নীড়বৃষ্টি পর্ব-০৬

0
2

নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
৬.

নরম আলোয় ঝকঝকে ডাইনিং টেবিলে নীলা বেগম নিজ হাতে রাতের খাবার সাজাচ্ছেন। ভদ্রমহিলার বাড়ির কাজের প্রতি খুব টান এবং মায়া। তাই ডিসির স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও বাড়তি কাজের লোক ঘরে রাখেন নি তিনি। প্রতিদিন সকালে কেবল একজন ছুটা বুয়া এসে ঘর ঝাড়ু দিয়ে মোছার এবং কাপড় ধুয়ে দেওয়ার কাজটুকু করে দিয়ে যায়। ঠান্ডার সমস্যা থাকায় নীলা বেগম চাইলেও বেশিক্ষণ পানির সংস্পর্শে থাকা কাজগুলো করতে পারেন না। তবে রান্নার ক্ষেত্রে উনি কারো সাহায্য নিতে নারাজ। উনার ভাষ্যমতে রান্নাঘরের মালিকানা কেবল উনার একার। যতদিন না বড়ো ছেলের বউ আসছে ততদিন তিনি এই রান্নাঘর অন্য কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করতে রাজি নন।

আজকের আয়োজনে রয়েছে উনার বড়ো ছেলের প্রিয় খাবার। কাঁঠাল দিয়ে গরুর গোস্ত, আলু দিয়ে কাচকি মাছ এবং কাঁচা মরিচ দিয়ে পটলের ছিকলার ভর্তা। খাবার দাবারের ব্যাপারে অয়ন বেশ শৌখিন। আয়েশ করে মায়ের হাতের বাঙালি খাবার পেলে তার আর কিচ্ছু লাগে না। খাবার সাজানো শেষ হতেই নীলা বেগম গলা উঁচিয়ে ডাকেন সকলকে। তিনটি ভিন্ন রুম থেকে একে একে বেরিয়ে আসে অয়ন, নিতুন এবং তাদের আব্বু ডিসি কামরুল মাহমুদ। টেবিলের কাছে আসতেই নিজের পছন্দসই খাবারের আয়োজন দেখে অয়নের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। কণ্ঠে কিছুটা কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে সে নীলা বেগমকে বলে,

“তুমি শুধু শুধু এতো কষ্ট করলে, আম্মু। কাঁঠাল কাঁটা কী কষ্টকর একটা কাজ! তোমার হাত ব্যথা করছে না?”

নীলা বেগম পরম মমতায় ছেলের গালে হাত রেখে বলে,

“আমার বাবুটার জন্য রান্না করলে একটুও কষ্ট লাগে না আমার। এতদিন বাড়ি থেকে দূরে ছিলে তুমি। কী খেয়েছো, না খেয়েছো কে জানে!”

ডিসি সাহেব চেয়ার টেনে বসতে বসতে সামান্য গলা ঝেড়ে বলেন,

“নীলা, তোমার ছেলে অন্য জেলায় ছিল, অন্য গ্রহে নয়। ওখানে খাবার, দাবার সবই পাওয়া যায়। না খেয়ে থাকেনি ও।”

নীলা বেগম কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

“এই সরকারি চাকরিজীবীদের এজন্যই দুই চোক্ষে সহ্য হয় না আমার। দেখছেন ছেলের সঙ্গে কথা বলছি। মাঝখানে আপনার নিমপাতার মতো মুখ চালানোটা কী খুব জরুরী?”

ডিসি সাহেব নিজ প্লেটে গরম গরম ভাত বেড়ে নিতে নিতে আড়চোখে স্ত্রী’র পানে তাকায়। ভদ্রমহিলার ধমক এই প্রথম হজম করছেন না তিনি। সংসার জীবনের লম্বা সময় ধরে এই মহিলা উনার সঙ্গে স্বৈরাচারী আচরণ করে আসছে। যে-ই কামরুল সাহেবকে থানায় সকলে সমীহ করে চলে, তাকেই কি-না ঘরে ধমকের উপরে রাখেন নীলা বেগম! ছেলেদের সামনে ইজ্জত সম্মানের বালাই নেই। নিতুন খাবার টেবিলে বসতে বসতে নাটকীয় স্বরে বলে উঠে,

“আজ আবারও প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে যে আমাকে তোমরা কুড়িয়ে পেয়েছো।”

নীলা বেগম চোখ পাকিয়ে বলে,

“একটা লাগাবো ধরে। বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে হিংসা করিস? এই, তোকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তোর পছন্দের নাস্তা বানিয়ে খাওয়াই না?”

অয়ন মাঝখানে ফোড়ন কেটে বলে উঠে,

“আম্মু, আজ দুপুরে নিতুনের মিসের সঙ্গে কথা হলো। উনি কমপ্লেইন করে গিয়েছেন। তোমার ছেলে পড়া রেখে মিসের সঙ্গে আধ্যাত্মিক আলাপ জুড়ে বসে না-কি।”

নিতুনের চেহারাটা মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে উঠে। মিসটা এই অঘটন কখন ঘটিয়ে দিয়ে গেলো? আম্মুকে না পেয়ে ভাইয়ার কাছে নালিশ করে গেলো? কী এক মুসিবত! নিতুন ভীত ভঙ্গিতে ঘাড় বাকিয়ে নিজের আব্বুর পানে তাকায়। ডিসি কামরুল সাহেবের মাঝে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তিনি মনযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছেন। মিসের নালিশটা আম্মু আব্বুর কাছে ফাঁস করে দিয়ে অয়নও আয়েশ করে খেতে বসেছে। নীলা বেগমও নীরবে ছেলেদের পাতে খাবার বেড়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খাবার নামে না কেবল নিতুনের গলা দিয়ে। আম্মু আব্বুর এই নীরবতা তো ভালো ঠেকছে না। কখন কোন দিক দিয়ে বিপদ আসবে তা আন্দাজ করতে পারছে না সে। নিতুনের এতো ভাবনার মাঝেই কামরুল সাহেব মৃদু ধমকে বলে,

“খাচ্ছো না কেন?”

সাদা ভাতের উপর লেবু চিপে রস নিয়ে পটলের ভর্তা দিয়ে মেখে খেতে শুরু করে নিতুন। মাথায় ঘুরছে দুঃশ্চিন্তা। আব্বুটা যে কখন এই নালিশের হিসাব তুলবেন, কে জানে?

__________

এএসপি অয়ন মাহমুদের তদন্তে সামিউলের বিরুদ্ধে স্নেহার করা অভিযোগের সত্যতা উঠে এসেছে ইতিমধ্যে। একে তো নারী নির্যাতন কেস যেটার কি-না সাক্ষ্য প্রমাণ মিলেছে, সে-ই সঙ্গে মাদকসেবন কেস এবং সরাসরি বাসা থেকে মাদকদ্রব্য উদ্ধার। সব মিলিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও সামিউলকে এতো সহজে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয় পুলিশের পক্ষে। শুধুমাত্র মারধরের কেস হলে জুভেনাইল জাস্টিস আইন অনুযায়ী সামিউলকে অপরাধী হিসেবে গণণা না করে কেবল কনফ্লিক্টেড চাইল্ড হিসেবে গণ্য করা হতো। সেক্ষেত্রে খুব বেশি হলে হয়তো শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হতো ওকে। কিন্তু যেহেতু মারধরের পাশাপাশি বাসায় মাদকও মিলেছে তাই পুলিশ ব্যাপারটাকে গুরুতরভাবে নিয়েছেন।

মোমিনা বেগমকে অয়ন স্পষ্ট জানিয়ে গিয়েছে হয় সামিউলকে রিহ্যাবে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে, না-হয় সে সকল সাক্ষ্য প্রমাণের সহিত সামিউলের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে দিবে। সে-ই সঙ্গে অয়ন কড়াভাবে সতর্কও করে গিয়েছে যেন স্নেহা তাসমিয়ার গায়ে হাত উঠানোর ব্যাপারে সামিউল সতর্ক থাকে। কারণ জিডিতে স্নেহা নিজের নিরাপত্তা চেয়েও আবেদন করেছে। তাই তার সামান্য ক্ষতি হলে পুলিশ সামিউলকে ছেড়ে দিবে না মোটেও।

অয়নের সতর্কবার্তার কারণেই কি-না কে জানে, তবে বাসায় ফেরার পর থেকে আজ কেউ-ই স্নেহাকে সামান্যতম ঘাটায় নি। স্নেহা নিজের মতো ঘর জুড়ে পায়চারি করছে, রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করছে, নিজের খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে বসছে এবং মোমিনা বেগম নীরবে বসে তা দেখছে। উনার মাথায় দুঃশ্চিন্তার পোকা কিলবিল করছে। ছেলের নামে মামলা হওয়াটা বিশাল একটা ক্ষতি। এই মামলার প্রভাবে সামিউলের ভবিষ্যৎ যদি নষ্ট হয়ে যায়? কিন্তু মামলা এড়াতে হলে পুলিশের কথা মেনে সামিউলের ডোপ টেস্ট করিয়ে তাকে রিহ্যাবে পাঠাতে হবে। নিজের গর্ভে ধারণ করা ছেলেকে ওই জায়গাটায় পাঠাতেও মন মানছে না মোমিনার। বিকাল থেকে তার গলা দিয়ে এক ফোঁটা পানি অব্দি নামে নি। মোমিনার সকল রাগ গিয়ে জমা হয় স্নেহার উপর। মনে মনে মেয়েটাকে কমজাত, বান্দির ঝিঁ, চণ্ডাল সহ নানান গালিতে ভূষিত করেন তিনি। এ-ই অকৃতজ্ঞের বাচ্চাটা যে ওদিন রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এরকম একটা কাজ করবে কে জানতো? জানলে মোমিনা স্নেহাকে কখনো বাড়ির বাহিরে পা রাখতে দিতো না। ডানা ঝাপটে উঁড়তে উঁড়তে মেয়েটা খুব দুনিয়া চিনে ফেলেছে। মোমিনার খুব আফসোস হয়। কেন যে তিনি এই মেয়েটার ডানা গজানোর পূর্বেই কেটে ফেললো না। এই এক ভুলের মাশুল আর কতভাবে দিতে হবে উনার?

ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা মোমিনা বেগম হঠাৎই নড়েচড়ে উঠেন। খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে স্নেহা সামিউলের রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মোমিনা বেগম ডাক দেওয়ার পূর্বেই স্নেহা দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করে। পুলিশ যাওয়ার পর থেকেই সামিউল রুম অন্ধকার করে বিছানায় শুয়ে ছিল। হুট করে কারো বিনা অনুমতিতে প্রবেশ তার চেপে রাখা রাগটার বিস্ফোরণ ঘটায়। একটা নোংরা গালি দিয়ে সে বলে উঠে,

“কে মরতে আসছে?”

স্নেহা ফট করে সুইচ টিপে রুমের লাইটটা জ্বেলে দেয়। কোনো ভনিতা না করে সরাসরি বলে,

“আমার ব্যাগ থেকে আজ অব্দি যত টাকা চুরি করেছিস সব ফেরত দে।”

মোমিনা বেগম ততক্ষণে স্নেহার পিছুপিছু রুমে এসে উপস্থিত হয়েছেন। ছেলের নামে এমন অপবাদ শুনে তিনি চেঁচিয়ে উঠেন,

“আমার পোলারে চোর বলস তুই?”

ফুঁসে উঠে সামিউলও। এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। তারস্বরে চেঁচিয়ে বলে,

“নিজের লাগাম টান। খুব বাড় বেড়েছিস। খুন করে ফেলবো তোকে আমি।”

সামিউলের চেঁচামেচি শুনে পাশের রুম থেকে আমিনুল সাহেব উঠে আসেন। স্নেহা কারো তোয়াক্কা না করে বলে,

“নাটক কম কর। গত তিন মাসে এ-ই পর্যন্ত চারবার আমার ব্যাগ থেকে টাকা গায়েব হয়েছে। উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় কখনো মুখ খুলি নি। এখন তো প্রমাণ আছে। আমার ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে, সে-ই টাকা দিয়ে তুই কী কিনতি তা আমার বুঝা হয়ে গিয়েছে।”

আমিনুল সাহেব সামান্য গলা ঝাড়া দিয়ে বলেন,

“স্নেহা, সামি তোমার ছোট ভাই। এসব নোংরা অপবাদ ওকে দিবে না। আজেবাজে কথা বলা বন্ধ করো।”

স্নেহা ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের বাবার মুখপানে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,

“নিজের ছেলেকে জোর করে আমার ভাই বানানোর চেষ্টা করবেন না। আমার এতো খারাপ দিন আসে নি যে এরকম একটা বখে যাওয়া ছেলেকে নিজের ভাইয়ের পরিচয় দিবো। তাছাড়া ঘরের সকল ব্যাপারে তো আপনাকে সবসময় চুপ থাকতে দেখেছি। আজ হঠাৎ কথা বলছেন যে? ওহ, আপনার ছেলেকে চোর বলেছি বলে?”

আমিনুলের সাহেবের মুখটা চুপসে যায়। তিনি কোনো পাল্টা কথা বলার সুযোগ পান না। মোমিনা বেগম বলে উঠেন,

“এরকম বেয়াদব মাইয়্যা আমি জগতে দুইটা দেখি নাই।”

স্নেহা সামান্য হেসে জবাব দেয়,

“পুরো জগত এখনো দেখা হয় নি আপনার। সাভার এবং মানিকগঞ্জের বাহিরে তো কখনো পা রাখেন নি। খুঁজলে আমার মতো চারিত্রিক গুণাবলীর মানুষ হয়তো পেয়েও যেতে পারেন।”

স্নেহার ওরকম হাসিমুখে দেওয়া অপমানসূচক জবাবে মোমিনা বেগমের পিত্তি জ্বলে উঠলো। মন চাইলো মেয়েটাকে মাটিতে ফেলে মুখে পাড়া দিয়ে ধরতে। ওই কেঁচির মতো জবানটা যদি আজনমের জন্য বন্ধ করে দেওয়া যেতো! মোমিনা বেগমের তপ্ত দৃষ্টিকে অবহেলায় পাশ কেটে গিয়ে স্নেহা দৃঢ় স্বরে সামিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“সব মিলিয়ে ছয় হাজার পাঁচশো টাকা নিয়েছিস। সঠিক এমাউন্টটা আমাকে ফেরত দিবি। আমার পরিশ্রমের উপার্জন চুরি করে কোনো অনৈতিক জায়গায় ঢালবি এবং আমি সেটা মাফ করে দিবো এমন ভুল ধারণা মনে পুষে রাখবি না।”

সামিউলের চড়া মেজাজটা হুট করে আরো চড়ে যায়৷ সে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ভুলে বসে আজ বিকেলে পুলিশ সদস্যের রেখে যাওয়া হুমকি বাক্যটা। বিছানা ছেড়ে নেমে স্নেহার দিকে তেড়ে যেতে যেতে কর্কশ গলায় বলে উঠে,

“তোর মাফ চাইছে কে রে? অপয়া কোথাকার! খুব টাকার বাহাদুরি দেখাস তুই? আমার বাবার টাকায় যে এতোগুলো বছর অন্ন ধ্বংস করেছিস? আগে সেটার হিসাব ফেরত দে। পড়াশোনা করে যে এতদূর এসেছিস, তোর স্কুল, কলেজের ফি কে দিতো শুনি? ন্যূনতম লজ্জা নেই তোর? চটাং চটাং জবান চালাস কীভাবে? দুনিয়াতে আসার সময় থেকে তুই সবার জীবন আঙ্গার করে রেখে দিয়েছিস। এখন আবার আমার পিছনে লেগেছিস। একটা অলক্ষী মেয়েমানুষ।”

সামিউলের ইঙ্গিতপূর্ণ কথার অর্থ রুমে উপস্থিত সকলেই বুঝতে পেরেছে। মোমিনা বেগম এবং আমিনুল সাহেব আশা করেছিল দূর্বলতম জায়গায় আঘাত লাগলে স্নেহা বোধহয় দমে যাবে। মুখে কুলুপ এঁটে বোধহয় নত দৃষ্টিতে বিদায় নিবে রুমটা থেকে। কিন্তু স্নেহা সেরকম কিছুই করলো না, না সামান্য নত হলো। বরং অযাচিত ইঙ্গিতটুকু এড়িয়ে গিয়ে আরো দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দেয়,

“উঁহু, সামান্যতম লজ্জা নেই আমার। লজ্জিত বোধ করার কোনো কারণই নেই। খরচের হিসাব নিয়ে কথা উঠছে তো? স্কুলের ফি, বছরে পাঁচ-ছয়টা জামা এবং খাওয়ার খরচ বাদে এক টাকা কখনো আমার পিছনে বাড়তি খরচ করতে হয় নি কারো। সরকারি স্কুলের ওই সামান্য বেতন এমন কোনো খরচ নয় যেটার জন্য কৃতজ্ঞতায় আমার সর্বদা মাথা নত করে চলতে হবে। এতো বছরে এ-ই বাসায় আমার জন্য যে-ই জামা কাপড় এসেছে সেগুলোর প্রত্যেকটার দামই যে হাজারের ঘর অব্দি কখনো পৌঁছায় নি, সেটাও কারো অজানা নয়। বাকি রইলো খাওয়ার খরচ? সেটা নিয়ে কিছু বললাম না। এই বাসায় আমার পিছনে যতটুকু টাকা খরচ করা হয়েছে, সেটা আমার প্রাপ্য ছিল। আমার প্রাপ্য আমাকে দিয়ে আমার উপর কোনো দয়া করে নি কেউ। তবুও এসএসির পরই আমি একে একে টিউশনি জোটাতে থাকি। নিজের কলেজের ফি এর জন্য কখনো এ-ই বাসার কারো কাছে হাত পাতি নি। না তো নিজের ইউনিভার্সিটির ফর্ম তোলা থেকে শুরু করে সেমিস্টার ফি এর জন্য কারো কাছে হাত পেতেছি। ষোলো বছর বয়স থেকে নিজের উপার্জনে চলা মেয়ের সঙ্গে ওই সামান্য সরকারি স্কুলের ফি এবং খাওয়াদাওয়ার খরচের খাতা খুলে বসবি না। আমার অংকের ফলাফলে কিন্তু তোরাই ছোটলোক প্রমাণিত হবি।”

স্নেহার কথা শেষ হতে না হতেই তার গালে কষে একটা চড় পড়ে। থাপ্পড়ের শব্দটা বেশ প্রকটভাবে শোনা যায় চারিপাশে। দরজার ওপাশ হতে রুমের ভেতর উঁকিঝুঁকি দেওয়া শায়নাও কেপে উঠে দৃশ্যটা দেখে। ভীত তার দু চোখ দিয়ে ঝড়ে বর্ষার অঝোর ধারা। স্নেহা চোখ তুলে তাকায়। উঁহু, এবার তাকে থাপ্পড় দেওয়া ব্যক্তিটা সামিউল নয়, বরং তার বাবা আমিনুল সাহেব। সর্বদা বোবা থাকা আমিনুল সাহেবের অহংবোধে আঘাত হেনেছে স্নেহা। তাই কষিয়ে চড়টা মারলেন তিনি। ক্ষুদ্ধ ভঙ্গিতে নিজের শার্টের বুকপকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করে কিছু টাকার নোট ছুড়ে মারলেন মেয়ের মুখে। অতঃপর রাগে গিজগিজ করতে করতে বলেন,

“নিজের সব খরচ যেহেতু চালাতেই জানিস, তাহলে আমার বাসায় পড়ে আছিস কেন? এক্ষুণি বের হ আমার বাসা থেকে। তোর এই অলুক্ষণে মুখ আর কখনো দেখাবি না আমাকে। বের হ তুই। বের হ, অমানুষের বাচ্চা।”

স্নেহা নীরবে দেখে নিজের বাবাকে। সবসময় চুপ থাকা বাবাটা আজ এতোগুলো কথা বললো। তারমানে, আমিনুল সাহেবের কথার ওজনটা আজ বেশ ভারী। স্নেহা সে-ই ভার অনুভব করে। তার চোখে বেদনা, হতাশা, দুঃখ কিছু নেই। তার ওই দু চোখের তারায় আসলে কিছুই নেই। কেমন শূন্য, নিষ্প্রাণ দৃষ্টি! স্নেহা আর কারো দিকে তাকালো না। আমিনুল সাহেবের ছুঁড়ে মারা টাকার নোটগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে সে পাশের রুমে গিয়ে ছিটকিনি আটকায়। প্রায় আধ ঘন্টারও কম সময় সে রুমটার ভেতর ছিল। যখন বের হলো তখন তার গায়ে একটা বাহিরে পরিধেয় উপযোগী থ্রি পিস। কাধে তার প্রতিদিনের ব্যবহার করা ব্যাগটা। ডান হাতের মুঠোয় রয়েছে একটা মাঝারি আকৃতির হ্যান্ডব্যাগ। বের হওয়ার আগে সে কেবল একবার শায়নার দিকে তাকালো। প্রতিদিন রাতে ঘুমের ঘোরে এই মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরে, হয়তো সে-ই টান থেকেই। শায়না ছলছল চোখ মেলে আপুকে দেখছিল। স্নেহা দরজার কাছে যেতেই সে দৌড়ে এসে স্নেহার কোমর জড়িয়ে ধরে। স্নেহা শায়নার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তার কানের কাছে সামান্য ঝুঁকে শীতল গলায় বলে,

“তোকে একটা কথা বলে যাচ্ছি। মেনে চলবি কি-না সেটা তোর ইচ্ছা। তোর ভাইয়া একটা জানোয়ারের বাচ্চা। ওর মতো নেশাখোরদের হুশজ্ঞানের খুব অভাব। রাস্তাঘাটের মেয়ে এবং তার নিজের ঘরের মেয়ে কেউই এই জানোয়ারদের কাছে নিরাপদ হয় না। এই বাসা থেকে চলে গিয়ে আমি আজ নিজেকে বাঁচিয়ে নিচ্ছি। তবে জেনে রাখ আপন বোন বলে তুইও কিন্তু খুব একটা নিরাপদ নস। তোর নিরাপত্তা তোর দায়িত্ব। ওর থেকে দূরে থাকবি। এই জানোয়ার যতক্ষণ বাসায় থাকবে রুম লক করে থাকবি। রাতে ঘুমানোর সময়ও দরজা লাগিয়ে ঘুমাবি। তবুও কখনো কোনো বিপদে পড়লে টেবিলে তোর বাংলা নোট খাতার প্রথম পাতায় আমি থানার নাম্বার লিখে রেখে এসেছি। কল করে তাদের কাছে সাহায্য চেয়ে নিস।”

শায়নার মস্তিষ্কে গভীরভাবে গেঁথে গেলো স্নেহার বলা প্রতিটি কথা। স্নেহা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই শায়না প্রশ্ন করে,

“তোমার নাম্বারটাও লিখে দিয়ে যাও, আপু।”

স্নেহা পিছনে না ফিরেই বলে,

“আমার কোনো দায় নেই, শায়না। নিজের খেয়াল নিজে রাখবি। চললাম।”

স্নেহা চলে যায়। শায়না খোলা দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়। এতো ভারী এবং গভীর বুঝ না থাকলেও তার মনটা খুব খারাপ হয়। আপুকে বড্ড পাষাণ বলে মনে হয় তার। শায়না তো কখনো বিপদে পড়লে সাহায্য চাওয়ার জন্য আপুর নাম্বার চায় নি। বরং আপুকে মিস করলে সামান্য কথা বলার জন্যই নাম্বার চেয়েছিল। আপু যে বলে গেলো আপুর কোনো দায় নেই আসলেই কী তাই? এই-যে শায়না আপুর জন্য কাদছে, আপুর কী তবুও কোনো টান অনুভব হয় নি?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]