নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২২.
‘কোৎ’ করে আর্তনাদ তুলে বেণি প্যাঁচিয়ে ধরা হাতটা ঢিলে হয়ে আসে। স্নেহা এই সুযোগে দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তার উপর হামলা চালানো ব্যক্তিটার চেহারা দেখতেই চমকায় সে। পরমুহূর্তেই রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“তুই!”
সামিউলের চেহারাটা হিংস্র দেখাচ্ছে। নাক চেপে ধরে সে ভয়ংকর চোখে স্নেহাকে দেখে ফোস ফোস করছে। স্নেহা সতর্ক হয়। এই অমানুষ যে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আছে তা সে ভালো করেই টের পায়। তাই দ্রুত পিঠ ঘুরিয়ে সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সামিউলের শরীরে যেন দানব ভর করে আছে। সে এক থাবায় আবার স্নেহার চুল ধরে তাকে এক টানে রাস্তায় ফেলে। প্রথম আঘাতে স্নেহার ডান গালের একপাশের চামড়া ছিলে রক্ত বের হচ্ছিলো। এবারের হামলায় সে ছিটকে পাকা রাস্তায় পড়ে। পা হাত সঙ্গে সঙ্গে ছিলে রক্ত বেরিয়ে আসে। জোরে চুল টেনে ধরায় মাথাও টনটন করে ব্যথা করছে।
স্নেহা আত্মরক্ষার জন্য মরিয়া। জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকে কারো সাহায্যের জন্য। পাশাপাশি হাতের নাগালে পাওয়া কিছু পাথর নিয়ে ছুড়ে মারে সামিউলের পানে। একটা পাথর সরাসরি সামিউলের চোখের কাছে লাগে। সামিউক ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠে। রাগে আরো উন্মাদ হয়ে উঠে সে। মুখ দিয়ে অশ্রব্য গালিগালাজ করে চলেছে স্নেহাকে। তুইতুকারি করে বলছে,
“তোরে আমি কাইট্টা ফেলমু, মা*র বাচ্চা।”
স্নেহা যে দ্রুত উঠে দৌড়ে যাবে তা পারছে না। দু পায়ের হাঁটু ছিলে একদম বাজে অবস্থা তার। একটুও নাড়াতে পারছে না সে। চেঁচাতে চেঁচাতে সে দ্রুত নিজের ব্যাগ থেকে ফোন বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার আগেই সামিউল একটা অভাবনীয় কাজ করে। উদ্ভ্রান্তের মতো আশেপাশে তাকিয়ে রাস্তার কোণ থেকে একটা বিশাল আকারের পাথর তুলে নেয় দু হাতে। অতঃপর এগিয়ে আসতে নেয় পাথর দিয়ে স্নেহার মাথা থেতলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এরকম মুহূর্তে পৃথিবীর যে কেউ-ই প্রাণ ভয়ে ভীত হবে। স্নেহাও ভয় পায়। সে জোরে চিৎকার করে দু-হাত তুলে নিজের চোখ মাথা ঢেকে ফেলে।
স্নেহা ভাবছিল এই জনমানবশূন্য রাস্তায় পাথর চাপা খেয়ে বুঝি তার মরতে হবে। এটাই বোধহয় তার শেষ মুহূর্ত। কিন্তু কিয়ৎকাল সময়ের মধ্যেই ঘটে যায় এক অভাবনীয় ঘটনা। কোথা থেকে একটা বাইক ছুটে আসে। বাইক পুরোপুরি থামার আগেই কেউ একজন বাইক ফেলে লাফিয়ে নামে। ছুটে এসে পাথর সহ সামিউলকে টেনে দূরে নিয়ে যায়। রাস্তায় ফেলে সামিউলকে এলোপাথাড়ি মারতে থাকে। সামিউল প্রতিহত করে। উঠে দাঁড়ায়, পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে। দু’জনের মারামারির মাঝে স্নেহা সময় পায় উঠে দাঁড়ানোর। ভয়ে তার কলিজা এখনো কাঁপছে। তার চোখ স্থির রাস্তার পাশে পড়ে থাকা বিশাল আকৃতির পাথরটার পানে। আরেকটু… আরেকটু দেরি হলেই এই পাথর দিয়ে তার মাথা থেতলে দেওয়া হতো। অভিভাবকহীন স্নেহা এই রাস্তায় মরে পড়ে থাকতো। পরের দিন সকালের তাজা খবরের কাগজে তার এই ভয়ংকর মৃত্যুর কথা ছাপানো হতো।
স্নেহা চোখ তুলে তাকায় সামনে। নীল শার্ট পরিহিত যেই লোকটা সামিউলকে পেটাচ্ছেন উনি যে অয়ন, তা বুঝতে ওর অসুবিধা হয় না। একটা রিকশা এদিকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। সামিউলের ভরসা নেই। সাথে যদি চাকু টাকু থাকে? অয়নের যদি শারীরিক ক্ষতি করে? স্নেহা তাই খুড়িয়ে হেঁটে কিছুটা সামনে এগিয়ে অয়নকে ফেরানোর চেষ্টা করছিল। সামিউল সুযোগ পায়। স্নেহার প্রতি ক্ষোভ থেকে সে একটা ভয়ংকর কাজ করে বসে। শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে সে চোখের পলকে স্নেহার তলপেট বরাবর একটা লাথি বসায়। অতর্কিত লাথি খেয়ে স্নেহা ছিটকে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। চলন্ত রিকশার সঙ্গে লেগে তার হাতের কনুইয়ের অংশ কেটে যায়। একসঙ্গে এতোগুলো জঘন্য আঘাত পেয়ে স্নেহা রাস্তায় পেট চেপে ধরে বসে পড়ে। ব্যথায় ছটফট করতে করতে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে।
কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই ঘটে যাওয়া ঘটনায় অয়ন হতভম্ব হয়ে স্নেহার দিকে তাকিয়ে ছিল। মাথা থেকে এখনো হেলমেটটা খোলার সুযোগ অব্দি হয় নি তার। এর পূর্বেই চোখের সামনে স্নেহাকে চিৎকার করতে দেখে তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়। সে ঘুরে তাকায় তার হাতের থাবায় বন্দী সামিউলের পানে। অয়ন ছেড়ে দেয় সামিউলের ঘাড়টা। সামিউল স্নেহার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি হাসতে হাসতে উচ্চারণ করছিল,
“মর, মা*। মর। আমারে রিহ্যাবে পাঠানোর মজা…”
সামিউল সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই অয়ন দ্রুত হাতে নিজের মাথা থেকে ভারী, শক্ত হেলমেটটা খুলে সেটা শক্ত করে ধরে ঘুরিয়ে মারে সামিউলের মুখ বরাবর। সামিউলের মাথা ভনভন করে উঠে। চোয়ালের হাড় বুঝি তার ভেঙে গেলো। সে লুটিয়ে পড়ে রাস্তায়। অয়ন থরথর রাগে কাপতে কাপতে ঠিক সে-ই পাথরটাই তুলে নেয় যেটা দিয়ে কিছুক্ষণ আগে স্নেহাকে মারার চেষ্টা করা হচ্ছিলো। মাথা বরাবর পাথর ছুঁড়ে মারতেই নিবে ঠিক সে-ই মুহুর্তে অয়নের কানে ভেসে আসে পেছন থেকে স্নেহার চিৎকারের আওয়াজ। সে-ই সঙ্গে ভেসে আসে অপরিচিত একটা মহিলার কণ্ঠস্বর,
“আয়হায়… মেয়েটা তো মনে হয় মরে যাচ্ছে।”
অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। দেখতে পায় রাস্তায় পেট চেপে ধরে যন্ত্রণায় গড়াগড়ি খেতে থাকা স্নেহাকে। তার হাত থেকে পাথরটা পড়ে যায় সামিউলের পায়ের উপর। সামিউল গগনবিদারী একটা চিৎকার করে উঠে। সেদিকে তাকানোর সময় নেই অয়নের। সে ছুটে যায় স্নেহার কাছে। চলন্ত রিকশা থামিয়ে নেমে আসা মহিলা স্নেহার শিয়রে বসে চেঁচাচ্ছে। অয়ন দ্রুত কোনো কথা না বলে স্নেহাকে পাজাকোলে তুলে রিকশায় বসিয়ে নেয়। এতে পেটের ব্যথায় মেয়েটা আরো বেশি চেঁচিয়ে উঠে অস্ফুটে ডাকতে থাকে,
“মা, মা, মা।”
অয়ন ততক্ষণে নিজেও স্নেহার পাশে উঠে বসেছে। ভদ্রমহিলা নিজের রিকশাটা ছেড়ে দিয়েছেন আহত মেয়েটার জন্য। রিকশা চলতে শুরু করে। অয়ন একহাতে স্নেহাকে ধরে রেখে অন্য হাতে ফোন থেকে থানায় কল করছে। কল রিসিভ হতেই সে দ্রুত বুঝিয়ে দিতে থাকে অর্ডার। স্নেহা তখন অয়নের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আওড়াচ্ছে,
“মা… মা।”
অয়ন শুনে তা। কানে ফোন চেপে ধরে রেখেই সে তাকায় স্নেহার পানে। এভাবে স্নেহার মুখে বারবার মা ডাক শুনে ওর হুট করেই মনে হয়, ও স্নেহার মধ্যে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। একই আয়নার এপিঠ ওপিঠ হওয়া সত্ত্বেও দু’জনের জীবনে কি আকাশ পাতাল তফাত। একজনের মা না থাকা সত্ত্বেও সে সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড়ো হয়েছে এবং অপরজন জীবনের প্রতিটা পদে ঠোকর খেয়ে এই অব্দি এসেছে।
__________
অয়ন ইচ্ছেকৃত ভাবেই কোনো সরকারি হসপিটালে না গিয়ে সাভারের একটা প্রাইভেট হসপিটালে নিয়ে এসেছে স্নেহাকে। সরকারি হসপিটালের লম্বা রোগীর সিরিয়ালে স্নেহাকে নিয়ে অপেক্ষা করার পরিস্থিতি নেই। রিকশাটা হসপিটালের সামনে থামতেই অয়ন দ্রুত নেমে স্নেহাকে ধরে নামায়। স্নেহার তখনও হুশ আছে। দু’হাতে তলপেট খামচে ধরে রেখেছে সে। সামান্য… সামান্যতম নড়চড়ও করতে গেলে তার জীবন বেরিয়ে আসছে। তবে অয়ন হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তাইতো সে দ্রুত একটা হুইলচেয়ার এনে স্নেহাকে বসিয়ে দেয়।
ভেতরে প্রবেশ করতেই ডিউটি নার্স দৌড়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে?”
অয়ন হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দেয়,
“রাস্তায় মারামারি… তলপেটে লাথি লেগেছে। দ্রুত ডক্টর ডাকুন…”
হুইলচেয়ার টেনে ভেতরে নিতে নিলে স্নেহা দ্রুত অয়নের কনুই অব্দি গোটানো শার্টের হাতা আঁকড়ে ধরে শক্ত করে। ব্যথায় গোঙাচ্ছে, তবুও অয়নের শার্টের হাতা ছাড়তে চাইছে না। নার্স নরম গলায় বলে,
“চিন্তা করবেন না, আমরা আছি। ভাইয়াও এখানেই আছেন। ছাড়ুন উনাকে।”
স্নেহা ছাড়তে বাধ্য হয়। তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় ইমারজেন্সি রুমে। অয়নের বুকের ভেতর কেমন একটা আতঙ্ক জমাট বেঁধে আছে। কিছু না ভেবেই ইমারজেন্সি রুমে একদফা ঢোকার চেষ্টা করে। নার্স বাঁধা দিয়ে বাহিরে অপেক্ষা করতে বলে। অয়নের খুব অসহায় লাগছে নিজেকে। মেয়েটার গাল, ঘাড় অনেকটা ছিলে রক্ত বের হচ্ছিলো। পা এবং হাতও ছিলে রক্তাক্ত অবস্থা। এর মধ্যে আবার পেটে এতো জঘন্য একটা আঘাত পেল। এতটা… এতটা যন্ত্রণার কথা ভাবলেও অয়নের খুবই হয়রান লাগছে। সে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ইমারজেন্সি রুমের বাহিরে বসেই দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠে। প্রিয় মানুষের উপর এতটা পাশবিক নির্যাতন দেখে সে শক্ত থাকতেই পারছে না। হৃদয় ছিড়েখুঁড়ে কান্না বেরিয়ে আসছে।
বেডে শুয়ে থাকা স্নেহাকে ক’জন ডাক্তার এবং নার্স ঘিরে রেখেছে। কেউ ইঞ্জেকশন রেডি করছে, কেউ ক্ষত পরিষ্কার করছে, তো কেউ স্যালাইনের স্ট্যান্ড তুলছে। স্নেহার চোখ জোড়া আধখোলা, ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে আসছে। ডাক্তার তার পেটের উপর আলতো চাপে ব্যথার জায়গা খুঁজে চলেছে। হুট করে যন্ত্রণার জায়গাটাতে চাপ লাগতেই স্নেহা ভয়ংকর চিৎকার দিয়ে উঠে। তার চিৎকার ইমারজেন্সি রুমের বাহির অব্দি পৌঁছায়। দরজার বাহিরে কেউ ছটফটিয়ে উঠে।
ডাক্তার দ্রুত কণ্ঠে নির্দেশ দিচ্ছে,
“এবডোমিন্যাল ট্রমা। ব্লান্ট ফোর্স ইঞ্জুরি। ভেতরে ইন্টার্নাল ব্লিডিং হচ্ছে কি-না নিশ্চিত হতে হবে। আল্ট্রাসাউন্ডের ব্যবস্থা করো। ব্লাড টেস্টের জন্য স্যাম্পল নাও।”
__________
অয়নের পাগল হওয়ার জোগাড়। বাসা থেকে লাগাতার কল আসছে। আপাতত অয়ন সে-সব কল রিসিভ করছে না। কেবল যেন কেউ চিন্তা না করে তাই ছোট করে ম্যাসেজ পাঠায়,
“একটু ব্যস্ত, আম্মু। পরে কল দিচ্ছি। খেয়ে নাও তোমরা।”
এর মধ্যেই ডক্টর বেরিয়ে আসে। অয়নকে দেখতেই জিজ্ঞেস করে,
“স্নেহা তাসমিয়ার সঙ্গে এসেছেন আপনি?”
অয়ন দ্রুত জবাব দেয়,
“জি।”
“কী হন আপনি? হাজব্যান্ড? না-কি ভাই?”
“ওরকম কিছু না। আমার ভাইকে প্রাইভেট পড়ান উনি। রাস্তায় ঝামেলা দেখে আমি রেস্কিউ করে নিয়ে এসেছি।”
“উঁহু, এভাবে তো হবে না। আমাদের গার্ডিয়ান দরকার। উনার ফ্যামিলিকে ইনফর্ম করেন।”
‘ফ্যামিলি’ শব্দটা শুনতেই অয়নের মেজাজ খারাপ হয়। সে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“উনার ফ্যামিলিই উনার অবস্থার পিছনে দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে থানায় কেস হবে। আপনি যা জানানোর আমাকে জানান।”
অয়নের অভিব্যক্তি দেখে ডক্টর বোধহয় তাকে বিশ্বাস করলো। তিনি বলে উঠেন,
“ভয় নেই, আপাতত সার্জারীর দরকার মনে হচ্ছে না। তবে অবজারভেশনে রাখতে হবে। সেন্সিটিভ স্পট হিটা করায় আঘাতটাকে গুরুতর বলা যায়। তবে ভাগ্য ভালো, বিশাল কোনো ক্ষতি হয় নি। আপাতত ব্যথা এবং শকে ও খুব দূর্বল।”
অয়ন বুঝে নেয় জটিল কথাগুলো। গলা শুকনো তার। দরজার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক দেখে স্নেহার অবস্থা। দেখে তার মাথার ভেতর ব্যথা শুরু হয়। নিরিবিলি একপাশে গিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে কল লাগায় কাউকে। অতঃপর পেশাদার ফিল্ডের ভিন্ন এক অয়ন রূপে ভয়ংকর স্বরে কাউকে আদেশ দেয়,
“জানোয়ারের বাচ্চাকে আমি আসার আগে কেউ যেন না ছোঁয়। শু*রের বাচ্চার নামের পাশে ততগুলো চার্জ বসাও, যতগুলো বসালে ওর জনম কাটবে জেলের ভাত খেয়ে এবং কোর্টের চক্কর কেটে। ওর জীবন জাহান্নাম করে ছাড়বো আমি।”
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]