নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১২.
স্নেহা সবসময়ই জেনে এসেছে যে তার আত্মীয় বলতে কেবল একজন খালামণি আছেন। তার মা’য়ের আপন ছোট বোন। কিন্তু বুঝ হওয়ার পর থেকে নিজের সে-ই খালামণির সঙ্গে তার হাতে গুণে কেবল তিন চারবারই দেখা হয়েছে। সে-ই তিন চার বারের দেখায় খালামণিকে অমায়িক মানুষ বলেই মনে হয়েছে স্নেহার। দেখা হলেই ভদ্রমহিলা স্নেহাকে খুব আদরে কাছে টেনে নিজের সঙ্গে বসিয়ে রাখতেন।
স্নেহার তখন নয় বছর বয়স। খালামণি সেবার এসেছিলেন স্নেহাকে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্নেহার বাবা এবং উনার দ্বিতীয় স্ত্রী। ওইটুকু বয়সে এতো মারপ্যাঁচ বুঝতে পারে নি স্নেহা। সে ধরে নিয়েছিল প্রকাশ না করলেও হয়তো বাবা তাকে নীরবে খুব ভালোবাসেন। তাই তো স্নেহাকে নিজের থেকে দূরে যাওয়ার অনুমতি দিতে চাচ্ছে না৷ তবে স্নেহার সে-ই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। তার একটুখানি মনটা হাজার টুকরোয় ভেঙেছিল যখন সে শুনতে পেরেছিল, শুধুমাত্র তার মা’য়ের ভাগের সম্পত্তির জন্যই বাবা তাকে নিজের কাছে রাখতে চায়। সেদিনই স্নেহা উপলব্ধি করেছিল তার বাবার ভালোবাসাটা আসলে স্নেহার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিগুলোর সীমানা অব্দিই সীমাবদ্ধ, এর বাহিরে স্নেহার প্রতি উনার কখনোই আলাদা টান ছিল না।
স্নেহা সেদিন এটাও দেখেছিল যে তার খালামণির চোখে কতটা অসহায়ত্ব ছিল। ভদ্রমহিলা মন থেকেই চাইতেন নিজের বড় বোনের একনাত্র মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যতটুকু সম্ভব যত্নে রাখার। হয়তো উনি স্নেহার বাবার বিরুদ্ধে আদালতে গিয়ে হলেও স্নেহার কাস্টাডি নেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু উনার একার ইচ্ছার দৌড় আর কতটুকুই বা হবে? স্নেহা ভালো করেই জানতো যে তার খালামণি সেদিন নিজের স্বামীর অনিচ্ছার কারণেই দমে যেতে বাধ্য হয়েছিল। খালুর চোখের অনাগ্রহটা স্নেহার আজও মনে আছে।
এতো বছর পর আজ খালামণির জানাজায় এসে হাজির হয়ে স্নেহার পুরনো সে-সব কথা মনে পড়ে গিয়েছে। এইতো সকাল বেলাই হুট করে তার খালাতো বোনের কল এলো যে, খালামণি আর নেই। স্নেহা ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরী হওয়া সে নিজের গন্তব্য বদলে বাস ধরে বগুড়ায় এসে হাজির হয়েছে। এর অবশ্য একটাই কারণ। ওই নয় বছর বয়সে খালামণির চোখে নিজের জন্য কিছুটা মায়া দেখেছিল সে। সেটারই শোধবোধ করতে এলো। হাজার হোক স্নেহা তো অকৃতজ্ঞ নয়।
বাড়ির উঠোনে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। কাফনের কাপড়ে মোড়ানো খালামণির লাশটা উঠোনের মাঝখানে একটা খাটিয়ার উপর রাখা আছে। সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকায় লাশের একাংশও দেখার সুযোগ নেই। চারিপাশে কান্নার শব্দ, ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ, কেউ কেউ নিচু স্বরে দোয়াও পড়ছে। স্নেহা নির্বিকার দৃষ্টি মেলে দেখে চারিপাশটা। খালু বাদে বাকি সবগুলোই তার জন্য নতুন মুখ। নিজের খালাতো বোনটাকেও তার চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। খুব ছোটবেলায় শেষবার দেখেছিল সে। স্নেহা নিঃশব্দে এই বাড়িতে প্রবেশ করার পর থেকেই কারো চোখে না পড়ার মতো করে এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এখনো খালু অথবা খালাতো বোন রাওফা লক্ষ্য করে নি।
উঠোনের ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখতে ব্যস্ত স্নেহা হঠাৎ দেখে ঘর থেকে রাওফা কাদতে কাদতে ছুটে বেরিয়ে আসছে। রাওফাকে ধরে আটকানোর চেষ্টা করছে দু’জন অপরিচিত মহিলা। কিন্তু আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। উল্টো মেয়েটার গগনবিদারী চিৎকারে চারিপাশ ভারী হয়ে উঠেছে। স্নেহা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে-ই দৃশ্যটা দেখে উপস্থিত অনেকেরেই চোখে জল চলে এসেছে, সে-ই দৃশ্য দেখেও তার কিছু অনুভব হচ্ছে না। কিছু না বলতে একদমই কিচ্ছু না। কেবল নিষ্প্রাণ দৃষ্টি মেলে দেখছে সে। একটা মা হারা মেয়ে হয়ে তার রাওফার কান্না দেখে হৃদয়ে কষ্ট অনুভব হওয়ার কথা। কিন্তু তার হৃদয়ে সবসময়ের মতো আজও শূন্যই অনুভব হচ্ছে।
রওফাকে দেখতে ব্যস্ত স্নেহা লক্ষ্যই করলো না কখন তার পাশে এসে একজন যুবক দাঁড়িয়েছে। হুট করে সেই যুবকের ডাক শুনে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। নিতুনের বয়সী একটা ছেলে শুকনো নুখে তাকিয়ে স্নেহাকে পরখ করতে করতে প্রশ্ন করে,
“তুমি স্নেহা আপু?”
প্রথম দেখায় ছেলেটাকে চিনতে অসুবিধা হলেও স্নেহা আন্দাজ করে নেয় ছেলেটা কে হতে পারে। সে প্রশ্ন করে,
“রাফিয়াত?”
রাফিয়াত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। স্নেহা ভালো করে দেখে নেয় নিজের খালাতো ভাইকে। বেশ বড়ো হয়ে গিয়েছে। চেহারার আদলটাও খালুর সঙ্গে মিলে। তবে খালুর চেহারায় মায়ার ছাপ নেই বিশেষ। কিন্তু রাফিয়াতের মুখ জুড়ে আদুরে মায়ার ছাপ মিশে আছে। হয়তো বাড়ির ছোট বলেই একটু আহ্লাদী গোছের মুখ তার। স্নেহাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাফিয়াত তীব্র মন খারাপের সুরে বলে,
“আম্মু তোমাকে খুঁজেছিল। তোমাকে শেষবার দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু সময় পেলো না।”
স্নেহা কিছু বলে না, নীরব রয়। এসব শুনে নিজের মনে মায়ার উদ্রেক হতে দেয় না সে। বরং ব্যাপারটাকে জীবনের অংশ ভেবে সে নীরবে মেনে নেয় যে তাকে নিয়ে একদণ্ড ভাবার একমাত্র মানুষটাও পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে। স্নেহা নীরব থাকলেও রাফিয়াত নীরব থাকতে পারে না। বিরতিতে যাওয়া কান্নাটা আবার উথলে বেরিয়ে আসে। নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আম্মুর প্রিয় মানুষকে আকস্মিক জড়িয়ে ধরে সে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠে,
“আম্মু সবসময় তোমার কথা বলতো, আপু… সবসময়…”
রাফিয়াতের কান্নার শব্দে আশেপাশের মানুষের মনযোগ এবার তাদের দিকে স্থির হয়। একে-তো রাফিয়াতের এরকম আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় স্নেহা সংকোচে পড়ে গিয়েছে, তার উপর আশেপাশের মানুষের মনযোগও তাকে তীব্র অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। কী এক যন্ত্রণা! শান্তনা টান্তনা দিতে শিখে নি স্নেহা, কখনো দেয়ও নি। কিন্তু বাচ্চা ছেলেটাকে চাইলেও ঠেলে দূরে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
শান্তনা দিতে না জানা স্নেহা চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করে। কিন্তু সে নিস্তার পায় না। রাফিয়াতের কান্নার শব্দে এতক্ষণে রাওফাও তাকে দেখে ফেলেছে। ঝড়ের গতিতে মেয়েটা ছুটে এসে স্নেহাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। পরপর আকস্মিক আলিঙ্গনে স্নেহার এবার দমবন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। সে অভ্যস্ত নয় এসবে। দুই ভাইবোন মিলে তাকে কেন জড়িয়ে ধরে আছে? স্নেহার সঙ্গে এদের খুব একটা কথাবার্তা অথবা দেখা-সাক্ষাৎ কখনো হয় নি। স্নেহার তরফ থেকে কোনো ইমোশন্যাল এটাচমেন্টও নেই। তাহলে ওরা স্নেহার প্রতি কীসের টান অনুভব করছে? স্নেহা ঠাই দাঁড়িয়ে রয়, কাদতে দেয় দুই ভাইবোনকে। নিজে হাত বাড়িয়ে এদের ফেরত জড়িয়ে ধরে না। সে-ই প্রয়োজনই অনুভব করে না। রাওফা রাফিয়াতের পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো মানুষের অভাব নেই। তাছাড়া খালামণি মারা গেলেও খালু এখনো এদের মাথার উপর আছে। ভদ্রলোক অন্যের সন্তানকে নিজের ঘরে আনার অনাগ্রহ দেখালেও পিতা হিসেবে চমৎকার। নিজের ছেলে মেয়ের যত্নে উনি ক্রুটি রাখবেন না। তাই অহেতুক স্নেহা ভাইবোনদের আশ্রয়স্থল হওয়ার চেষ্টা চালায় না। কেদেটেদে নিজ থেকেই একটা সময় ঠান্ডা হয়ে যাবে এরা।
__________
বৈশাখ মাসের রাতের আকাশে মেঘেরা ভীড় করেছে। প্রকৃতি যেন দম চেপে অপেক্ষা করে যাচ্ছে কিছু একটা ঘটার। এডভোকেট হারুনুর রশীদকে প্রত্যাখ্যান করে অয়ন কেসের প্রসিকিউশন শুরু করেছে কেবল চব্বিশ ঘণ্টাও হলো না। এর মধ্যেই ভীষণ বাজে একটা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। রাত তখন দশটার উপর বাজে। বাইক নিয়ে বাড়িতে ফিরতে রওনা হয় অয়ন। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অনুভব করে পিছনে দুটো বাইক তাকে ফলো করছে। চিন্তার বিষয় হলো বাইক দুটো যেন একপ্রকার তাকে ধাওয়া করছে। বাইক চালাতে চালাতে অয়ন লক্ষ্য করেছে পিছনের বাইক দুটোতে বসা ছেলে চারটার মুখ কেমন যেন কাপড় দিয়ে বাধা৷
অয়ন আঁচ করতে পারছে যে এরা হয়তো এমপি আখতারুজ্জামান সাহেবের লোক। এদের উদ্দেশ্যও হয়তো অয়নকে ভয় দেখানো অথবা ক্ষতি করা। তাই অয়ন বাইকটাকে বাসার রাস্তায় না নিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের আশপাশ দিয়েই বারবার চক্কর কাটাচ্ছে। এদিকে রাস্তায় তা-ও মোটামুটি মানুষ আছে। কিন্তু তার বাসার ওদিকে মোটামুটি অন্ধকার এবং নিরিবিলি পরিবেশ। আপাতত ওদিকে যাওয়াটা সেফ নয়। মাথা ঠান্ডা রেখে বাইক চালাতে থাকা অয়ন হঠাৎ উপলব্ধি করে যে তার বাইকের তেল প্রায় ফুরিয়ে আসছে। কি এক মুসিবত!
অয়ন এবার একপ্রকার বাধ্য হয়েই বাইকটা রাস্তার এককোণে থামিয়ে রাখে। নিজেও চটজলদি বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে নিজের প্যান্টের একপাশে থাকা পিস্তলটার উপর হাত রেখে প্রস্তুত হয়ে থাকে। ছেলেগুলো কিছু করার চেষ্টা করলে নিজের নিরাপত্তার জন্য সে পিস্তলটা বের করবে। কিন্তু অয়নকে অবাক করে দিয়ে ছেলেগুলো কিছুই করলো না। বরং অয়নের সামনে দিয়েই বাইক চালিয়ে চলে যায়। দুঃশ্চিন্তায় কপাল কুচকে রাখা অয়ন বুঝতে পারে ওদের উদ্দেশ্য ক্ষতি করা ছিল না বরং ভয় দেখানো ছিল।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজের পকেট হতে ফোনটা বের করতে নিয়েই অয়ন একটা পরিচিত নারী স্বরের ডাক শুনে,
“আপনি এখানে?”
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই অয়ন দেখে কপালে ভাজ পড়া স্নেহার ক্লান্তিমাখা মুখখানি। অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হওয়ায় অয়নও অবাক হয়ে বলে,
“আরে মিস, আপনি এখানে?”
স্নেহা অয়নের থেকে কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে দু কদম এগিয়ে এসে জবাব দেয়,
“এটা আমার ক্যাম্পাস।”
অয়ন অবাক হয়ে নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার রাতেও ক্লাস থাকে?”
স্নেহা বিরক্তি নিয়ে নীরবে তাকিয়ে রয় অয়নের পানে। অয়ন বুঝতে পারে সে ভুল প্রশ্ন করে ফেলেছে। মনে মনে নিজের প্রতি-ই বিরক্ত হয় সে। সারাদিন সবার সামনে তো তার মাথা এবং মুখ ঠিকঠাকই চলে। এই মেয়ের সামনে এলেই এসব এম্বারেসিং সিচুয়েশনে কেন পড়তে হয় তার? নিজেদের মধ্যকার এ-ই অস্বস্তিকর ভাবটা দূর করতে অয়ন কথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে,
“আপনি বাসায় ফিরছিলেন?”
অয়নের প্রশ্নের পিঠে স্নেহার খেয়াল হয় হলের কথা। বগুড়া থেকে ফিরতে গিয়ে রাস্তায় জ্যামে পড়েছিল সে। প্রায় দুই ঘন্টা শুধুমাত্র জ্যামে বসেই কাটাতে হয়েছে তার। কিন্তু বাস থেমে থাকলে কী হবে? সময় তো থেমে থাকে নি। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সাড়ে দশটার উপর বেজে গিয়েছে। হলের গেট ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হলে প্রবেশ করতে হলে এখন বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে তার। স্নেহা কপালে সামান্য চিন্তার ছাপ নিয়ে আনমনে জবাব দিয়ে বসে,
“হলে ফিরছিলাম।”
অয়নকে অবাক দেখায়। থানায় স্নেহা যে-ই বয়ান দিয়েছিল, সে-ই অনুসারে তো স্নেহার বাসায় থাকার কথা। তাহলে হলে উনার কী কাজ? অয়ন প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে যায়। ব্যাপারটা হয়তো স্নেহার ব্যক্তিগত। কিছু জিজ্ঞেস করলে মিস মাইন্ড খেয়ে যেতে পারেন। তাই অয়ন স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলে,
“অনেক রাত হয়ে গিয়েছে তো। হলের গেট তো সম্ভবত বন্ধ করে দিয়েছে। এখন কী করবেন?”
স্নেহার ধ্যান ভাঙে। চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে এসে অয়নের প্রশ্নের পিঠে জবাব দেয়,
“অসুবিধা নেই। আমি ব্যবস্থা করে ফেলবো। জরুরী কারণ দেখালে হলে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে দিবে।”
আকাশ অন্ধকারের চাদর টেনেছে বহু আগেই। মেঘগুলো নিচে নেমে এসেছে অনেকটা। বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে ঝলকে উঠছে আকাশের গায়ে, সঙ্গে রয়েছে বজ্রধ্বনি। স্নেহা নিজের জবাবটুকু দিতেই ধুম করে কারেন্ট চলে যায়। পুরো রাস্তাটা মুহূর্তেই অন্ধকারে ডুবে যায়। না চাইতেও স্নেহা সামান্য চমকে উঠে। চমকায় অয়নও, কিছুটা বোধহয় ঘাবড়েও যায়। বাতাস তখনও থেমে থাকে নি, উল্টো তার গতি যেন আরো বেড়েছে। অয়ন আবহাওয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারে বৃষ্টি নামতে বেশি দেরি নেই। সে কিছুটা চিন্তা নিয়েই বলে,
“আপনার এখন হলে ফেরা উচিত। বৃষ্টি শুরু হবে এনিটাইম। এখানে আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে নির্ঘাত বৃষ্টিতে ভিজে যাবেন।”
স্নেহা নিজেও জানে তার এখন ফেরা উচিত। এই লোকের সঙ্গে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে এভাবেই সে নিজের সময় অপচয় করে ফেলেছে। আর এক মুহূর্ত এখানে অন্ধকারে এই লোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। স্নেহা নিজের হাতে থাকা ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে অয়নকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“যাচ্ছি।”
ব্যস! এট্টুকই! আর কোনো কথা নেই। স্নেহা নীরবে নিজের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায়। এখান থেকে হলের দূরত্ব পায়ে হেঁটে মাত্র সাত মিনিট। একটু দ্রুত পা চালায় সে বৃষ্টি নামার আগেই হলে পৌঁছানোর লক্ষ্যে। অয়ন নীরবে দেখে স্নেহাকে দ্রুতবেগে প্রস্থান করতে। অয়নের উচিত ছিল নিজের রাস্তা মেপে চুপচাপ বাসায় ফেরা। কিন্তু আশেপাশের আঁধার এবং নির্জন পরিবেশটা তাকে চিন্তায় ফেলে দেয়। মন তাকে অনুমতি দেয় না এভাবে একটা মেয়েকে একা হলে ফিরতে দেওয়ার। যতই সে-ই মেয়েটা একা চলতে জানুক না কেন, অয়ন নিজের মাঝে কিছুটা তাগিদ অনুভব করে স্নেহার নিরাপদে হলে প্রবেশ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার ব্যাপারে। বাইকের চাবিটা নিজের পকেটে ভরে নিয়ে অয়নও নীরবে আঁধারে লুকিয়ে চুরিয়ে স্নেহার পিছু নেয়। লুকোচুরি করার কারণ হলো, স্নেহার রাগ। অয়নের ধারণা স্নেহা তাকে পিছু করতে দেখলে উল্টাপাল্টা ভেবে রেগে যেতে পারে।
সাত মিনিটের রাস্তা স্নেহা পাঁচ মিনিটেই অতিক্রম করে ফেলে। হলের গেটের থেকে কয়েক কদম দূরত্বে আসতেই সে হঠাৎ থেমে যায়। চট করে পিছনে ঘুরে নিজের ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা তাক করে। মুখে এক ফালি আলো এসে পড়তেই অয়ন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তার মুখখানা এমন যেন সে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছে। এই ঠান্ডা আবহাওয়ার মাঝেও তার কপালে ঘাম জমতে শুরু হয়। স্নেহা যদি এখন এখানে তাকে ভুল বুঝে আজেবাজে কথা বলা শুরু করে দেয়? অয়নের ইজ্জত সম্মান সব যাবে তাহলে। মানুষ বলবে পুলিশ হয়ে ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্রীকে উত্যক্ত করছে ডিসি সাহেবের বড়ো ছেলে। সিন ক্রিয়েটের ভয়ে অয়ন দ্রুত নিজের সাফাই গেয়ে বলে,
“আপনি হলে ঠিকঠাক পৌঁছাতে পেরেছেন কি-না, সেটা মেক শিওর করতে পিছু নিয়েছি। অন্য কোনো কারণ নেই। সত্যি বলছি।”
স্নেহা নীরবে পরখ করে অয়নের মুখখানা। সে আরো আগেই টের পেয়েছিল যে অয়ন তার পিছু নিয়েছে। তবে উদ্দেশ্য কী সে নিশ্চিত ছিল না। এ-ই মুহূর্তে ভদ্রলোকের চেহারাও যেন এক প্রকার সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তিনি সত্যি বলছেন। যদিও এই চিন্তা কিংবা উপকারটুকুর স্নেহার প্রয়োজন ছিল না, তবুও সে এ-ই ভালো মানুষিকতাকে আমলে নিলো। অয়নের দিকে ধীর পায়ে দু কদম এগিয়ে যায় সে। অয়ন তখন মনে মনে দোয়া করছে আর যা-ই হোক এই মেয়ে যেন তার নেক উদ্দেশ্যকে ভুল না বুঝে।
অয়নের দোয়া কবুল হয়। স্নেহা তার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে কেবল নিজের হাতে থাকা হালকা নীল রঙা ছাতাটা এগিয়ে দেয়। অয়ন অবাক হয়। বিশ্বাস করতে চায় না যে সে সত্যি দেখছে। স্নেহা ভনিতা না করে বলে,
“বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। এটা সাথে রাখুন। পরে ফিরিয়ে দিয়েন।”
অয়ন ধ্যানমগ্ন হয়ে ছাতাটা নেয়। স্নেহার ফোনটাও সে-ই মুহূর্তে অফ হয়ে যায়। সারাদিনের দৌড়াদৌড়িতে ফোন চার্জ দেওয়া হয় নি। আবারও চারিপাশ অন্ধকারে ডুবে যায়। স্নেহা কথা বাড়ায় না। এই দু কদমের জন্য তার আলোর প্রয়োজন নেই। অন্ধকারেই সে ছুটে হলের গেটের পানে। গেটের ভেতর প্রবেশের ঠিক আগ মুহূর্তে স্নেহা এক সেকেন্ডের জন্য কী ভেবে যেন ফিরে তাকায়। সে ভেবেছিল অন্ধকারে তার এই ফিরে তাকানো অয়নের চোখে পড়বে না। কিন্তু প্রকৃতির পরিকল্পনা ছিল অন্য। ঠিক সে-ই মুহূর্তেই আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকে চারিপাশটা ক্ষীণ সময়ের জন্য আলোকিত হয়ে উঠে। বিদ্যুতের ক্ষণিক ঝলকে স্নেহার ফিরে তাকানোটা ধরা খায় অয়নের চোখে। পরমুহূর্তেই চারিপাশটা আবারও অন্ধকারে ছেয়ে যায়। স্নেহা ততক্ষণে হলের গেটের ভেতর চলে গিয়েছে। কেবল অয়নই নিজ জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। এক সেকেন্ডের দৃশ্যটা হুট করেই তার মানসপটে গেঁথে যায় অজানা সময়ের জন্য।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]