নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৪.
বৃষ্টি এখনো থামার নাম-গন্ধ নেই। খালুর সঙ্গে কথা বলে ফের লাইব্রেরীতে ফিরেছে স্নেহা। ক্লান্ত কায়দায় হেঁটে নিজের বইখাতা ছড়ানো টেবিলে গিয়ে বসে সে। ফোন রেখে বন্ধ করে রেখে যাওয়া বইয়ের পাতা খুলতেই স্নেহার চোখে পড়ে একটা নীল রঙের স্টিকি নোটের পাতা। স্নেহার কপালে ভাজ পড়ে। উন্মুক্ত স্টিকি নোটে থাকা গোটা অক্ষরে লেখা চিরকুটে সে নজর বুলায়।
“রাস্তার একটা নেড়ি কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে জানা চমৎকার মানুষটার মাথায়ও হাত বুলিয়ে দেওয়ার একটা মানুষ হোক। শ্যাওলা পড়ে যাওয়া দেওয়ালের বাড়ির মতো সাধারণ তবে দৃঢ় মেয়েটার মাথার উপর ছায়া দেওয়ার জন্য একটা বটবৃক্ষ হোক। ফুটপাতে নিঃসংকোচে বসে বিশ্রাম নেওয়া ক্লান্ত মেয়েটার আরামের জন্য কেউ শীতল পাটি হোক। সে-ই মানুষটা আমি হলে, হাতটা আমার হলে এবং পাটিটা আমি হলে কি খুব মন্দ হয়? আপনার উত্তরের অপেক্ষায় আগামীকাল দুপুর একটা বেজে ত্রিশ মিনিটে ক্যাম্পাসের বাহিরের কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে অপেক্ষমান থাকবো…”
তিনটা ডট দিয়ে শেষ হওয়া চিরকুটটা পড়ে স্নেহা সেটাকে এক টানে বইয়ের পাতা থেকে খুলে হাতের মুঠোয় নেয়। হাতের মুষ্টিতে দুমড়ে মুচড়ে ফেলা কাগজটাকে উঠে গিয়ে প্লাস্টিকের ময়লার ঝুড়িতে ফেলে টেবিলে ফিরে আসে। ফের মনযোগ দিয়ে অংক সমাধান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। একবারও লাইব্রেরিতে উপস্থিত কারো দিকে নজর বুলায় না। চিরকুটটা কে দিতে পারে, সেই ব্যাপারে দেখায় না ন্যূনতম কোনো আগ্রহ।
__________
অয়ন আজ সকাল থেকেই বেশ ব্যস্ত। একটা জরুরী কেস নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে সে। সাভারে মাদক সরবরাহে এমপি আখতারুজ্জামানের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে নিজের কাছে মজুদ সকল প্রমাণ নিয়ে সে কাজ করছে। আইনের নিয়ম অনুযায়ী এই জঘন্য কাজে লিপ্ত সকলের শাস্তিই সে নিশ্চিত করবে। সেদিন রাতে বাইক দিয়ে ধাওয়া করার ঘটনাটা অয়নের জেদ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কী ভেবেছে এরা? ভয় দেখালে অয়ন কেস ছেড়ে পালাবে? অয়ন এর শেষটা অবশ্যই দেখে ছাড়বে।
এসব ঝামেলার মধ্যেই হুট করে অয়নের কাছে কল আসে একটা। কলটা নীলা বেগম করেছেন। অসময়ে মা’য়ের কল পেয়ে অয়ন অবাক হয়। মা এখনো নানার কাছে রয়েছেন। নানার কিছু হলো না তো? দু মিনিট সময় বের করে মা’য়ের কলটা রিসিভ করে অয়ন। সালাম দিয়ে বলে,
“জি, আম্মু।”
নীলা বেগম কণ্ঠে কিছুটা তাড়া মিশিয়ে বলে,
“বাবা, নিতুনের স্কুল থেকে কল এসেছে। ও নাকি ফুটবল খেলতে গিয়ে কীভাবে ব্যথা পেয়েছে। তোমার আব্বু তো কাজে সাভারের বাহিরে গিয়েছে। একটু দ্রুত স্কুলে যেতে পারবে, বাবা? গিয়ে দেখ তোমার ভাইয়ের কী হলো। আমি তো তোমার নানাকে অসুস্থ ফেলে আসতে পারছি না…”
মা’কে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে না দিয়ে অয়ন তড়িঘড়ি করে ব্যস্ত হয়ে বলে,
“আমি দুই মিনিটের মধ্যে যাচ্ছি, আম্মু। তুমি চিন্তা করো না। আমি পৌঁছে তোমাকে কল দিবো।”
কণ্ঠে তীব্র দুঃশ্চিন্তা নিয়ে নীলা বেগম কল কাটার আগে বলেন,
“আল্লাহ আমার ছেলেটাকে ঠিক রাখুক।”
অয়ন চট জলদি তিন মিনিটের মধ্যে কাজ গুছিয়ে সময় হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ভাইয়ের স্কুলের উদ্দেশ্যে। বাইকটা একটান দিয়ে নিতুনের স্কুলে পৌঁছাতে প্রায় পনেরো মিনিট লেগে যায়। স্কুলে থাকা মেডিক্যাল রুমের বেডে নিতুন তখন পা সোজা করে শুয়ে ব্যথায় চিৎকার করছে। অয়ন এক প্রকার দৌড়ে এসে উপস্থিত হয় ভাইয়ের কাছে। মেডিক্যাল রুমে প্রবেশ করেই ভাইয়ের এই ভয়ংকর কান্না দেখে সে দ্রুত ভাইয়ের কাছে এগিয়ে যায়। পা ধরে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে,
“ব্যথা পেলি কী করে?”
নিতুন জবাব দিতে পারে না। বরং পায়ে ভাইয়ের হাত পড়তেই সে আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠে। অয়ন এ-ই পর্যায়ে ঘাবড়ে যায়। পাশ থেকে রুমে উপস্থিত একজন স্যার বলে উঠে,
“বাচ্চাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। ফুটবল খেলতে খেলতে কীভাবে কী হয়ে গিয়েছে কেউ-ই বুঝতে পারে নি। ওকে মাঠে পড়ে চিৎকার করতে দেখে আমরা তাড়াতাড়ি ধরে এখানে নিয়ে আসি। নিতুনের আম্মুকেও কল করে জানাই। আমাদের মেডিক্যালে উপস্থিত ডক্টর আন্দাজ করছে পায়ের হাঁটুতে হয় জটিল রগ টান খেয়েছে আর না-হয় লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আপনি দ্রুত ওকে হসপিটালে নিয়ে যান। ওখানে টেস্ট করালে হয়তো আরো ভালো করে বুঝা যাবে ওর কী হয়েছে।”
স্যারের কথা শুনতে শুনতেই অয়ন দ্রুত ফোন বের করে। বাইকে করে নিতুনকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না মনে হচ্ছে তার। রিকশায় উঠাটাও ঝামেলা হয়ে যাবে। তাই সে দ্রুত একটা উবার কল করে নেয় স্কুল গেটের সামনে। নিতুনকে সামলে ধরে স্কুলের গেট অব্দি যেতেই অয়ন দেখে উবার ইতিমধ্যে এসে পড়েছে। বাইকটা ঠিকঠাক জায়গায় পার্ক করা আছে দেখতেই অয়ন নিতুনকে নিয়ে গাড়িতে উঠে। পুরো রাস্তা জুড়ে কান্নাকাটি করতে থাকা ছোট ভাইকে আগলে ধরে রাখে সে। সে-ই সঙ্গে নিতুনকে নিয়ে হসপিটালে যাওয়ার খবরটা পৌঁছে দেয় নিজের আম্মু, আব্বুর নিকট। অতঃপর ভাইকে কিছুটা নরম ধমকের স্বরেই বলতে থাকে,
“হাতে পায়ে এতো বড় হয়েছিস, অথচ এখনো ফুটবল খেলতে গিয়ে ব্যথা পাস। কান্না করিস না, এইতো আরেকটু। হসপিটালে এসে পড়েছি প্রায়।”
ব্যথায় কাতরাতে থাকা নিতুন কেবল বলতে পারে,
“ব্যথা পাওয়ার বয়স হয় না। তুমি যেদিন ব্যথা পাবে সেদিন দেখা যাবে…”
এট্টুক বলেই নিতুন আবারও ব্যথায় কেঁদে উঠে। অয়ন তখন হতাশ কায়দায় মাথা দুলাচ্ছে। পায়ের ব্যথা নিয়ে চিল্লানোর মাঝেও এই ছেলে জবাব দিতে ভুলে না!
__________
শায়নার দিনগুলো ইদানিং খুব আতংকে কাটছে। আপু এবং ভাইয়া যাওয়ার পর থেকে বাসার ভেতর সর্বক্ষণ একটা টাইম বোম্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে-ই টাইম বোম্বটা আর কেউ নয়, বরং তার মা মোমিনা বেগম। মহিলার মেজাজ ইদানিং সর্বক্ষণ খারাপ থাকে। বাসায় মেজাজ খারাপ করার মতো কিছু না হলেও তিনি মেজাজ খারাপ করে বসে রয়। সে-ই খারাপ মেজাজের ঝাল তিনি মেটাচ্ছেন শায়নার উপর দিয়ে। অহেতুক ধমকাধমকি, চড়-থাপ্পড়, অশ্রব্য গালিগালাজের মধ্যে দিয়ে শায়না ভয়ংকর একটা পরিস্থিতি পাড় করছে। যতক্ষণ সে স্কুলে থাকে, ততক্ষণ একটু স্বস্তি পায়। বাসায় ফিরতেই ঘাপটি মেরে নিজের রুমে বসে থাকে। তবুও খুব একটা লাভ হয় না।
এই যেমন আজ বিকালের ঘটনা। সারাদিন স্কুলে এতো পরিশ্রম করে শায়না বিকালে ক্লান্ত দেহটাকে একটু আরাম দিতে বিছানায় শুয়েছিল। ভেবেছিল মাগরিবের আগ অব্দি একটু ঘুমিয়ে নিয়ে পরে পড়তে বসবে। মোমিনা বেগম তখনই রুমে এসে হাজির হয়। শায়নাকে এক টানে ঘুম থেকে তুলে ধমকে জিজ্ঞেস করে, ওয়াড্রবের উপর রাখা পাঁচশো টাকার নোটটা কোথায় রেখেছে? শায়না বিস্মিত এবং ভীত হয়ে জবাব দেয়, তার এই ব্যাপারে কিছু জানা নেই। মোমিনা বেগম বিশ্বাস করেন না। উল্টো শায়নাকে স্টিলের স্কেল দিয়ে পেটাতে শুরু করে। বেরহম মাইরের শিকার হয়ে শায়না গলা ফাটিয়ে কাঁদছিল। কিন্তু মোমিনা বেগম থামেন না। তিনি পেটাতে পেটাতে উদ্ভ্রান্তের মতো বলতে থাকেন,
“ভাইয়ের থেকে শিখছোস? বল… বল, কুলাঙ্গারের বাচ্চা। আর কী কী শিখাইছে তোর ভাই? নেশাপানিও গিলছ? তোরও রিহ্যাবে যাওয়ার শখ জাগছে? জানোয়ারের বাচ্চা… একদম মুখ দিয়া শব্দ বাইর করবি না। পাড়া দিয়ে গলার আওয়াজ বন্ধ কইরা দিমু। একদম চুপ…”
স্কেলের আঘাতে শায়নার হাতের বাহু এবং পিঠ সামান্য কেটে অব্দি গিয়েছে ইতিমধ্যে। তবুও মা’য়ের কথা শুনে ভয়ে সে মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বের করে না। কেবল নিঃশ্বাস আটকে আসার ভঙ্গিতে সে ফোপাঁতে থাকে। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে মোমিনা বেগম নিজেই স্কেল ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ছোট্ট শায়না তখন ব্যথা এবং ভয়ে বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে ভয়ে কাঁপছে। শায়না সবসময়ই ভাবতো তার মা হয়তো শুধুমাত্র স্নেহা আপুকে অপছন্দ করে। কিন্তু সেটা তবুও মানা যায়। স্নেহা আপু মা’য়ের নিজের মেয়ে নয়। তার প্রতি মায়ের মায়া নাই-ই থাকতে পারে। কিন্তু শায়না? শায়না তো নিজের মেয়ে। তাহলে শায়নার সঙ্গে এমন আচরণের কারণ কী? কথা শোনানোর জন্য স্নেহা আপুকে নাগালে না পেয়েই কি দিশেহারা হয়ে নিজের মেয়ের উপর ঝাল মেটাচ্ছে?
শায়না আর কিছু ভাবতে পারে না। বুঝ হওয়ার পর থেকে সে নিজের মা’কে স্নেহা আপুর সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে দেখেছে। কিন্তু কখনো গায়ে হাত তোলার সুযোগ পায় নি। স্নেহা আপুর সঙ্গে হাজার খারাপ আচরণ করলেও মা আপুকে অজানা কারণে ভয় পেয়ে চলতো। কিন্তু স্নেহা তো শক্ত ধাঁচের মানুষ ছিল। শায়না যতই চাক না কেন, সে তো আর আপুর মতো শক্ত হতে পারবে না। আপুর মতো কীভাবে হতে হবে তা ওর জানা নেই। তাই শায়না মা’য়ের ভয়ে সয়ে নেয় মাইর এবং ধমক। একদম চুপ করে, একদম মুখ বুজে।
__________
নিতুনের সে-ই পায়ে চোট পাওয়ার দু’দিন পরের এক দৃশ্য। বৈশাখ মাসের এক দমবন্ধকর দুপুর। চারিদিক জুড়ে গুমোট বাতাস। ক্ষাণিকক্ষণ আগের রৌদ্রজ্জ্বল দুপুরের রূপ বদলে আকাশটা কেমন আঁধার বর্ণ ধারণ করেছে। থেকে থেকেই বজ্রধ্বনির শব্দ শোনা যাচ্ছে। পিচঢালা রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো পাতাগুলো বাতাসের প্রকোপে বাতাসের ঘূর্ণির সঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই বৃষ্টির সম্ভাবনাময় মুহূর্তে অয়ন তার নিজস্ব বাইকটা নিয়ে সাভার মডেল থানায় যাচ্ছে। হেলমেট পরে থাকার ফলে ধুলোবালি চোখে লাগার সুযোগ পাচ্ছে না। আজ তার পরনে রয়েছে নিজের ইউনিফর্মটা। চৌকস দৃষ্টির সম্পূর্ণ মনযোগ তখন রাস্তার পানে নিবদ্ধ। বাইকের গতি মাঝামাঝি অবস্থায় রেখে এগিয়ে চলেছে সে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হুট করে অয়নের দৃষ্টিপাত হয় রাস্তার পাশে ফুটপাতের ওদিকটায়। চার পাঁচটা কিশোর বয়সী ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে পরিচিত নারী মুখটা। আঙুল তুলে বজ্র ধমকে শাসিয়ে যাচ্ছে ছেলেগুলোকে। দৃশ্যপটে আশেপাশে অল্প বিস্তর মানুষের জমায়েতও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঝড়ো বাতাসে হালকা আকাশি রঙা ওড়নাটা কিছুটা উড়ছে, সঙ্গে এলোমেলো ভঙ্গিতে খোলা চুলগুলোও উড়ছে। মুখ জুড়ে প্রশাধনীর বদলে রয়েছে তেজস্বী ভাব। ধমকে বলে চলেছে,
“বাইক লাইসেন্স কোথায় তোমাদের? কে অনুমতি দিয়েছে রাস্তায় ৯০-১১০ স্পিডে বাইক চালানোর? চুপ কেন? পুলিশ ডাকবো আমি? ডাকবো পুলিশ? রাস্তাঘাটে এসব উদ্ভ্রান্তের মতো বাইক চালিয়ে নিজেরা তো মরেই, সঙ্গে মানুষও মারে। মানুষের জীবনের দুই আনারও দাম নেই যেমন…”
কারো স্পষ্ট শাসানোর স্বর, বিদ্যুতের ঝলকের ন্যায় ধমকের ভঙ্গিমা এবং অগ্নিদৃষ্টি দেখতে এতো মনোরম হতে পারে? কে জানে! হুশজ্ঞান হারানো অয়নের কাছে দৃশ্যটা মোহনীয় লাগে। এতটাই মোহনীয় যে সে দৃষ্টি ফেরাতে ভুলে যায়। ভুলে বসে যে সে চলন্ত বাইকে রয়েছে। অয়নের এই অমনোযোগী রূপটাই বিপত্তি ঘটায়। রাস্তা পাড় করতে ব্যস্ত এক ভ্যানের সঙ্গে ধাক্কা লাগে বাইকটার। অকস্মাৎ ধাক্কায় ভ্যান একপাশ হয়ে উল্টে যায়। উল্টে পড়ে অয়নের বাইকটাও। ভাগ্যক্রমে দরিদ্র ভ্যানওয়ালার শারীরিক ক্ষতি না হলেও অয়নের শেষ রক্ষা হলো না। ভ্যানের উপর থাকা সকল পাকা আম তখন পিচঢালা রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাইক সমেত উল্টে পড়া অয়নও সেই আমের উপর পড়ে তব্দা খেয়ে বসে আছে। ধাক্কার প্রচণ্ড আওয়াজে আশেপাশের সকলের মনযোগ ততক্ষণে অয়নের উপর এসে স্থির হয়েছে। কেউ ভাবছে হয়তো বাইকার অসচেতন ছিল, তো কেউ সম্পূর্ণ দৃশ্যপট দেখে হাসিতে ফেটে পড়েছে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছেলেগুলোকে শাসাতে ব্যস্ত স্নেহার মনযোগও তখন বাইকারের পানে নিবদ্ধ। কপালে কিঞ্চিৎ রাগের ভাজ তার এখনো ফুটে আছে, সে-ই সঙ্গে অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে বিরক্তি।
চারিপাশের এতো মানুষকে ছাপিয়ে অয়ন স্নেহাকে দেখতে ব্যস্ত। স্নেহার কটমট করে তাকানোর ভঙ্গিমা দেখে তার পেটের ভেতর যেন প্রজাপতি উড়তে শুরু করে। তার খেয়াল নেই যে ভ্যানওয়ালা তাকে গালমন্দ করে যাচ্ছে বেচারার বিক্রি উপযোগী ফল নষ্ট করার দায়ে। তার খেয়াল নেই যে সে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাকা আমের উপর পড়ে সেগুলোকে নিজের বলিষ্ঠ দেহ দিয়ে চটকে আম ভর্তা বানিয়ে ফেলেছে। তার এটাও খেয়াল নেই যে পাকা রাস্তায় পড়ে তার এক হাতের কনুইটা বিশ্রীভাবে কেটে গিয়েছে, হয়তো হাড় সামান্য নড়েও গিয়েছে।
এমনই এক ঝড়ো দিনে অয়ন হাড়গোড় ভেঙ্গেই প্রেমে পড়ে যায়। একদিন আগেই ছোট ভাইকে ব্যথা পাওয়া নিয়ে জ্ঞান দেওয়া অয়ন বেচারা এতো বাজেভাবেই পড়ে যে উঠে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় থাকে না আর। বলা হয়ে থাকে প্রেমে পড়লে মানুষ এমন সব কাজ করে যা তার করা উচিত না। ভরা রাস্তায় অয়নও করে ফেলে একটা বোকামি। স্নেহাকে আরেকটু পরিষ্কার করে দেখার উদ্দেশ্যে নিজের হেলমেটের শিল্ডটা তুলে এক হাতে। স্পষ্ট হয়ে উঠে তার চোখ জোড়া। স্নেহা সহজেই মানুষ চিনে ফেলতে পারে। ওরকম দীঘির মতো চোখ জোড়া দেখে তার এক মুহূর্ত সময় লাগে না বুঝতে যে পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত লোকটা আর কেউ নয় বরং অয়ন মাহমুদ। এরকম দামড়া একটা লোককে এমন হ্যাবলার মতো রাস্তায় বাইক নিয়ে পড়ে থাকতে দেখে স্নেহার মেজাজের পারদ আরো গরম হয়ে যায়। এই ঘুষখোর পুলিশ নিশ্চিত সর্বোচ্চ গতিতে বাইক চালাচ্ছিল! যে-ই দেশের পুলিশেরই বাইক চালানোর এই দশা, সে-ই দেশের জনগণকে ধমকানোটা খুব একটা কার্যকর নয় বলে মনে হয় স্নেহার। মনে একরাশ ক্ষোভ, বিরক্তি এবং রাগ নিয়ে সে মুখ ফিরিয়ে ক্যাম্পাসের ভেতর চলে যায়। বাপ মা’য়ের ওই দামড়া বাবুকে দু চারটা কঠিন কথা শোনানোর মতো সময় এই মুহূর্তে তার হাতে নেই। তবে যাওয়ার পথে মনে মনে বেশ কিছু বাংলা গালি দিতে ভুললো না স্নেহা।
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]