নীড়বৃষ্টি পর্ব-১৩

0
5

নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৩.

সকালের নাস্তার টেবিলে বসে আছেন ডিসি কামরুল সাহেব এবং উনার বড়ো ছেলে। ছোট লাট সাহেব ঘুমে ডুবে থাকায় আজ নাস্তার টেবিলে অনুপস্থিত। দিনটা শুক্রবার হওয়ায় নিতুনের আজ বেলা বারোটা পর্যন্ত ঘুমানো নিয়ে কোনো বাঁধা নেই। নীলা বেগম রান্নাঘরে পরোটা ভাজছেন। ডাইনিং রুমটা ফাঁকা পেয়ে অয়ন সাবধানে নিচু স্বরে নিজের আব্বুকে জানালো গতকাল রাতের সেই দুই বাইকের ঘটনা। কামরুল সাহেবের মুখে দুঃশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। উনি যা নিয়ে চিন্তা করছিলো তাই হচ্ছে। এমপি আখতারুজ্জামান সাহেব অয়নকে নিজের শত্রুদের তালিকায় ফেলে দিয়েছেন সম্ভবত। রাজনৈতিক কারো সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না।

কিন্তু কামরুল সাহেবের আইডলজি উনাকে নিজের ছেলেকে এই কেস থেকে সরে আসার পরামর্শ দেওয়ার অনুমতিও দিচ্ছে না। এটা তো অয়নের জব। এখানে ছেলেকে পিছুপা হতে বলার এখতিয়ার উনি রাখেন না। আব্বুকে চিন্তায় চুপ হয়ে যেতে দেখে অয়ন শুধায়,

“এমপিকে দোষী প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ আমার কাছে মজুত আছে, আব্বু। আমি কেসের কার্যক্রম চলমান রাখার সিদ্ধান্তেই স্থির আছি। তবুও জানতে চাইছি, তোমার কী মতামত?”

ডিসি সাহেব চিন্তাকে পাশ কেটে বলেন,

“আইন এবং তোমার মন যা বলে তা-ই করবে তুমি। কিন্তু নিজের সেফটিও মাথায় রেখে চলবে, বাবু। আপাতত তুমি একটা রিস্কি সিচুয়েশনে আছো, আশা করি বুঝতে পারছো।”

অয়ন জানে সিচুয়েশনটা আসলেই রিস্কি। গতকাল তাকে ভয় দেখানো হয়েছে এবং একইসঙ্গে যেন নীরব হুমকি দিয়ে যাওয়া হয়েছে। আগামীকাল হয়তো সরাসরি কোনো এট্যাক হয়ে বসবে। এমতাবস্থায় অয়নের জীবন ঝুঁকিতে আছে বললে খুব একটা ভুল হবে না। কিন্তু অয়নের বিশ্বাস জীবন মরণ দুটোই আল্লাহর লিখিত নিয়মেই হবে। সেটা নিয়ে এতো ভাবাভাবির কিছু নেই৷ ভয় পেয়ে কেস উইথড্র করে ঘরে বসে থাকার থেকে, আসন্ন যেকোনো বিপদ মোকাবিলা করাটাই একজন সুপুরুষের কাজ। এবং অয়ন আগাগোড়া নিজের নীতিমালায় বিশ্বাসী একজন সুপুরুষ।

বাপ ছেলের মাঝে আর কোনো বাক্য বিনিময় হওয়ার পূর্বেই নীলা বেগম একটা প্লেটে করে পরোটা নিয়ে হাজির হয়। উনাকে দেখতেই কামরুল সাহেব এবং অয়ন চেহারায় স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনেন। এ-ই মানুষটা সারাদিন এই সংসারের মঙ্গলের কথা এবং নিজের স্বামী সন্তানদের ভালো থাকার কথা ভেবে চলেন। তাই উনাকে অহেতুক বাহিরের এসব ক্যাচালের কথা জানিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ফেলতে চান না উনার স্বামী এবং বড়ো ছেলে।

নীলা বেগম এসে চেয়ার টেনে বসতেই অয়ন চোখ তুলে আম্মুর মুখের দিকে তাকায়। বিপদকে অয়ন কখনো ভয় পায় না। ভয় পেলে কখনো পুলিশের চাকরি সে করতো না। তবে তার আম্মুর কষ্টের কারণ হওয়ার কথা ভেবে অয়ন ভয় পায়। আল্লাহ না করুক, তার কখনো কিছু হলে আম্মু ঠিক থাকবে না। এবং আম্মু ঠিক থাকবে না এই ভাবনা অয়নকে কখনো শান্তিতে মরতেও দিবে না। নাস্তা করার মাঝেই নীলা বেগম হুট করে লক্ষ্য করেন ছেলে উনার দিকে কেমন মায়াভরা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা কামরুল সাহেবও লক্ষ্য করেন। নীলা বেগম হেসে বলে,

“কী হয়েছে, আব্বা?”

অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে আব্বুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

“আম্মুকে পেয়ে তুমি জিতেছো, আব্বু।”

ছেলের কথায় কামরুল সাহেব সপ্রতিভ হাসেন। ওদিকে নীলা বেগম কিছুটা লজ্জায় লাল হলেও রসিকতা করে বলেন,

“এদিকে তোমার এই নিরামিষ আব্বুকে পেয়ে আমি জীবনযুদ্ধে বাজেভাবে ঠকে গিয়েছি।”

অয়ন মজা পেয়ে হাসতে শুরু করে। হাসেন নীলা বেগমও। কামরুল সাহেবই কেবল জোর করে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বসে থাকেন। ছেলেকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা উনার মাথা থেকে দূর হচ্ছে না।

__________

দুপুর গড়িয়ে তখন ঘড়ির কাটা প্রায় দুটোর ঘরে স্থির আছে। রোদের তেজ কিছুটা কমলেও গরমের ক্লান্তি যেন আঠার মতো শরীরে লেগে আছে। স্নেহা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ঢুকলো লোকাল এক মার্কেটের ভেতর। কিছু দরকারি জিনিস কেনার উদ্দেশ্যেই এসেছে সে। একটা মুদির দোকানে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র নিচ্ছিলো সে এর মাঝেই ব্যাগে থাকা তার ফোনটা বেজে উঠলো। স্নেহা দোকানদারে সঙ্গে কথা বলতে বলতে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে। স্ক্রিনে নীলা বেগমের নাম্বার। স্নেহা ফোনটা রিসিভ করার চেষ্টা করতেই টের পেলো স্ক্রিনটা ফ্রিজ হয়ে আছে। বারবার স্ক্রিনে চাপ দেওয়া সত্ত্বেও কাজ হচ্ছে না কোনো। স্নেহা বিরক্তি নিয়ে ব্যাক বাটন চাপে, অতঃপর পাওয়ার বাটন। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। ফোনটা পুরোপুরিই হ্যাং হয়ে আছে।

ফোনটা ব্যাগে রেখে দিয়ে স্নেহা আবার কেনাকাটায় মনযোগী হয়। প্রতিদিন এই ফোনের তালবাহানা দেখতে দেখতে সে বিরক্ত। মাঝেমধ্যে মন চায় এক আছাড় মেরে ফোনটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে। কিন্তু সকল মনের চাওয়াকে পাত্তা দিতে নেই। তালবাহানা করলেও অন্তত নিজের কাছে একটা ফোন তো আছে। কিন্তু এটা গেলে আপাতত নতুন ফোন কেনা অসম্ভব স্নেহার পক্ষে। তবে স্নেহা মনে মনে ঠিক করে পরবর্তী মাস থেকে টিউশনির বেতন হতে দু হাজার করে টাকা সে আলাদা করে জমাতে শুরু করবে। একবার নতুন একটা ফোন কিনে নিলেই তার ঘাড় থেকে এই মেয়াদ ফুরিয়ে আসা ফোনের ঝামেলা দূর হবে।

__________

কেনাকাটা করে হলে ফিরে ক্যান্টিন থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে নিতুনকে পড়াতে আসে স্নেহা। এর মধ্যে ফোনটা নিজ থেকেই বন্ধ হয়ে পড়ে আছে তার ব্যাগের এককোণে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে প্রবেশের পূর্বেই স্নেহার চোখে পড়ে বাড়ির নামফলকটা। গেটের বাহিরে একপাশে দেয়ালের উপর বড় করে টানানো নামফলকে লেখা ‘নীলাঞ্জনা’। আজকালকার যুগে বাড়ির এমন চিজি নাম রাখার কারণ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না স্নেহা।

স্নেহার মনে পড়ে নিতুনের মা’য়ের নাম নীলা। তারমানে ডিসি সাহেব বোধহয় নিজের স্ত্রী’র নামেই বাড়ির নাম রেখেছে। বাহ! সরাসরি কখনো ডিসি সাহেবের সঙ্গে দেখা না হলেও স্নেহার ধারণা ছিল কামরুল সাহেব বোধহয় আর দশটা সরকারি কর্মকর্তার মতো কাঠখোট্টা, বদমেজাজি স্বভাবের হবে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে ভদ্রলোক ভালোই স্ত্রী প্রেমি পুরুষ মানুষ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নেহা বাড়ির গেট হয়ে আঙিনায় প্রবেশ করে। কেঁচিগেটের কাছে গিয়ে কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে রয় বেরস মুখে। দুই মিনিট পাড় হয়। কিন্তু কারো আসার নামগন্ধ নেই। স্নেহা বিরক্তি নিয়ে আরো একবার কলিংবেল চাপে। সঙ্গে সঙ্গে সিড়ি ভেঙে তাড়াহুড়ো করে নামতে দেখা যায় একজনকে। সিড়ি ভাঙার শব্দে স্নেহা ভেবেছিল নিতুন আসছে বুঝি৷ কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে নিতুনের বদলে অয়ন নেমে এসেছে চাবি হাতে।

স্নেহা কপাল কুচকে দেখে অয়নের ঘাড়ে ঝুলানো তাওয়াল এবং মাথার ভেজা চুল। দেখে বুঝাই যাচ্ছে মাত্র গোছল করে বেরিয়েছে। কিন্তু দুপুর বেলা এই লোক বাসায় কী করছে এবং নিতুনের বদলে ইনি কেন এলেন সে-ই কারণই বুঝতে পারছে না স্নেহা। অয়ন তালা খুলতে খুলতে নিজেই বলে,

“কেমন আছেন আপনি?”

“ভালো। নিতুন কোথায়? বাসায় নেই?”

অয়ন হাচ্ছি দিয়ে নাক টানতে টানতে জবাব দেয়,

“না। নানাভাই না-কি অসুস্থ। আম্মু এবং নিতুন তাই নানাভাইয়ের কাছে গিয়েছে। আপনাকে জানায় নি?”

স্নেহা বুঝতে পারে নীলা বেগম তখন বোধহয় এটা জানানোর জন্যই কল করেছিল। মনে মনে নিজের ফোনটাকে দুটো গালি দেয় সে। তখন যদি ফোনটা হ্যাং না খেতো, তাহলে এখন তার অযথা রিকশা ভাড়া খরচ হতো না। স্নেহার ভাবনার মাঝেই অয়ন আরেকটা হাচ্ছি দেয়। স্নেহা দু কদম পিছিয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। সে কপাল কুচকে অয়নকে দেখে নেয়। এই লোক তো গতরাতেও ঠিক ছিল। রাতারাতি ঠান্ডা কীভাবে লেগে গেলো? বৃষ্টিতে ভিজেছে না-কি? কিন্তু স্নেহা তো বৃষ্টির থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিজের ছাতা ধার দিয়েছিল। তবুও? স্নেহা মনে মনে ভেবে নেয় দামড়া বাবু ভাইয়া বোধহয় টিনেজ পোলাপানদের মতো দু হাত পেতে বৃষ্টিবিলাস করেছে। স্নেহার ছাতা ধার দেওয়াটা তাহলে অহেতুক উপকার ছিল।

অয়ন ততক্ষণে কেচিগেট খুলে আতিথেয়তার সুরে বলে,

“এই গরমে যেহেতু এসে পড়েছেন তাহলে লেবুর শরবত খেয়ে যান। বাসায় পানি, বরফ, চিনি এবং লেবু আছে। ট্যাংও আছে।”

স্নেহা এক ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করে,

“এক্সকিউজ মি?”

স্নেহার তাকানোর ভঙ্গিমা দেখে অয়ন বুঝে উঠতে পারে না সে আবার কিছু করেছে কি-না। মাথার উপর উত্তপ্ত সূর্য দেখে তো সে ভালো মানুষ হিসেবে শরবতের অফার করলো। এখানে ভ্রু উঁচানোর কী হলো? স্নেহা কথা না বাড়িয়ে উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিলেই অয়ন পিছু ডাকে,

“আবার কী করলাম?”

স্নেহা এক সেকেন্ডের জন্য থেমে জোরে একটা দম নেয়। পৃথিবীতে যদি অন্তত একটা খুন মাফ হতো তাহলে হয়তো সে এই লোককে খুন করে ফেলতো, সবসময় তার ঠান্ডা মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার জন্য। ওদিকে, প্রশ্নটা করে অয়ন নিজেই ভাবছিল যে সে কী ভুল করেছে। দুই সেকেন্ড ভাবতেই সে বুঝে ফেলে যে গড়বড়টা কোন জায়গায় হয়েছে। খালি বাসায় সে স্নেহাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফেলেছে। কি বিব্রতকর একটা ব্যাপার! ধ্যাৎ!

অয়ন দ্রুত পিছু ডেকে বলে,

“শিট! সরি মিস! আমার খেয়াল ছিল না। আমি এতোকিছু ভেবে বলি নি। আমার উল্টোপাল্টা কোনো নিয়ত নেই, সত্যি বলছি।”

স্নেহা পিছনে ফিরে তাকায় না। কোনো জবাবও দেয় না। নীরবে বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে চলে যায়। অয়ন দাঁড়িয়ে রয় কেচিগেটের কাছে। নিজের প্রতি একরাশ বিরক্তি এবং হতাশা নিয়ে। এরকম বেফাঁস কথাবার্তায় যদি সে লাগাম না টানে তাহলে একদিন নির্ঘাত মাইর খাবে।

__________

স্নেহা চলে যেতেই বাসায় প্রবেশ করে নিজ রুমে ঢুকে অয়ন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল মুছতে ব্যস্ত তার হঠাৎ চোখ পড়ে রুমের একপাশে থাকা ওয়াড্রবের উপর রাখা নীল রঙা ছাতার দিকে। অয়নের খেয়াল হয় গতরাতের কথা। স্নেহা ছাতাটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টি নেমেছিল। ছাতা মাথায় ধরে বাইক অব্দি অয়ন নিরাপদেই পৌঁছেছিল। কিন্তু এক হাতে ছাতা ধরে বাইক চালানো তো আর সম্ভব না। তাই সঙ্গে ছাতা থাকা সত্ত্বেও অয়নকে কাকভেজা হয়েই বাসায় ফিরতে হয়। বৃষ্টিতে ভেজার দরুণ আজ সকাল থেকেই ঠান্ডা লেগে আছে তার। তাই থানায় খুব জরুরী কোনো কাজ না থাকায় সে নাস্তা সেড়ে ঠান্ডার ওষুধ খেয়ে ঘুম দিয়েছিল। এক ঘুমে উঠে এখন গোছল সেড়ে কিছুটা আরাম পাচ্ছে সে। যেহেতু হাফ ডে’র ছুটি নিয়েছিল অয়ন তাই এখন ওকে থানায় যাওয়ার জন্য রেডি হতে হবে। কিন্তু স্নেহার ছাতাটা! এটাই তো মনে করে আর ফেরত দেওয়া হলো না। ধুর! কাজের সময় জরুরী কথা মনে না পড়ার বিরক্তি নিয়েই অয়ন রেডি হতে শুরু করে। ফাঁকে ফাঁকে আয়না গলে দৃষ্টিপাত করে ছাতার পানে।

__________

অন্ধকার আকাশটা তখন ভীষণ মেঘে ঢাকা। হলের লাইব্রেরীর ফ্যানগুলো মাথার উপর কিছুটা শব্দ তুলেই ঘুরছে। সন্ধ্যা পরবর্তী এই প্রহরে লাইব্রেরীতে মেয়েদের তেমন একটা ভীড় নেই। রোমাঞ্চকর এবং ঝড়-বৃষ্টি মুখোর এই আবহাওয়াটা সবাই নিজেদের মতো করে কাটাচ্ছে। কেউ কেউ এই ঠান্ডা আবহাওয়া পেয়ে রুমে গায়ে কাথা টেনে ঘুমোচ্ছে। কেউ কেউ আবার বন্ধুদের সঙ্গে একজোট হয়ে হলের রান্নাঘরে খিচুড়ি বসানোর আয়োজন করছে। কেউ কেউ নিজ রুমেই বসে বন্ধুদের নিয়ে চানাচুর মাখার আড্ডায় ডুবে। কেউ কেউ প্রিয় মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত ফোনালাপে ব্যস্ত। তো অপরদিকে কিছু সংখ্যক মানুষ লাইব্রেরীতে বসে বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে রেখেছে। স্নেহাও তাদের মধ্যে একজন।

স্তব্ধ আকাশটা থেমে থেমে বজ্র গর্জন তুলতেই লাইব্রেরী দু একটা খোলা জানালা দিয়ে সে-ই দৃশ্যটা চমৎকারভাবে দেখা যাচ্ছে। তবে স্নেহার সেদিকে ধ্যান নেই। সে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে তাকাচ্ছে টেবিলের উপর থাকা নিজের সেলফোনটার পানে। সাইলেন্ট করে রাখা ফোনটায় পরপর দু’বার কল করে ফেলেছেন খালু। তৃতীয়বারের মতো আবারও কল করছেন। অংকের কঠিন সমস্যা সমাধান বাদ দিয়ে স্নেহা আপাতত এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে চলেছে যে, খালু হুট করে তাকে এতবার কল করছেন কেন?

কলটা রিসিভ করবে না ভেবেও একটা সময় স্নেহা ফোন হাতে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরীর গন্ডি পেরিয়ে নিরিবিলি সিড়ির কোঠায় চলে আসে। খালুর তৃতীয় কলটা ততক্ষণে কেটে গিয়েছে। স্নেহা কলব্যাক করে না। খালুর বিশেষ প্রয়োজন থাকলে তিনি নিশ্চিত আরেকবার কল দিবেন। নিজে আগ বাড়িয়ে কল দিয়ে ফোনের টাকা শেষ করার মতো আগ্রহ স্নেহার নেই। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় খালুর নাম্বার থেকে আবার কল আসে। স্নেহা এবার কলটা রিসিভ করে সালাম দেয়,

“আসসালামু আলাইকুম।”

ব্যস, এতটুকুই। অপর পাশের ব্যক্তিটা কেমন আছে বা কী খবর তা জানার কোনো আগ্রহ স্নেহার মাঝে প্রকাশ পায় না। খালু নামক মানুষটা সালামের জবাব নিয়ে তাই নিজেই প্রশ্ন করে,

“কেমন আছো? ব্যস্ত ছিলে নাকি? কল রিসিভ করতে দেরি হলো যে?”

“ভালো আছি। জি, ব্যস্ত ছিলাম।”

এরকম সরাসরি জবাবে খালু বোধহয় কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। তিনি সামান্য গলা ঝেড়ে নেন। অতঃপর কণ্ঠে তেজ মিশিয়ে বলেন,

“তুমি নাকি বাসা ছেড়ে দিয়েছো? আমিনুল ভাইয়ের সঙ্গে শুনলাম রাগারাগি হয়েছে। একা মেয়ে মানুষ ভার্সিটির হলে কীভাবে কী করছো?”

“জ্বি, ছেড়েছি। আপনার আমিনুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার রাগারাগি হয় নি। রাগারাগি হওয়ার মতো সম্পর্ক আমাদের মধ্যে নেই। আমার ওই বাড়িটা নিজের থাকার উপযোগী মনে হয় নি বলে ছেড়ে এসেছি। হলে বাকি মেয়েরা যেভাবে যা করে, আমিও সেভাবেই করছি।”

“তোমার হলে থাকতে হবে না। রাওফাও ঢাকায় থেকেই পড়াশোনা করবে। আমি ওর জন্য সাভারের ওদিকেই একটা বাসা ভাড়া নিয়ে দিচ্ছি। তুমি বরং ওর সঙ্গে একই বাসায় থাকো। তোমার ক্যাম্পাস থেকে খুব একটা দূর হবে না। দুই বোন একসঙ্গে থাকলে একটু দু’জনই নিজেদের দিকে খেয়াল রাখতে পারবে। হলের থেকে বাসার পরিবেশও ভালো হয়।”

খালুর অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাব শুনে স্নেহার চমকানোর কথা ছিল। সে চমকায় না। এক মিনিট চুপ থেকে বোঝার চেষ্টা করে এমন হঠাৎ সদয় আচরণের রহস্য। বেশি একটা ভাবতে হয় না স্নেহার। সহজেই সে রহস্যটা ধরে ফেলে। ঠোঁটের কোণে মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বলে,

“চোখের সামনে মা হারা রাওফা এবং রাফিয়াতকে দেখে কি আপনার মা হারা স্নেহার প্রতি করুণা অনুভব হচ্ছে, খালু?”

স্নেহার কথা শুনে খালু কিছুটা থতমত খেয়ে যান। মেয়েটা কীভাবে বুঝে গেলো ব্যাপারটা, তিনি বুঝতে পারছেন না। খালুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে স্নেহা নিজেই বলে উঠে,

“আমাকে মা হারা বেচারি মেয়ে মানুষ ভাবার ভুল করবেন না। আমি শুধু এবং শুধুমাত্র স্নেহা, যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে একা চলার শক্তি মিশে আছে। কারো করুণা বা সাহায্যর আমার জীবনে কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি রাওফা এবং রাফিয়াতের বাবা, ওদের বাবা হয়েই থাকুন। আমার অভিভাবক সরূপ কাউকে আমি জীবনে আশা করি নি কখনো এবং ভবিষ্যতেও করবো না।”

কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে খালু বলে উঠে,

“রাওফা, রাফিয়াতকে অন্তত মাঝেমধ্যে কল দিও। তোমার খালার মুখে তোমার নাম শুনতে শুনতে ওরা তোমাকে খুব আপন ভাবে। ওদের সঙ্গে কথা বললে ওদের ভালো লাগবে।”

খালুর কথা শুনে স্নেহার মধ্যে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে নীরবে কলটা কেটে দেয়। চুপচাপ কিছুক্ষণ বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ভাবে খালুর আবদার এবং খালাতো ভাইবোন দুটোর কথা। খালুর আবদারটা স্নেহা রাখবে না। নিজ থেকে রাওফা বা রাফিয়াতকে সে কল দিবে না কখনো। ওই ছেলে মেয়ে দুটোর আত্মীয়স্বজনের অভাব নেই। ওদের ভালো লাগার জন্য সঙ্গের অভাব হবে না কখনো। কিন্তু স্নেহা একা থেকে, একা চলে অভ্যস্ত। দু তিনদিন কারো সঙ্গে কথা বলে সম্পর্ক গাঢ় করতে সে মোটেও আগ্রহী নয়। একবার যদি মানুষের সঙ্গের অভ্যাস হয়ে যায় তখন স্নেহার একা থাকতে খুব অসুবিধা হবে। ক্ষণে ক্ষণে সে একাকিত্বে ভুগবে। স্নেহা এরকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে চায় না বলেই সে নিজের কথা ভেবে এই কঠিন সিদ্ধান্তে অটল। এতে কারো খারাপ লাগলো নাকি ভালো, তাতে তার কিছু যায় আসে না।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]