নীড়বৃষ্টি পর্ব-০২

0
2

নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২.

আলো-ছায়ায় ভরা ক্যাম্পাসের বটতলায় বসে আছে স্নেহা। বটতলার ঠিক পেছনে থাকা লেকটা শান্তরূপে স্থির হয়ে আছে। সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিসিএসের প্রস্তুতির বইগুলো। বাংলাদেশ বিষয়াবলী, গণিত, ইংরেজি বইয়ের সঙ্গে রয়েছে একটা নিয়ন রঙের হাইলাইটারও। পড়ার জন্য আপাতত এই নিরিবিলি জায়গাটাকেই বেছে নিয়েছে স্নেহা। আজকের টপিক হলো – বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি। নিরিবিলি পরিবেশটা স্নেহাকে মনযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করছিল।

কিন্তু পরিবেশটা বেশিক্ষণ নিরিবিলি রইলো না। হুট করেই একটা বন্ধুদল এসে জমায়েত হলো সেখানে। তাদের হাসি ঠাট্টার কলরবে মুখরিত হয়ে উঠে চারিপাশ। স্নেহার মনযোগে ব্যাঘাত ঘটায় সে চোখ তুলে এক মুহূর্তের জন্য তাকায় তাদের পানে। চোখে মুখে তার রাজ্যের বিরক্তি। কারো হাতে গিটার, তো কারো হাতে ঝালমুড়ি। তারুণ্যের উচ্ছ্বাস সকলের চোখেমুখে।

বইখাতা ভুলে স্নেহা নির্লিপ্ত দৃষ্টি মেলে দেখতে থাকে তাদের। ছেলেমেয়েগুলো তার সমবয়সীই৷ অথচ কী তফাত তাদের মধ্যে! স্নেহার চোখেমুখে উচ্ছ্বাস নেই, জীবনে কোনো বন্ধু নেই, ব্যাগে আপাতত শখ করে দশ টাকার ঝালমুড়ি খাওয়ার অব্দি টাকা নেই। তবে একটু পরেই তার ব্যাগের ভেতর থাকা শূন্য ওয়ালেটটা টাকার নোটে পরিপূর্ণ হবে। আজ মাসের প্রথম দিন। নিতুনের মা সম্ভবত আজকেই বেতনটা দিয়ে দিবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিতুনকে বিরক্তিকর লাগলেও, এই টিউশনিটা পেয়ে স্নেহার বেশ উপকারই হয়েছে। ডিসির ছেলে হওয়ায় এবং দুই ঘন্টা সময় নিয়ে মোটামুটি সবগুলো সাবজেক্টই পড়ানোর কারণে একটা ভালো এমাউন্টের বেতন পাওয়ার সুযোগটা কম বড়ো বিষয় নয়।

গতকাল রাতে মোমিনার বলা কথাগুলো স্নেহা ভুলে নি। মনে মনে ঠিক করে রাখলো বেতন পেতেই সে সবার আগে বাজারে গিয়ে কিছু বাজার করে নিবে। তার জন্য দুমুঠো ভাত, তরকারির খরচটা যেন এখন থেকে কারো বহন করতে না হয় সে-ই বিষয়ে সে সচেতন থাকবে। স্নেহা বাসায় নীরব থাকে বলে নিজের আত্মসম্মান তো আর বিসর্জন দেয় নি। তাছাড়াও সে প্রথম বর্ষ থেকে চেষ্টায় আছে হলে একটা সিট পাওয়ার। ফার্স্ট ইয়ারে সিট না পেলেও সে আশাবাদী এবার বোধহয় সিট পেয়ে যাবে। একবার হলে উঠতে পারলেই সে আর কারো উপর বোঝা হয়ে থাকবে না।

প্রায় রঙ উঠে যাওয়া চিকন বেল্টের হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে স্নেহা সময় দেখে নেয়। আপাতত আর শান্তিমতো নিরিবিলিতে পড়ার সুযোগ নেই। তাই বইখাতা গুছিয়ে ব্যাগে তুলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। মিনিট চল্লিশ পর থেকে নিতুনকে পড়ানোর কথা। স্নেহা সিদ্ধান্ত নিলো আজ আর সে রিকশা নিবে না৷ এখন রওনা দিলে হেঁটে হেঁটে ঠিকই সময়মতো পৌঁছে যাওয়া যাবে। ভাবনা অনুযায়ী তপ্ত রোদ মাথায় নিয়েই হাঁটা ধরে স্নেহা। গন্তব্য হলো ছাত্রের বাড়ি।

__________

নিতুনের মনটন বেজায় খারাপ আজ। গতরাতে আব্বু বাড়ি ফেরার পর আম্মু তার নামের নালিশের খাতা খুলে বসেছিল। আব্বু পড়াশোনা এবং শাসনের সময় পৃথিবীর সবথেকে নিষ্ঠুরতম পিতার রূপ ধারণ করে। গতকালও তার ব্যতিক্রম হয় নি। তবে এবার আব্বুর শাসনের ভাষাটা ভিন্ন ছিল। পিঠে ধুমধাম মাইর বসায় নি। বরং চুপচাপ নিতুনের আইপ্যাড, গেমিং স্টেশন থেকে শুরু করে তাকে সাজানো কমিকসের বইগুলো বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। সে-ই সঙ্গে শীতল গলায় জানিয়ে গিয়েছে, বোর্ড পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে যদি নিতুনকে সামান্যতম তিড়িংবিড়িং করতে দেখা যায়, তাহলে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানানো জালি বেতের আঘাতে ঠ্যাং ভেঙে দিবেন তিনি।

স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগটা টেবিলে রেখে বারান্দায় এসে রেলিঙের উপর ঝুঁকে দুঃখবিলাসে মগ্ন নিতুন লক্ষ্য করে নি কখন তার পাশে এসে তার বড়ো ভাই দাঁড়িয়েছে। পিঠে একটা শক্ত থাবা পড়তেই নিতুন ধড়ফড়িয়ে উঠে। পাশ ফিরে তাকিয়ে পরিচিত মানুষটাকে দেখেই নিজের বুকে মিছেমিছি থুতু ছুড়ে বলে,

“আম্মুর আঁচল ছেড়ে আমার রুমে এলে যে!”

খোলা বারান্দার রেলিঙে দুই হাত ঠেকিয়ে দাঁড়ানো ব্যক্তি মেঘমেদুর স্বরে বলে উঠে,

“আমি কখনো আম্মুর আঁচল ধরে ঘুরি না।”

“উঁহু, ভুল বলেছি। তুমি নও, বরং আম্মুই দিনরাত তোমার পিছনে ঘুরঘুর করে। তোমাকে চোখে হারায়!”

ভ্রু বাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,

“কিছু পোড়ার গন্ধ পাচ্ছিস তুই?”

নিতুন অভিমান নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কোনো জবাব দেয় না। বরং পাল্টা প্রশ্ন করে,

“আম্মু আব্বুর স্মার্ট বয়। একটা প্রশ্নের জবাব দাও তো। এখান থেকে লাফ দিলে আমার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কত পারসেন্ট?”

“দো তলা থেকে লাফ দিয়ে মরার স্বপ্ন দেখিস? এখান থেকে পড়লে সর্বোচ্চ তোর হাত পা ভাঙবে। মাথা ফাটারও সম্ভাবনা আছে। উপুড় হয়ে পড়লে নাক মুখের নকশাও বদলে যেতে পারে। তবে আমার গাট ফিলিংস বলছে তোর নিহত হওয়ার চান্স একদম জিরোর কাছাকাছি।”

নিতুনের মন খারাপ হয়। ভাইয়ার গাট ফিলিংসের প্রতি তারা অটুট আস্থা রয়েছে। ভাইয়া যেহেতু বলেছে সেহেতু বোধহয় তার লাফ দেওয়ার প্ল্যানটা ক্যান্সেল করতে হবে। হাত পা ভেঙে বসে থাকলেও প্যারা! মরতে গিয়ে বেঁচে ফিরলে আব্বু বেত দিয়ে পিটিয়ে তার পিঠের ছাল তুলে ফেলবে। নিতুন মন খারাপ নিয়ে বলে,

“আমার মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি। গেম না খেলে এতগুলো মাস কীভাবে পাড় করবো আমি? আব্বু এতটা কঠোর কীভাবে হতে পারলো? সত্যি করে বলো তো, আমাকে তোমরা কোথা থেকে কুড়িয়ে এনেছো? নিজের আপন ছেলের উপর তো কেও এমন একটা দণ্ড জারি করতে পারে না!”

“তোকে কোথা থেকে তুলে আনা হয়েছে সেটা সরাসরি আব্বুকেই বরং প্রশ্ন করিস।”

নিতুন কিছু বলার পূর্বেই রুমের দরজার ধারে এসে উপস্থিত হলেন নীলা বেগম। তিনি গলা চড়িয়ে বলেন,

“নিতুন! এই ফাজিলের বাচ্চা! এখনো ইউনিফর্ম বদলাস নি? তোর মিস কল দিলো। পড়াতে আসছে। তাড়াতাড়ি গোসল করে বই খাতা নিয়ে বস। পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে যদি তোকে আমি এখানেই দেখি, তাহলে আজ তোর একদিন কী আমার একদিন।”

ছোট ছেলের উদ্দেশ্যে কথাটুকু সম্পন্ন করেই ভদ্রমহিলা বড়ো ছেলের উদ্দেশ্যে কণ্ঠে মমতা ঢেলে দিয়ে বলেন,

“বাবু, তুমি না বলছিলে বের হতে হবে তোমাকে? আমি ভাত বাড়ছি। তুমি এসে খেয়ে নাও আগে। আম্মু আজকে তোমার পছন্দের রুই মাছের মুড়িঘণ্ট রেধেছি। না খেয়ে কিন্তু বাড়ির বাহিরে যেতে পারবে না।”

নীলা বেগমকে কখনো ‘না’ বলাটা এই বাড়ির বড়ো ছেলের ধাতে নেই। সে অনেকটাই মা ভক্ত সন্তান। তাই নীরবে মা’য়ের পিছুপিছু রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিপুন আরো কিছুক্ষণ একা একা বারান্দার রেলিঙে বানরের মতো ঝুলে থেকে অবশেষে ক্লান্ত ভঙ্গিতে রুমে ফিরে যায়।

__________

আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই দেরি হলো স্নেহার বাড়ি ফিরতে। পড়ানো শেষে সে বাজার করতে গিয়েছিল। নিজের পছন্দসই টুকটাক সবজি এবং দুটো লাল মুরগী কিনেছে সে। খাবারের খোটা শুনেও সে-ই বাসার খাবার নিজের মুখে তোলার মতো বেহায়া স্নেহা নয়৷ এই-যে বাজার করে আনলো, এগুলো একান্ত তার জন্যই সে এনেছে। নিজে রান্না করে, নিজেই খাবে। কারো কথা হজম করার মতো সহনশীল নয় সে।

বাসায় ফিরে হাতের বাজার গুলো রান্নাঘরে রাখতে রাখতে স্বভাবসুলভ কঠিন স্বরে সে জানিয়ে দেয়,

“রাত সাড়ে নয়টায় এখন থেকে আমি রান্নাঘরে ঢুকবো। এর আগে যার যা রান্না করার তা করে যেন রান্নাঘরটা আমাকে দুই ঘন্টার জন্য খালি ছেড়ে দেওয়া হয়। তাছাড়া এখন থেকে আমার খাওয়ার বাজার এবং রান্না আমি-ই করবো। তাই বাসায় যেন কেউ কষ্ট করে পাঁচ সদস্য সংখ্যার জন্য বাজার না করে। কথাগুলো আমি দ্বিতীয়বার রিপিট করবো না।”

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে খুন্তি নাড়াতে ব্যস্ত মোমিনা বেগমের কানে পৌঁছায় প্রতিটা বাক্য। তিনি টু শব্দও করেন না। নিজের মতো রান্না করতে থাকেন। স্নেহার পিতা আমিনুল সাহেব চিরকাল বোবা প্রকৃতির ব্যক্তি৷ বড়ো মেয়ের কথা তার কানেও পৌঁছেছে। তবে সবসময়ের মতো নীরব রয়ে তিনি টিভিতে খবর দেখতে থাকেন। গায়ের জামা বদলানোর পূর্বে স্নেহা বাসা থেকে বেরিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ায়। ছাদে নাড়া নিজের কাপড়গুলো প্রতিদিন বাসায় ফিরে তারই নিয়ে আসতে হয়। বহুবছর ধরে এমনটাই হয়ে আসছে৷

__________

গরম দিনের শেষে মৃদু শীতল হাওয়া বইছে। ছাদের দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলতেই রাতের আকাশ পানে এক মুহূর্তের জন্য তাকায় স্নেহা। অতঃপর ছাদের এককোণে গিয়ে নিজের কাপড়গুলো নামাতে থাকে। হুট করে সে লক্ষ্য করে ছাদের অন্য কোণ হতে কিছু একটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। স্নেহা সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়। কাপড়গুলো দড়ির উপর জবুথবু করে রেখে সে নিঃশব্দে এগিয়ে যায় অন্ধকার কোণে শব্দের উৎস খুঁজতে। কিছুটা সামনে যেতেই সে লক্ষ্য করে একটা লম্বা চওড়া ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ওখানটায়। এক হাতে তার একটা পলিথিন ব্যাগ, যেটার ভেতর রয়েছে সাদা পাউডার। অপর হাতে কার্ড জাতীয় কিছু একটা। ছায়ামূর্তিটা সে-ই কার্ডের সাহায্যে পলিথিন হতে পাউডার তুলে নাকের কাছে নিয়ে সেটার গন্ধ টানছে বারবার। মাঝেমধ্যে জিভও ছোঁয়াচ্ছে। কেমন অদ্ভুৎ আবেশে চোখ বন্ধ করে শ্বাসও নিচ্ছে।

স্নেহার খুব একটা কষ্ট হয় না সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বুঝে নিতে। সে চোখেমুখে রাগ এবং ঘৃণা নিয়ে কঠিন স্বরে ডাকে,

“সামিউল!”

অসময়ে বড়ো বোনের কণ্ঠ শুনে সামিউল ভড়কে যায়। চকিতে হাতের পলিথিনটা ছাদের মেঝেতে ফেলে দিয়ে পাশ ফিরে তাকায়। এই স্বল্প আলোতেও লক্ষ্য করে স্নেহার অগ্নিদৃষ্টি। স্নেহা সেকেন্ড দুয়েক সামিউলকে দেখে নিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবেই ছাদ থেকে প্রস্থান করে। সামিউল তখনও একটা ঘোরের মাঝে আটকে আছে। ধরা পড়ে যাওয়ার ফলস্বরূপ কিছুক্ষণের জন্য তার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছিল। কিন্তু হুশ ফিরে পেতেই সে দ্রুত ছুটে যায় স্নেহার পিছুপিছু। স্নেহা ততক্ষণে বাসায় এসে পৌঁছে মোমিনা বেগম এবং আমিনুল সাহেবকে তাদের ছেলের কাণ্ডকীর্তি সম্পর্কে বলতে শুরু করেছে।

সামিউল তখনই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে। বোনকে বসার ঘরে মা বাবার কাছে সবটা খোলাসা করতে শুনে চেঁচিয়ে উঠে,

“মিথ্যা বলছো কেন তুমি? আমার নামে অপবাদ কেন দিচ্ছো? মা’য়ের কথার ঝাল তুলছো আমার উপর দিয়ে?”

স্নেহা চোখ রাঙিয়ে বলে,

“একটা চটকানা দিয়ে তোর সবগুলো দাঁত ফেলে দিবো, গাঞ্জাখোর কোথাকার। আমি মিথ্যা বলছি? এই তুই এদিকে আয়… এদিকে আয়…”

ধমক দিয়ে কথা বলতে বলতে স্নেহা সামিউলের ঘাড় ধরে একটান মেরে মা বাবার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,

“আমার কথা বিশ্বাস না করলে ওর মুখের কাছে গন্ধ শুকে দেখেন। দেখেন অমানুষটা কেমন কুলাঙ্গারদের মতো কাজ কারবার শুরু করেছে। নিজেরাই দেখেন…”

মোমিনা বেগম এতক্ষণ স্নেহার কথাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও, এ-ই মুহূর্তে কী ভেবে যেন সামিউলের মুখের কাছে নিয়ে সামান্য ঘ্রাণ শুকলো। সঙ্গে সঙ্গে উনার পেট গুলিয়ে বমি পায়। আমিনুল সাহেবেরও বুঝতে বাকি থাকে না ছেলের সম্পর্কে অভিযোগটা যে সত্য সে-ই সম্পর্কে। মোমিনা বেগম রাগে ছেলেকে দু চারটা থাপ্পড় মেরে এবং গালমন্দ করে বলে উঠে,

“নষ্ট ছেলেপেলেদের সঙ্গে মিশে নিজেও নষ্ট হইছিস!”

স্নেহার ভারী বিরক্ত লাগে। মোমিনা বেগম এরকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছেলের দোষ কাটাতে চাইছেন। ওদিকে শায়না সকলের চেঁচামেচি শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। চোখে মুখে ভয় এবং আতংক তার। স্নেহা তাকে লক্ষ্য করে ধমকায়,

“এখানে কী? রুমে যা। দরজা লাগিয়ে দিয়ে পড়তে বস।”

বোনের এক ধমকে বারো বছরের শায়না দ্রুত রুমের ভেতর চলে যায়। স্নেহা এবার সরাসরি কঠিন স্বরে জানায়,

“আপনাদের ছেলেকে দেখে বিকারগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছিলো আমার। কুকুরের মতো জিভ দিয়ে চেটে ওইসব ছাইপাঁশ মুখে নিচ্ছিলো। ওকে রিহ্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।”

মোমিনা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়,

“রিহ্যাব-টিহ্যাবে পাঠানো হবে না। এইসব বয়সের দোষ। বাসায় দুইদিন টাইট দিলেই ঠিক হইয়া যাইবো।”

স্নেহা চরম মেজাজ খারাপ নিয়ে বলে,

“ভুলেও ওকে ছাড় দেওয়ার কথা ভাববেন না। এসব মাদকাগ্রস্ত বাসায় পালার দুঃসাহস দেখাবেন না৷ ঘরে আমি আছি, শায়না আছে। এসব কুলাঙ্গারদের হুশ থাকে না। এর সঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকার প্রশ্নই আসে না।”

মাদকদ্রব্যের প্রভাবে সামিউলের চোখ দুটো কিছুটা লালচে এবং ঘোলাটে দেখাচ্ছে। শরীরে অনুভব করছে উত্তপ্ত তাপমাত্রা। স্নেহার বলা কথাগুলো তার বিষের মতো লাগে। নিজের মেজাজটা ধরে রাখতে পারে না। নিজের খোলসটা উন্মোচন করে কুৎসিত রূপটা প্রকাশ করে চিলের মতো ছুটে গিয়ে স্নেহার গলা চেপে ধরে অশ্রব্য গালাগালি দিতে দিতে বলে,

“তোর জিভ টাইন্যা ছিঁড়া ফালামু আমি। আমার ঘরের থেইক্যা আমারে বাইর করতে চাস? আমি কুলাঙ্গার? তুই কী তাহলে? তুই একটা…”

স্নেহা অন্যায় অথবা বেয়াদবি সয়ে নেওয়ার মতো মেয়ে নয়। সে এক ধাক্কা মেরে সামিউলকে সরিয়ে দেয়। ধাক্কার প্রকোপে পিছিয়ে গিয়ে দরজার কোণার সঙ্গে হাতের কনুইয়ে আঘাত লাগে সামিউলের। সে হয়ে উঠে আরো বেপরোয়া, আরো হিংস্র। তার উপর যেন দানবীয় শক্তি ভর করেছে। ফের তেড়ে এসে সরাসরি স্নেহার গালে সজোরে থাপ্পড় লাগিয়ে, তার চুলের মুঠো ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির ন্যায় এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। মোমিনা বেগম এবং আমিনুল সাহেব ঘটনার আকস্মিকতায় বাকহারা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিস্ময়তা কাটিয়ে মোমিনা বেগমই প্রথম এগিয়ে এসে ছেলেকে টেনে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। উনার ধমকে আমিনুল সাহেবও এসে ছেলেকে জাপ্টে ধরে সরিয়ে আনে। সামিউল তখনও গালাগালি দিয়েই যাচ্ছে।

দানবীয় চড়টার আঙুলের ছাপ স্নেহার বাম গালে যেন বসে গিয়েছে। এলোপাথাড়ি মাইরের চোটে কখন যে তার ডান কানের ছোট্ট রিং আকৃতির দুলটায় টান লেগেছে তা অজানা৷ সেই টান লাগার ফলস্বরূপ কানের ওখানটা অনেকটা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। মোমিনা বেগম এই পরিস্থিতি দেখে ঘাবড়ালেন। সামিউলকে ছেড়ে এসে স্নেহাকে ধরে বললো,

“আমি পরিষ্কার করে দেই।”

স্নেহার চোখেমুখে ব্যথা অথবা যন্ত্রণার ভাব নেই। বরং আগের তুলনায় যেন আরো বেশি ক্রোধ এসে ভর করেছে তার উপর। সে মোমিনার কাছ থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আমিনুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ওকে কী রিহ্যাবে পাঠানো হবে?”

আমিনুল সাহেবের হয়ে উনার স্ত্রী-ই জবাবটা দিলেন,

“ঘরের কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানানোর ইচ্ছে জেগেছে? ছোট মানুষ, ভুল করেছে, শাসন পেলে ঠিক হয়ে যাবে। মাত্র এই বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে, এসব করে ওর পড়াশোনার ক্ষতি করো না।”

স্নেহা তবুও উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রয় নিজের পিতার দিকে। সময় গড়ায়। কিন্তু আমিনুল সাহেবের তরফ থেকে কোনো উত্তর আসে না। আজও উনি বোবার ভূমিকাই পালন করেন। উনার এই নীরবতা যে মোমিনা বেগমের কথার সঙ্গে একমত প্রকাশ করা সূচক তা নিজ বোধশক্তি দিয়ে বুঝে নেয় স্নেহা। সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না। নিজের রুমের দরজা ঠেলে গিয়ে ব্যাগটা কাধে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। মোমিনা বেগমের পিছু ডাকেও সে থামে না। আজকের এ-ই ঘটনা এবং অন্যায়ের জবাবটুকু সে একদম মেপে সম্পূর্ণটা দিবে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]