নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৩.
রাত তখন প্রায় দশটা বাজে। সাভার মডেল থানার অফিস কক্ষে নিজস্ব টেবিলের ওপাশে থাকা চেয়ারটায় বসে আছেন ওসি মনিরুল। চেয়ারটা সামান্য পিছনে ঠেলে টেবিলে পা তুলে বসে আছেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে। হাতে আধখাওয়া সিগারেট। ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কন্সটেবল মারুফ। কাঁচা ঘুমে তার দু-চোখ লাল হয়ে আছে। তবে হাতে গরম চায়ের কাপ নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ওসি মনিরুল হঠাৎ কী ভেবে যেন বলে উঠেন,
“নতুন এএসপি সম্পর্কে কী কিছু জানতে পেরেছো, মারুফ?”
সজাগ স্বরে সঙ্গে সঙ্গে কন্সটেবল জবাব দেয়,
“আমার কানে এসেছে আজ দুপুরে নাকি উনি আশুলিয়া থানায় গিয়ে বিভিন্ন ফাইলপত্র চেক করছিলেন। কেউ-ই কিছু জানতো না। থানায় না-কি একটা থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।”
ওসি মনিরুল বিরক্তি নিয়ে বলে,
“এতো বছর ধরে চাকরি করছি, কোনো সার্কেল অফিসারকে এতো খুঁটিনাটি নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে দেখি নি। অথচ এই নতুন অফিসার প্রথম দিন এসেই কাউন্টার চেক করছে! কখন জানি এখানেও এসে হানা দেয়। আগান না জানিয়ে আসলে আরেক মুসিবত! আমাদের এখন সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকতে হবে।”
কন্সটেবল মারুফ চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে আড়চোখে তাকায় ওসির পানে। টেবিলের উপর এক ঠ্যাং তুলে রেখে এতো সতর্ক বাণী আওড়ালে কোনো লাভ আছে? আল্লাহ না করুক, এএসপি যদি এখনই এসে থানায় হাজির হয়? ওসি মনিরুল এর মাঝেই প্রশ্ন করে বসেন,
“অফিসারের নামটা যেন কী?”
ঠিক সে-ই মুহূর্তে অফিস কক্ষের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে এক যুবক। পরনে তার একটা ছাই রঙা শার্ট এবং কালো প্যান্ট। শার্টটা ভদ্রলোকের মতো প্যান্টের ভেতর টাক ইন করে রাখা। লোকটার বয়সটা বোধহয় ত্রিশের ঘরে হয়তো। ওসিকে পরখ করে নিয়ে রাশভারী স্বরটা প্রশ্ন করে,
“ওসি মনিরুল?”
মনিরুল বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,
“কে? পরিচয় কী? কী চাই?”
সদ্য প্রবেশ করা ভদ্রলোক শান্ত স্বরে উত্তর দেয়,
“অয়ন মাহমুদ৷ নিউ এএসপি অফ সাভার সার্কেল।”
ওসিকে ক্ষানিকটা বিব্রত দেখায়। ভদ্রলোকের ভাবসাবে মনে হচ্ছে তিনি মিথ্যা বলছেন না। ওসি সঙ্গে সঙ্গে একলাফে নিজের পা টেবিল থেকে নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দ্রুত বলে উঠে,
“আসসালামু আলাইকুম। স্যার, আপনি? এই সময়? স্যার, আপনি আসবেন আমার জানা ছিল না৷ আমি দুঃখিত, আপনাকে সিভিল গেটাপে দেখে চিনতে পারি নি। আমি আসলে… স্যার, পায়ের রগটা টান খেয়েছিল… তাই আমি একটু পা-টা তুলে…”
এতো ব্যাখ্যা শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করে না অয়ন। সরাসরি বলে উঠেন,
“পরিদর্শনে এসেছি আমি৷ কে, কীরকম কাজ করে সেটাই দেখতে এসেছি। তাছাড়া বিগত তিনদিনের জিডিগুলোও দেখতে চাই।”
ওসি সমাদর করে বলেন,
“আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আপনি প্লিজ বসুন, স্যার। আমি চা পানির ব্যবস্থা করছি। এই, মারুফ। স্যারের জন্য এক্ষুনি এক কাপ স্পেশাল চা নিয়ে এসো গরম গরম।”
মারুফকে ব্যস্ত দেখালো। সে দ্রুত হাতের ঠান্ডা চায়ের কাপটা নিয়েই দরজা ঠেলে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার সময় দরজাটা টেনে আটকে দিতে বেমালুম ভুলে যায়। ঠিক তখনই অয়ন দরজার ফাঁক গলে লক্ষ্য করে থানায় প্রবেশ করেছে এক রমণী। অফিস রুমের ভেতর থেকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তার শোচনীয় স্থিতি। হালকা আকাশি রঙের থ্রি পিস পরিহিত রমণী বাহিরে এক কন্সটেবলকে কিছু জিজ্ঞেস করছে। অয়ন তা লক্ষ্য করে ওসি মনিরুলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“উনার কী সমস্যা জেনে আসুন।”
ওসি মনিরুল দ্রুত আদেশ পালনে লেগে পড়েন। উনি রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে সে-ই রমণীর সঙ্গে এক মিনিট কিছু কথা বলে রুমে ফিরে আসেন। অয়নকে জানান,
“স্যার, মামলা করতে এসেছেন। ভায়োলেন্স কেস।”
অয়ন নীরবে ওসির আসনটায় গিয়ে বসতে বসতে বলে,
“উনাকে আসতে বলুন।”
মনিরুল আবারও বেরিয়ে যায়। এবার ফিরে আসে সে-ই রমণীকে সঙ্গে নিয়ে। অয়ন লক্ষ্য করে রমণীর দৃঢ় ভঙ্গিতে সে-ই দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করাটা। ডান কানের পাশটা রক্তাক্ত, গালেও স্পষ্ট আঘাতের দাগ অথচ চোখে মুখে অদ্ভুৎ কাঠিন্য। অয়ন দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে হাতে ইশারা করে টেবিলের ওপাশের একটা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বলে,
“বসুন।”
সামনের একটা চেয়ার দখল করে মেয়েটা বসে পড়তেই অয়ন মনিরুলকে বলে,
“উনার জন্য পানি নিয়ে আসতে বলুন।”
মনিরুল বেরিয়ে যেতেই অয়ন এবার দু-হাতের কনুই টেবিলের উপর রেখে প্রশ্ন করে,
“আপনার নাম?”
চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কঠিন নারী স্বরটা জবাব দেয়,
“স্নেহা তাসমিয়া।”
পেশাদারি দায়িত্বশীল পুরুষ কণ্ঠটা জানতে চায়,
“কী ঘটেছে আপনার সঙ্গে?”
“আমার ছোট ভাই সামিউল হাবীব আমার গায়ে হাত তুলেছে। ভ্যারব্যালি এবং ফিজিক্যালি আমাকে এবিউজ করেছে। আমি ওর নামে মামলা করতে চাচ্ছি।”
অয়ন আরেকফা লক্ষ্য করে মেয়েটাকে। এবিউজিং কেসে মামলা করতে এসে কোনো নারী এতটা সাবলীল অথচ দৃঢ় কণ্ঠে কথা বলতে পারে, এরকম দৃশ্য তার আগে কখনো দেখা হয় নি। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জানতে চায়,
“আপনার ছোট ভাইয়ের এরকমটা করার পিছনে কোনো কারণ আছে? ঝগড়া বিবাদ জাতীয় কিছু? অথবা অন্য কোনো কারণ?”
“হি ইজ এ ড্রাগ এডিক্ট। ওকে হাতেনাতে ধরেছি আজ আমি। বাসায় সকলের সামনে এক্সপোজ করেছি ওকে। সে-ই সঙ্গে জানিয়েছি ওকে যেন রিহ্যাবে পাঠানো হয়৷ একজন নেশাখোরের সঙ্গে একই বাসায় থাকতে আমার ঘোর আপত্তি আছে। রিহ্যাবে পাঠানোর কথা বলাতে বিকারগস্তটা ক্ষেপেছে। হুশ হারিয়ে হি এট্যাকাড মি। প্রথমে গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধের চেষ্টা করেছে। ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ায় রেগে গিয়ে আবারও আমাকে এট্যাক করে। এলোমেলো ভঙ্গিতে অগণিত আঘাত করে আমাকে। সে-ই সঙ্গে বিভিন্ন অশ্রব্য কথাবার্তা বলতে থাকে। ও যে ড্রাগ এডিক্ট সেটা ডোপ টেস্ট করলে প্রমাণ পেয়ে যাবেন। এবং আমাকে করা ফিজিক্যালি এবিউজের প্রমাণ আপনার সামনেই আছে। আর কিছু জানার আছে আপনার?”
কাটকাট ভঙ্গিতে বলা কথাগুলো এবং শেষে পাল্টা ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের ভঙ্গিমাটা অয়নের পুরোপুরি মনোযোগ আকর্ষণ করে এবার। সে কিছু বলার পূর্বেই ওসি মনিরুল কন্সটেবল মারুফের সঙ্গে রুমে প্রবেশ করে। কন্সটেবলের হাতে একটা ট্রে। সে দ্রুত অয়নের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গরম ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপটা টেবিলে রাখলো। সঙ্গে রাখলো বিস্কুটের একটা প্যাকেট। সঙ্গে আনা এক গ্লাস পানিটা স্নেহার সামনে রাখলো। মনে মনে অয়ন কিছুটা বিরক্তবোধ করলো। সে এসব খাতির আপ্যায়নের ফরমায়েশ করে নি। উপরন্তু নিজ সমস্যা নিয়ে উপস্থিত নারীর সামনে এরকম আপ্যায়ন পাওয়াটা তার অস্বস্তির কারণ হলো। নিজের বিরক্তিটা চেপে গিয়ে অয়ন স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“আপনি প্লিজ পানি খেয়ে নিন।”
স্নেহা স্পষ্ট বলে,
“নো থ্যাংকস।”
অয়ন আর জোর করে না। বরং ওসি মনিরুলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“উনার কেসটা হ্যান্ডেল করছি আমি। আপনি কোনো মহিলা স্টাফকে ডেকে দিন। উনার প্রাথমিক চিকিৎসাও প্রয়োজন দ্রুত।”
মনিরুল বেরিয়ে যেতেই স্নেহার জিডি লেখার কাজটুকু অয়নই সামলে নেয়। জিডিতে বিস্তারিত বিবরণ লেখার সময় অয়ন অবাক হয় যখন শুনে আঘাতকারী ছেলেটার বয়স ১৮ এর নিচে। আজকালকার কিশোররা এতটা বেপরোয়া! তবে বিষয়টা যে পুরোপুরি অবাস্তব না সেটাও অয়ন ভালো করেই জানে। ইতিপূর্বে বগুড়ায় পোস্টিং থাকা অবস্থায় সে একটা মাদক চক্রের কেস সামলেছে। ওই কেসে জড়িত বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে গুলোই ছিল কিশোর কিশোরী। অয়নের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার এই পথে হেঁটে এরা কী মজাটা পায় কে জানে!
জিডি লেখা শেষে অয়ন ফাইলটা এবং হাতের কলমটা স্নেহার দিকে এগিয়ে দেয়। স্নেহা নিজের স্বাক্ষর, ঠিকানা এবং মোবাইল নম্বরটা জায়গামতো লিখে দিতেই ওসি মনিরুলকে প্রবেশ করতে দেখা যায়। সঙ্গে রয়েছে একজন মহিলা অফিসার। অয়ন এবার স্নেহাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আপনি উনার সঙ্গে হসপিটালে যান। দ্রুত ফার্স্ট এইড করান। ডক্টরের দেওয়া মেডিক্যাল ডকুমেন্টস গুলো নিজের সঙ্গে রাখবেন। খুব বেশি অনিরাপদ অনুভব করলে আজ রাতটা আপনার কোনো আত্মীয়র বাসায় কাটান। আগামীকাল আপনি সকালে আটটার পরে এসে আপনার জিডির কপিটা বুঝে নিবেন। পুলিশ অতিদ্রুত ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবে। চিন্তা করবেন না।”
স্নেহা কেবল সামান্য মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে তার চারিপাশটা যেন দুলে উঠে। নিজের ভর সামলাতে সে চকিতে একহাতে টেবিলের এককোণ ধরে দাঁড়িয়ে পড়ে। অয়ন পেশাদারিত্বের জায়গা থেকেই চিন্তিত হয়ে দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে,
“ঠিক আছেন আপনি?”
স্নেহার অবস্থা দেখে মহিলা স্টাফটাও দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে ধরে। স্নেহার মাথাটা তখনও যেন মৃদু ঘুরছে। তার মনে পড়ে যায় গতরাতের ঘটনার পর আজ সকালে সে বাসায় নাস্তা করে নি। ক্যাম্পাসে গিয়েও নাস্তা করার সুযোগ পায় নি। লাঞ্চ টাইমে লাইব্রেরী ঘুরে কিছু নোটস ফটোকপি করানোর কারণে দুপুরেও খাওয়ার সুযোগ পায় নি। অতঃপর রাতে বাসায় ফিরে তো সে বসার সুযোগটুকুও পেল না। সবমিলিয়ে কি দাঁড়ালো? গতরাত থেকেই স্নেহা অভুক্ত আছে। এই কারণেই তো তার সব সয়ে যাওয়া শরীরটা হঠাৎ শক্তির অভাবে এরকম নাটক করা শুরু করেছে। স্নেহা সামান্য মাথা নেড়ে বলে,
“ঠিক আছি।”
অয়নের তবুও স্নেহার শরীরের হাবভাব সুবিধার মনে হয় না। সে হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে মনিরুলকে বলে,
“গাড়ি বের করতে বলুন। আমিও উনার সঙ্গে যাচ্ছি। বাইক সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম, সেটা বাহিরে রইল। কাল বিকালে এসে আজকের অসমাপ্ত কাজটুকু দেখবো। সব জিডিগুলোর ফাইল রেডি রাখবেন।”
কথাটুকু বলেই অয়ন মহিলা অফিসার ফাতিমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“উনাকে নিয়ে চলুন।”
__________
সাভার উপজেলা স্বাস্হ্য কমপ্লেক্স। রাত তখন এগারোটার উপর বাজে। ফাঁকা হয়ে থাকা করিডোরটা দিয়ে দায়িত্বশীল ভঙ্গিতে স্নেহার পাশে হাঁটছে অয়ন। স্নেহা চুপচাপ আছে। মুখে কোনো কথা নেই, চোখে কোনো কান্নার ভাব নেই। ডান কানে রক্তের রেখা। কান থেকে ঘাড় এবং ঘাড় থেকে কাধ হয়ে তার কামিজের কাধের অংশটা রক্তে ভিজে আছে। এই পথটুকু হাঁটার সময় স্নেহা অনুভব করে যে এই রক্ত এবং গালে থাপ্পড়ের ছাপটুকু তাকে তীব্র অপমানিত বোধ করাচ্ছে। নিজের ছোট ভাইয়ের হাতে এই আঘাত পাওয়াটা তার কাছে অপমান তুল্যই।
ইমারজেন্সি রুমের সামনে পৌঁছাতেই অয়ন দরজা ঠেলে ধরে রাখে স্নেহার জন্য। স্নেহা এবং মহিলা অফিসার নীরবে প্রবেশ করতেই অয়ন কেবল একজন নার্সকে ডেকে বলে,
“লেসারেশন ইঞ্জুরি। উনাকে জরুরী চিকিৎসাটুকু দিন। প্রয়োজনীয় ড্রেসিংও করে দিন দ্রুত। সে-ই সঙ্গে উনার একটা মেডিক্যাল রিপোর্ট দরকার। ভায়োলেন্স কেস। কোনো ডক্টরকে বলুন দ্রুত কাগজটা রেডি করে ফেলতে। আমি বাহিরেই অপেক্ষা করছি।”
ইমারজেন্সি ইউনিটের বাহিরে সটান দাঁড়িয়ে থাকা অয়ন নিজের পকেট থেকে ফোনটা বের করে। প্রিয় নাম্বারটা ডায়াল করে বাসায় জানিয়ে দেয় যে তার ফিরতে দেরি হবে। কলে কথা বলার মাঝেই ইমারজেন্সি রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে যায় একজন নার্স। সামান্যতম সময়টুকুতে অয়ন লক্ষ্য করে হসপিটালের সিঙ্গেল বেডটায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে স্নেহা। বিভিন্ন ধরনের তরল মেডিসিন, তুলো, কাঁচি ইত্যাদির সাহায্যে তার ড্রেসিং চলছে। অয়ন অবাক হয়ে দেখে তুলোর সাহায্যে লাগানো এন্টিসেপ্টিকের জ্বালাপোড়াও এই মেয়েকে দূর্বল করতে পারছে না। অয়ন নিজ মনেই ভাবলো, মেয়েটা কী উন্মাদ?
__________
ড্রেসিং শেষ হয়ে যেতেই ডক্টর স্নেহার মুখের দিকে তাকায়। অফিসার ফাতিমার মুখে উনি শুনেছেন যে মেয়েটার মাথা ঘোরাচ্ছে এবং শরীর দূর্বল বোধ করছে। স্নেহার শুকনো মুখটা পর্যবেক্ষণ করে মহিলা ডাক্তারটা প্রশ্ন করে,
“কতক্ষণ ধরে না খাওয়া?”
স্নেহা আড়চোখে অফিসার ফাতিমার দিকে তাকায়। ফাতিমা কেমন আগ্রহী দৃষ্টি মেলে ওকেই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। উনার সামনে অস্বস্তিবোধ করলেও স্নেহা ডাক্তারকে সত্যিটাই বলে,
“গতরাত থেকে।”
অফিসার ফাতিমা কেমন বিস্মিত স্বরে বলেন,
“ওহ মাই গড!”
ডাক্তার স্নেহার প্রেশার চেক করে তার শুকনো মুখটা দেখে নিয়ে বলে,
“খাওয়া দাওয়া নেই, ডিহাইড্রেশন, শরীর দূর্বল, মাথা ঘুরানো, প্রেশার লো। এক্ষুণি একটা স্যালাইন চড়াতে হবে। একঘন্টা সময় লাগবে। স্যালাইন শেষে বাসায় যেতে পারবে। বাসায় গিয়ে কিছু খেয়ে ঘুমিও।”
বাসার নাম শুনতেই স্নেহার ধ্যান ফিরে। বাসায় ফেরার আগ্রহ খুঁজে পায় না সে। ওই পুলিশটা যেন কী সাজেস্ট করেছিল? কোনো আত্মীয়ের বাসায় যেতে? স্নেহার তো ঢাকা শহরে কোনো আত্মীয় নেই। স্নেহার আসলে কেউই নেই। আপাতত নিজের ওই বাসা বাদে যাওয়ার জায়গায়ও নেই। তবে সে নিজের বন্দোবস্ত করতে জানে। স্নেহা অফিসার ফাতিমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আপনি যেতে পারেন। আমি নিজের খেয়াল রাখতে জানি। আগামীকাল থানায় যাবো নি জিডির কপি নিতে।”
অফিসার প্রশ্ন করে,
“তোমার স্যালাইন শেষ হলে বাসায় ড্রপ করে দিয়ে যাই?”
“উঁহু, অসুবিধা নেই। আমি আজকে রাতে এখানেই থেকে রেস্ট করবো। কোথাও ড্রপ করার প্রয়োজন নেই।”
অফিসার ফাতিমা অবাক হয়ে বলে,
“সারারাত হাসপাতালে থাকবে?”
“অসুবিধা তো দেখছি না।”
ফাতিমা স্নেহাকে আর না ঘাটিয়ে ইমারজেন্সি রুম থেকে বেরিয়ে আসে। বাহিরে অপেক্ষমান অয়ন জানতে চায় স্নেহার শারীরিক স্থিতি সম্পর্কে। ফাতিমা গড়গড় করে বলতে শুরু করে,
“কানের ড্রেসিং করা হয়েছে, স্যার। মেয়েটাকে এক ঘন্টার জন্য স্যালাইন দেওয়া হবে। গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে না খেয়ে দূর্বলতা এবং মাথা ঘুরানো জুটিয়েছে। স্যার, মেয়েটা ভারী অদ্ভুৎ! বলছে আজ রাতে নাকি হসপিটালে থাকবে।”
অয়ন কিছুটা অবাক হয়। এক ঘন্টার স্যালাইনের জন্য সারারাত হসপিটালে থাকার মানে কী? স্নেহার এই মাত্রারিক্ত জেদ, শীতলতা এবং গাম্ভীর্যই হয়তো অয়নকে প্রয়োজনের তুলনায় আগ্রহ ধারণে এবং দায়িত্ব পালনে বাধ্য করে। সে অফিসারকে চলে যেতে বলে একা কিছুক্ষণ করিডর ধরে হাঁটাহাঁটি করে। কী ভেবে যেন একটা স্টাফ বয়কে দিয়ে কিছু প্যাকেটজাত খাবার এবং পানীয়ও আনায়। সে-সব এবং কিছুটা দ্বিধা নিয়েই সে দরজা ঠেলে প্রবেশ করে ইমারজেন্সি রুমে। সরকারি কমপ্লেক্সের একটা সাদামাটা বেডে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসেই ঝিমুচ্ছে স্নেহা। হাতে লাগানো ক্যানোলার সহয়তায় শরীরে প্রবেশ করছে স্যালাইন। এরকম অবস্থায়ও মেয়েটার বসার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সামান্য মূর্ছে গেলেও সে ভাঙ্গে নি। নিজের অপ্রয়োজনীয় ভাবনাকে পাশ কেটে গিয়ে অয়ন আস্তে করে বেডের পায়ের কাছে হাতের পলিব্যাগটা রাখলো। একজনকে নার্সকে ডেকে বলে দিলো,
“উনাকে ডেকে সোজা হয়ে ঘুমাতে বলুন। যেকোনো সময় ঘুমের ঘোরে পড়ে যেতে পারেন উনি। এবং স্যালাইন শেষ হলে উনাকে ডেকে খেয়ে নিতে বলবেন কিছু।”
বলেই অয়ন একপলক স্নেহার পানে তাকায়। তার কেন যেন মনে হলো এই মেয়ে অয়নের টাকায় কেনা জিনিস মুখে তুলবে না। তাই সে নার্সকে বলে দেয়,
“উনাকে বলবেন নিশ্চিন্তে খেতে, খাবারটা ফ্রী এর নয়। আমাকে পরে একশো নিরানব্বই টাকা ফিরিয়ে দিতে বলবেন। আপাতত ঋণ রইল।”
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]