নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১. ( অবতরণিকা )
বৈশাখ মাসের উত্তপ্ত এক দুপুর। সূর্যের প্রকোপে চোখ মেলে তাকানো দায়। পিচ ঢালা রাস্তাটা রৌদ্র তাপে গরম কড়াইয়ের ন্যায় হয়ে আছে। গাছের পাতাগুলোও সামান্যতম বাতাস বিলিয়ে দিতে কার্পণ্য করছে খুব। পাখিরা নিজ নিজ নীড়ে নিঃশব্দে ঝিমুচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ফটকটাকে পেছনে ফেলে স্নেহা যখন রাস্তায় পা রাখল, তখন চারপাশে বিরাজ করছে তন্দ্রাচ্ছন্ন স্তব্ধতা। কড়া রোদে চোখ জোড়া কুচকে আসে তার। কপালে দৃশ্যমান হয় ভাজ। স্নেহা অনুভব করে উত্তপ্ত রাস্তার তাপটা তার জুতো ভেদ করে পায়ের পাতায় অনুভূত হচ্ছে। ঘাড়ের কাছের চুলগুলোও ঘামে ভিজে সেঁটে গিয়েছে।
ক্লাসের ল্যাটা চুকানো শেষে এবার তার স্টুডেন্ট পড়ানোর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পালা। ইউনিভার্সিটির গেট থেকে স্টুডেন্টের বাসা রিকশায় করে কেবল পনেরো মিনিটের পথ। স্নেহার ক্লান্ত চোখ গিয়ে পড়ে রাস্তার ওপর পাশে ঠান্ডা ঠান্ডা আখের শরবত বিক্রি করা ভ্যানটার দিকে। শুকনো চৌচির গলাটা যেন কিছুটা তৃষ্ণা অনুভব করলো। মাসের শেষ দিন আজকে। হাতের টানাটানি অবস্থা চলছে। এ-ই মুহূর্তে মনের এ-ই সামান্য খায়েশ মেটাতে গেলে তার বিসিএস প্রস্তুতির দরকারি দুটো বই কেনার টাকা শর্ট পড়ে যাবে। তাই লোভী হয়ে উঠা আত্মাটাকে সংবরণ করে সে রিকশা ঠিক করতে আগায়। তবে পরপর দুটো রিকশা অন্যায্য ভাড়া দাবি করতেই স্নেহার মেজাজ চটে যায়। গরম একটু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে এই ভাড়া বেড়ে যাওয়ার হিসাবটা সে বুঝে উঠতে পারে না। দুই মিনিট ধরে বাকবিতন্ডা করে অবশেষে স্নেহা একটা রিকশা ঠিক করে।
দামাদামিতে জিতে গিয়ে স্নেহা উঠে বসতেই হুড তোলা রিকশাটা চলতে শুরু করে। রিকশার ছায়ায় বসেও গরম থেকে নিস্তার মেলে না। চারিপাশে উড়ে বেড়ানো ধূলোয় চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসতে চায়। স্নেহা সে-সব দিকে তোয়াক্কা না করে ব্যাগ থেকে নিজের ফোনটা বের করে স্টুডেন্টের মা’য়ের নাম্বারে একটা মিসড কল দেয়। এটা তার নিত্যদিনের রুটিন। নিতুন নামক ছেলেটাকে পড়ানোর জন্য রওনা দিয়েই সে সবসময় তার মা’কে একটা কল দিয়ে রাখে যেন ভদ্রমহিলা ছেলেকে মিসের আগমনী বার্তাটুকু জানিয়ে রাখে। নিতুনও সে-ই অনুযায়ী সকল কাজ ফেলে দ্রুত বই খাতা গুছিয়ে টেবিলে বসে রয়। এতে করে স্নেহা পৌঁছে সরাসরি পড়ানো শুরু করে দিতে পারে।
__________
সতেরো মিনিটের মাথায় নিজ গন্তব্যে পৌঁছে যায় স্নেহা। রিকশা ভাড়াটা মিটিয়ে নামতেই এক মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে তাকায় সামনের দিকে। আমিনবাজারের শেষপ্রান্তে কাঠাল গাছের ছাঁয়ায়, উঁচু বাউন্ডারির ভেতর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা দোতলা ছিমছাম বাড়ি। বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে প্রবেশ করতেই সামনে পড়ে একটা ছোটখাটো উঠোন। বাড়ির কর্তী বেশ শৌখিন ঘরানার মানুষ বলেই সে-ই সামান্য জায়গা জুড়েই বেশ কিছু ফুল গাছ সাড়ি করে লাগিয়েছেন। স্নেহা প্রকৃতি দেখায় সময় অপচয় না করে ঝটপট বাড়ির কেচি গেটের এপাড়ে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজায়।
দোতলা হতে সিড়ি ভেঙে ধুপধাপ কদমে নেমে আসে একটা হ্যাংলা পাতলা ছেলে। বয়স সংখ্যাটা তেরো থেকে চৌদ্দর মাঝে সীমাবদ্ধ। হাতে তার কেচি গেটের চাবি। চাবির সাহায্যে তালাটা খুলতে খুলতেই হেসে সালাম দেয়,
“আসসালামু আলাইকুম, মিস।”
স্নেহা শুকনো মুখে জবাব দেয়,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”
ব্যস! এট্টুকই! এর বাহিরে একটা টু শব্দও করলো না স্নেহা। নিতুন ছেলেটা মিসের এরকম শুকনো আচরণে অবাক হয় না। তার মিসটা এরকমই। সিমেন্টে গড়া মানুষদের মতো অনুভূতিশূন্য৷ কখনো হাসে না, পড়ানোর বাহিরে অপ্রয়োজনীয় বাড়তি আলাপ জুড়ে বসে না, কপালে সবসময় একটা বিরক্তির ভাজ ফেলে রাখে, পড়া না পারলে নারীসলুভ ন্যূনতম মায়া মমতা না দেখিয়ে কাঠের স্কেলটার আঘাত বসায় নিতুনের পিঠে। আঘাতের প্রকোপ এতটাই তীব্র হয় যে কখনো কখনো স্কেলটা দুই খণ্ড হয়ে ভেঙেও যায়। আজকেও নিতুনের মাইরবার। মিস গতদিন তাকে ত্রিকোণমিতির সাতটা অংক করতে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে-ই হোমওয়ার্কটুকু এখনো সম্পন্ন করা হয় নি। এর শাস্তিস্বরূপ আজকে কয় ঘা খেতে হবে কে জানে!
এসির টেম্পারেচার মাত্রা আঠারোর ঘরে স্থির। ঠান্ডা, শীতল রুমটাতে কদম রাখতেই স্নেহার আত্মা জুড়িয়ে যায়। এই অমানবিক গরমটা সয়ে এসে এইটুকু ঠান্ডার সান্নিধ্যে সে প্রশান্তি অনুভব করে ক্ষানিকটা। তবে চেহারার অভিব্যক্তিতে তা প্রকাশ পায় না। বরং চেয়ারে বসে, কাধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে নিজেই নিতুনের টেবিলের উপর থাকা হোমওয়ার্কের খাতাটা টেনে নেয়। পেজ পাল্টাতে পাল্টাতে লক্ষ্য করে খালি পাতাগুলো। অতঃপর খাতাটা রেখে স্কেলটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করে।
নিতুন ঠান্ডা ঠান্ডা লেবুর শরবতের গ্লাস হাতে রুমে প্রবেশ করে। গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে বলে,
“মিস, শরবত খেয়ে নিন। বরফকুচি দিয়েছি আমি। যা গরম আজ বাহিরে!”
স্নেহা নির্বিকার দৃষ্টি মেলে লক্ষ্য করে নিতুনের কপাল বেয়ে নেমে আসা ঘাম। কোনো এক অদ্ভুৎ ক্ষমতার দরুণ সে নিজের স্টুডেন্টদের মাইন্ড রিড করতে পারে। এই-যে এই শরবতের আতিথেয়তাটা, এটা হলো নিতুনের তরফ থেকে এক প্রকার ঘুষ। টিংটিঙে বাচ্চা ছেলেটা নিশ্চয়ই মনে মনে দোয়া করছে যেন, শরবতটুকু খেয়ে স্নেহা নিজের গরম মাথা ঠান্ডা করে আজকের দিনের জন্য ক্ষমা দান করে। কিন্তু স্নেহা তো ঘুষখোর নয়! তাই সে জালিমের মতো বললো,
“ডান হাতটা আগাও।”
নিতুনের চোখে মুখে আঁধার নেমে আসে। মনে মনে মিসকে উদ্দেশ্য করে ছুড়ে কিছু শব্দ। পাষাণ, নির্দয় এবং জালিম শব্দগুলো মনে মনে আওড়িয়ে সে নিজের ডান হাতটা এগিয়ে দিতেই শক্ত স্কেলের আঘাত পড়তে নেয় তার হাতে। তবে ঠিক সে-ই মুহূর্তেই নিতুনের মা নীলা এসে হাজির হোন রুমে। স্নেহাকে দেখেই সপ্রতিভ হেসে বলেন,
“তোমার স্টুডেন্ট কী আজকেও মার খাওয়ার মতো কাজ করেছে না-কি?”
ছাত্রের মা’য়ের সম্মানে স্নেহা স্কেলটা টেবিলের উপর রেখে দিলেও সত্যটা চেপে না গিয়ে জানায়,
“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি। আপনার সঙ্গে আজ ওর ব্যাপারে কথা বলবো ভাবছিলাম আমি। ভালো হলো যে আপনি চলে এলেন। নিতুনকে গতকাল হোমওয়ার্ক করতে দিয়ে গিয়েছিলাম। ও হোমওয়ার্কের কাজটুকু সম্পন্ন করে নি। গত এক মাস ধরে ওকে পড়াচ্ছি আমি। এই এক মাসে আমি যা বুঝলাম তা হলো, ও পড়াশোনা নিয়ে চরম উদাসীন। আমার শাসন এবং মাইর ছাপিয়ে পড়াশোনার প্রতি ওর এই উদাসীনতার প্রভাবটা ওর রেজাল্টে পড়তে পারে বলে আমি ধারণা করছি। ওর নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি না থাকলে আপনি পৃথিবীর সবথেকে চমৎকার শিক্ষকটা এনে দিলেও ওর পড়াশোনায় কোনো উন্নতি আসবে না।”
নিজের ব্যাপারে গৃহশিক্ষিকার এরকম মন্তব্যে নিতুনের মুখটা আরো কালো হয়ে যায়। আজকে তার রক্ষা নেই। আম্মুর ঝাটার বাড়িটা আজ নিশ্চিত তার পিঠে পড়বে! ছেলের ব্যাপারে এহেন বিরূপ গুণগান শুনে নীলা বেগম কটমট করে ছেলের দিকে তাকায়। রাগ নিয়ে বলে,
“তোকে আমি এখন কিচ্ছু বলবো না। আজ তোর বাপ আসুক। উনি তোর হিসাবটা বুঝে নিবেন।”
জেলা প্রশাসক পিতার নাম নিয়ে আম্মুর ছুড়ে দেওয়া হুমকিটা নিতুনের হৃদয়ে ভয়ের উপদ্রব সৃষ্টি করে। আব্বু হিসাব বুঝবে মানে? মিসের মাইরটা যদি আটলান্টিক মহাসাগরের সমান ভয়াবহ হয়, তবে আব্বুর মাইরটা প্রশান্ত মহাসাগরের সমান ভয়াবহ। স্নেহা গলার স্বর কঠিন রেখেই বলে,
“আমি ওকে পড়ানো শুরু করেছি বছরের চারটা মাস শেষ হওয়ার পর। সামনে ওর জেএসসি পরীক্ষা। বোর্ড পরীক্ষার খুব একটা দেরি নেই। তবুও আমি শুরু থেকে ওর বই ধরেছি যেনো সিলেবাসের একটা কিছু মিস না হয়। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে আমি ওর জন্য যতটুকু এফোর্ট দিচ্ছি, স্টুডেন্ট হিসেবে ও আমার ততটুকু এফোর্টকে মূল্যায়ন করছে না। এরকম চলতে থাকলে বোর্ডে ভয়াবহ একটা কাণ্ড করবে ও। আমার মনে হয়, বাসায় ওকে আরেকটু স্ট্রিক্টলি ট্রিট করে একটা রুটিনের মধ্যে চলার জন্য বাধ্য করা উচিত। আমার এতটুকু বলা জরুরী মনে হলো বলে বললাম। বাকিটা আপনি যা ভালো মনে করেন।”
নীলা বেগম ছেলের সম্পর্কে সম্পূর্ণ অভিযোগটা স্বামীর অপেক্ষায় তুলে রেখে স্নেহাকে বলে,
“তুমি চিন্তা করো না। ওর আব্বু আসলে আজ এ-ই ব্যাপারে কথা বলবো আমি। উনিই ওর একটা বিহিত করবেন। তোমাকে আমি আসলে অন্য একটা কথা বলতে এসেছি। আজকে দুপুরের লাঞ্চটা তুমি আমাদের সঙ্গে করলে খুশি হবো খুব৷ আসলে আমার বাবু অনেকদিন পর বাড়ি ফিরলো তো! সে-ই উপলক্ষে সামান্য আয়োজন করেছি।”
‘বাবু’ শব্দটা শুনে স্নেহার কপাল কুচকে এলো। ভদ্রমহিলা কাকে বাবু বলে সম্বোধন করছেন, তা বোধগম্য হলো না তার। সে বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে সে জবাব দেয়,
“দুঃখিত, আন্টি। আমার নিতুনকে পড়িয়ে আরেকটা স্টুডেন্ট পড়াতে যেতে হবে। আজ সম্ভব নয়।”
ভদ্রতার খাতিরে শেষ বাক্যটুকু যোগ করলেও, সত্যিকার অর্থে স্নেহা অপরিচিত কারো বাসায় এক গ্লাস পানি পান করতেও আগ্রহী নয়। স্মার্ট ফোনে থাকা নীল সাদার জগতে ভয়ংকর এক নিউজ পড়েছিল সে। স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়ে এক মেয়ে শিক্ষিকা সম্মানহানির শিকার হয়। তদন্তে না-কি জানা গিয়েছে উক্ত শিক্ষিকার খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ জাতীয় ড্রাগস মিশিয়ে এরকম নিচু কাজটুকু করা হয়েছিল। ব্যাপারটা নিত্যদিনের একটা সামান্য খবর হলেও স্নেহা সেটা গভীরভাবে আমলে নিয়েছে। তার মতো মেয়েকে জীবন তাগিদে একা চলতে গেলে এসব বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে, চোখ-কান খোলা রেখেই চলতে হয়। নির্মম এ-ই পৃথিবীতে নারী হিসেবে কাউকে ভরসা না করাটা সে একটা জরুরী ব্যাপার বলে মনে করে।
নীলা বেগম তবুও কিছুটা জোর খাটিয়ে বললো,
“তাহলে আজ নিতুনকে পড়ানোর প্রয়োজন নেই। একেবারে লাঞ্চ করে নেই আমরা, চলো। তারপর না-হয় গেলে তুমি!”
স্নেহা মনের অনাগ্রহটুকু বহাল রেখেই সামান্য মিথ্যা মিশিয়ে বলে,
“আপনি ব্যস্ত হবেন না, আন্টি। আমি ওকে পড়াতে আসার আগে ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ করে নিয়েছিলাম। এখন কিছু খাওয়া সম্ভব না। পেটে সামান্যতম জায়গা নেই। অন্য কোনোদিন ইন শা আল্লাহ।”
এরপর আর জোর করার মতো কিছু থাকে না। নীলা বেগম ছেলেকে কড়া করে চোখ পাকিয়ে চলে যান। নিতুন বেচারা মিসের সামনে চেয়ার টেনে বসে কিছুটা ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো করে বলে,
“মিস, আসলে গতকাল সন্ধ্যায় বাবু ভাইয়া বাসায় আসায় আমি হোমওয়ার্ক করার সময় পাই নি।”
স্নেহা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কড়া গলায় প্রশ্ন করে,
“তোমার বাবু ভাইয়া তোমার হাত পা বেঁধে রেখেছিল?”
নিতুন নিজের নখ খুঁটতে খুঁটতে জবাব দেয়,
“না। আসলে ভাইয়া অনেকদিন পর এসেছে তো! সে-ই উপলক্ষে আম্মু অনেককিছু রান্না করেছিল। এখন এতোকিছু খেয়ে আমার পেট ফুলে ঢোল হয়ে ছিল। খেয়েদেয়ে কি আর এনার্জি থাকে, বলুন? তাই ফুলো পেট নিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
এরকম বাচ্চামো কথাবার্তায় স্নেহা বিরক্ত হয়। নিতুনকে একটা উপপাদ্য করতে দিয়ে সে বিজ্ঞান বইটা খুলে অষ্টম অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো হাইলাইটার দিয়ে উজ্জ্বল করে দাগাতে থাকে। ডিসি বাপের ছেলের অদ্ভুৎ সব সমস্যা! সে নাকি রিডিং পড়ার সময় বুঝতে পারে না এমসিকিউর জন্য কোন লাইনগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্নেহার প্রতিদিন এই ছেলের বই দাগিয়ে দিতে হয়। মনে মনে এরকম নবাবজাদা ধরনের সমস্যা দেখে সে বেজায় বিরক্ত।
এরকম আলালের ঘরের দুলালদের প্রতি স্নেহার মনে সবসময়ই বিতৃষ্ণা কাজ করে। এই দুলালদের নাখরার শেষ নেই। এই যেমন নিতুনের এইমাত্র বলা কথাটা – খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে সে নাকি পড়ার এনার্জি পায় নি। এই কথাটা স্নেহার কাছে খুবই লেম বলে মনে হয়েছে। মানুষ শরীরে শক্তি জোগাতে খায়। আর এই বড়লোকেরা না-কি খেয়েদেয়ে শরীরে শক্তি খুঁজে পায় না! স্নেহার ইচ্ছে করে এই শ্রেণীর মানুষদের ঘাড় ধরে একটু ফুটপাতের ধারে নিয়ে যেতে। ফুটপাত জুড়ে কতো ভুখা শিশু খাবারের অভাবে কষ্ট পায়, তা যদি এই ধনীরা বুঝতো!
দীর্ঘ দুই ঘন্টা সময় নিয়ে নিতুনকে পড়ানো শেষ করে স্নেহা বাসা থেকে বের হওয়ার সময়ই লক্ষ্য করে উঠোনের একপাশে থাকা একটা অসচরাচর বাইককে। তার মনে পড়ে যায় কোনো এক বাবুর আগমনের খবরটা। নিতুনের কোনো ভাইবোন আছে সেটা স্নেহার জানা ছিল না। কখনো এই ব্যাপারে আগ্রহও দেখায় নি সে। তার কাজ শুধুমাত্র পড়ানো এবং নিজের মাইনেটা বুঝে নেওয়া দিয়ে। ভ্যাপসা গরমে ত্যক্ত স্নেহা নিজের কুচকে রাখা মুখ নিয়েই বাইকটাকে পাশ কেটে বেরিয়ে যায়।
__________
ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে নয়টা ছুঁই ছুঁই। আশুলিয়ার ব্যস্ত রাস্তার হালকা গুঞ্জন জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকছে। মাথার উপরের ফ্যানটা বিদঘুটে শব্দ তুলে ঘুরলেও সে-ই বাতাসে স্বস্তি মিলছে না। তিন বেডরুমের ছোট্ট ফ্ল্যাটের ডাইনিং টেবিলে গরম ভাতের ধোঁয়া উঠছে। টেবিলে একদম হিসাব করে পরিমিত পরিমাণে রান্না করা খাবার সাজানো। আলু ভর্তা, ডিম ভুনা এবং টোম্যাটো দিয়ে রান্না করা পাতলা ডাল।
স্নেহা বাড়ি ফিরেছে এক ঘণ্টা হলো। ক্লাস শেষ করে পরপর তিনটা স্টুডেন্টকে পড়াতে হয় তার। সকলকে পড়িয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রতিদিনই দেরি হয়ে যায়। ঘাম, ক্লান্তি এবং ধুলোবালি মুছে ফেলতে বাসায় ঢুকেই সরাসরি গামছা, কাপড় নিয়ে গোসল করতে ঢুকেছিল সে।
গোসল সেড়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে প্লেট নিয়ে একে একে ভাত, আলুর ভর্তা বেড়ে নিয়ে স্নেহা নিজের রুমে ফিরে এসে পড়ার টেবিলটায় খেতে বসে। এই বাসার ডাইনিং টেবিলে চারটা চেয়ার রয়েছে। সে-ই চারটা চেয়ারে পর্যায়ক্রমে স্নেহার বাবা আমিনুল সাহেব, উনার স্ত্রী মোমিনা বেগম, কলেজ পড়ুয়া ছোট ভাই সামিউল এবং স্কুল পড়ুয়া ছোট বোন শায়না বসে। স্নেহা সেখানে কখনো বাড়তি চেয়ার নিয়ে গিয়ে নিজের স্থান করে নেওয়ার চেষ্টা করে না। নিজেকে যতটা পারে সকলের দৃষ্টির আড়ালে রেখে চলে সে।
ভাতের প্রথম লোকমাটা মুখে তুলতেই স্নেহার কানে ভেসে আসে ডাইনিং টেবিল হতে মোমিনা বেগমের গুঞ্জন,
“আলুর কেজি দাম চল্লিশ টাকায় গিয়ে ঠেকসে। লাল ডিমের হালি হইসে বিয়াল্লিশ টাকা। কী হিসাব করে চলতে হয়, এইডা যদি সবাই বুঝতো! বাপের ঘাড়ে বইস্যা খায় বইল্যা বাজার সদাইয়ের হিসাব তো জানে না! আয়েশ কইরা বইস্যা গিললে এতো হুশ থাকে না-কি?…”
মোমিনার বাজারের দরদাম নিয়ে বিলাপ চলতেই থাকে। কেউ তার কথার মাঝে ফোড়ন কাটে না। অবশ্য কেউ ফোড়ন কাটার প্রয়োজনটুকুও বোধ করে না। কারণ মোমিনা বেগমের বলা কথাগুলো তাদের কারো উদ্দেশ্যেই না। যার উদ্দেশ্যে এতো হিসাবের রেষারেষি চলছে সে ভাতের দ্বিতীয় লোকমাটা আর মুখে তুললো না। নীরবে প্লেট নিয়ে উঠে যায় ডাইনিং টেবিলে। আছোঁয়া ডিমটা তুলে রাখে কড়াইয়ে, অক্ষত ভর্তাটুকু তুলে রাখে বাটিতে, এখনো না মাখা ভাতটুকু সুন্দর করে তুলে রাখে হাড়িতে। বাদবাকি যতটুকু এঁটো হয়েছে তা ময়লার ঝুলিতে ফেলে প্লেট এবং নিজের হাতটা ধুয়ে নেয়।
টেবিলে বসে থাকা চারজন সদস্যই নীরবে দেখে সম্পূর্ণ দৃশ্যটা। স্নেহা মুখে কুলুপ এঁটে রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজাটা আটকে দেয়। ডাইনিং রুমটা ফের সরব হয়ে উঠে। বাড়িওয়ালা কারো বাপ না থেকে শুরু করে নানাধরণের মন্তব্য ছোঁড়া হয় স্নেহার উদ্দেশ্যে। সে-সকল মন্তব্য গায়ে না মেখে আলোটা নিভিয়ে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে স্নেহা। আজ দুপুরে ক্যান্টিনে বসে দুটো আলুর সিঙ্গারা খেয়েছিল সে। খাওয়ার সময় পাশের টেবিলে বসা দুটো মেয়ের আলাপ তার কানে এসেছিল। আদরের দুলালী মেয়েটাকে নাকি তার মা-বাবা কখনো খালি পেটে ঘুমোতে দেয় না। হাজার রাগ করে থাকলেও মা নাকি মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিয়ে তারপর ঘুমানোর অনুমতি দেয় মেয়েটাকে। এ-ই ব্যাপারটা নিয়ে মেয়েটার সে কী দুঃখ! সে নাকি শান্তিতে একটু দুঃখবিলাসও করতে পারে না। ঘটনাটা মনে পড়তেই চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে শুয়ে থাকা স্নেহার গা জ্বলে উঠে। হুট করেই তার ইচ্ছে হচ্ছে ওই মেয়েটাকে খুঁজে বের করে দুই গালে ঠাসঠাস করে দু চারটা চটকানা মেরে এই ঢংয়ের দুঃখ ছুটিয়ে দিতে। ওই মূর্খ মেয়েটা কখনোই বুঝবে না যেটা তার দুঃখের কারণ, সেটাই কত মানুষের রাত জাগা হাহাকারের একটা অধ্যায়।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]