নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১১.
থানার সার্কেল অফিসে নিজ কেবিনের ডেস্কে বসে আছে এএসপি অয়ন। তার ডেস্কের ওপর রাখা একটা ল্যাপটপ। সে-ই ল্যাপটপের সঙ্গে সংযুক্ত হেডফোন কানে চেপে অয়ন মনযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে দুটো ব্যক্তির কল রেকর্ডকৃত কথপোকথন।
“হ্যাঁ, আমি নিজে সব দেখছি। স্যারের নির্দেশ অনুযায়ীই কাজ আগাচ্ছে। সঠিক সময়ে এসে প্যাকেট গুলো তুমি জোগাড় করে নিয়ে যেও। এবং একটু সতর্ক থেকো। কেউ যেন সন্দেহ না করে।”
“ভাই, পোলাপাইন কল দিয়ে পাগল বানায় ফেলতেছে মালের জন্য। বুঝেনই তো গাঞ্জা খাইয়্যা মাথামোথা ঠিক থাকে না এডির। একটু দেইক্ষেন যেন দুইদিনের মাঝেই প্যাকেট রেডি থাকে।”
“আহহা! বললাম তো সময়মতো জিনিস এসে যাবে। এতো নজরদারির চোখ ফাঁকি দিয়ে জিনিস আনা হয় কখনো কখনো একটু সময় তো লাগতেই পারে। তুমি কথা বাড়িও না এখন। রাখছি এখন।”
ফোনকলের সমাপ্তি এখানেই। অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কান থেকে হেডফোনটা খুলে রাখে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা থানার টেকনিক্যাল ইউনিটের সদস্য ইশতিয়াক লক্ষ্য করে সে-ই দীর্ঘশ্বাস। অয়ন ইশারা করতেই ইশতিয়াক ল্যাপটপটা বুঝে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। অয়ন ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দেয় চেয়ারে। এতক্ষণ ধরে ড্রাগ ডিলিং এর জন্য আটককৃত রাসেল এবং এমপি আখতারুজ্জামানের পিএ জাহাঙ্গীর ভুঁইয়ার ফোন কলের কথপোকথন শুনছিল সে। কল রেকর্ডিং থেকে এটা স্পষ্ট যে ড্রাগ সাপ্লাইয়ের ব্যাপারে আখতারুজ্জামান সরাসরি জড়িত। উনিই নিজের কোনো নেটওয়ার্কের মাধ্যমে মাদক সরবরাহ করে সেটা এই রাসেলকে দিয়ে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেয়। অয়নের ধারণা এই মাদক বিক্রির টাকার একটা বড়ো অংশ সম্ভবত আখতারুজ্জামান নিজে বুঝে নিয়ে বাকি টাকা রাসেলকে দেয় অবৈধ কাজের শেয়ার হিসেবে। যদিও রাসেল এখন অব্দি মুখ খুলে নি, তবে পুরো ব্যাপারটা ইতিমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
অয়নের ডিউটি আওয়ার শেষ হতে আরো আধঘন্টা বাকি। মনে মনে সে ঠিক করেছে বাসায় ফিরে আব্বুর সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনা করে নিবে। যদিও অয়ন আগেও মাদকের কেস সামলেছে তবে কখনো সরাসরি কোনো রাজনীতিবীদের বিরুদ্ধে এরকম প্রমাণ তার হাতে উঠে আসে নি। এবার যেহেতু এসেছে তবে সে আইনের নিয়ম অনুযায়ীই কাজ করবে৷ কিন্তু এই ব্যাপারে আব্বুকে আগাম জানিয়ে রাখাটা উত্তম বলে মনে করছে সে।
এরই মাঝে দরজায় নক পড়তেই অয়ন চোখ তুলে তাকায়। দরজা সামান্য ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিয়ে একজন ভদ্রলোক হেসে বলেন,
“আসসালামু আলাইকুম এএসপি সাহেব। এডভোকেট হারুনুর রশীদ বলছিলাম। একটু সময় হবে আপনার?”
অয়ন নড়েচড়ে বসে অনুমতি দেয়,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। জি, আসুন।”
ভদ্রলোক রুমে প্রবেশ করেই অয়নের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসেন। অয়নকে দেখে নিয়ে বলে,
“ডিসি সাহেবের ছেলে এবং সার্কেলের নতুন এএসপি তবে আপনিই!”
অয়ন কেবল মৃদু হেসে বলে,
“এ-ই রাতের বেলায় আপনি কী কারণে এসেছেন সেটা নিয়েই না-হয় আমরা কথা বলি, এডভোকেট সাহেব।”
অয়নের এরকম সরাসরি মোদ্দা কথায় আসার ব্যাপারটা এডভোকেটের পছন্দ হলো। তিনি ভনিতা না করে সরাসরি বলেন,
“আপনার হেফাজতে থাকা একজনকে ছাড়ানোর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”
অয়ন এবার আরেকটু হেসে বলে,
“এই রাতের বেলা হাজত থেকে কাউকে ছাড়াতে এসেছেন? আদালতের অর্ডার আছে?”
এডভোকেট হারুনুর রশীদ কিছুটা সহজ হয়ে বসে গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলে,
“এমপি সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনারা রাসেল নামের যে-ই ছেলেটাকে আটক করেছেন সে এমপি সাহেবের দলের লোক। আমরা চাইলে এখন কথা বলেই ব্যাপারটা মিটমাট করে ফেলতে পারি।”
অয়ন ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই বলে,
“আদালতের অর্ডার নিয়ে আসুন, অবশ্যই কথা বলবো।”
হারুনুর রশীদ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলে,
“আপনার মতো চৌকস অফিসার কাগজে এতো নিয়ম খুঁজেন কেন? আদালত তো কাল সকালে বসবে। আমি এই রাতের বেলা এলাম আপনার সঙ্গে নিরিবিলি কথা বলতে। এমপি সাহেব চান, আপনি বিষয়টা ম্যানেজ করে যেন ছেলেটাকে ছেড়ে দেন। ফরমালিটি না-হয় পরদিন করে নিবো আমরা।”
অয়ন ভ্রু কুচকে সামান্য জোরালো কণ্ঠে বলে,
“যে-ই ছেলের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন সে ড্রাগ ডিলিং মামলায় আটককৃত অবস্থায় আছে। এই মামলা এভাবে জামিনযোগ্য নয়। তাছাড়া আপনি যেটা বলছেন সেটা জামিন নয় বরং প্রভাব খাটিয়ে আসামিকে মুক্ত করার চেষ্টা।”
অয়নের কথাবার্তা এখনো সোজা লাইনে দেখে হারুনুর সাহেব সামান্য প্রলোভন দেখাতে বাধ্য হোন,
“এমপি আখতারুজ্জামান সাহেব এবং আপনার বাবার মধ্যে কিন্তু কখনো কোনো ঝামেলা হয় নি। বলা যায় ডিসি সাহেব কিন্তু স্যারের গুড বুকেই আছেন। উনার ছেলে হিসেবে আপনাকেও কিন্তু স্যার নিজের গুড বুকেই আশা করছেন। ভালো করে ভেবে দেখুন এএসপি স্যার। আপনার সঠিক সিদ্ধান্ত কিন্তু আপনার জন্যই সুযোগের দরজা খুলে দিবে।”
আবারও আকারে ইঙ্গিতে অয়নকে লোভ দেখানো হচ্ছে। অয়নের মেজাজ খারাপ হয়। তবুও সে মাথা ঠান্ডা রেখে বলে,
“আমার কাজ দেশকে সেবা করা, এডভোকেট সাহেব। কোনো নির্দিষ্ট মহলকে নয়। ব্যক্তিগত মুনাফা এবং রাজনৈতিক চাপ আমার উপর খাটে না। আশা করছি আপনি বুঝতে পারছেন। এবার আপনি যেতে পারেন।”
অয়নের ঠান্ডা মাথায় দেওয়া জবাবটা হারুনুর রশীদের মুখ কালো করে দেয়। তিনি মুখ আঁধার করে উঠে দাঁড়ায়। থমথমে গলায় বলেন,
“খুব সাহসী কথা বলে ফেলেছেন, এএসপি সাহেব। আপনার সাহস দীর্ঘস্থায়ী হয় কি-না সেটাই দেখার পালা। আসি আমি।”
হারুনর রশীদ চলে যান। কেবিনে রয়ে যায় কেবল অয়ন। দু হাতের কনুই টেবিলের উপর ঠেকিয়ে দু হাতের তালুতে মুখ গুজে কিছুক্ষণ বসে থেকে দম ফেলে সে। মনে মনে ঠিক করে আগামীকাল থেকেই এই কেসের প্রসিকিউশন শুরু করার ব্যবস্থা করবে সে।
__________
রাত নয়টার পর থেকে জাহানারা ইমাম হলের ক্যান্টিনে বেশ ভীড় থাকে। মেয়েরা সব রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে এসে ভীড় জমায়। স্নেহাও বাহির থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে খেতে এসেছে। কাউন্টার থেকে নিজের খাবার নিয়ে বেছে বেছে নিরিবিলি এবং খালি একটা টেবিল খুঁজে বের করে সেখানে গিয়ে বসে সে। তার সামনে ট্রে-তে রয়েছে ধোঁয়া উঠা সাদা ভাত, মসুর ডাল, লাউয়ের তরকারি এবং আলু ভাজি।
ভাত মেখে এক লোকমা মুখে তুলে আশেপাশে তাকায় সে। মোটামুটি প্রত্যেক টেবিলেই মেয়েরা একজোট হয়ে বসে খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। স্নেহা বিরক্তি নিয়ে সে-সব দেখছে। তার বিরক্তির কারণ হচ্ছে খাবারের স্বাদ। পেটের দায় না থাকলে স্নেহা পারলে এসব খাবার মুখেও তুলতো না। খাওয়ার মাঝেই হুট করে পাশের টেবিলের চারটা মেয়ের কথপোকথন স্নেহার কানে আসে। একটা মেয়ে নিজের সঙ্গে নিয়ে আসা একটা টিফিন বক্স খুলে বন্ধুদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলছে,
“তোরা খাবি বলে আম্মু এবার বেশি করে কাবাব বানিয়ে পাঠিয়েছে। আমি রান্নাঘর থেকে গরম গরম ভেজে এনেছি। খেয়ে দেখ।”
অপর দুটো মেয়ে আগ্রহ নিয়ে সে-ই কাবাব মুখে নিয়ে একসঙ্গে বলে উঠে,
“এত্তো মজা হয়েছে! আন্টির হাতের রান্না জোস! বাসা থেকে আসার সময় আম্মুরা যদি কখনো এরকম খাবার প্যাক করে দিয়ে না দিতো তাহলে আমাদের ক্যান্টিনের খাবার খেয়েই একদিন মরে যেতে হতো।”
মেয়ে দুটোর কথা শুনে বাকি দু’জনও হেসে উঠে। স্নেহা নীরবে শুনে তা। চুপচাপ নিজ প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকা সে হঠাৎই খুব শূন্য অনুভব করে। তারও একটা মা থাকলে বোধহয় খারাপ হতো না। কিন্তু স্নেহার দূর্ভাগ্য যে তার মা নেই। অবশ্য স্নেহার কেউ-ই নেই। এই-যে পৃথিবীতে কতো মানুষ, এরা কেউ-ই স্নেহার আপন নয়। এই-যে হলে স্নেহার আশেপাশে এতো এতো মেয়ে এদের কারো সঙ্গেই স্নেহার সখ্যতা নেই। আপাতদৃষ্টিতে স্নেহাকে অসামাজিক এবং পাথর গোছের মেয়েমানুষ বললে ভুল হবে না। কেন যেন তার মধ্যে কখনো রাগ এবং বিতৃষ্ণা ব্যতীত কোনো ধরনের অনুভূতি কাজ করে না। কখনো কোনো মানুষের প্রতি কোনো ভালো অথবা খারাপ লাগাও তার কাজ করে না।
স্নেহার ধারণা প্রসবের সময় তার মা যখন মারা যাচ্ছিল তখন বোধহয় স্নেহার সকল অনুভূতি এবং স্বাভাবিকতাও সঙ্গে করে নিয়ে চলে গিয়েছেন। আহারে মা! তিনি কখনো জানলেনও না যে, যে-ই মেয়ের জন্য তিনি এতো আদুরে এবং মিষ্টি একটা নাম ঠিক করে রেখে গিয়েছেন, সে-ই মেয়েটার জীবন ভর্তি কেবল তিক্ততা। ভাবনায় ডুবে থাকা স্নেহা অনায়াসেই এ-ই স্বাদহীন খাবারটুকু সাবাড় করে ফেলে। তার মতো মানুষের জন্য খাবার হলো কেবলই শরীরে শক্তি জোগানোর একটা মাধ্যম। তা-ই খাবারে অহেতুক স্বাদ খোঁজার বিলাসিতাটা সে আর দেখায় না৷
__________
বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়া করে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো অয়ন। কেবলই গোসল সেড়ে এসে বিছানায় টানটান ভঙ্গিতে উবুড় হয়ে শুয়েছে সে। সারাদিন মেরুদণ্ড সোজা করে ডিউটি পালনের থেকে কঠিন কাজ বোধহয় দুনিয়াতে আর দ্বিতীয়টা নেই। তবে এতো পরিশ্রমের বিনিময়ে একটা জিনিস ভালো হয়। সেটা হলো ঘুম। পরিশ্রম যত বেশি, দৈহিক ক্লান্তিও ঠিক ততটাই জেকে ধরে। এতে করে বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমের রাজ্যে ডুব দেওয়া যায়। অহেতুক রাত জেগে সময় অপচয় করা মানুষদের তালিকায় নামও লেখাতে হয় না।
এসির শীতলতায় আরাম পেয়ে যে-ই না অয়নের চোখ লেগে আসতে নিচ্ছিলো ঠিক তখনই ধুম করে কিছু একটা তার পিঠ সহ সারা শরীরের উপর পড়ে। অয়ন ধড়ফড়িয়ে উঠে। পরমুহূর্তেই ব্যথায় আর্তনাদ করে। তার মেরুদণ্ড বুঝি নাই হয়ে গেলো! অল্পের জন্য অয়নের মনে হয়েছিল সিলিং থেকে ফ্যান ছুটে বুঝি তার উপরে পড়েছে। কিন্তু তার উপর জায়গা দখল করে রাখা ভারী জিনিসটা যে কোনো বস্তু নয় বরং ব্যক্তি তা বুঝতে বাকি নেই। অয়ন বিরক্তি নিয়ে আওড়ায়,
“নিতুন!”
ভাইয়ের পিঠে উবুড় হয়ে পড়ে অক্টোপাসের মতো লেপ্টে ঘাড় জড়িয়ে ধরা নিতুন জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“ভাইয়া, তুমি কী ঘুমাচ্ছিলে?”
অয়নের মেজাজ খারাপ হয়। সে জবাব দেয়,
“না। ঘুমাচ্ছিলাম না। ডিস্কো ডান্স করছিলাম।”
নিতুন দাঁত বের করে হেসে বলে,
“বাব্বাহ! বাবু ভাইয়া আজকাল সারকাজমও করে। তোমার দেখি সুবুদ্ধি উদয় হচ্ছে!”
অয়ন নিজের পিঠ ঝাড়া দিয়ে নিতুনকে পাশে ফেলে বলে,
“আমার কোমরের হাড় ভেঙে তুই দম নিবি?”
নিতুন হতাশ হয়ে বলে,
“আমার মতো ছাপ্পান্ন কেজি ওজনের একটা বাচ্চা ছেলের ভার তুমি সইতে পারছো না! বিয়ের পর ভাবীকে কীভাবে কোলে নিবে তুমি? ভাবীকেও কি এভাবে খোঁটা দিবে?”
অয়ন বলে,
“ভাবী কোথা থেকে টপকালো আবার?”
“টপকায় নি। তবে তুমি চাইলেই টপকাতে পারে। ভাইয়া, প্লিজ একটা ভাবী এনে দাও না।”
অয়ন চোখ বুজে ঘুম জড়ানো গলায় বলে,
“যা তো, নিতুন। ঘুমাতে দে। পরে তোকে বাজার থেকে খুঁজে ভাবী এনে দিবো নি।”
নিতুন মুখ বেজার করে ফেলে। ঘুমের ঘোরে ভাইয়া আবোলতাবোল বকছে। বাজারে আবার ভাবী বিক্রি হয় না-কি? ভাবীকে তো চোখ কান খোলা রেখে আশেপাশে খুঁজে বের করতে হবে। একদম দামে কম, মানে ভালো মনমতো ভাবী। যে কি-না নিতুনকে আম্মু, আব্বু এবং ভাইয়ার অহেতুক শাসন থেকে বাঁচাবে। নিতুন যখন পড়ায় ফাঁকি দিবে তখন ভাবীও তার সে-ই পড়া চুরি সবার থেকে আড়াল করবে। এবং ভবিষ্যতে নিতুন যখন একটা প্রেম করবে তখন ভাবীই বাসায় সবাইকে রাজি করাবে। ঠিক এমন ভাবীই তো চাই নিতুনের।
যা-ই হোক। ভাইয়ার হাবভাব ভালো নয়। যেকোনো সময় নাক ডাকা শুরু করে দিবে। নিতুন তাই চটপট আসল কথায় আসে।
“ভাইয়া। এই, ভাইয়া। শুনো না।”
ঘুমের ঘোরেই অয়ন জবাব দেয়,
“বল।”
নিতুন প্রশ্ন করে,
“সাভারে কি কানকাটা ছিনতাইকারীদের দল বেড়িয়েছে?”
অয়নের ভ্রু কুচকে আসে। সে সামান্য চোখ ফাঁকা করে প্রশ্ন করে,
“কানকাটা ছিনতাইকারী আবার কী জিনিস?”
“স্নেহা মিসের কানে আমি আজকে ব্যান্ডেজ দেখেছি। খুব সম্ভবত উনার কান কেটে গিয়েছে। কিন্তু কিভাবে কেটেছে জিজ্ঞেস করার পর উনি কিছু বলে নি।”
স্নেহার নাম শুনতেই অয়ন পুরোপুরি চোখ মেলে তাকায়। ঘাড় ঘুরিয়ে নিতুনের দিকে তাকায় প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে। নিতুন অবাক হয়। ভাইয়ার চোখের ঘুম কোথায় উড়ে গেলো? এ কী অসম্ভব ব্যাপার স্যাপার!
অয়নের মস্তিষ্কে তখন ঘুরছে আজ স্নেহার সঙ্গে দেখা হওয়ার দৃশ্যটা। না চাইতেও কিভাবে যেনো মিসকে বেশ রাগিয়ে দিয়েছে আজ সে। আবার দেখা হলে কি মিসকে সরি বলা উচিত তার? কিন্তু মিস যদি এতে আরো রেগে যায়? ভাবুক অয়ন চিন্তায় বুদ থেকেই নিতুনকে প্রশ্ন করে,
“ঢ্যামনা মানে কী রে, নিতুন?”
নিতুন অবাক হয়। ঢ্যামনা? শব্দটার সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নয়। এক দু বার স্কুলে বোধহয় সহপাঠীদের মুখে এটা শুনেছিল সে। কিন্তু অর্থটা ঠিক জানা নেই তার। তবে নিতুনের মাথায় কী বুদ্ধির অভাব? আধুনিক যুগের কল্যাণে তার অজানা সকল কিছু চ্যাটজিপিটির জানা আছে। নিতুন তাই ভাইয়ের বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে আগে ভাইয়ের আঙুল চেপে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ইউজ করে তা আনলক করে। অয়ন কিছুটা রাগ নিয়ে বলে উঠে,
“ফোন নিচ্ছিস কেন?”
নিতুন ততক্ষণে গুগলে কিছু একটা টাইপ করতে করতে জবাব দেয়,
“ঢ্যামনার অর্থ বের করছি।”
অয়নকে কিছুটা আগ্রহী দেখায়। সে ঘাড় তুলে উঠে ছোট ভাইয়ের গা ঘেঁষে উবুড় হয়ে থাকে। দু ভাই পাশাপাশি একই ভঙ্গিতে উবুড় হয়ে ফোনে খুব মনযোগ দিয়ে ঢ্যামনার অর্থ তালাশ করছে। তাদের তালাশ অভিযান অবশ্য সফলও হয়েছে। চ্যাট জিপিটি সুন্দর করে সাজিয়ে উত্তর দিয়েছে,
‘ঢ্যামনা’ শব্দটি বাংলা ভাষার একটি আঞ্চলিক বা প্রমিত ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ নয়। তবে এটি বাংলাদেশে বিশেষ করে গ্রামীণ বা কথ্য ভাষায় অপমানজনক ভাবে ব্যবহার হতে দেখা যায়। এই শব্দটি সাধারণত অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন, বোকাসোকা, নিজেকে অনেক কিছু ভাবে অথচ তেমন কিছু নয়, বিরক্তিকর বা গুরুত্বহীন কাউকে অপমানসূচক ভাবে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। এটা অনেকটা ঠাট্টা, অপমান বা রাগের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দ।
অয়নের চেহারাটা একটুখানি হয়ে যায়। মিস তাকে অপমান করে গেলো? কিন্তু কেন? অয়ন তো অল্প বুদ্ধিসম্পন্ন নয়। সে বোকাসোকাও নয়, বরং পুলিশের চাকরি করার উপযোগী চালাক। অয়ন নিজেকে অনেক কিছু ভাবেও না। তবে কী অয়ন বিরক্তিকর? এজন্যই এই শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে? নিতুন ভাইকে লক্ষ্য করে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,
“তোমাকে কি কেউ ঢ্যামনা বলেছে?”
অয়ন রাগ দেখিয়ে বলে,
“আমি কখন বললাম আমাকে কেউ ঢ্যামনা বলেছে? সবসময় বেশি বুঝিস। যা তো। আমাকে ঘুমাতে দে। না-হয় আম্মুকে ডাকবো এখন।”
নিতুন ফোনটা রেখে উঠে চলে যেতে যেতে বলে,
“ওই একটা জিনিসই শুধু পারো। কথায় কথায় আম্মুকে ডাকার হুমকি দেওয়া ছাড়া আর কী জানো? বি এ ম্যান, ভাইয়া।”
নিতুন বেরিয়ে যায়। অয়ন অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। নিতুন কি এইমাত্র তাকে অপমান করে গেলো? ম্যান হতে বললো কেন? অয়ন কী মাম্মাস বয় নাকি?
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]