নীড়বৃষ্টি পর্ব-০৪

0
2

নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৪.

নিশুতি রাতের নিস্তব্ধতা কেটে ভোরের আলো আভা ছড়াতে শুরু করেছে। হসপিটালটাও ধীরে ধীরে পুরোদমে সরব হয়ে উঠছে। সে-ই শব্দেই স্নেহার চোখ ধীরে ধীরে খুলে গেল। শরীরের দূর্বলতা অনেকটাই কেটে গিয়েছে। সে হাই তুলতে তুলতে উঠে বসে। কুচকানো চোখ মেলে তাকায় চারিপাশে। আশেপাশের বেড গুলোর পেশেন্টগুলোকে একদফা দেখে নিয়ে সে বিছানা ছেড়ে নামে। নিজের চুলগুলো হাত খোপা করে নিয়ে ওড়নাটা দিয়ে ভালো করে ঘাড় কাধ ঢেকে নিলো। কামিজের কাধের ওখানের রক্তাক্ত অংশটা এই দিনের আলোয় মানুষের চোখে পড়লে দেখতে বিদঘুটে লাগবে। নিজের ব্যাগটা কাধে তুলে নিতে গিয়েই স্নেহা লক্ষ্য করলো বিছানার একপাশে রাখা আধখাওয়া বিস্কুটের প্যাকেটটা। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ে গেলো একশো নিরানব্বই টাকা ঋণের কথা। আজই থানায় গিয়ে জিডির কপি নেওয়ার সময় ওই এএসপিকে তার টাকা ফিরিয়ে দিয়ে আসবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো স্নেহা। তবে থানায় যাওয়ার আগে তার একবার বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। জামা বদলে, গোসল করে, ক্যাম্পাসে যাওয়ার আগে না-হয় সে থানা থেকে ঘুরে যাবে। স্নেহা হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলো। সকাল ছয়টা বাজতে তিন মিনিট বাকি। আজকে তার সাড়ে নয়টায় একটা ক্লাস আছে। অর্থাৎ ক্লাসের আগেই চটপট তার সব কাজ সেড়ে ফেলতে হবে। সময় অপচয় না করে স্নেহা হসপিটালের বিল মিটিয়ে রওনা হয় বাসার উদ্দেশ্যে।

ফজরের নামাজ পড়ে এবং নাস্তা সেড়ে আমিনুল সাহেব কাজের জন্য বেরিয়ে গিয়েছেন সবে। গতরাতের ঝড়ের পর থেকে বাড়ির পরিবেশটা এখনো বেশ থমথমে। মোমিনা বেগমের দুঃশ্চিন্তার চোটে আর ঘুম হলো না। গতরাত থেকে স্নেহা বাড়ি ফিরে নি। মোমিনা বেগম এবং আমিনুল সাহেব বেশ অনেকবার ফোন করেছেন। কিন্তু অসভ্য, বেয়াদব, চণ্ডাল মেয়েটা ফোন রিসিভ করে নি। মোমিনা বেগমের স্নেহার জন্য আলাদা বিশেষ টান অথবা চিন্তা নেই। উনার সকল চিন্তা নিজেদের জন্য। এই মেয়ের কিছু একটা হয়ে গেলে মানুষ উনাদের দায়ী করবে। মোমিনা বেগমের নিকট স্নেহা হলো গলায় আটকে থাকা কাঁটার মতো একটা আপদ। কবে যে এই কাঁটাটা দূর হবে কে জানে!

আপাতত মোমিনা বেগমের মাথায় আরেকটা চিন্তাও ঘুরপাক খাচ্ছে। সামিউলটাকে কীভাবে সুপথগামী করা যায় সেই চিন্তা! মাদকে আসক্ত হয়ে যাওয়াটা কোনো ভালো বিষয় নয়। ওই অসভ্য মেয়ের ভরসা নেই। সামিউলকে রিহ্যাবে পাঠানোর ব্যাপারে অসম্মতি জানানোর শোধ তুলতে যদি ওই মেয়ে এলাকায় সকলকে বলে বেড়ায়, যে সামিউল একটা নেশাখোর? ভয়ংকর ব্যাপার! শায়না বড়ো হলে ওকে পাত্রস্থ করার জন্য হলেও অন্তত নিজেদের পরিবারের ইমেজ ক্লিন রাখাটা খুবই জরুরী। আমিনুল সাহেবের তো এতো টাকা নেই, যে উনি টাকা দিয়ে মেয়েকে ভালো ঘরে তুলে দিতে পারবেন! এরকম মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ভালো ঘরে বউ হয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হলো রূপ, গুণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং একটা ক্লিন পারিবারিক ইমেজের। কপাল গুণে শায়নার গায়ের রঙটা স্নেহার মতো এতো চাপা নয়! পড়াশোনার প্রতিও মনোযোগ আছে মেয়েটার। এখন বাকিটুকু দেখার দায়িত্ব মোমিনা বেগমের।

গভীর ভাবনার রেশ কাটে কলিংবেলের শব্দে। মোমিনা বেগমের ধ্যান ভাঙ্গে। মনে মনে ভাবে এই সময় আবার কে এলো? আমিনুল সাহেব না-কি? ফোনটা কী বাসায় ফেলে গেলো? মনের মধ্যে ঘুরপাক করতে থাকা প্রশ্নগুলো নিয়েই মোমিনা বেগম দরজা খুলেন। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা স্নেহাকে দেখে তিনি কিছুটা অবাক হোন। সবার আগে তিনি লক্ষ্য করেন স্নেহার ডান কানের ড্রেসিংটাকে। স্নেহা অবশ্য মোমিনা বেগমকে বিশেষ পাত্তা দিলো না। সে পাশ কেটে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। মোমিনা বেগম দরজা লাগিয়ে দিয়ে পিছু এসে রাগী স্বরে জানতে চায়,

“সারারাত কই ছিলা? আমি আর তোমার বাবা কতবার কল দিছি, খেয়াল আছে? কলটা রিসিভ করো নাই কেন?”

স্নেহা টেবিলের ধারে দাঁড়িয়ে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে উত্তর দেয়,

“আপনাকে জবাবদিহিতা করার প্রয়োজন মনে করছি না।”

মোমিনা বেগম আরো রেগে যান। তারস্বরে বলেন,

“বেয়াদব, ফাজিল কোনহানকার। খুব পাংখা গজাইছে তোমার? দুইদিন হইলো না ভার্সিটিতে আসা যাওয়া শুরু করেই পাংখা গজাই গেছে? আমাকে জবাব দিবে না তো কাকে দিবে? আমার বাসায় দাঁড়ায়, আমার সঙ্গে ফাজলামো করো?”

স্নেহা ঢকঢক করে পানিটুকু গিলে নেয়। বাড়তি প্যাঁচাল তার অপছন্দ। তাছাড়া আপাতত কারো সঙ্গে প্যাঁচাল পারার মতো হাতে খুব একটা সময়ও নেই। তাই সে শীতল স্বরে সংক্ষিপ্ত করে জবাব দেয়,

“আমার উপর অধিকার ফলাতে আসবেন না কখনো। ভুলে যাবেন না, আপনি আমার মা নন। অনাধিকার চর্চা আমার একটুও সহ্য হয় না।”

নিজের কথা শেষ করে স্নেহা রুমে চলে যায়। মোমিনা বেগম থম মেরে দাঁড়িয়ে রয়। উনার ব্যাপারে একটা গোপনীয় সত্য হলো, কোনো এক অজানা কারণে উনি স্নেহার অত্যাধিক নীরবতা এবং রাগকে খুব ভয় করে চলেন। উনার ধারণা এই মেয়েটা ঠান্ডা মাথায় দু চারটা খুন করেও নির্লিপ্ত থাকতে পারা দলের মানুষ। এইমাত্র স্নেহার বলে যাওয়া কথাটা জবাব ছিল নাকি হুমকি কে জানে! মোমিনা বেগম আর ঘাটায় না স্নেহাকে। জাহান্নামে যাক এই মেয়ে৷ কার কী আসে যায়?

__________

বাসা থেকে গোসল করে বেরিয়েছে স্নেহা। ভাগ্য ভালো যে আসার আগে সামিউলের মুখ দেখতে হয় নি তার। সকাল সকাল ওই ছেলেকে দেখলেই তার মেজাজ চটে যেতো! সাভার মডেল থানার সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ায় স্নেহা। থানায় প্রবেশের পূর্বে নিজের খোলা চুলগুলো সামনের দিকে এনে কানের ড্রেসিংটা ঢাকার চেষ্টা করলো। স্নেহার মধ্যে নিজেকে সুন্দর দেখানোর কোনো প্রবণতা নেই। সে কেবল চাচ্ছে না তার ব্যান্ডেজ দেখতে মানুষ বারবার তার দিকে ফিরে তাকাক। অহেতুক মানুষের থেকে মনোযোগ পাওয়াটা কেন যেন তার হজম হয় না। থানার ভেতর প্রবেশ করতেই স্নেহা অফিসার ফাতিমাকে দেখতে পেলো। তাই সে এগিয়ে গিয়ে উনাকেই জিজ্ঞেস করলো,

“আমাকে আজকে সকালে এসে জিডির কপিটা নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। কোথা থেকে সংগ্রহ করতে হবে? আমার তেমন একটা ধারণা নেই থানা সম্পর্কে।”

ফাতিমা স্নেহাকে এক দেখায়ই চিনতে পারে। সে নিজের মিশুক স্বভাবটুকুর কারণে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে,

“কী অবস্থা তোমার? এখন কেমন আছো? কানে ব্যথা আছে?”

স্নেহা না চাইতেও কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে। ভদ্রমহিলা তাকে এসব প্রশ্ন করছে কেন? স্নেহার সঙ্গে তো উনার কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে? এরকম খোঁজ খবর নেওয়ার মানুষ স্নেহার কোনো কালেই ছিল না। তাই এরকম স্বাভাবিক একটা ব্যাপারও তাকে কেমন দ্বিধায় ফেলে দিলো। তবুও নিজের অস্বস্তিকে পাশ কাটিয়ে সে জবাব দেয়,

“জি, ভালো।”

ফাতিমা এবার স্নেহাকে এক পাশের একটা বেঞ্চিতে বসতে দিয়ে বলে,

“বসো তুমি। আমি জিডির কপি পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। তোমার ভাই পরে আর হাত তুলেছে গায়ে?”

স্নেহা মাথা নেড়ে কেবল না উত্তর দেয়। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না তার। তবে ফাতিমা যেতে নিলেই তার হুট করে কিছু একটা মনে পড়ে। সে চকিতে প্রশ্ন করে,

“উনি আছেন?”

ফাতিমা ঘুরে তাকিয়ে অবাক হয়ে জানতে চায়,

“কার কথা জানতে চাইছো?”

ভদ্রলোকের নাম স্নেহার জানা নেই। তাই সে ভেঙে বলে,

“গতকাল যিনি আমাদের সঙ্গে হসপিটালে গিয়েছিলেন। এএসপি অফিসার সম্ভবত। উনি আছেন?”

“ওহ, স্যারের কথা বলছো? উনার তো বিকেলে থানায় আসার কথা। এখন উপস্থিত নেই। কেন? কোনো কাজ আছে?”

স্নেহা আর টাকার ব্যাপারটা খোলাসা করলো না। বিকেলে এসে নাহয় সে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। আপাতত সে না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। অফিসার ফাতিমা চলে যায়। স্নেহা একা বসে নির্লিপ্ত দৃষ্টি মেলে দেখতে থাকে থানার অসহ্যকর পরিবেশটাকে। জীবনে চলার পথে যে কখনো তাকে থানায়ও আসতে হবে, কে জানতো!

__________

মাথার উপরের ফ্যানটা ঘুরছে আপন গতিতে। বই থেকে চোখ তুলে নিতুন তাকায় এসিটার পানে। চল্লিশ মিনিট হয়ে গিয়েছে কারেন্ট নেই। আইপিএস এর দরুণ ফ্যান, লাইট চললেও এসিটা কারেন্ট ব্যতীত চলে না। কী এক মুসিবত! এসি ছাড়া নিতুনের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে আসছে। ফ্যানের বাতাসও যথেষ্ট মনে হচ্ছে না তার। কেমন তড়তড় করে ঘামছে! নিতুনের পাশের চেয়ারে বসা স্নেহা লক্ষ্য করে তার অমনোযোগী আচরণ। স্নেহা কপাল কুচকে প্রশ্ন করে,

“এসির দিকে বারবার তাকাচ্ছো কেন? অংকের সূত্র ভুলে গিয়েছো? এসি এসে তোমার অংক করে দিবে?”

নিতুনের মনটা উদাস। কিছুটা দুঃসাহসিক আচরণ করে সে বললো,

“মিস, আপনার মনে হয় না পড়াশোনা একটা লস প্রজেক্ট? একদিন তো মরেই যাবো। অহেতুক জীবনের পঁচিশটা বছর পড়াশোনার পিছনে খরচ করা কি যৌক্তিক? ধরুন আমি আগামীকাল মরে গেলাম। কবরে মুনকার নাকির এসে আমাকে যে-ই তিনটা প্রশ্ন করবে সেটার উত্তর তো আমার জানাই আছে। ওরা তো আমার পরীক্ষার রেজাল্ট শিট দেখতে চাইবে না। তাহলে কী লাভ এতো পড়াশোনার? পয়সার অপচয়, সময় অপচয় এবং ব্রেইনের স্টোরেজের অপচয়।”

স্নেহার মেজাজ খারাপ হয়। আলালের ঘরের দুলালদের এসব আজাইরা আলাপ তার অসহ্যকর লাগে। ইচ্ছে হয় স্কেলের আঘাতে পিটিয়ে এদের মানুষ বানাতে। কিন্তু আপাতত গরমে তার দুই হাতের তালু ঘামছে। এই অবস্থায় স্কেল হাতে তুলতে ইচ্ছে হলো না তার। তাই কেবল থমথমে গলায় বললো,

“আজাইরা পকপক না করে অংক শেষ করো।”

নিতুন অংক করলো না। হাতের কলমটা খাতার উপর রেখে দিয়ে মিসের দিকে ঘুরে বসলো। উদাস চোখ মেলে তাকিয়ে বললো,

“মিস, আজকে একটু আজাইরা পকপক করি? আই প্রমিজ আগামীকাল এই সব অংক হোমওয়ার্ক দেখাবো আপনাকে। আসলে আমার মন খুব খারাপ। কিন্তু আমার মন খারাপকে বাসায় কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে আমি ডিপ্রেশনে ভুগছি। চ্যাট জিপিটির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একবার জানতে পেরেছিলাম যে ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। আমিও ইদানীং নিজের মধ্যে সেই প্রবণতা লক্ষ্য করছি। কিন্তু কাজটা করতে পারছি না। এর অবশ্য কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো আব্বু। আমি ভুলক্রমে আত্মহত্যা করতে গিয়ে বেঁচে ফিরলে আব্বু আমার পিঠে গাছের ডাল ভাঙবে। দ্বিতীয় কারণ হলো আমার বড়ো ভাই। আমি মরে গেলে বাবার সব সম্পত্তি ভাইয়া পেয়ে যাবে। আমি আমার ভাগের সম্পত্তি কক্ষনো ভাইয়ার জন্য রেখে মরতে চাই না। তৃতীয় কারণ হলো মুসলিম হিসেবে আত্মহত্যা করা মহাপাপ। মরে যাওয়ার পর আমাকে জাহান্নামের গরম কড়াইয়ে ফ্রাই করা হবে। তাছাড়া সবথেকে বড়ো কারণ হলো মরে যাওয়া একটা কষ্টকর প্রক্রিয়া। আমার এতো সাহস নেই।”

স্নেহা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তাকিয়ে শুনলো নিতুনের সকল কথা। মরে যাওয়ার সাহস নেই অথচ আত্মহত্যার বুলি আওড়ায়! এই নাটকীয় পোকাটা যে গেমস এবং ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না স্নেহার। সে টেবিলে এক হাত তুলে গালে হাত রেখে অনুভূতিশূন্য স্বরে জানতে চায়,

“আচ্ছা, তারপর?”

মিসের তরফ থেকে পাত্তা পেয়ে নিতুন নড়েচড়ে বসলো। বেশ আগ্রহ নিয়ে বলতে শুরু করে,

“মিস, তো আমি যেটা বলছিলাম। পড়াশোনা হলো একটা স্ক্যাম। কীভাবে স্ক্যাম বুঝিয়ে বলছি। আমরা পড়াশোনা কেন করছি? একটা চাকরি জুটিয়ে, টাকা কামাই করে জীবিকা নির্বাহ করতে। মানে জীবিকা নির্বাহ করাটা হলো মেইন পয়েন্ট। সেটার জন্য টাকা কামাই করা জরুরী। কিন্তু টাকা কামানোর জন্য পড়াশোনা প্রয়োজনীয় নয়। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের দেখুন। সতেরো বছর বয়সে এইচএসসি পরীক্ষার জন্য খেটে মরছে। অথচ ওদিকে স্প্যানিশ ফুটবলার ইয়ামালকে দেখুন, সতেরো বছর বয়সে চমৎকার ফুটবল খেলে একদম স্টারবয় খেতাব পেয়ে বসে আছে। এই সতেরো বছর বয়সে ও এক মাসে যা ইনকাম করছে, তা এই দেশের শিক্ষিত মানুষের টোটাল বাৎসরিক ইনকামের সমান।”

স্নেহা এবার শীতল গলায় প্রশ্ন করলো,

“তোমার ইয়ামালের মতো ফুটবল স্কিল আছে? অথবা জাস্টিন বিবারের মতো গানের গলা? অথবা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর মতো অভিনয়ের দক্ষতা?”

নিতুন মন খারাপ করে বললো,

“উঁহু।”

স্নেহা আবার প্রশ্ন করলো,

“এটা কী ইউরোপের কোনো উন্নত দেশ, যেখানে পড়াশোনা ব্যতীত বিকল্প পথের ছড়াছড়ি আছে?”

নিতুন আবারও না বোধক উত্তর দেয়। হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পারছে যে সে এতক্ষণ যা বলছিল তা এই দেশের প্রেক্ষাপটে খুব একটা যৌক্তিক ছিল না। স্নেহা এই প্রথম নিতুনকে কিছুটা বুঝানোর সুরে বললো,

“তোমার ক্ষেত্রে জীবিকা নির্বাহের জন্য পড়াশোনা জরুরী নয়, নিতুন। তোমার আব্বু একজন ডিসি। আই এম শিওর ফাইন্যান্সিয়ালি তোমার কখনো কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু পড়াশোনা না করলে তুমি যেটা পাবে না সেটা হলো সম্মান। বাপ দাদাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি ভোগ করে বেঁচে থাকা কোনো সম্মানজনক কাজ নয়। বাকিটা তুমি ভেবে যা ভালো বুঝো, তা-ই করো। তোমার মনযোগ যেহেতু এখন পড়াশোনায় নেই তাহলে আজ আমি আর তোমাকে জোর করছি না। থাকো তুমি। আমি যাই। আন্টি বাসায় আছেন?”

নিতুন দৃষ্টি নত করে জবাব দেয়,

“আম্মু বাসায় নেই। আব্বুও নেই। ভাইয়া আছে শুধু।”

স্নেহা মাথা নেড়ে বলে,

“ওহ, আচ্ছা।”

__________

স্নেহা নীরবে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। নিতুনও পিছু পিছু এসে মিসকে বাসার দরজা অব্দি পৌঁছে দেয়। নিচে গেট খোলাই আছে তাই সে আর সঙ্গে করে নিচে গেলো না। স্নেহা ক্লান্ত ভঙ্গিতে সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে। হুট করেই সে ক্লান্ত অনুভব করছে। তা-ই ইচ্ছে করেই আজ নিতুনকে দ্রুত ছুটি দিয়ে দিলো। নীলা বেগমের সঙ্গে তার কথা ছিল। কিন্তু ভদ্রমহিলা যেহেতু বাসায় নেই তাই সে অহেতুক আর কথা বাড়ায় নি। বাসা থেকে বেরিয়ে উঠোনে পা রাখতেই স্নেহা লক্ষ্য করলো কারো উপস্থিতি। উঠোনের উত্তর পাশটায় থাকা বাইকের পাশে এক হাঁটু গেড়ে বসে আছে কেউ। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বাইকের চাকা পরীক্ষা করছে। পরনে তার হালকা আকাশি রঙা শার্ট এবং কালো প্যান্ট। স্নেহার দিকে পিঠ করে থাকায় মুখটা স্পষ্ট দেখার সুযোগ হলো না। স্নেহার মনে পড়ে গেলো নিতুন একটু আগেই বলেছিল যে তার ভাই শুধুমাত্র বাসায় আছে। তবে এটাই কী সে-ই ভাই? এ-ই দামড়া লোকটা ওই একটুখানি টিংটিঙে নিতুনের বড়ো ভাই?

স্নেহা একবার ভাবলো চলে যাবে নীরবে। কিন্তু পরক্ষণেই তার নিতুনের ভাবনা মাথায় এলো। মনে মনে বিরক্তি নিয়েই তাই সে বাধ্য হয়ে ডাকলো,

“বাবু সাহেব, একটু শুনবেন?”

ডাক কানে পৌঁছাতেই অদূরের লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মুখটা দেখে স্নেহা অল্প বিস্তর অবাক হয়। স্নেহাকে দেখে অবাক হয় অপর ব্যক্তিটাও। বিস্মিত ভঙ্গিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ায় স্নেহার মুখোমুখি। অপ্রত্যাশিত স্বরে বলে,

“আপনি!”

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]