ভেসে উঠল।
শিরীন বললেন, “এটা কে? কী মিষ্টি দেখতে! মাশাল্লাহ!”
রাফিদের মুখেও অকৃত্রিম হাসি ফুটল, উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “এটা একটা রাজপুত্র। এত্ত মায়া লাগে। আমার সাথে ভীষণ ভাব হয়েছিল।”
“কোথায় পেয়েছিলি ওকে?” ছেলের ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাস দেখে প্রশ্ন করলেন তিনি।
রাফিদ সিলেটে তপার সাথে দেখা হওয়া, ওই বাড়িতে যাওয়ার ঘটনা সমস্তই খুলে বলল। মায়ের কাছে রাফিদ মনের আগল খুলতে কখনো দ্বিধা করে না। সে বন্ধু অন্তঃপ্রাণ মানুষ। তবে মা তার সবচাইতে কাছের বন্ধু। বাবা অনেক সিদ্ধান্ত ওর উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন, মা ঢাল হয়ে না দাঁড়ালে রাফিদ আজকের রাফিদ থাকতে পারত না। ন’টা-পাঁচটার কর্পোরেট মানুষ হয়ে যেত। জাগতিক খাওয়া-পরার চিন্তায় মত্ত থাকত হয়ত।
“ডিভোর্স? আহারে? ওর কোনো ছবি নেই?”
তিনি দর্পণের ছবিটা আবার দেখছেন, শিশুদের হাসিমুখ দেখলে পৃথিবী ভুলে যাওয়া যায়। বাচ্চাটার বাবার খারাপ লাগে না! মায়া হয় না! ভাবলেন তিনি।
রাফিদের ফোন হঠাৎ বেজে উঠল। সায়েদা আন্টির কল। কয়েকদিন থেকে খুব অভিমান ঝাড়ছেন তিনি। মা’য়ের অসুস্থতার জন্য বিয়ের আগেরদিন যাবে বলেছে। তবুও তিনি নাছোড়বান্দা।
“রাফিদ, আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। কমপক্ষে সাতদিন সময় নিয়ে তোমাদের আসতেই হবে। আপাকে বোঝাও।”
কিছু মানুষের বলায় এত আন্তরিকতা থাকে যে কথা ফেলা যায় না। সায়েদা আন্টি তেমন মানুষ।
“আচ্ছা, আন্টি। আমি বলব।”
“শুধু বলা না। আর তিন দিনের মধ্যে আমার বাড়িতে তোমরা আসবে। তোমার বাবা ব্যস্ত মানুষ জানি, তবুও তাকেও বলো।”
রাফিদ জানে ওর বাবা সেখানে যাবেন না। উনি কোনো ফ্যামিলি প্রোগ্রামে থাকেন না৷ উনার যাবতীয় আনাগোনা তার নিজস্ব বলয়ে।
“বাবা খুব ব্যস্ত। তবে মাকে নিয়ে আমি আসব আন্টি।”
“মিস হয় না যেন। আমি খুব কষ্ট পাব।”
রাফিদ মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “তোমার বাল্য সখী, তোমার বিরহে কাতর। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নাও। আমরা যাচ্ছি।”
শিরীন হেসে বলল, “ও একটুও বদলায়নি দেখছি। ভীষণ নাছোড়বান্দা।”
তার চোখ আরেকবার দর্পণের ছবিটার উপরে পড়ল। রাফিদ খেয়াল করে বলল,
“ওই মায়া রাজপুত্রকেও তুমি সামনা-সামনি দেখতে পাবে। ওর মাকেও।”
রাফিদ কিছুক্ষণ আগেও মোটামুটি অনড় ছিল, বিয়েতে একদিন আগে যাবে। এমন সহসা সিদ্ধান্ত বদলের পেছনে কি কেবলই সায়েদা আন্টির আন্তরিকতাই দায়ী নাকি অন্য এক টানে!
দর্পণটা যেন রাফিদকে বড্ড টানছে। ওর কানে বাজছে,
“দাফেত”
সেদিন জোছনা ধোয়া রাতের মায়ের কোলে থাকা দর্পণের খিলখিলিয়ে উঠা হাসি ভেসে উঠল রাফিদের মানসপটে। সাথে দর্পণের মায়ের দৃঢ়, কঠিন মুখটাও।
ওই বয়সী কোনো তরুণীর মুখে ওমন কাঠিন্য কোনোদিন দেখেনি রাফিদ।
………..
#নিভৃত_দহনে (পর্ব ৯)
নুসরাত জাহান লিজা
তপা অফিস শেষে ফেরার পথে লাইব্রেরিতে এসেছে, কিছু বই কেনা দরকার। ফেসবুকে এখন খুব একটা থাকা হয় না। মেসেঞ্জারে নানাজন না প্রশ্ন করে। বেশিরভাগই ব্যক্তিগত প্রশ্ন। অনেককেই ব্লক করে দিয়েছে বিরক্ত হয়ে। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু মানুষের আগ্রহের এমনিতেই শেষে নেই, তার উপর ওরটা তো বলতে গেলে ‘হট টপিক’। ডিভোর্স, আবার কবীরের মতো ধনাঢ্য ব্যক্তির সাথে। এসবে যে ভব্যতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, ভীষণ অশোভন এসব প্রশ্ন তা তারা বোঝে না নাকি এই পরিমিতিবোধ তাদের নেই সেটাই তপা বুঝতে পারে না।
অফিসের পরে দর্পণের সাথে সময় কেটে যায়। তবে ছুটির দিনে একটু একঘেয়েমি দূর করার জন্য বইয়ের পাতায় চোখ বুলানো যেতেই পারে! সুস্থ একটা বিনোদন হয় এতে। নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নেবার অবসরও পাওয়া যাবে।
এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘’অল কোয়াইট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ বইটায় চোখ পড়ল। একবার বাংলা অনুবাদ পড়েছিল, কিন্তু অনেক সংক্ষিপ্ত ছিল সেটা। আজ ইংরেজি বইটা পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। জীবনানন্দ আর রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই নিল দুটো। এরপর রিসিপশনে আসতেই একটা পরিচিত মুখের দেখা পেয়ে গেল।
কথা রাফিদই আগে বলল, “আপনি? এখানে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।”
“কেন? আমার কি লাইব্রেরিতে আসা বারণ নাকি?”
তপার পাল্টা প্রশ্নে খানিকটা অপ্রতিভ হলো রাফিদ, তবে হাস্যোজ্জ্বল মুখেই বলল, “তা হবে কেন? বাসায় শুনলাম আপনি অফিসে, দর্পণের সাথে দেখা হয়েছিল তখনই শুনেছি। তাই…”
তপা এবার কিছুটা অপ্রস্তুত হলো, আজকাল সে সহজ কথা কেন যেন খুব বেশি সহজভাবে নিতে পারে না। ওর ব্যক্তিগত ক্ষোভের দায় কেন একজন নিরীহ মানুষের উপরে চাপাবে! তাই এবার সামলে নিয়ে বলল, “কিছু মনে করবেন না। আপনি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ, আপনি?”
তপা মৃদু হেসে বলল, “ভালো। আপনি এখানে নিশ্চয়ই কাজে এসেছেন। আমি আসছি তাহলে।”
তপা বইয়ের দাম দিয়ে বেরিয়ে আসছিল, রাফিদ পেছন থেকে বলল, “একটু দাঁড়ান প্লিজ। আমিও বাসায় যাব। একই জায়গায় যাব, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, একসাথে যেতে পারি?”
তপা একটু ভেবে সম্মত হলো। রাফিদও একটা বই নিয়ে একসাথে বেরিয়ে এলো।
“বিয়ের ফটোগ্রাফি করতে তাহলে চলেই এলেন?”
“হ্যাঁ। কী আর করা। তাছাড়া এবার মা’কে সাথে নিয়ে এসেছি।”
“ও, শুনেছিলাম সায়েদা আন্টি আর আপনার মা’য়ের মধ্যে পুরোনো যোগসূত্র আছে। অত বিস্তারিত জানি না।”
হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে এগিয়ে যাচ্ছে দু’জন, এই সময়টা কিছুটা ভিড়ভাট্টা থাকে। অফিস ফেরত মানুষজন, কেনাকাটা করতে আসা মানুষজনের।
“হ্যাঁ। আমার নানা আর সোমার নানা ছিলেন ভাই। তাই আন্টির সাথে মা’র সম্পর্কটা কাজিনের চাইতে ফ্রেন্ডের মতো ছিল। আরেকটা বিষয় হলো আমার মা সায়েদা আন্টির প্রতি একটা কারণে ভীষণ কৃতজ্ঞ।”
তপা সৌজন্য রক্ষার্থে আগ বাড়িয়ে কারণ জিজ্ঞেস করল না, কিন্তু রাফিদ নিজে থেকেই বলল, “বাবা ওই গ্রামে গিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। তখনই মা’র সাথে পরিচয়, তারপর প্রণয়। এবার সেই প্রণয়কে পরিণয়ে রূপ দিতে আমার নানা ছিলেন প্রধান প্রতিবন্ধক। তো সেই সময় সায়েদা আন্টি বেশ বড় ভূমিকা পালন করে। উনি বয়সে এক বছরের ছোট হলেও তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। তিনি নানাকে রাজি করিছিলেন। আমার নানা এক কথার মানুষ ছিলেন, তাই রীতিমতো দুঃসাধ্য একটা কাজ তিনি করেছিলেন।”
“বাহ্! সেই সময়ের লাভ ম্যারেজ! নিশ্চয়ই আন্টিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।”
“তা তো অবশ্যই।”
“আঙ্কেল এসেছেন?”
“বাবা? না, উনি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ।”
রাফিদ যেন কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেল খানিকটা।
রাফিদ মনে মনে বলল, “ভবিষ্যতে অনেকটা রোবটের মতো হয়ে যাবে জানলে মা কী তখন তাকে বিয়ের জন্য এতটা ডেস্পারেট হতো? জিজ্ঞেস করতে হবে একদিন।”
***
দুই পুরোনো সখী বহুদিন পরে কাছাকাছি হয়ে পুরোনো স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেছেন। সেই শৈশব কৈশোরের হিরন্ময় স্মৃতি। হঠাৎ সায়েদা বললেন,
“আমার মেয়ে দুইটা মানুষটার জান ছিল। বড় মেয়ের বিয়েটা দিয়েছিল খুব ধূমধাম করে। এখন সে নেই। আমি জানি সে বেঁচে থাকলে সোমার বিয়েটাও সেভাবেই দিতে চাইত। আমারও বয়স হয়ে গেছে এখন। অত খেয়াল রাখতে পারি না। তবুও চেষ্টা করেছি, মানুষটার ইচ্ছে যতটুকু সম্ভব পূরণ করা যায়।”
শিরীন দেখলেন, তার চাইতে বয়সে ছোট হলেও, বয়সের ছাপ তার চাইতে বেশিই পড়েছে সায়েদার মধ্যে। স্বামীকে অসম্ভব ভালোবাসত সে, তাকে হারিয়ে জীবনের অনেক রঙ হারিয়ে ফেলেছে।
“মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে আমার শান্তি। এরপর আমার আর পিছুটান নেই।”
“তোর মেয়ে চলে গেলে একা কীভাবে থাকবি?”
সায়েদা স্মিত হেসে বললেন, “সেজন্যই তো বাড়িটা ভাড়া দিলাম। তপা মেয়েটা খুব ভালো। তবে বড় দুঃখী। ওর ছোট্ট ছেলেটা, কী যে আদুরে! আমার সময় কেটে যাবে।”
“হ্যাঁ, রাফিদের কাছে শুনেছি ওর কথা। ওর ছেলেটা এখন কই রে?”
“তুমি বসো। আমি মলিনাকে ডাকি।”
কিছুক্ষণ পরে মলিনা এলো দর্পণকে কোলে নিয়ে।
শিরীন হাত বাড়াতেই কোলে চলে এলো। তার নাকফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল। মুখে অবোধ্য শব্দ। অথচ মনে হচ্ছে ভাষাটুকু তিনি যেন বুঝতে পারছেন। রাফিদও ছোটবেলায় কোলে নিলে তার নাকফুল ছুঁয়ে দিত।
***
আজ শুক্রবার। অফিস নেই। তপা বসে বসে দর্পণকে খাওয়াচ্ছিল। দুপুর হয়ে গেছে। হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে সোমা এলো।
“তপা আপু, তোমার কাছে একটা ফেবার চাইতে এলাম।”
“কী ফেবার বিয়েত কণে?”
“আসলে অনিক আমার সাথে দেখা করার জন্য পাগলামি শুরু করেছে।”
“সে তো করবেই। হবু বউ বলে কথা।” মজা করে বলল তপা।
“আপু, প্লিজ মজা কোরো না তো। আজ বিকেলেই আসবে। চা বাগানের দিকে যেতে বলেছে। কিন্তু মা’কে সত্যিটা বলতে লজ্জা লাগছে। তুমি যদি তোমার কোনো দরকারের কথা বলে আমাকে নিয়ে বেরোনোর কথা বলতে খুব ভালো হতো।”
তপা দর্পণকে পানি খাইয়ে মুখ মুছে দিতে দিতে বলল, “কিন্তু যার তিন-চারদিন পরে বিয়ে, তাকে নিয়ে আমি আমার কাজে যাব, এই বিষয়টাও তো ভালো দেখাবে না।”
“তাও ঠিক। তাহলে কী করব?”
“তুমি বরং আন্টিকে বলেই দাও।”
“একদম না। মা হয়তো কিছু মনে করবে না। কিন্তু আমার বলতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। দুইদিন পরে বিয়ে, আর আজ সে হবু বরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে, বিষয়টা আমি সরাসরি বলতে পারব না।”
তপা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল, দর্পণকে নিয়ে খানিকক্ষণ বাগানে হাঁটবে ভাবছে। এরমধ্যে রাফিদকে দেখল ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে হেলে-দুলে ভেতরে ঢুকছিল। তপা দর্পণকে কোলে নিয়ে সোমাকে বলল,
“চলো রুম থেকে বের হই। একটা উপায় বোধহয় পেয়েছি।”
দরজা খুলে বেরিয়ে বাগানে নেমে এলো ওরা। রাফিদকে ডেকে তপা বলল, “রাফিদ, একটা কথা ছিল, আপনি কি ফ্রি আছেন আজ?”
“আমি? কোনো দরকার?”
“হ্যাঁ, আসলে দরকারটা সোমার।”
“বলো সোমা।”
“আসলে অনিক আসবে আজ।”
“অনিক, মানে তোমার…”
“হ্যাঁ।”
“এর সাথে আমি ফ্রি থাকার সম্পর্ক কী?”
এবার তপা বলল, “বিষয়টা আন্টিকে বলতে ও লজ্জা পাচ্ছে। অন্য কোনো একটা অজুহাত দিয়ে বের হতে চায়। তবে সেরকম পোক্ত অজুহাত খুঁজে পাচ্ছি না। তাই আপনার কাছে এলাম।”
“আপনার প্ল্যানটা বলবেন?”
“আপনি গিয়ে আন্টিকে বলবেন, আপনি সোমার বিয়ের ফটোগ্রাফির জন্য কিছু লোকেশন খুঁজবেন। এখন তো ওয়েডিং ভিডিও বিয়ের ভেন্যুর বাইরেই হয়। আপনি বলবেন একটু রেকি করে আসবেন। সোমার পছন্দেরও একটা বিষয় আছে, আপনার চেনাও নয় জায়গাগুলো। তাই ওকে সাথে নিয়ে যেতে চান। আমিও সাথে থাকব, এটা বললে আন্টির কাছে হয়তো বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে।”
“বুঝলাম। ঠিক আছে। আমি বলছি আন্টিকে। দর্পণ যাবে?”
“হ্যাঁ। আজ ছুটির দিন, ওরও ঘোরা হয় না কোথাও এমনিতে। আজ একটু ঘুরতে নিয়ে যাব।”
রাফিদ সহসা খুশি হয়ে গেল, “কখন যাচ্ছি?”
সোমা বলল, “এই তো, দুপুরে খাবার পরেই। আমরা একটু আগে আগে খেয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ব।”
সোমার তৈরি হতে বেশ খানিকটা সময় লাগল। একটা লাল রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। শাড়ি পরার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মা সন্দিহান হতে পারেন, তাই আর রিস্ক নিল না।
তপা বেশ সাদামাটা, পরিপাটি হয়ে বেরিয়েছে। দর্পণের কপালের উপরের দিকের এক কোণে কাজলের একটা টিপ দেয়া বড় করে। সবাই মিলে একটা সিএনজি নিয়ে উঠে পড়ল।
সিএনজি থেকে নেমে রাফিদ দর্পণকে কোলে নিল, “আমি কিন্তু ওকে কোলে নিয়ে থাকব বলে দিলাম।”
তপা হেসে বলল, “ঠিক আছে। তবে ডিস্টার্ব করলে আমাকে দিয়ে দেবেন।”
“কে ডিস্টার্ব করবে? দর্পণ? মোটেও না। আর করলেও ওইটুকু আমি সহ্য করে নিতে পারব।”
তপা হেসে ফেলল। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই অনিকের দেখা মিলল। বেশ মিশুক ছেলে। সবার সাথে পরিচিত হলো। বেশ বিনয়ী বলে মনে হলো।
“আপনারা আমাদের জন্য এত কষ্ট করে এসেছেন, আমার এখন কিছুটা লজ্জাই লাগছে।”
এরমধ্যে আড়চোখে কয়েকবার সোমার দিকে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ফেলেছে বেচারা।
ওদের সময় দেবার জন্যই রাফিদ তপাকে বলল, “চলুন, আমরা বরং ওইদিকটায় যাই। দর্পণ সোনাটা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পরে বিরক্ত হয়ে যাবে।”
তপা বুঝল, ওদের আলাদা করে সময় কাটাবার সুযোগ দেবার জন্যই এই আমন্ত্রণ। তাই সে পিছু নিল।
দর্পণ বেশ মজা পেয়েছে আজ। ওরা হাঁটছে চা বাগানের পাশের সরু রাস্তা ধরে। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি।
দর্পণ প্রথমদিন রাফিদকে চিনতে পারেনি বলে কী ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল ওর। সে জানে অতটুকু বয়সে মস্তিষ্ক স্মৃতি খুব বেশি সময়ের জন্য ধরে রাখতে সক্ষম হয় না। তবুও কষ্ট হয়েছিল। তবে সে-ও নাছোড়বান্দার মতো লেগে ছিল। এখন বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। একসাথে খেলাধূলাও চলে বেশ।
রাফিদ তপাকে একবার দেখল, আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ মনে হলেও তপার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে, যা তাকে খুব সহজেই অসাধারণ করে দেয়। কিন্তু সেটা কী তা বুঝতে পারছে না।
তবে এই নির্জন রাস্তায় এভাবে এই দুই সঙ্গীর সাথে হাঁটতে রাফিদের ভীষণ ভালো লাগছে। আচমকা একটা খুব পুরোনোদিনের বিখ্যাত লাইন ওর মাথায় এসে হানা দিয়ে গেল,
“এই পথ যদি না শেষ হয়…”
নিজের ভাবনায় সহসা ভীষণ চমকে উঠল রাফিদ। দর্পণের খিলখিলিয়ে উঠা হাসি ওর কানে প্রতিধ্বনি তুলছে।
…….
(ক্রমশ)