নির্বাসিত ফুল পর্ব-০৪

0
12

#নির্বাসিত_ফুল
#কলমে_তানজিলা

৪.

আমার ভেতরটা অনবরত কাঁপছে। মাথাটা ঘুরে উঠছে। হাঁটতে পারছিলাম না। কোনরকম রাস্তার ধারে ব্রেঞ্চে বসলাম। কাঁদতে লাগলাম। একটু শব্দ হতেই পাশের মানুষগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। আমি মুখ চেপে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করলাম। শরীরে কাঁপুনি এসেছে। বুকটা ধড়ফড় করছে। অস্থির লাগছে।
আকাশের দিকে তাকালাম। ক্রন্দনরত গলায় বললাম, ‘আল্লাহ, আমাকে সাহায্য করুন। আপনি ছাড়া কেউ নেই। আল্লাহ্, আল্লাহ..’
ডেকে উঠলাম তাকে। আমার কণ্ঠস্বর কাঁপছে। একটা মহিলা পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, আমার পাশে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে? আমি নিজেকে ধাতস্থ করে জানালাম, আমার চাকরি হয়নি। আমার কেউ নেই। তার করুণা হলো বোধহয়। মাথায় হাত বুলালেন। মোলায়েম গলায় বললেন, ‘এতটুকুতে ভেঙে পড়িওনা মা। চেষ্টা চালিয়ে যাও, বাস্তবতা অনেক কঠিন। আমার মেয়েও একসময় তোমার মত ছিলাম, ওর বাবা নেই। কত রাত যে নির্ঘুম, কেঁদে গেছে। অবশেষে আল্লাহ সফলতা দিয়েছেন। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়, দোয়া করো। আল্লাহর ইবাদত করে সাহায্য চাও। তিনি তোমাকে হতাশ করবেন না। ভেঙে পড়ও না।’

তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। আমায় অনুপ্রাণিত করল। আরও কিছুক্ষণ সময় থেকে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। বুঝলাম, এতটুকুতে ভাঙা যাবে না। জীবনটা আসলেই কঠিন। বাইর থেকে যতটা সুন্দর মনে হয়, ততটা নয়। কষ্টের পরেই সুখ আসবে। নিজেকে সামলে ফিরলাম বাড়িতে। সেদিন ফিরতে দেরী হলো আমার। বাসায় আন্টি আমাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেন। তার দৃষ্টিতে বেশ ভালো মনে হলো না আমার। কাপড় পাল্টে ঘুমিয়ে গেলাম। রাতে কিছু খেলাম না। ঘুমটাও ভীষণ বাজে ছিল। এত চেষ্টা করেও পারছিলাম না। আমার অবাধ্য চোখদুটো অনবরত অশ্রু ফেলছিল। মেয়ে দুটো হয়তো বুঝেছিল, আমি কেঁদেছি। এভাবেই পরেরদিন বেরিয়ে পড়লাম নতুন কিছুর খোঁজে। সকালে উঠতে দেরী হলো একটু। বেরোনোর আগে দেখলাম, মেয়ে দুটো আন্টিটার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমাকে আড়চোখে দেখলেন তিনি।

আমি ক্ষীণ কথা বলে গেলাম। সারাদিনের ছোটাছুটিতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। কিছু পেলাম না। নিউজপেপারগুলোতে চোখ বুলালাম। চাকরির অভাব নেই, তবে সেগুলো আমার ক্ষেত্রে অসম্ভব। এভাবেই দিন ফুরাতে লাগল আমার। তারপর একদিন, আন্টি জানালেন আমাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। কারণ হিসেবে দেখালেন, ওনার ছেলে আসবে, একারণে। যদিও সেটা মিথ্যে ছিল। বাকিদুটো মেয়েকে দেখে মনে হলো না, তাদের এমন কিছু বলা হয়েছে। মাসের চৌদ্দ তারিখ চলে আজ। আমি সময় চাইলাম, মাসের শেষটুকু অন্তত দিক। তিনি মানলেন, তবে ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘যত তাড়াতাড়ি পারো যেও।’

মাথার উপর আরেকটা চাপ পড়ল। একদিকে টাকা কম, চাকরি – টিউশনি কিছুই নেই, এখন থাকার জায়গাটাও যাচ্ছে। আমি বাড়ি খুজতে লাগলাম। এবার ঠিক করেছি, আলাদা থাকব। কোন মেসে, হোস্টেলে থাকব না। অন্তত শান্তিতে থাকতে পারব। প্রতিদিনে জবাবদিহি করতে হবেনা। কেউ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবে না। কিন্তু সহজে পেলাম না বাড়ি। একা মেয়েকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে না। অবশেষে পেলাম একটা, আমার মন মতোই। দুটো রুম, ছোট বারান্দা, বাথরুম, কিচেন। কিন্তু ভাড়া বেশি সাড়ে পাঁচহাজার! এত টাকা প্রতিমাসে কীভাবে দেব? হাতে আর টাকাই আছে আট নয় হাজারের মত। ভাড়া এডভ্যান্স দিতে হবে। দিয়ে দিলাম। মায়ের গয়নাগুলো বের করলাম। এটাকে আমি বিক্রি করতে চাইনি, মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা আর হলো কই? শেষমেষ বিক্রি করতে হলো। সেদিনও আমি কাদলাম। তারপর নতুন বাড়িতে দ্রুত শিফট হলাম। জিনিসপত্র স্থানান্তর করতে আরও টাকা গেল। এতটা অসহায়ত্ব বোধ কখনও করিনি। সেদিন এত কেঁদেছিলাম যে গায়ে জ্বর এল। পাশে কেউ নেই। জ্বরে একাই কাতরাত ছিলাম আমি। ছটফট করছিলাম। বমি অনবরত। খিদেতে পেট মোচড় দিচ্ছে। কেউ নেই মাথায় জলপট্টি দেয়ার, একটু খাবার বেড়ে এনে দেয়ার। মাথা ধরে উঠতে পারলাম না আমি। খাওয়া হলো না কিছু রাতে। ছটফট করছিলাম খালি বাড়িতে। আমার আর্তনাদগুলো বারবার প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। কান্না থামাতে পারলাম না। মাথা ব্যাথা উঠেছে। মাকে ডেকে কেঁদে উঠলাম, ‘মা, ও মা.. তুই কেন আমাকে ছেড়ে গেলি? মা, মারে ফিরে আয় মা। ও মা..

কোন সাড়াশব্দ এল না। শুধু আমার আওয়াজে প্রতিধ্বনি হতে লাগাল। প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। জ্বর হলে আমার নাজেহাল অবস্থা হয়ে যায়। মনে পড়ল অতীত। মা সারারাত পাশে বসে পট্টি দিত। মাথায় হাত বুলাত, দোয়াদুরুদ পড়ত। উঠতে পারতাম না বলে, ঘরের ভেতরে মা পানি এনে দিয়ে দিতো। যা খাবো তাই, এনে দিত। খেতে পারতাম না, তবুও খাওয়াতো জোর করে। ঔষুধ খাইয়ে দিত। বমি করতাম, সেসব পরিষ্কার করত। আজকে আমার পাশে কেউ নেই। বাড়িতে ঔষুধটুকুও নেই। শুকনো খাবারও নেই, রান্না কে করবে? পেটে মোচড় দিতেই বিছানা থেকে মুখটা নামিয়ে গলগল করে ঘরের মেঝেতেই বমি করলাম। মুখটুকু ধোয়ার জন্য পানিটুকুও কাছেও নেই। নিজেকে অসহায় লাগল। আর্ত করে উঠলাম, ‘মা, ও মা আয় না মা? ও মা..’
এল না কেউ। এভাবেই শুয়ে পড়লাম বিছানায়। কারেন্ট গেল অন্ধকার। মশা ভোভো করছে। শরীরটা পুরো ব্যথা করছে। ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু যন্ত্রণায় ঘুম আসছে না। আমি কী মারা যাব? হয়তোবা যাব। মনে হচ্ছে, আমার জীবন এইটুকু পর্যন্ত ছিল। আমি কালেমা পড়তে লাগলাম, মনেহয় মৃত্যু আমার দুয়ারে এসে গেছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

মধ্যরাতে ঘুম আলগা হয়ে এল। অনুভব করলাম, কেউ মাথায় হাত বুলাচ্ছে। তাকানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু শক্তি পেলাম না। বিড়বিড় করলাম, ‘মা, মা..
ভালো লাগছিল। মাথায় যেন বিলি কেটে দিচ্ছিল। শান্তি অনুভব হচ্ছিল। আমি তলিয়ে গেলাম ঘুমে।
মাথাটা ভীষণ ভারী লাগছে। চোখদুটো এমন ভাবে লেগে আছে যেন সুপার গ্লু লেগেছে কেউ। খিদেয় পেট মোচড় দিচ্ছে। ঠাণ্ডা লাগছে ভীষণ। ভার মাথায় উঠলাম। নাকে ভেসে এল বমির দুর্গন্ধ। মেঝেতে পা পড়তেই লেগে গেল। তেলাপোকা বিভিন্ন রকমের পোকামাকড় পড়েছে তাতে। আমার গা গুলিয়ে এল। আমি ঢুলতে ঢুলতে বাথরুমে গেলাম কোনরকম। গিয়েই মাথাটা ট্যাপের নিচে রাখলাম। ঠাণ্ডা পানিতে মাথাটা ঠান্ডা হয়ে এল। ব্যথায় একাকার। ভার টা একটু হলেও কমলো যেন। খানিকটা সময় ধরে পানি দিলাম। এরপর এসে চুল মুছলাম। খিমারটা গায়ে মাথায় বেরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঔষুধ আনতে। বাইরে বেরিয়েই একটা রিক্সা পেলাম। মাত্র পাঁচ মিনিটের রাস্তা কিন্তু হাঁটার শক্তিটুকু নেই আমার। রিক্সাওয়ালাকে বললাম ফার্মেসিতে নামিয়ে দিয়ে। লোকটা বোধহয় বুঝল আমি অসুস্থ। তাই আমাকে বলল, ‘আপা তোমরা বইসো। কী কী নেবেন মোক কন।’
আমি তাকে মাথাব্যথা, জ্বরের ঔষধ আনতে বললাম। সঙ্গে রুটি, কলা শুকনো নাস্তা। লোকটা এনে দিল। তিনিই আবারও আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলাম। দুর্বল শরীরে একটু ভালো লাগল। তাকে পঞ্চাশ টাকা দিলাম। অনেক খুশি হলেন তিনি। আমি ঘরে ঢুকেই আগে পাউরুটি খেলাম। এমন ভাবে খাচ্ছিলাম, কেউ দেখলে নিশ্চয়ই বলতো জংলী খাদক। খাওয়া হতে না হতে আবারও একি জায়গায় বমি করলাম। আমার এটাই সমস্যা। আফসোসের বিষয় বমির ঔষুধ নেয়া হয়নি। সেসময়ে মনে ছিল না। আমি ঔষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লাম। বিছানার চাদরটা উঠিয়ে গায়ে দিলাম, ঠান্ডা লাগছে। চুলগুলো ভেজা। আস্তে আস্তে আরাম লাগছিল, মাথা ব্যথার ঔষুধ খেয়ে। ঘুমটাও ভালোই হলো।

আমার ঘুম যখন ভাঙল, তখন আজান দিচ্ছে। আমি ভাবলাম হয়তোবা যোহরের কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম আছরের আজান। ঘরে গন্ধে ভরে গেছে। মাছিগুলো ভনভন করছে। আমি উঠলাম। শরীরে ব্যথা, জ্বর এখনও আছে। তবে মাথা ব্যথাটা কমেছে। এভাবে থাকা যাবেনা। তাই উঠলাম। উঠে মেঝেটা পরিষ্কার করলাম। পরিষ্কার করতে গিয়ে আমার আবারও বমি এল। দৌড়ে বাথরুমে গেলাম। বমি করতেও এত কষ্ট হচ্ছিল। পেটটা নাড়ি যেন ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার। আগে বমি হলে মা দৌড়ে এসে পেট চেপে ধরত আমার, বমি যতক্ষণ করতাম পাশে থাকত। একটুকু ঘৃণা থাকত না তাতে। কান্না পেল আমার। শরীর সামলে ঘরে গেলাম। পরিষ্কার করলাম। এভাবে নোংরায় থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ব। অনুভব করলাম, শরীরটা যেন আরও গরম হচ্ছে। দুর্বলতা বাড়ছে। তবুও উঠে চাল ধুয়ে ভাত বসালাম গ্যাসে। দুটো আলু দিলাম তাতে। কিন্তু গ্যাসে জ্বালাতে গিয়ে খেয়াল করলাম, গ্যাস আসেনি। আমি পারছিলাম না। মাথাটা যেন হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠল। দৌড়ে ঘরে যেতে গিয়ে মাথা ঘুরে উল্টে পড়ি ফ্লোরে। ওখানেই কয়েকমিনিট পরে রইলাম। শরীর উঠছে না, টেনে নিয়ে বিছানায় শুলাম। ব্যস! একটা বালতি এনে রেখেছিলাম তখন। বমি হলে যাতে ঘর নোংরা না হয়। একাকী জীবন, কত কষ্টের। উপলব্ধি করলাম—এমন কত জ্বরে মা উঠে রান্না করে খাইয়েছিল। আসলেই জীবন বড় কঠিন। আপনাআপনি চোখ থেকে পানি পড়তে লাগল। আমি কষ্ট যে সইতে পারছি না। আল্লাহ্ আমাকে ধৈর্য দাও, ধৈর্য দাও।

এভাবে কাতরাতে কাতরাতে কেটে গেল দুটোদিন। একটু সুস্থ হলাম। জ্বরটা কমেছে। দুদিন বাদে ফোনটা হাতে নিলাম। দেখলাম, আপার অনেকগুলো মিস কলড হয়ে আছে। আমি আপাকে কল করেই তৎক্ষণাৎ রিসিভ হলো। বিচলিত গলায় বলল, ‘হ্যালো, সৌমি! ময়না তুই কোথায়? ঠিক আছিস?’

আমি ধীর গলায় বললাম, ‘আমি ঠিকাছি আপা।’
আপা আবারও বলল, ‘এতদিন কল ধরিস নি কেন? জানিস কত টেনশনে ছিলাম? তোর কণ্ঠ এমন শোনা যাচ্ছে কেন?’
আমি গলা খাকারি দিয়ে বললাম, ‘বাসা চেঞ্জ করেছি, তাই কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সারাদিনে কাজে একটু দুর্বল হয়ে পড়েছি।’
আপার বিস্মিত কণ্ঠ, ‘চেঞ্জ করেছিস? এত তাড়াতাড়ি কেন?’
‘এমনই। ওখানে কমফোর্টেবল লাগছিল না তাই।’
‘ওহ, সামনের সপ্তাহে যাব।’
‘আচ্ছা, আসিস আপা।’
আপা কল কাটার আগে বলল, ‘সৌমি, ময়না কোন সমস্যা হলে আপাকে জানাস, আচ্ছা?’
আমি ‘ঠিকাছে’ বলে কল কাটলাম। সৌমি আমার আরেক নাম। মা আমাকে সুবাসিনী বলে ডাকতেন। মা মরার পর থেকে আমার এ নামটা কেন জানি ভালো লাগে বেশি।

সময় গড়াল। আপা দুলাভাই আসলো একদিন। আপা আমাকে দেখে খুশি হলো। একটা দিন থাকল তারা এরপর চলে গেল। আপাকে আমি আমার বর্তমান জীবনের কিছুই বললাম না। দুটো বাচ্চা নিয়ে ও এমনিতেই টানাপোড়নে, বাড়তি টেনশন দিয়ে ওর জীবনটা নষ্ট করতে চাইনা। নিজের জীবন নিজেকেই গড়তে হবে আমার।
কথায় আছে বিপদ যখন আসে, তখন সব বিপদই একসাথে আসে। আমি কোন টিউশনি পেলাম না। আর না কোন। প্রতিদিন নিউজ পেপার চেক করি, বিভিন্ন চাকরির খবর কিন্তু সেসব আমার পক্ষেসম্ভব নয়। দিন যাচ্ছিল, টাকাও সীমিত। নিজেকেও নির্দিষ্ট রুটিনে চলানোর চেষ্টা করলাম। মাঝেমধ্যে না খেয়েও কাটালাম। পরে ভাবলাম, না খেয়ে থাকার থেকে রোজা রাখি। সপ্তাহে তিনটে দিনই আমি রোজা রাখতে শুরু করলাম। সোম, বৃহস্পতিবার রোজা এমনিতেও সুন্নত। এভাবে চলতে ভালোই হলো। টাকা, খাবার বাঁচল, আবার আমার ইবাদতও হয়ে গেল। রাতে ঘুম হতো না আমার। এদিক, ওদিক ঘুরে আমার আড়াইটে বাজত। অথচ আমি ঘুমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। কিন্তু ঘুমটাও বোধহয় আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। তাই ঘুম যেহেতু ধরে না, তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে শুরু করলাম। তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমেই আল্লাহর সবচে কাছে পাওয়া যায়। মন ভরে কাদলাম। আল্লাহ্ আমাকে শান্তি দাও!

এইভাবে কেটে যায় কয়েকমাস। হঠাৎ একদিন চোখ পড়ল ‘শিক্ষক নিবন্ধন নিয়োগ’ এর বিজ্ঞপ্তি। চাকরির এসব সম্পর্কে ধারণা কম ছিল। জানতাম না আমি। ভেবেছিলাম শিক্ষক নিয়োগের চাকরি বছরে একবার হয়। কিন্তু পরে আমার মনে আশা জাগল। জানতে পারলাম, এটা বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ। যাইহোক সরকারি, বেসরকারি—আমাকে পেতেই হবে। আবারও আপ্রাণ চেষ্টা চালালাম। এইবার তো প্রাইভেট, কোচিং কিছুই নেই। দিনরাত, খাওয়া দাওয়া সেরে এক করে পড়লাম। মনে মনে বোঝালাম, এটাই শেষ চান্স! আমাকে পেতেই হবে। নাহলে আমি হার মেনে নেব।
পরীক্ষা দিলাম, দিনরাত দোয়া করলাম। মনটা সারাক্ষণ অস্থির, বিচলিত থাকছিল। চাকরিটা যদি না পাই? আমার অস্থিরতায় ফলাফলের সময় ঘনিয়ে এল। আমি আগেরবার ভাঙা হৃদয়টা জোড়া লাগেছিলাম আশায়। এবার যেন না ভাঙে। কিন্তু ভাগ্য বোধ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল আমার থেকে, এইবারও আমি পারলাম না। আবারও হেরে গেলাম। এই চাকরিটাও হলো না। আমি বুঝে গেলাম, আমি নিঃশেষ। আসলেই আমাদের মতো মেয়েদের জন্য ডির্ভোস নয়। দুদিন বাদে বোধহয় আমাকেও রাস্তায় নামতে হবে।
হতাশা মনটাও কাঁদতে ভুলে গেল। কেমন নির্জীব। আমি ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। মনটাতে এতটা আঘাত লাগল, কান্নাও কোথাও আটকে গেছে আমার। বহুদিন বাদে সেদিন আয়নায় তাকালাম, শীঘ্রই আমার পতন হবে। ওইদিন মানুষগুলো বোধহয় ঠিকই বলেছিল, যতটা সহজ ভেবেছিলাম, পথ ততটাই কঠিন। আয়নায় নিজের জীর্ণ শীর্ণ শরীরটাকে দেখলাম, শুকিয়েছে অনেক। নিজের জীবনকে অভিযোগ করলাম—

‘প্রিয় জীবন,

তুমি কেন এত কঠোর আমার প্রতি?
প্রতিদিন ভেবেছি একটু শান্তি পাব, অন্তত নিঃশ্বাসটা স্বস্তিতে ফেলতে পারব। কিন্তু তুমি কি একদিনও সে সুযোগ দিচ্ছ না আমাকে? শৈশব কেটেছে ভয় আতঙ্কের ভেতর, যৌবন এল বোঝা নিয়ে। মানুষ পেয়েছি, কিন্তু মনের মানুষ পেলাম না। যারা ছিল আমার ভরসা স্থান, তারা সময়ে সময়ে দূরে ঠেলে দিয়েছে।

প্রতিদিন সকাল বেলায় যখন অন্যরা আশার আলো দেখে, আমি দেখি শুধু আরেকটা বোঝা নামছে মাথার ওপরে। টাকার জন্য, সম্পর্কের জন্য, সুস্থতার জন্য, একটুখানি ভালোবাসার জন্য কত কিছু সহ্য করছি। হাজারো স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু কোনোটাই পূর্ণ হচ্ছে না। বরং স্বপ্ন দেখাটাই এখন অপরাধ মনে হয়, কারণ শেষমেশ ভাঙনই নিয়তি হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমার।

জীবন,
তুমি কি কখনও আমার চোখের জলের হিসাব রাখো? রাতের অন্ধকারে যখন একা একা কাঁদি, তোমার কি একবারও মায়া হয় না? মনে হয় যেন আমি শুধু কষ্ট সহ্য করার জন্যই জন্মেছি। সুখ আমার ভাগ্যে নেই—এই কথাটাই প্রতিদিন তোমার কাছে নতুন করে প্রমাণ পাই।

তবুও তোমাকে ছেড়ে যেতেও পারি না। কারণ, যতই অভিশাপ দিই, যতই অভিমান করি, তুমি-ই আমার সবকিছু। কিন্তু একটা প্রশ্ন রেখে যাচ্ছি—
তুমি কেন আমাকে এতটা কঠোর পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করালে? আমি কি সত্যিই সুখের যোগ্য নই? আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে.. আমাকে সুখ দাও, সুখ দাও জীবন। ’

সে রাতে আমি ভেঙে পড়লাম। বাঁধ ভাঙা কান্না। এত চিন্তা, অস্থিরতায় আবারও জ্বর এল। অতীত যেন ফিরে এল। অবস্থা আগেরবারের থেকেও খারাপ হলো। আমি নির্জীব হয়ে একা, একা পড়ে রইলাম অন্ধকারের কোঠায়।

চলবে