নির্বাসিত ফুল পর্ব-০৬

0
12

#নির্বাসিত_ফুল
#কলমে_তানজিলা

৬.

সময়ও ভীষণ পল্টিবাজ। নাহলে সুখের সময়গুলো স্বল্প এবং দুঃখের সময়গুলো দীর্ঘ হয় কেন? কিভাবে চোখের পলকেই কেটে যায় সুখের সময়গুলো? থেমে রাখার কোন উপায় নেই? এইতো, সেদিনই না আমি চাকরিতে জয়েন করলাম, অথচ দেড় বছর হয়ে গেল। দিনগুলো এত তাড়াতাড়ি কাটল! আমি জয়েন করেছি দিনাজপুরের খোলাহাটিতে নামের জায়গায় অবস্থিত বীর উত্তম শহীদ মাহবুব সেনানিবাসে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাই স্কুলে। পুরোপুরি শহুরে এলাকা নয়। ক্যান্টনমেন্টটা থাকার দরুন বর্তমানে উন্নতি হচ্ছে। আমি বাইরে একটা ফ্ল্যাটে থাকি।

সেদিন রেজাল্ট দেখে আমি থমকে গেছিলাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। টের পেলাম অনবরত চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে। আমি ওখানেই ধপ করে বসি। অস্ফুট কণ্ঠে ডেকে উঠি, ‘আল্লাহ, আল্লাহ!
শরীর কাপছিল। তখনই আবার আপার কল আসলো। আমি রিসিভ করতেই আপা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘সৌমি, রেজাল্ট দেখলি?’
আমি কিছু বলতে পারলাম না। সশব্দে কেঁদে ফেললাম। আপা অস্থির হয়ে আমাকে ডাকল কয়েকবার। আমি কেঁদেই গেলাম। আপা আমাকে সান্ত্বনা দিল, ‘কাদিস না, মানুষ ব্যর্থ হয়েই তো সফলতা পায়। মানুষ ছয় সাতবার পরীক্ষা দিয়েও চেষ্টা করছেই যাচ্ছে। তুই এতটুকুতেই হতাশ হচ্ছিস কেন? দেখিস আল্লাহ তোকে নিরাশ করবেন না।’

আমি ক্রন্দনরত গলায় বলে উঠলাম, ‘আপা নিরাশ করেনি, আমি পেরেছি আপা, আমি পেরেছি।’
আপা খুশিতে চিৎকার করে উঠল। এতটা খুশি বলার বাইরে। মনে হলো, আমার থেকে আমার আপার খুশীই বেশি। তারপর সময় কেটে যাচ্ছিল, ট্রেনিং শেষে আমাকে পোস্টিং দেয়া হয় দিনাজপুরের ক্যান্টনমেন্টে। যদিও এটা দিনাজপুরে, তবে রংপুর থেকে বেশি কাছে, দিনাজপুর থেকে দূরে। এদিকে শোরুমের আপুকে বলে আমি জব ছাড়লাম, আপুকেও বেশ আনন্দিত হয়েছিলেন। আমি এখানকার বাড়িটা ছেড়ে গেলাম, আমার চাকরির জায়গায়। প্রাথমিক অবস্থায় সাড়ে বারো হাজার টাকা বেতন। আমাকে ক্লাস শিশু, অন, থ্রির বাচ্চাদের ক্লাস দেয়া হলো। এখানে এসে আমি একটা বিষয়ে ভীষণ আশ্চর্য হলাম, এখানের টিচারদের রেশন দেয়া হয়। চাল, চিনি, আটা, তেল, ডাল পাবো। বাচ্চার উপর নির্ভর করে দেয়া হয়, আমার তো নেই। নিজের জন্য যতটুকু পেতাম ততটুকুই আমার লাগতো না। রেশনের আংশিক বিক্রি করতাম। আগে রেশন দেয়া হতো না, বিশ সাল থেকে এটা শুরু হয়েছে, শুধুমাত্র ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অধীনস্থ স্কুল কলেজের টিচারদের জন্য । অথচ আমি জানতাম না। খরচ অনেকাংশই কমে গেছে আমার। রেশন থেকেও টাকা পাচ্ছি, চাকরির টাকা, ফ্রিল্যান্সিংও ছাড়ি নি। মাঝেমধ্যে পেইন্টিং করতাম, ইচ্ছে আছে পেইন্টিং এর বড় বিজনেস দাড় করানোর।

বর্তমান জীবনে আমি বেশ ভালো আছে। নিজের ইচ্ছেমত খেতে পারছি, যেটা যখন প্রয়োজন পাচ্ছি।প্রতিমাসে বেতনের কয়েকহাজার টাকা আমি আম্মুর জন্য সদকায়ে জারিয়া দেই। আমার জীবনে সবচে অনুপ্রেরণা দিয়েছে আমার মা। ছোট থেকে। তার বলা কথাগুলো সবসময় মনে গেঁথে ছিল। ভাবছিলাম, আজকে যদি মা বেঁচে থাকত তার সব ইচ্ছে পূরণ করার চেষ্টা করতাম। মা ভীষণ শৌখিন ছিলেন, কিন্তু কখনোই সেসব পাননি। ইচ্ছে পূরণ হয়নি। জীবিত থাকতে নাহয় কিছু করতে পারিনি, অন্তত মৃত্যুর পর কিছু করি। সন্তানেরা ভালো কাজ করলে নাকি আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দেন। আমার জানতে ইচ্ছে হয়, আমার মাকেও কী জানানো হয়েছে?

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। উঠে দাড়ালাম। নিজেকে দেখলাম আয়নাতে। একটুখানি হেসে উঠলাম। খুব বেশি আনন্দিত হইনা। আমি শুধু মনে করি আমার ডিভোর্সের প্রথম বছরটা কেমন গেছিল! কত কষ্ট, দুঃখ, ব্যর্থতার, অসুস্থতার মাঝে ছিলাম। বিভীষিকা দিনগুলো! মনে পড়লেই ভেতরটা যেন কেঁপে উঠে। বারবার ব্যর্থ হয়ে ভেঙে ফেলে, আবারও আমাকে উঠে দাঁড়ানোর সক্ষমতা দিয়েছেন আল্লাহ। সেই বিষণ্নদিনগুলো থেকে মুক্তি দিয়েছেন আমাকে। আয়নাতে তাকাতেই আমার প্রতিবিম্বটাই যেন আমাকে বলে উঠল, ‘কিরে সুবাসিনী, এখন হাসছিস কেন? খুব তো হতাশ হতি। এখন দেখছিস সুবাসিনী? আমাকে দোষারোপ করতে ছাড়তি না! আমি বলতাম না, ধৈর্য রাখ! চেষ্টা কর। নিষ্পাপ মনে আল্লাহ্কে ডাকলে তিনি কখনও নিরাশ করেনা। দেখলি তো?’
আমি হাসলাম। নিজেকে কতবার বকাঝকা করেছিলাম। মানুষের খোচাখুচিতে মাঝেমধ্যে ভাবতাম দোষটা আমারই। দুঃখের সময়ে হতাশ পড়তাম। আবার নিজেই নিজেকে আশ্বাস দিতাম, সব ঠিক হয়ে যাবে, আল্লাহ নিরাশ করবেন না। তাই যেন হয়েছে। মারইয়াম সূরার একটা আয়াতের কথা মনে পড়ল, ‘হে আমার রব, আমিতো কখনো তোমাকে ডেকে ব্যর্থ হইনি।’ হ্যাঁ, আমি নিরাশ হইনি। যা চেয়েছি তার থেকে, আমাকে অনেক বেশি দিয়েছেন তিনি। শুদ্ধ মনে ডাকলে আপ্রাণ চেষ্টার ফল তিনি দেরিতে হলেও দেন। আমিও পাচ্ছি।

তবে এখন আমার ইচ্ছে, আমার মতন মেয়েগুলোর জন্য কিছু করার। আমার তো পড়াশোনাটা জানা ছিল, আপা ছিল বলে পারলাম। সবাই তা পারে? হাজারও অসহায় মেয়েরা আছে, যাদের যাওয়ার জায়গা নেই। আমাদের দেশে হাজারও বৃদ্ধাশ্রম থাকলেও অসহায় মেয়েদের জন্য কোন শ্রম নেই। এমন নিরুপায় আমিও ছিলাম। তাই ইচ্ছে তাদের জন্য কিছু করা। অসহায় মেয়ে, ডিভোর্সী, বিধবা। শুধুমাত্র তাদের জন্য বললে ভুল হবে, আমারও স্বার্থ থাকবে এতে। কী করা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমার একজন কলিগের সাথে কথা বললাম। প্রায় আমার সমবয়সী। শিখা নাম। তার সঙ্গে আলোচনা করতে তিনি আমাকে একটা মেয়ের কথা বললেন, বিধবা, একটা বাচ্চা আছে, ভিক্ষা করে খায়। বেশি বয়স নয়। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম।

মেয়েটার নামটা ভীষণ সুন্দর, আলো। অথচ তার জীবনে অন্ধকারে ভরা। মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, মেয়েটা নিম্ন মধ্যবিত্তের। ক্লাস টেন অব্দি পড়েছে। বাবা-মা মারা গেছে। ভাইয়েরা জমির ভাগ দেয়নি। অন্যদিকে শ্বশুরবাড়িতে স্বামী মরার পর তাকে বের করে দিয়েছে, স্বামীর কোন অংশও দেয়া হয়নি। নিরুপায় হয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে শেষমেশ ভিক্ষার রাস্তাটা বেছে নিয়েছে মেয়েটা। বয়স বোধহয় তিরিশের ঊর্ধ্বে হবে। বত্রিশ, তেত্রিশ।

আমার মায়া লাগল। ওর খরচ চালানোর মত, সক্ষমতা নেই। সেদিন অল্প সংখ্যক টাকা দিয়ে চলে আসলাম। কী করাব, কী করাব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এমন কোন কাজ বেছে নেব, সেখানে আমারও প্রফিট হবে, তারাও নিজের পেট চালাতে পারবে? সম্ভবত উদ্যোক্তা বলে। কোন বিষয়ের উপর হব ভেবে পাচ্ছিলাম না। ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা ভাবলাম একবার, এতে বেশ সময় লাগবে। সবাই সহজে পারেনা, কাজ পায়না। ততদিন মেয়েটার খরচ চালাবে কে? আবার ল্যাপটপ পিসিরও ব্যাপার আছে। পেইন্টিং সবাই পারেনা, এটা ব্যয়বহুল। রঙের যা দাম! বাকী সামগ্রী? এতে খুব বেশি সেলও হয়না বড় প্লাটফর্ম না থাকলে। সেদিন সারাদিন ভেবেও পেলাম না।

অস্থিরতা, চিন্তার মাঝে গভীর রাতে হঠাৎ আপার কল আসলো। আমি তটস্থ হলাম। এত রাতে? কল ধরতেই আপা বলল, ‘সৌমি, কী অবস্থা তোর?’
‘ভালো আপা। তুই বল। হঠাৎ এত রাতে কল করলি, সব ঠিকাছে?’
আপা চুপ রইলেন। সময় নিয়ে ইতস্তত কন্ঠে বললেন, ‘আছি রে। শোন না, তুই কাল পরশু এদিকে আসবি?’
আমি উঠে বসলাম, ‘আপা সব ঠিকাছে? বাবুরা, তুই, দুলাভাই? হঠাৎ ডাকছিস?’
আপা আবারও সময় নিয়ে বললেন, ‘তুই একটু আয় না ময়না।’
আমি অধৈর্য হয়ে পড়লাম, ‘কী হয়েছে বলবি তো? আঙ্কেল আন্টি ঠিকাছেন?’
আপা তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘বাবা খুব অসুস্থ।’
আমি অস্থির কণ্ঠে বললাম, ‘কী হয়েছে আঙ্কেলের?’
আপা চুপসে রইলেন। আমি আবারও জিজ্ঞেস করায় আপা বললেন, ‘আমাদের বাবা রে সৌমি।’
আমি বিড়বিড় করে উঠলাম, ‘আমাদের বাবা?’
‘হুম।’

আমি নীরব রইলাম। চোখে ভেসে উঠল, সেদিনের কঠোরতা। কানে বেজে উঠল, ‘আমার বাড়িতে উঠতে পারবি না।’ চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। চোখ বন্ধ করে আটকানোর চেষ্টা করলাম। চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘আমি তার কেউ না আপা। তাই আমার যাওয়ার কোন প্রয়োজন বোধ করছি না।’
আপা কাতর স্বরে ডাকল, ‘সৌমি!’
আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, ‘আমি ব্যস্ততায় আছি আপা। যেতে পারব না।’
আপা বুঝল আমি রেগে বলেছি। ও অসহায় গলায় বলল, ‘বাবা হাসপাতালে সৌমি। খুব অসুস্থ। তোকে দেখতে চাচ্ছে। আ..
আপার কথা শেষ না হতেই আমি বললাম, ‘আমাকে আগে দেখেনি, এমন তো না তাইনা?’
আপা তার কথা সমাপ্ত করতে লাগল, ‘তার শরীরের অবস্থা বেশি ভালো নয় সৌমি। কখন কী হয় বলা যায়না। তোকে দেখতে চাচ্ছে। আয় না একবার বোন। যতই হোক আমাদের বাবা তো, বল?’

আমার কান্না এসেই গেল। দৃঢ় গলায় বললাম, ‘কিছুই হয়নি ওনার। ওসব নাটক, ঢং যত। কী খেয়ে মরবে উনি?’ ঠিক সেভাবেই বললাম, যেভাবে ওই লোকটা আমার মায়ের অসুস্থতার সময় বলতো। আপা বুঝতে পারল মায়ের মৃত্যুর ক্ষোভ প্রকাশ করলাম। আপা বলল, ‘সৌমি, মা এত কষ্ট করেও কখনও বাবার অমঙ্গল চায়নি। সবসময় দোয়া করেছেন। বাবা যা করেছে তার সঙ্গে তাও তিনি কখনও ছাড়ে যাননি। বাবার প্রতি রাগ রাখেননি। এত কিছু সহ্য করে মায়েই যখন তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে, তখন আমরা কী রে বল?’

মায়ের এই সরলতার প্রতিও আমার ক্ষোভ। তবে লোকটার প্রতি যে শুধু মায়ের জন্যই রাগ লাগত, তা না। মায়ের সঙ্গে যাই করুক না কেন, তবুও মনে তার প্রতি ভালোবাসা ছিল আমার। বাবা তো! কিন্তু ভরা আসরে যেদিন তিনি আমাকে প্রত্যাখান করলেন, আমার ভেতরটা চুরমার হয়ে গেছিল। বাবার অস্তিত্ব মুছে দিয়েছি মন থেকে। সেদিনটা নাহয় গেল, ডিভোর্সের পরও ভাবল না, মেয়েটা কোথায় আছে, কিভাবে থাকবে, কিভাবে চলবে, খাবে! আমার ভেতরে তার প্রতি অনুভূতিটুকু দাফন করেছি সেদিনই। আপাকে আমি দৃঢ় গলায় বললাম, ‘তিনি তোর সঙ্গে সেসব করেনি যা আমার সঙ্গে করেছে। আমি ভুলিনি আমার কষ্টগুলো। আমি এই সমাজে কতটা সংগ্রাম করে বেঁচে ছিলাম, জানিস? মানুষে যখন জিজ্ঞেস করত, ডিভোর্সের পর বাবার বাড়িতে কেন যাইনি? আমি কী উত্তর দিতাম? বাবা নেয়নি! তখন তারা বুঝত মেয়েটাই খারাপ, নাহলে বাবাও নেয়নি কেন?’

শ্বাস ফেললাম। চোখ মুছে বললাম, ‘ওনার সুস্থ থাকার জন্য বউ এনছিল না? বউই সুস্থ করুক। আমি গেলে তিনি সুস্থ্ হয়ে যাবেন না। রাখলাম।’
কল কাটার আগ মুহূর্তে আপা বললেন, ‘তার নাহয়, বিবেক, মনুষ্যত্বে ঘাটতি ছিল, তোর তো নয়। আমরাও যদি তার মতোই করি, তাহলে পার্থক্য কোথায় রইল?
তার জন্য না হলেও, আমার জন্য আয়। তোর আপার কথা রাখবি না, ময়না?’
তারপর কিছুক্ষণ থেমে, ‘আমি আর জোর করব না, শুধু এতটুকুই তোর আপার কথা ভেবে দেখিস।’

বলে রেখে দিল। সারারাত আমি ঘুমাতে পারলাম না। বারবার কানে বাজছিল, ‘বাবা হাসপাতালে। বেশি ভালো অবস্থা নয়।’ পুরোটা রাত আমি ছটফট করছিলাম। বুকটা ভার হচ্ছিল। বাবার সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত খুব কম। হাতে গোণা কয়েকবার পাশাপাশি বসা, জড়িয়ে ধরা হয়েছিল। ছোটবেলায়। সেসব চোখে ভাসছিল।
আমি নিজেও বুঝতে পারলাম না, আমি কেন কাদছিলাম। আপার বলা কথাটা বোধহয় সত্যিই, তার মনুষ্যত্বে নাহয় নেই, আমার তো আছে?

পরেরদিন স্কুলে গিয়ে হেডমাস্টারকে জানিয়ে ছুটি নিলাম দুদিনের। ট্রেন ধরে চলে এলাম রংপুরে। আপার বাড়ি এখানেই, তবে আমাদের বাড়ি থেকে দূরে। আমি আপার বাড়িতে গেলাম। তারপর আপা সহ গেলাম ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি আছেন। আপা ঢুকলেন আগে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। বুকটা কাপছিল। তিনি আপার সঙ্গে কথা বলছিলেন, সেসময়ে আমি ঢুকলাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন। যেন চিনতে পারছিলেন না। আমি নিকাবটা সরালাম। তিনি পলকহীন তাকিয়ে রইলেন। তার চোখ দিয়ে অশ্রু পড়তে লাগল। অস্ফুট গলায় বললেন, ‘সৌমি, মা..

আমি ভাবান্তর হলাম না। আপা বলল, ‘আয়।’
ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। লোকটা কাদলেন। ক্যানুলা লাগানো হাতটা দিয়ে আমার হাতে ছুঁলেন। শক্ত করে ধরলেন। জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন আছিস মা?’
আমি স্বাভাবিক ভাবে জবাব দিলাম, ‘আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো।’
তিনি আমার হাতটা ধরে রইলেন। বললেন, ‘তোর বাবার প্রতি রেগে আছিস, মা? আমি তোর খারাপ চাইনি, সংসারটা বাঁচাতে চেয়েছিলাম মা। তালাকের কয়েকমাস পর তোর খোজ করছিলাম, বাড়িতে আনতে। জানলাম তুই নাকি চাকরি করে খাচ্ছিস। ভালো আছিস। তাই আর..’

আমি ছোট করে ‘ওহ আচ্ছা ‘ বললাম। তাতে স্পষ্ট অনুভূতিহীন। বাবা অঝোর ধারায় কেঁদে বললেন, ‘তুই আমাকে ক্ষমা করে দে রে, ক্ষমা করে দে। অনেক কষ্ট দিছি।’
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘দিলাম ক্ষমা করে।’
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তৎক্ষণাৎ এল তার দ্বিতীয় স্ত্রী। মিষ্টি হেসে বলল, ‘সৌমি না? কেমন আছো?’
‘ভালো।’
‘এতদিন পর।’
‘আপা ডেকেছে, তাই।’
‘বিয়ে করেছ?’
‘না।’
‘এখন কী করছ?’
‘চাকরি।’
‘শুনেছিলাম দোকানে দাঁড়িয়ে কাপড় বিক্রি করে, কী যেন বলে? এখনও সেটা করছ?’
খানিকটা তাচ্ছিল্য ভাবে বলল। আমি সাবলীল ভাবে জানালাম, ‘জি না, আমি ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে শিক্ষকতা করি।’
বাবা অবাক হলেন, ‘তুই শিক্ষক হয়ে গেছিস?’
ইমোশনাল হলেন। চোখে যেন গর্ব ভেসে উঠল।মহিলাটা ভ্রু উঁচিয়ে রইলেন। তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘বেতন কত পাও? এটা কী সরকারি নাকি বেসরকারি?’
আমি ক্ষীণ হাসলাম, ‘যা পাই আলহামদুলিল্লাহ। এছাড়া রেশনও আছে। সরকারি জব।’
মহিলাটা যেন আরও অবাক হলেন, ‘রেশনও দেয়? কী কী পাও?’
আমি বললাম। তৎক্ষণাৎ বেহায়ার মত বললেন, ‘আমাদের দিও তো। ওতগুলো কী করবা?’
আমি খানিকটা রগড় করে বললাম,
‘আমি আমার জিনিসের কী করি, করব সেটা নিশ্চয়ই আপনার বলার কথা নয়? দান করতে আমি পছন্দ করি, আপনাকে নাহয় দিলাম কিছু।’

অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে গেল। মহিলাটা বাবার দিকে তাকালেন রাগান্বিত হয়ে। বাবা তাকে চুপ করে থাকতে বললেন। আমি আমার হাতটা ছড়িয়ে নিলাম। বাবা বললেন, ‘আজকের দিনটা থাক না আমার কাছে। থাকবি?’
শান্ত গলায় শুধালাম, ‘দুঃখিত।’
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা যা, কাল আবার আসিস।’
‘আবারও দুঃখিত।’
তার মুখটা ক্রন্দনরত হলো। যেন খুব অসহায়। আমি উপেক্ষা করে আপা বললাম, ‘আপা আমি যাচ্ছি। তুই কী এখন যাবি?’
‘আরেকটু পড়ে যাই।’
‘না আপা, আমার যেতে হবে। রাত হয়েছে অনেক।’
‘আজকে আমার বাড়িতে থাক।’
‘না আপা, আর জোর করিস না। তুই তোর দোহাই দিছিলি বলেই এসেছি, এখানে। আমার কোন কাজ কিংবা প্রয়োজনীয়তা নেই এখানে।’
নিজেকে গুছাতে গুছাতে বললাম, ‘তুই তবে দুলাভাইকে ডেকে নিস। আমি গেলাম।’

বলে বেরোলাম। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পথে নামলাম। নেকাবটা ভিজে যাচ্ছে অশ্রুতে। আটকানো কান্নাগুলো বেরিয়ে আসছে। কী অদ্ভুত! একসময় যে মানুষটা নিতে নাকচ করে দিয়েছেন, আজ আমার উপস্থিতি দীর্ঘ হোক চাইছেন। ভাগ্যের উপরও হাসি পায়। মনটা নরম হলেও, ওনাকে দেখার কেন অনুভূতিহীন হয়ে গেছিলাম। বাবা..! কতটা ভার শব্দের। আমার স্টুডেন্টগুলোর বাবাদের দেখি, হাত ধরিয়ে ধরিয়ে স্কুলে দেয়। অথচ আমার স্কুল ও বাবার অফিস একই দিকে হয়েও তিনি নিয়ে যেতেন না।এসব ভেবে মন করতে ভালো লাগেনা। সেদিন ট্রেন ধরে চলে আসলাম খোলাহাটিতে।

পরেরদিনটা ছুটি নিয়েছিলাম। এতসবের মধ্যে আলো নামের মেয়েটার কথা। মেয়েটাকে আমি ভরসা দিয়েছি ওর কাজের ব্যবস্থা করব। কিন্তু কী কাজের ব্যবস্থা করব সেটা জানি না। পরের দিন আমি আলোর কাছে গেলাম। কী একটা ঘর! আলোকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কী কী পারো?’
আলো জানাল, সে বাড়ির সব কাজকর্ম পারে। আমাকে রিকুয়েস্ট করল—নাহয় কোন মানুষের বাড়িতে কাজ দিতে, কিংবা আমি যেন তাকে রাখি। আমার কাজের মেয়ে প্রয়োজন নেই।
আমি আলোকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। ও বুঝল। আবারও একই প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি এমন কোন কাজ পারো, মানে যেটা দিয়ে ভালো ইনকাম করতে পারবে। মানুষের বাড়িতে কাজ ব্যতীত।’

আলোর মুখ অন্ধকার হলো। অকস্মাৎ উজ্জ্বল হয়ে বলল, ‘আমি খুব ভালো রাঁধতে পারি আপা।’
আমি ভাবলাম, নাহ একটা হোটেল কিংবা খাবারের দোকান দেয়া সম্ভব নয়। ব্যয়বহুল। অনলাইন করা যায় তবে এ এলাকায় চলবে বলে মনে হয়না। রংপুর হলে হতো। আমি বললাম, ‘আর?’
ও বিড়বিড় করল, ‘আর..
মনে করতে লাগল। ঈষৎ সময় গেল। তারপর বলল, ‘আমি টুকটাক সেলাই পারি, আমার আম্মা করত। তখন শিখছিলাম।’
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘সেলাই মেশিনে?’
মাথা নাড়াল আলো। এটা করা যায়। আমি বলি, ‘ওটা কোথায়? তাহলে এত কষ্ট করে খাচ্ছ কেন তুমি?’
ও নির্লিপ্ত গলায় বলল, ‘ঐটা ভাবি দেয় নাই আপা। ওখানে আছে।’
আমি বলার কিছু পেলাম না। সেদিন সেখান থেকে ভাবতে ভাবতে ফিরলাম। মেয়েটার যদি কোন ব্যবস্থা হয়, তবে অধিকার যেগুলো হরণ করা হয়েছে, সেগুলো ফেরাব। পরেরদিন স্কুলে গিয়ে কলিগটার সঙ্গে কথা বললাম। সে ভেবে বলল, ‘তুমিই কিনে দিতে পারো ওকে। তাহলেই তো হচ্ছে। তুমি তো উদ্যোক্তা হতে চাও, পাশাপশি অসহায় মেয়েদের সহায়তা করতে চাও তাইনা? তাহলে একটা থেকে নাহয় শুরু হোক আলোকে দিয়ে।’
আমি ওকে নিষ্প্রভ কণ্ঠে করলাম, ‘কিন্তু এখানেও বেশি না হলেও সব মিলিয়ে দশ বারো হাজার টাকা খরচ হবে।’
‘কিছু করতে চাইলে দিতে হবে। ইভেস্ট না করলে হবে?’

আমি সারারাত ধরে ভাবলাম সেদিন। খারাপ আইডিয়া না। শুরু করা যেতে পারে। কয়েকটা দিন কাটলো। হঠাৎ একটা নাম্বার থেকে কল এলো। রিসিভ করে সালাম দিয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে আপনি?’
‘সৌমি, মা। আমি তোর বাবা।’
মুখটা থমথমে হলো, ‘আমার নাম্বার কোথায় পেলেন?’
‘তোর আপার থেকে নিয়েছি।’
‘কী কারণে?’
‘তোর কথা খুব মনে পড়ছিল।’
‘কী জন্য?’
আমি জিজ্ঞেস করলাম। উনি বললেন, ‘সেই যে গেলি, আর এলি না।’
‘প্রয়োজন বোধ করছি না। আপনাদের কাছে তো আমি অপ্রয়োজনীয়।’

তিনি অসহায় কণ্ঠে বলেন, ‘এভাবে কথা বলছিস কেন মা?’
‘সরি, কীভাবে?’
তিনি চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, ‘আর কিছু বলার থাকলে বলুন নয়তো রাখুন।’
তিনি এক দুটো কথা বলে রাখলেন। আমার একদমই ভালো লাগেনা। যখন প্রয়োজন ছিল, তখন পাশে পাইনি—এখন আর কাউকে দরকার নেই। এখন সুবাসিনী নিজেই চলার সক্ষমতা রাখে। সেই সুবাসিনী, যাকে ডির্ভোসের জন্য নিজের বাবাই প্রত্যাখান করেছিল, সেই সুবাসিনী যাকে ডিভোর্সী বলে সমাজের কিছু মানুষ মুখ ছিটকাতো।

সময়গুলো কাটতে লাগে দ্রুত। আলোকে আমি যাবতীয় কিছু কিনে দিয়েছি। অবশ্য দেয়ার আগে একটা চুক্তি করে নিয়েছি স্ট্যাম্প পেপারে। আজকাল কজন মানুষকে ভরসা করা যায়! তাই কোন রিস্ক নেইনি। সময়গুলো দ্রুত কাটছিল। আলোকে কাজ পাওয়া অব্দি আমার বাড়িতে কাজের জন্য রাখলাম, বেশি খেতো না মেয়েটা। শুধু বাচ্চাকে খাওয়াতো। ওর তেমন ডিমান্ড ছিল না, শুধু তিনবেলা দুমুঠো ভাত খেলেই তৃপ্ত হতো, আর দু একটা কাপড়।
মাসের পর মাস চলে গেল। চারমাস ভালোভাবে কাজ করতে শিখল পাশাপশি শুরু করল। আলো প্রথম প্রথম ব্যর্থ হচ্ছিল, তারপর ওকে আমি আমার করুণ গল্প শোনালাম। যদিও আমি নিজেও সংশয়ে ছিলাম, শাবানার মতো কী একটা মেশিন দিয়ে ভাগ্য খুলবে?

ও নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। ধীরে ধীরে টুকটাক কাজও পেল। মাঝেমধ্যে ও হতাশ হয়ে বলতো, ‘আমার জন্য আপনার টাকা নষ্ট হলো।’
আমি বিশ্বাস রাখতাম, ও পারবে। ও পেরেছিলও। সময় লেগেছিল, তবে ধীরে ধীরে সফল হতে লাগছিল। এদিকে আমিও আরেকটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, যখন ক্লাস ফোরের ক্লাসও দেয়া হলো। ওখানের কিছু বাচ্চা প্রাইভেট পড়তে আগ্রহী ছিল। আমি না করিনি। শুরুতে চারটে পড়লেও আস্তে আস্তে সংখ্যাটা বৃদ্ধি পায়। আমার আয় আরও বাড়ল। ফ্রিল্যান্সিং এ এখন ভালই ইনকাম হচ্ছে। চাপ বেশি যাচ্ছে, তবুও ভালোই। এদিকে আমার বেতনও বেড়েছে। আস্তে আস্তে আলোও সফল হচ্ছে। আমি আমার স্বপ্নের খুব কাছে। কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল। কষ্টের পরেই সুখ আসে। সবকিছু সম্ভব হয়েছে আমার রবের জন্য। তিনি আমায় ভেঙে, আবারও জোড়া লাগিয়েছেন। ব্যর্থ করে এতবেশি সফলতা দিয়েছেন, বলার বাইরে। এজন্যই তো সুরা আদ দোহায় বলেছেন, ‘শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এত দেবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে।’

চলবে~