নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৫.
প্রসস্থ বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে পাশাপাশি আছে দুই ভাই। নীলা বেগম দুই ছেলের পাশে বসে ওজিফা পড়ে ছেলেদের সুস্থতা কামনা করে চলেছেন। সদ্য বাসায় ফেরা কামরুল সাহেবও বিছানার শিয়রে দাঁড়িয়ে দুই ছেলের অবস্থা দেখছেন। এক ছেলে ফুটবল খেলতে গিয়ে চোট পেয়ে এক পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে বসে আছে, তো অন্য ছেলে বাইক এক্সিডেন্ট করে হাত ছিলে সেই সঙ্গে ভয়াবহ জ্বর বাধিয়ে বসে আছে। একসঙ্গে দুটো ছেলের এই অবস্থা হয়ে যাওয়ায় নীলা বেগম এবং কামরুল সাহেব দু’জনের মনটাই বিষণ্ণ হয়ে আছে।
নীলা বেগম ছেলেদের ব্যাপারে খুবই আবেগী। গত দু’দিন ধরে উনার দুই চোখ দিয়ে কেবল অশ্রুধারা বয়ে চলেছে। এখনো উনি নীরবে কাদতে কাদতেই দোয়া পড়ছিলেন। কামরুল সাহেব স্ত্রীকে এই পর্যায়ে কিছুটা ধমকেই বলেন,
“আহ, কান্না থামাও। কান্নাকাটি করলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো। নিজে অসুস্থ হলে এই দুই ছেলের খেয়াল রাখবে কী করে?”
নীলা বেগম খুব একটা কুসংস্কারে বিশ্বাসী নয়। তবে তিনি নজর নামক ব্যাপারটাকে খুব মেনে চলেন। তিনি কান্না চেপে করুণ স্বরে বলেন,
“আমার বাবা দুইটার নজর লেগেছে। আব্বার এখানে গেলাম না? সেখানে ওই প্রতিবেশী খালাম্মার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। উনি বারবার করে বাবু এবং নিতুন কতটা বড়ো হয়েছে দেখতে চাচ্ছিলেন। আমি বাধ্য হয়েই উনাকে আমার ছেলেদের ছবি দেখাই। অসভ্য মহিলা একটা, মুখ দিয়ে মা শা আল্লাহ বেরই হয় নি উনার। উল্টো বাবু, নিতুনকে দেখে, ও মা বলে চিল্লিয়ে উঠেছে। আমার তখনই পেটে মোচড় দিয়েছিল। যেভাবে ছবির দিকে তাকিয়ে মহিলা ঢোক গিলেছেন…”
কামরুল সাহেব স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
“আল্লাহ ভরসা। এসব বলে লাভ নেই। ডক্টর তো বলেছেন, দুইজনই সুস্থ হয়ে যাবে। আর অন্য মহিলার নজরের দোষ দিয়ে লাভ আছে? তোমার দুই ছেলে যে গায়েগতরেই বড়ো হয়েছে শুধু, সেটা দেখতে পাচ্ছো না? নিতুন সবসময়ই বাঁদর, ওরটা তা-ও মানা যায়। কিন্তু বাবু? ও কি-না একটা পুলিশ অফিসার হয়ে খালি রাস্তায় বাইক এক্সিডেন্ট করে পড়ে থাকে। ওকে জিজ্ঞেস করো তো, বাইক চালানোর সময় ও চোখ কোথায় দিয়ে রেখেছিল? কী লজ্জার একটা ব্যাপার! আমার ছেলে রাস্তায় আমের উপর পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিল!”
বড়ো ছেলের বিরুদ্ধে কথা শোনার ধাঁত নেই নীলা বেগমের। তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেন,
“আমার বাবু কি ইচ্ছে করে এক্সিডেন্ট করেছে নাকি? এভাবে বলছেন কেন? এরকম বেহুশের মতো কাজ ও কি এর আগে কখনো করেছে? ছেলেটা যে কি বাজেভাবে হাত ছিলে ফেলেছে, সেটা দেখছেন না? ব্যথায় একেবারে জ্বরে কাবু হয়ে আছে।”
নিতুন সজাগ বসেছিল। পায়ের ব্যথায় তার জগতের কিছুই ভালো লাগছে না। হাঁটুর লিগামেন্টের মাঝারি আকৃতির ছিঁড়লেও, পা ঠিক হতে লম্বা সময় লাগবে ডক্টরের ভাষ্যমতে। আপাতত পায়ে ক্রিপ ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে হালকা করে। কিছুদিন বেডরেস্টে থেকে পায়ের ফোলা কমার অপেক্ষা করতে হবে আগে। এর মধ্যে ডক্টরের বলা অন্যান্য চিকিৎসাও নিতে হবে। তারপর প্রয়োজন অনুসারে ফিজিওথেরাপি করাতে হতে পারে।
নিতুনের পাশেই বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে অচেতন অয়ন। জ্বরে পুরোপুরি কাবু সে। বৃষ্টিতে ভেজার বেশ কয়েকদিন পাড় হয়ে গিয়েছে। এই কয়েকদিন পাড় হয়ে যাওয়ার পর জ্বর কেন এলো, কে জানে? প্রেম বৃষ্টিতে কাবু হওয়া জ্বর হবে সম্ভবত। অচেতন অবস্থায়ও তার চোখের পর্দায় ভাসছে সে-ই কাল বৈশাখীর রাতে বিদ্যুতের ঝলকে দেখতে পাওয়া স্নেহার ফিরে তাকানোর দৃশ্য। ছোট্ট জীবনে অয়ন প্রকৃতির অসংখ্য চমৎকার দৃশ্য দেখেছে। কিন্তু অন্ধকারাচ্ছন্ন সে-ই রাতে প্রকৃতির সৌন্দর্য যেন সে নতুন করে আবিষ্কার করেছে।
অচেতন অবস্থায় স্নেহার ফিরে তাকানোর স্মৃতিচারণ করতে করতে অয়ন কী যেন বিড়বিড়িয়ে উঠে। নীলা বেগম ব্যস্ত হয়ে বড়ো ছেলের পাশে উঠে বসেন। ছেলের জ্বর পরখ করতে করতে তিনি স্বামীকে পাঠান জলপট্টি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে। নিতুন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,
“এখন দেখলে তো ভাইয়া, ব্যথা পেতে বয়স লাগে না? হেহ, আমার কান্নাকাটির জন্য কথা শোনাচ্ছিলে। এখন কে বাচ্চাদের মতো গোঙাচ্ছে?”
অয়নের কানে নিতুনের কথা পৌঁছায় না। জ্বর এলেই সে খুব অসহায়দের মতো আচরণ করে। আজও জ্বরের ঘোরেই অসহায়ের ন্যায় প্রলয় বকতে থাকে,
“মা… মা… মা…”
ছেলের অবস্থায় নীলা বেগমের মাতৃ হৃদয় আরেকটু আবেগে ভেসে যায়। তিনি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন,
“হ্যাঁ, বাবা। এইতো আম্মু, এইতো মা।”
__________
ফাহিম নামক এক স্টুডেন্টকে পড়িয়ে সবে বেরিয়েছে স্নেহা। দুপুরের ঠিক সেই ক্ষণ এখন, যখন কি-না রাস্তাঘাট একেবারেই সুনসান থাকে। অলস দু চারটে কুকুর বাদে রাস্তায় কোনো মানুষের আনাগোনা নেই। তাছাড়াও ফাহিমের বাসার এদিকে সচারাচর মানুষের সমাগম কমই থাকে বলা যায়। আজ মাথার উপর রোদের তাপটাও তীব্র। স্নেহার হেঁটে যাওয়ার মতো একটুও শক্তি নেই। বিভিন্ন ব্যস্ততায় গত দু’দিন ধরে পানি খুবই কম খাওয়া পড়ছে তার। তাই ডিহাইড্রেশনে ভুগছে বোধহয় কিছুটা।
ক্লান্ত স্নেহা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে দুই পাশে দৃষ্টি বুলায়। কোনো খালি রিকশার আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। স্নেহার মেজাজ খারাপ হয়। যখন টাকা বাঁচানোর জন্য সে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করে, তখন ঠিকই রিকশার কোনো অভাব হয় না। অথচ যখন সে একটু আরাম পেতে রিকশা খুঁজে, তখন যেন বাংলাদেশের সব রিকশা একইসঙ্গে উধাও হয়ে যায়। স্নেহা বিরক্তি নিয়ে ফুটপাত হয়ে হাঁটা ধরে। ঠিক তখনই হঠাৎ কোথা থেকে একটা রিকশা এসে তার পাশেই থামে। স্নেহা কিছু বলার পূর্বেই রিকশাওয়ালা নিজেই বলে উঠে,
“চলেন আপা, আপনাকে আমিনবাজারে নামায় দেই।”
স্নেহা চমকায়। পরমুহূর্তেই তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠে সন্দিহান ভাব। সে জিজ্ঞেস করে,
“আমি আমিনবাজার যাবো, সেটা আপনি কীভাবে জানলেন?”
মধ্যবয়স্ক রিকশাওয়ালা থতমত খেয়ে যায় নিজের বোকামিতে। তিনি ভয়ে কিছু বলতে পারেন না। কেবল বলে উঠে,
“এইদিকে এখন রিকশা পাইবেন না, আপা। চলেন। আপনারে নামায় দিয়ে আসি।”
রিকশাওয়ালার কথা শুনে স্নেহা এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি নত করে সূত্র মেলানোর চেষ্টা করে। ঘটনা কী তা বুঝতে চাইছে সে। সুনসান রাস্তায় এই রিকশার আগমন এবং রিকশাওয়ালার কথাবার্তা খুবই সন্দেহজনক। তবে কী… স্নেহা আর কিছু ভাবার আগেই ঠিক সে-ই মুহূর্তে তার সামনে দিয়ে একটা বাইক চলে যাওয়ার শব্দ হয়। স্নেহা চকিতে চোখ তুলে তাকায়। দেখে মোটামুটি উচ্চ গতিতে তার সামনে দিয়ে চলে যাওয়া বাইক এবং বাইকের মালিককে। কালো রঙের বাইকের উপর বসে থাকা বাইকের মালিকের মুখ দেখার সুযোগ হলো না স্নেহার। হেলমেট পরিহিত লোকটার কেবল গায়ের গড়ন এবং পরিহিত পোশাকই তার চোখে পড়ে।
ছিমছাম গড়নের লোকটার পরনে ছিল একটা সাদা রঙের টি শার্ট এবং জিন্স। গায়ের রঙটাও স্নেহার ন্যায় রোদে পোড়া। সেকেন্ড কয়েকে স্নেহা এতটুকু দেখতেই বাইকটা মোড় ঘুরে দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে যায়। আর দেখা হলো না স্নেহার… তবে এতটুকু সে নিশ্চিত এই লোকটা তার পরিচিত কেউ নয়। তবে কে হতে পারে? সে-ই অদ্ভুৎ চিরকুটের লেখক? দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতেই স্নেহা চোখ তুলে রিকশাওয়ালার দিকে তাকায়। এক প্রকার আগুন ঝরা স্বরে সে জিজ্ঞেস করে,
“এই বাইকওয়ালা আপনাকে পাঠিয়েছে এখানে? চুপ থাকবেন না। জবাব দেন এক্ষুণি…”
রিকশাওয়ালা ভীত ভঙ্গিতে কোনো মতে জবাব দেয়,
“আপা, আপনি দাঁড়ায় থাইকেন না। ভাইয়ে কইছে আপনারে নামায় দিয়ে আসতে। চলেন আপা।”
স্নেহার গা রাগে রিরি করতে থাকে। ফাইজলামি চলছে এখানে? তাকে কেউ স্টক করে বেড়াচ্ছে আর স্নেহা সেটা টেরই পায় নি? অসম্ভব! এই লোক কি স্নেহার থেকেও বেশি বুদ্ধিসম্পন্ন? ধূর্ত বুদ্ধি দিয়ে স্নেহার মতো একজনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে? কি সাহস! কি মারাত্মক দুঃসাহস! রিকশাওয়ালা আবারও বলে উঠে,
“আপা, যাইবেন না?”
স্নেহা রণচণ্ডী রূপ নিয়ে ঝাঁঝালো কায়দায় জবাব দেয়,
“নিজের অসভ্য, লাফাঙ্গা ভাইকে সাবধান করে দিবেন। আমি ফাইজলামি হজম করি না। এই ধরনের কাজ আর কখনো করতে দেখলে খুব খারাপ হবে তার সঙ্গে।”
কথাটা শেষ করেই স্নেহা হনহনিয়ে হাঁটা ধরে। রিকশাওয়ালার সাহস হয় না তার পিছুপিছু আসার। উনি আপন জায়গায় রিকশা নিয়ে স্থির রয়। ঠিক সে-ই সময়ই তার শার্টের বুকপকেটে থাকা বাটন ফোনটায় একটা কল আসে। কলটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরতেই অপর পাশ থেকে ভেসে আসে একটা প্রশ্ন। রিকশাওয়ালা সে-ই প্রশ্নের জবাবে বলে,
“রাগী আপা তো চেইত্তা গেলো গা।”
__________
কলিংবেল বেজে উঠতেই নীলা বেগম ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন দরজা খুলতে। ওড়নার আঁচলে হাত মুছে দরজা খুলতেই তিনি দেখেন স্নেহা দাঁড়িয়ে। মেয়েটার ঘেমে বাজে অবস্থা। মুখটাও কেমন শুকনো দেখাচ্ছে। স্নেহা সালাম দেয়,
“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।”
নীলা বেগম ব্যস্ত হয়ে দরজার প্রবেশ পথ থেকে সড়ে দাঁড়িয়ে স্নেহাকে জায়গা করে দিয়ে বলে,
“এসো, স্নেহা। সরি, তোমাকে এই দুপুরবেলা কষ্ট করে আসতে হলো। বাহিরে যা গরম!”
স্নেহা ঘরে প্রবেশ করতে করতে বলে,
“অসুবিধা নেই, আন্টি। আমি তো এই সময়ই পড়াই সবসময়। আমার অভ্যাস আছে।”
নীলা বেগম স্নেহাকে আর ড্রয়িং রুমে বসতে দিলেন না। বরং নিজের রুমে নিয়ে এসি অন করে বসালেন। এই মেয়েটাকে দেখলে অজানা কারণে উনার মায়া অনুভব হয়। আঁচ করতে পারেন মেয়েটার পরিশ্রম সম্পর্কে। এরকম মেয়েকে এসির নিচে বসিয়ে দু মিনিট স্বস্তি দিতে পারলেও উনার ভালো লাগে। স্নেহা নিজের হাতে থাকা ফলের ব্যাগটা নীলা বেগমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন,
“নিতুনের জন্য, আন্টি।”
“তুমি আবার এসব আনতে গেলে কেন?”
স্নেহা সামান্য সৌজন্যবোধের হাসি ফোটায় ঠোঁটে। নিতুনের পায়ের চোট সম্পর্কে তাকে দু’দিন আগেই জানানো হয়েছে। অসুস্থ বলে এই দু’দিন সে নীলা বেগমের কথাতেই নিতুনকে পড়াতে আসে নি। আজও পড়ানোর উদ্দেশ্যে আসে নি। বরং কিছু কথা বলতে তাকে ডাকা হয়েছে। এখন অসুস্থ কারো বাসায় আসলে অন্তত দুটো ভালো মন্দ ফল নিয়ে আসাটাও এক ধরনের সামাজিকতা। অসামাজিক স্নেহার মনে হলো এট্টুক সামাজিকতা না দেখালে ব্যাপারটা খুবই বিশ্রী হবে। তাই সে ফলের দোকান থেকে খুঁজে দেশী তিন পদের ফল নিয়ে এসেছে অল্প করে।
নীলা বেগম স্নেহাকে বসিয়ে একটু রান্নাঘরে যেতে চাইলে স্নেহা কিছুটা অনুরোধ করে বলে,
“আন্টি, প্লিজ কোনো ঝামেলা করবেন না।”
নীলা বেগম সবসময় স্নেহার সঙ্গে কোমল স্বরে কথা বলেই অভ্যস্ত। তবে আজ তিনি মৃদু ধমক এবং শাসনের স্বরে বললেন,
“তুমি বসো চুপচাপ। আজকে কোনো না শুনবো না। আন্টি যা দিবো চুপচাপ খাবে। ক্যান্টিন থেকে লাঞ্চ করে আসলেও খেতে হবে। না-হয় যেতে দিচ্ছি না।”
স্নেহা আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। নীলা বেগম বেরিয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে রুম থেকে। কিছুটা অস্বস্তিতে স্নেহা নিজেই নিজের নখ খুটছে। নীলা বেগমকে নিয়ে তার মনে তেমন কোনো সন্দেহ অনুভব হয় নি কখনো। তবুও সে কীভাবে বোঝাবে যে সে অচেনা, অজানা কারো দেয়া খাবার খায় না? স্নেহা একা মানুষ। তাকে কেউ মেরে গুম করে দিলেও কেউ তার খোঁজ করতে আসবে না। তাই স্নেহা নিজেই নিজের কারণে সবসময় সতর্ক থাকে।
স্নেহা আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা হাসফাস করতে থাকে। হুট করে তার চোখে পড়ে একটা জিনিস। রুমের একটা কেবিনেটের উপর থাকা ফটোফ্রেমটা। ফ্রেমের ভেতরে বেশ কয়েকটা ছবি একসঙ্গে রাখা। সেখানে ডিসি কামরুল সাহেব, নীলা বেগম এবং উনাদের দুই ছেলের বেশ কিছু ছবি রয়েছে। তবে একটা ছবিতে অচেনা এক সদস্যকেও দেখা যাচ্ছে। মানুষটা কে হতে পারে আন্দাজ করার পূর্বেই নীলা বেগম রুমে প্রবেশ করে একটা ঠান্ডা শরবতের গ্লাস হাতে। স্নেহাকে শরবতের গ্লাসটা দিয়ে নীলা বেগম তার সামনে বসেন। গ্লাস হাতে নিলেও স্নেহা সেটাতে চুমুক দেয় না। বরং নীলা বেগমকে প্রশ্ন করেন,
“নিতুনের এখন কী অবস্থা, আন্টি?”
নীলা বেগম মন খারাপ করে বলেন,
“কী আর বলবো! পা নিয়ে হাঁটাচলা কিছুই একা করতে পারছে না ছেলেটা। এই বছরই এমন একটা ব্যথা পেলো! ওর জন্য চিন্তায় কাহিল অবস্থা। এর মধ্যে আবার নিতুনের ব্যথা পাওয়ার পরের দিন বাবুটাও কী ভয়ংকর একটা বাইক এক্সিডেন্ট করে বাড়ি ফিরলো। ভাগ্যিস বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। হাত পা ছিলেছে এই আরকি। কিন্তু ব্যথায় আজ দু’দিন ধরে ছেলে আমার অচেতন হয়ে পড়ে আছে। দুটো ছেলেরই এই অবস্থা দেখলে কি আর ভালো লাগে, বলো?”
বাবা-মা’য়ের দামড়া বাবু অর্থাৎ অয়নের সে-ই বাইক এক্সিডেন্ট সম্পর্কে স্নেহা আগে থেকেই অবগত। তা-ই সে সেটা নিয়ে খুব একটা অবাক হলো না। তবে সামান্য এক এক্সিডেন্টে একটা প্রায় ছয় ফুটের তাগড়া লোক জ্বর এনে অচেতন হয়ে আছে শুনে সে অবাক হলো। এই লোক এতটা নাজুক? এখন তো স্নেহা প্রায় নিশ্চিত যে এই লোক জালিয়াতি করে পুলিশ হয়েছে। না-হয় এই চড়ুইয়ের কলিজা নিয়ে পুলিশ কীভাবে হলো?
নীলা বেগম মহিলা মানুষ। দুই মিনিটের জন্য মন খারাপের কথা বলার মানুষ পেতেই তিনি দুঃখী মুখ নিয়ে বলে যেতে থাকলেন,
“নিতুনটা মোটামুটি একটু শক্ত আছে। এতো বড়ো একটা ব্যথা পেয়েও হাসিঠাট্টা করে বেড়াতে পারে। প্রায় প্রতিনিয়তই বাদড়ামি করতে গিয়ে ব্যথা পেয়ে অভ্যস্ত বলে, ব্যথা বা অসুস্থতা ওকে খুব একটা কাবু করতে পারে না। কিন্তু বাবু হয়েছে একদম ওর বিপরীত। সহজে কখনো অসুস্থ হয় না বা ব্যথা পায় না। কিন্তু একবার অসুস্থ হলে ছেলেটার শরীর ছেড়ে দেয় একদম। বাচ্চাদের মতো বিছানায় লেপ্টে থাকে। এতো বড়ো হয়ে গিয়েছে এখনো অসুস্থ হলে মা’কে খুঁজে। ওকে অসুস্থ দেখলে আমি আরো ভেঙে পড়ি। ছেলেটা গত এক বছর পোস্টিংয়ের জন্য যখন আমাদের থেকে দূরে ছিল, তখন অসুস্থ হলে কীভাবে কী সামলেছে ভাবলেই বুক ফেটে যাচ্ছে। এতো মায়া হয় ওর জন্য!”
স্নেহা নীরবে শুনে সবটা। সাধারণত মানুষের এসব আলাপে তার খুব একটা আগ্রহ নেই। কিন্তু আজ না চাইতেও সে মনযোগী মনে নীলা বেগমের কথা শুনছেন। স্পষ্ট দেখছে তার সামনে বসে থাকা একজন মহিলাকে, যার কি-না সন্তানের অসুস্থতা নিয়ে দুটো কথা বলতে গিয়েও চোখ চিকচিক করে উঠছে জলে। স্নেহার একটা মা থাকলে বোধহয় স্নেহাও অসুস্থ হতো, স্নেহাকে নিয়ে ঠিক এমনই আবেগী হতো সেই মাতৃসলুভ হৃদয়। স্নেহা আনমনে প্রশ্ন করে বসে,
“বড়ো ছেলেকে নিয়ে বোধহয় আপনি বেশি আবেগী, তাই না?”
নীলা বেগম কিছুটা মৃদু হেসে বলে উঠেন,
“হ্যাঁ, আমার প্রথম বাচ্চা না? ওর আব্বুর প্রস্তাব যেদিন আসে আমি তো বাসায় চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেই যে কক্ষনো বয়সে এতো বড়ো একটা লোককে আমি বিয়ে করবো না। কিন্তু যেদিন উনি দেখতে এলেন সেদিন উনার সঙ্গে বসে থাকা দীঘির মতো টলটলে চোখের বাচ্চাটার মায়ায় পড়ে গিয়েই আমি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাই। এতো মায়ায় মোড়ানো একটা ছেলের মা হওয়ার লোভ আমি সামলাতে পারি নি। তাই ওর আব্বুকে বিয়ে করে হয়ে যাই আমি আমার বাবুর আম্মু।”
স্নেহা না চাইতেও অবাক হয়। বিস্ময় প্রকাশ পায় তার চোখেমুখে। সে সে-ই বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করে বসে,
“আপনি উনার আসল মা না?”
নীলা বেগম হেসে দিয়ে বলেন,
“আসল নকল আবার কী জিনিস? মা তো মা-ই। পেটে ধরি নি, এ-ই যা। এই-যে ফোটো ফ্রেমে এই চমৎকার সুন্দর মানুষটাকে দেখছো না? উনিই ডিসি সাহেবের প্রথম স্ত্রী এবং বাবুর জন্মদাত্রী মা, সানজানা আপা।”
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]