নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৫.
লম্বা, সুঠামদেহী লোকটার গায়ের গরন মেদহীন তবে রঙটা উজ্জ্বল। ছাঁটানো চুল এবং পরিষ্কার শার্ট প্যান্টে গায়ে ফুটে উঠেছে একটা পরিপাটি ভাব। লোকটার পুরো চেহারায় সবথেকে আকর্ষণীয় দিকটা হলো তার দীঘির মতো গভীর, টলটলে দুটো চোখ। পরিচিত মুখটা দেখে স্নেহা অবাক হলেও সেটাকে খুব একটা প্রকাশ করলো না। বরং মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে সরাসরি প্রশ্ন করে,
“আপনি বাবু সাহেব? নিতুনের বড় ভাই?”
বিস্মিত লোকটা জবাব দেয়,
“আমি নিতুনের ভাই। কিন্তু বাবু সাহেব কে?”
স্নেহার চোখে সন্দেহর রেশ। সে ভ্রু কুচকে বলে,
“আপনি বাবু সাহেব নন? আন্টি তো সেদিন আপনার নাম বাবুই বললো। নিতুনও তো নিজের বড়ো ভাইকে বাবু ভাইয়াই ডাকে।”
কথাটা বলতে বলতে স্নেহার মুখে আরো বিতৃষ্ণা ছড়িয়ে পড়লো। যেন এতো দামড়া একটা লোকের এমন নাম দেখে সে বেজায় বিরক্ত। নাম বিভ্রাটের ঘটনা বুঝতে পেরে লোকটা কিছুটা লজ্জা পেলো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতেই বললো,
“বাবু আমার নাম নয়। বাসায় সকলে এই নামে ডাকে। আমার আসল নাম অয়ন মাহমুদ। গতকাল দেখা হলো না আমাদের? আমাকে চিনতে পারেন নি? এএসপি অয়ন মাহমুদ? থানা থেকে হসপিটাল? মনে পড়েছে?”
স্নেহার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে অয়নের বলা প্রথম তিনটি বাক্যই যথেষ্ট ছিল। শেষে বাড়তি খাতির দেখানো বাক্যগুলো স্নেহার বিশেষ পছন্দ হলো না। সে অয়নকে খুব একটা পাত্তাও দিলো না। বরং নিজের যা বলার ছিল গলা ঝেড়ে তা বলতে শুরু করে,
“নিতুনের ব্যাপারে কথা বলার ছিল। আন্টিকে বাসায় পেলে উনাকেই জানাতাম আমি। যেহেতু উনি নেই, তাই আপনাকে বলে যাচ্ছি। আপনার ভাই সেধে সুইসাইডিক্যাল ব্যাপারে আলোচনা করতে বসেছে আজ আমার সঙ্গে। যদিও আমি বুঝতে পেরেছি, ও সিরিয়াস নয়। তবুও জানিয়ে রাখাটা জরুরী মনে হয়েছে বলে জানাচ্ছি। ভাইয়ের দিকে খেয়াল রাখুন। জগতের উদ্ভট সব ভাবনা ছেড়ে যেন পড়ায় একটু মন দেয়। ওর মতো উদাস, খামখেয়ালি ছেলে আমি দুটো দেখি নি। খুবই অমনোযোগী!”
ভাইয়ের ব্যাপারে নালিশ শুনে অয়ন আগ্রহী ভঙ্গিতে জানতে চায়,
“আপনি কী নিতুনের হোম টিউটর?”
অদ্ভুৎ লোক তো! কমন সেন্স কী নেই না-কি? এরকম আক্কেল নিয়ে পুলিশ কীভাবে হলো এই দামড়া বাবু? নিশ্চিত ডিসি বাপ টাকা দিয়ে ছেলের চাকরি করিয়ে দিয়েছে। স্নেহা কণ্ঠে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
“জি।”
“বেশ!”
কিছু মনে পড়তেই স্নেহা দ্রুত নিজের ব্যাগটা খুলে নিয়ে ওয়ালেট বের করে। দুটো একশো টাকার নোট বের করে অয়নের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনার টাকা রাখুন।”
অয়ন একবার নোট দুটো দেখে নিয়ে বলে,
“এখানে দুইশো টাকা আছে। আমার তো একশো নিরানব্বই টাকা পাওনা ছিল। এক টাকা বেশি দিচ্ছেন কেন?”
গরমের মাঝে খোলা উঠোনে সূর্যের উত্তপ্ত তাপের ভেতর দাঁড়িয়ে থেকে এতো কথা বলতে বিরক্ত লাগছে স্নেহার। সে এবার কণ্ঠে কিছুটা ঝাঁঝ মিশিয়েই বললো,
“বাড়তি এক টাকা কৃতজ্ঞতা সরূপ রাখুন। এক টাকার এ্যালপেনলিবে কিনতে পাওয়া যায়। কিনে খেয়ে নিয়েন।”
অয়নকে চিন্তিত দেখালো। সে বলে,
“উঁহু, এক টাকাও বেশি নেওয়া সম্ভব নয়। ন্যায্য পাওনার বাহিরে এক টাকা বেশি নেওয়াটা অন্যায়। আইনের লোক হয়ে আমি বেআইনি কাজ করতে পারবো না।”
অয়নের কথার পিঠে স্নেহা এক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর সে তীব্র তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে,
“মশকরা করেন? জীবনে সুদ ঘুষ খান নি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন? ভালো প্রচেষ্টা।”
অয়ন অবাক হয়ে বলে,
“আপনার সঙ্গে আমি মশকরা কেন করবো? সুদ ঘুষ খাই নি সেটার প্রমাণও বা আপনাকে কেন দিতে যাবো? আমি তো শুধুমাত্র সত্যি বললাম।”
স্নেহার ধৈর্য্য হয় না কথা বাড়ানোর। লোকটা খুবই বিরক্তিকর। কথা টেনে লম্বা করে। এরকম লোক স্নেহার মোটেও পছন্দ নয়। তারই আসলে ভুল হয়েছে যে সে এই লোককে ডাক দিয়েছিল। সে-ই ভুলে স্নেহা পস্তাচ্ছেও। নিজের কথার ইতি টানতে তাই সে বিরক্ত হয়ে বলে,
“বেশ! আপনি আপনার আইন নিয়ে থাকুন। আমি তাহলে চললাম।”
বলেই স্নেহা গেটের দিকে পা বাড়াতে নিলে অয়ন পিছন থেকে প্রশ্ন করে উঠে,
“আপনি এখন কেমন আছেন? গতকালের তুলনায় সুস্থ বোধ করছেন? দূর্বলতা কেটেছে?”
অয়ন স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই প্রশ্ন গুলো করেছে। তবে সে-ই প্রশ্ন শুনে স্নেহার পা জোড়া থেমে যায়। আজ এসব কী হচ্ছে তার সঙ্গে? সবাই তার ভালো মন্দ নিয়ে প্রশ্ন কেন করছে? স্নেহা তো এসবে অভ্যস্ত নয়। এই থানার মানুষগুলো কী তাকে করুণার দৃষ্টিতে দেখছে? স্নেহা মোটেও করুণা গ্রহণের পাত্রী নয়। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। পিছনে না ফিরেই সে হনহনিয়ে হেঁটে বেরিয়ে যায় গেট দিয়ে। অয়ন বোকার ন্যায় একা দাঁড়িয়ে থাকে। এটা কী হলো? নিতুনের মিস কী তার প্রশ্ন শুনতে পারেন নি? কানের পর্দাতেও সমস্যা হলো না-কি মেয়েটার? কে জানে!
__________
উদাস বিকেল বেলা তখন। মা’য়ের চোখ রাঙানিকে অগ্রাহ্য করে সামিউল তৈরী হয়েছে এলাকার রাস্তায় ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার জন্য। বন্ধুরা তার অপেক্ষায় আছে। মা সকাল থেকে কানের কাছে প্যানপ্যান করে যাচ্ছে। কিন্তু সামিউল থোড়াই কেয়ার করে না-কি? ব্যাটটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হতেই কলিংবেলের শব্দ শুনে সে। মোমিনা বেগম রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। কলিংবেলের শব্দে কিছুটা কৌতূহলী দেখাচ্ছে উনাকে। এ-ই সময় তো কারো আসার কথা নয়। বেকুব সামিউল কিছু জিজ্ঞেস না করেই গিয়ে ফট করে দরজাটা খুলে দেয়। মোমিনা বেগম ততক্ষণে মাথায় ওড়না তুলে নিয়েছেন। দরজাটা খুলতেই সামিউল চমকে যায়। কপালে ঘাম জমা হতে শুরু করে তার। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে চারজন পুলিশ কর্মকর্তা। তাদের সঙ্গে রয়েছে সিভিল ইউনিফর্ম পরিহিত একজন ভদ্রলোক। সামিউলকে সেখেই তিনি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে জানতে চান,
“সামিউল হাবীব?”
সামিউল ভীত স্বরে প্রশ্ন করে,
“আপনারা?”
সিভিল ইউনিফর্ম পরিহিত লোকটা কোনো ভনিতা না করে সরাসরি বলেন,
“আমি এএসপি অয়ন মাহমুদ। আপনার বিরুদ্ধে থানায় জিডি করা হয়েছে। নারী নির্যাতন এবং মাদকে আসক্ত হওয়ার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে আপনার নামে। সেটার তদন্ত করতেই এসেছি আমরা। আমাদের সঙ্গে কো অপারেট করুন।”
মোমিনা বেগম স্পষ্ট শুনলেন সব। উনার বুঝতে বাকি নেই এসব কার কাজ হতে পারে। তিনি দ্রুত এগিয়ে এসে ছেলেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলেন,
“কীসব বলছেন? আপনাদের হয়তো কোনো ভুল হচ্ছে। আমার বাচ্চা ছেলে নারী নির্যাতন করবে কেন? মাদকই বা কেন সেবন করবে? ওকে দেখে মাদকাসক্ত মনে হয়?”
অয়ন এক মুহূর্তের জন্য নিগূঢ় দৃষ্টি মেলে পরখ করে সামিউলের চেহারা এবং হাবভাব। ছেলেটার চোখ মুখের ভয়, আতংক তার দৃষ্টি এড়ায় না। পূর্বেও মাদকের কেস সামলেছে সে। তার অভিজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি এক দেখাতেই বুঝতে পারে সত্যটা। সে স্পষ্ট গলায় জবাব দেয়,
“জি, দেখে মাদকাসক্তই মনে হচ্ছে। বাকিটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দিন।”
সামিউল কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে প্রশ্ন করে,
“কে জিডি করেছে আমার নামে?”
অয়ন শান্ত গলায় জবাব দেয়,
“মিস স্নেহা তাসমিয়া।”
সামিউলের চোখে দপ করে ক্ষোভ ফুটে উঠে। এতো সাহস? সামিউলের নামে থানায় অভিযোগ করে? মনে মনে ফুসতে শুরু করে সামিউল। এই অকৃতজ্ঞ মেয়ের সাহসের শেষ অব্দি সে দেখে ছাড়বে। অয়ন সামিউলের কটমট মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে বলে,
“আপনার বোনের গায়ে যে আপনি হাত তুলেছেন সেটার প্রমাণ এবং মেডিক্যাল স্টেটমেন্ট কপি আমাদের কাছেই আছে। আপনার চোখে মুখেও মাদকাসক্তির ভাব আছে। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদের তদন্ত করা প্রয়োজন। আমাদের কাজে বাঁধা দিবেন না। সড়ে দাঁড়ান।”
ছোট খাটো নিরিবিলি বাসাটায় প্রবেশ করে একে একে পুলিশ সদস্যরা। সকলেই একেক রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে তদন্ত কাজে। সামিউল আতংকিত ভঙ্গিতে একজন পুলিশের পিছু পিছু চলে যায় নিজের বেডরুমটায়। মোমিনা বেগম সাধারণ দশটা নারীর মতন আহাজারি জুড়ে দিয়ে পুলিশদের বলতে থাকেন যে উনার ছেলে নির্দোষ। এএসপি অয়ন যে-ই বেডরুমটায় প্রবেশ করে, সে-ই রুমের পড়ার টেবিলে বসে পড়ছিল শায়না। আচমকা অপরিচিত কারো অনুপ্রবেশে সে ভড়কে যায়। ভীত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। অয়ন বাচ্চাটার ভীত ভাব কাটাতে বলে,
“ভয়ের কিছু নেই। আমি একটু রুমটা ঘুরে দেখতে এসেছি। এক্ষুণি চলে যাবো।”
বলেই অয়ন রুমটায় একদফা চোখ বুলায়। রুমের পরিপাটি গোছগাছের ধরণ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা মেয়েদের রুম। মিস স্নেহা এই রুমে থাকেন বোধহয়। অয়ন রুমটা দেখতে দেখতে শায়নাকে প্রশ্ন করে,
“আপনি স্নেহা তাসমিয়ার কে হোন?”
শায়না শুনতে পাচ্ছে রুমের বাহির হতে মা এবং ভাইয়ের চেঁচামেচি। সে ভীত গলায় জবাব দেয়,
“বোন।”
অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় শায়নার পানে। ভারী অদ্ভুৎ ব্যাপার! এই বাড়ির একটা মানুষের সঙ্গেও দেখি স্নেহা ম্যাডামের চেহারা মিলে না। কি অদ্ভুৎ! এতো গোলগাল চেহারার ভীড়ে মিস স্নেহার ফেসকাটটা এতো শার্প হলো কী করে? নিজের ভাবনাকে পাশ কেটে অয়নের মনে অন্য আরেকটা প্রশ্ন জাগে। সে কিছুটা কোমল স্বরে শায়নাকে প্রশ্ন করে,
“গতকাল সম্ভবত আপনাদের বাসায় কোনো ঝামেলা হয়েছিল। আপনার আপু কিছুটা আহত হয়েছেন। আপনি এ-ই ব্যাপারে কিছু জানেন? কিছু দেখেছেন? কীভাবে ব্যথা পেলো বা কিছু?”
শায়নাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখায়। তার কী সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত? কিন্তু আম্মু যদি বকে? কিন্তু সত্য না বললেও তো অসুবিধা। আজ ইসলাম এবং নৈতিক শিক্ষা ক্লাসে স্যার বলেছেন যে, মিথ্যাবাদীকে মৃত্যুর পর অনেক ভয়ংকর ভয়ংকর সাপ এসে কামড়ায়। সাপের কামড় খাওয়ার থেকে আম্মুর মাইর খাওয়া ঢের ভালো। তাই শায়না ফট করে বলে দেয়,
“আমি রুমের দরজা ফাঁক করে লুকিয়ে দেখেছি। ওরা সবাই ঝগড়া করছিলো। হুট করে ভাইয়া আপুকে অনেক জোরে জোরে মারতে শুরু করে। চুল ধরে, থাপ্পড় মারে, ঘুষিও মারে। আপু পরে বাসা থেকে বেরিয়ে চলে যায়।”
স্নেহার গালে, কানে মাইরের চিহ্নটা দেখা গেলেও শক্তপোক্ত প্রমাণ হিসেবে একজন সাক্ষীর প্রয়োজন ছিল। শায়নার দরুন সেই সাক্ষটুকু পেয়ে গেলো অয়ন। প্রশ্নটুকু করার আগে সে কৌশলে নিজের ফোনের অডিও রেকর্ডারটা অন করে নিয়েছিল। শায়নার সাক্ষ পুরোটুকুই রেকর্ড হয়ে গিয়েছে। এখন আর চিন্তা নেই। এই স্টেটমেন্ট রেকর্ডিং করে রাখার পিছনে একটা কারণ আছে। পরবর্তীতে অনেক কেসেই দেখা যায় প্রয়োজনের সময় সাক্ষী অন্যের চাপে পড়ে নিজের মন্তব্য পেশ করতে কার্পণ্য করে। তাই অয়ন সবসময়ই চেষ্টা করে সকল কেসে এরকম বিভিন্ন প্রমাণ নিজের হেফাজতে রাখতে। অয়ন ফোনটা নিজের পকেটে ভরে রাখতেই পাশের রুম থেকে চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পায়। অয়ন দ্রুত কদমে পাশের রুমে যেতেই দেখতে পায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটা কলেজ ব্যাগ উল্টে ধরে ঝাকাচ্ছেন। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন বই, খাতা, কলম। সেসবের মাঝেই দৃশ্যমান ছোট ছোট দুটো সাদা জিপলক ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর থাকা সাদা গুড়ো জাতীয় বস্তুটা যে কী হতে পারে তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। অয়ন কেবল শীতল দৃষ্টি মেলে তাকায় সামিউলের পানে। সামিউল তখন ভীত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলছে,
“এসব আমার না। আমি জানি না এগুলো কার। আমি কিছু করি নি। কসম, স্যার। আমি কিছু করি নি।”
এগারো হাজার টাকা দামের ফোনটা ইদানীং বেশ ঝামেলা করছে। হুটহাটই ফোনের চার্জ শেষ হয়ে স্নেহাকে ঝামেলায় ফেলে দিচ্ছে। এইতো আজ সন্ধ্যা বেলায়ও কী এক কাজে ফোন বের করে স্নেহা দেখে যে ফোন ডেড হয়ে আছে। কী এক মুসিবত! এই এতো ঝামেলার মাঝে এখন এই ফোনের মুড সুইংও হজম করতে হবে স্নেহাকে। অথচ একটা জ্বলজ্যান্ত মেয়ে মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তার মুড সুইং প্রকাশ করার সুযোগ নেই। সবই কপাল!
__________
বাসায় ফিরে কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে অপেক্ষারত স্নেহার কপালে ক্লান্তির ভাজ। এই কুত্তামরা গরমে প্রতিদিন বাসার বাহিরে যাওয়াটা একটা অসহ্যকর ব্যাপার। কিন্তু জীবনের তাগিদে নিত্যদিন অসংখ্য মানুষকে এরকম শরীরের মায়া ত্যাগ করে রোদে পুড়তে হয়। স্নেহার ভাবনার মাঝেই বাসার দরজাটা খুলে গেলো। দরজার ওপাশে শায়নাকে অশ্রুসিক্ত চোখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্নেহা কেমন সন্দিহান দৃষ্টি মেলে বাসায় প্রবেশ করে। অন্যদিনের তুলনায় বাসার পরিবেশটা বেশ থমথমে আজ। বাবা টিভির সামনে বসে নেই। শায়নার মা রান্নাঘরে খুন্তি নাড়ছেন না। সামিউলের রুমের দরজাটাও পুরোপুরি চাপানো। ঘরে আছে কি-না বুঝার উপায় নেই। স্নেহা আন্দাজ করতে পারে ঘরে কোনো একটা কাহিনী অবশ্যই হয়েছে। সে রুমে ফিরে ব্যাগটা রাখতে রাখতে তার পিছু পিছু আসা শায়নাকে প্রশ্ন করে,
“মাইর খেয়েছিস?”
শায়না কাঁদতে কাঁদতেই উপর নিচে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দেয়। এই গরমের মাঝে নিজের কানের ড্রেসিং এবং গালের চড়ের দাগ ঢেকে রাখতে স্নেহা চুল ছেড়ে সামনে এনে রেখেছিল সারাদিন। এখন রাখঢাকের ঝামেলা নেই বলেই সে সবার আগে চুলগুলোকে উঁচু করে খোপা করে ঘেমে যাওয়া ঘাড়টাকে একটু বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসের সংস্পর্শে আসার সুযোগ করে দিলো। আরাম করে বিছানার এককোণে জিড়িয়ে নিতে বসে শায়নাকে প্রশ্ন করে,
“বাসায় কী হয়েছে?”
শায়না নাক টেনে নিয়ে জবাব দেয়,
“বিকেলে পুলিশ এসেছিল বাসায়। ভাইয়ার রুমে কী যেন পেয়েছে! একটা পুলিশ বলে গিয়েছে ভাইয়াকে কোথায় যেনো পাঠাতে হবে। এ নিয়ে বাসায় অনেক তুফান গিয়েছে। পুলিশরা চলে যাওয়ার পর আম্মু রাগে আমাকে এবং ভাইয়াকে খুব মেরেছে।”
স্নেহা বুঝে যায় ঘটনার মূলমর্ম। সে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সত্যি বলতে গতকাল জিডি করলেও পুলিশদের উপর তার খুব একটা আস্থা কাজ করছিল না। ভেবেছিল তার জিডিপত্রটাও বুঝি একটা সময় থানার পুরনো ফাইলের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে যাবে। অথবা ভেবেছিল অসাধু পুলিশেরা বুঝি তার থেকে বাড়তি অর্থের সন্ধান করবে। যাক, এরকম কিছু হয় নি সেটাই আসল ব্যাপার। পুলিশদের এই সামান্য কর্তব্য পালন নিয়ে এতো খুশি হওয়ার আসলে কিছু নেই। বেশি লাই পেলে এরা মাথায় উঠে নাচবে। কাউকে মাথায় তুলে নাচতে দেওয়া স্নেহার স্বভাব বহির্ভূত কাজ। মাথা থেকে পুলিশদের ঝেড়ে ফেলে স্নেহা বলে,
“ওহ! আচ্ছা। আমি গোসল করে আসি তাহলে।”
কথাটুকু বলেই স্নেহা উঠে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। শায়না বোকার মতো তাকিয়ে রয় আপুর যাওয়ার পানে। আপুর মনে কী একটুও ভয়ডর নেই? এই-যে শায়না আম্মুর মার খাওয়ার ভয়ে রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে, অথচ আপুর মাঝে ভয়ের ছিটেফোঁটাও নেই। কী চমৎকার একটা ব্যাপার! শায়নার কাছে হুট করেই আপুর এই নির্ভীক আচরণ খুব আকর্ষণীয় মনে হয়। মনে মনে সে ঠিক করে বড়ো হয়ে সে আপুর মতো হবে। কাউকে ভয় না পাওয়া স্নেহা আপু হবে সে!
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]