নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৪.
নিতুন আজ সারাদিন খুব পড়াশোনা করেছে। তা-ই সন্ধ্যা থেকে আপাতত সে ছুটি পালন করছে। আয়েশ করে সোফায় পা তুলে বসে টিভি দেখছে সে। কোলে রয়েছে নুডুলসের বাটি। আম্মু চিংড়ি দিয়ে মজা করে নুডুলস ভেজে দিয়েছে। সেটা খেতে খেতে স্ট্রেঞ্জার থিংস নামক নেটফ্লিক্স সিরিজ দেখতে দেখতে নিতুন সময় পাড় করছিল। এর মধ্যেই কলিংবেলের শব্দ শোনা গেল। নিতুনের কষ্ট করে উঠে গিয়ে দরজা খুলতে হলো না। তার আগেই আম্মু রান্নাঘর থেকে ছুটে যায় দরজা খুলতে।
অয়ন বাড়ি ফিরেছে। বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। নীলা বেগম বড়ো ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দ্রুত রান্নাঘরে ছুটে যায় ছেলের জন্য কিছুটা ঠান্ডা পানি নিয়ে আসতে। অয়ন ততক্ষণে এসে লিভিং রুমের একটা সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসেছে। চোখেমুখে তার চরম হতাশার ছাপ। নিতুনের চোখ এড়ায় না কিছুই। সে ভাইকে জিজ্ঞেস করে,
“মারা খেয়ে এসেছ?”
অয়ন কড়া চোখে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকায়। তবে মুখে কিছু বলে না। ততক্ষণে নীলা বেগম পানির গ্লাস হাতে হাজির হয়েছেন। অয়ন মায়ের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানি খেয়ে নেয়। নীলা বেগম জিজ্ঞেস করে,
“কিছু নাস্তা দেই, বাবা?”
অয়ন উত্তর দেয়,
“তোমার কষ্ট না হলে কিছু খেতে দাও, আম্মু। অনেক খিদে পেয়েছে। ক্ষুধায় বুক জ্বলছে।”
ছেলেটার মুখ দেখে মায়া হয় নীলা বেগমের। তিনি ছুটে যান রান্নাঘরে। সচারাচর অয়ন কখনো নিজ থেকে খাওয়ার কথা মুখে আনে না। একমাত্র তীব্র ক্ষুধা নিয়েই এভাবে আবদার করে। তবে নীলা বেগম এটাও জানেন যে একমাত্র খুব মন খারাপ হলেই অয়নের এরকম ক্ষুধা পায়। ছেলেটার কী নিয়ে মন খারাপ হয়েছে, কে জানে? সুযোগ বুঝে কথা বলতে হবে।
সোফায় গা এলিয়ে বসে থাকা ভাইকে আরেক দফা দেখে নিয়ে নিতুন জিজ্ঞেস করে,
“ভাইয়া, মিস তোমাকে ঠিক কী রিপ্লাই দিয়েছে?”
অয়ন শূন্যে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আপনার মনে প্রেম আছে দেখে আমার মনেও থাকবে এটা সংবিধানের কত নাম্বার পয়েন্টে লেখা আছে? আপনার মনে মানুষকে বিলানোর মতো মধু আছে। আমি এতো মধু নিয়ে ঘুরি না।”
নিতুন হতাশায় মাথা দু’পাশে নাড়ে। খুব একটা অবাক হয় নি সে। এটাই তো হওয়ার ছিল। কিন্তু তার ভাই নিশ্চয়ই খুবই কষ্ট পাচ্ছে? নিতুন ভাইকে শান্তনা দিয়ে বলে,
“থাক, বাদ দাও। স্নেহা মিস গেছে তো কী হয়েছে? আমার কি মিসের অভাব না-কি? শুনো ভাইয়া, স্কুলে আমার একটা ইংরেজি মিস আছে। খুবই সুন্দরী তিনি…”
অয়ন রেগে কটমট করে তাকায়। নিতুনকে চাপা স্বরে ধমকে বলে,
“স্নেহা যায় নি। উনি সময় নিক। দু’দিন আমাকে নিয়ে ভাবলেই দেখবি, উনিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। তুই আপাতত নিজের চিন্তা কর। উনি তোর ভাবী হয়ে আসলে…”
নিতুন বাংলা সিনেমার দুখী চরিত্রের মতো বলে,
“না, এ আমি মেনে নিবো না। উনার মতো পাষাণপ্রিয়া এ-ই বাসায় এলে আমি বাসা ছেড়ে চলে যাবো। না-হয় উনি দিনে পঞ্চাশটা করে স্কেল ভাঙবেন আমার পিঠে…”
অয়নের চেহারা থেকে হতাশা উবে যায়। সে চরম আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে,
“তাহলে তুই নতুন বাসা খুঁজে নে নিজের জন্য। না-হয় পিঠের জন্য একটা বডি শিল্ড কিনে নে। কারণ স্নেহা এই বাসায় বউ হয়ে আসবে অবশ্যই।”
বাবু ভাইয়ার এই প্রেমে বাবু ভাইয়া কতটা ভুগবে নিতুনের জানা নেই। কিন্তু নিতুন নিজে যে খুব ভুগবে তা সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। আহ, তার শান্তির দিন বুঝি শেষ হতে চললো।
___________
সামিউলকে লম্বা সময়ের জন্য হাজতে ভরা অয়নের জন্য বাম হাতের খেল ছিল। বিকারগ্রস্ত মূর্খটা এলোমেলো মস্তিষ্ক নিয়ে প্রতিশোধ নিতে এসেছিল বলেই, তার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করা খুবই সহজ হয়েছে। তবে অয়ন এখানে কিছুটা অপশক্তিও ব্যবহার করেছে। সামিউলের নামের পাশে আরো বেশ কিছু বাড়িয়ে চার্জ বসিয়েছে। এতটুকু না করলে তার মনের ঝাল একেবারেই মিটছিল না। তাছাড়া এরকম জানোয়ারকে লকাপে বেশিদিন রাখার ব্যবস্থা করা মানে, সমাজেরই ঘুরে ফিরে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দেওয়া। আর কারই বা সাধ্যি আছে পুলিশের লাগানো চার্জকে ভুল প্রমাণ করার? হু?
তবে অয়ন এটাও লক্ষ্য করেছে যে মোমিনা বেগম এবং আমিনুল সাহেব কীভাবে নিজেদের অপরাধী ছেলেকে বাঁচানোর জন্য থানার চক্কর কাটছে। কখনো উকিল, কখনো পুলিশ – টাকা পয়সা খাইয়ে হলেও ছেলেকে ছাড়ানোর ব্যাপারে খুব সোচ্চার তারা। কিন্তু অয়ন থাকতে উনাদের এতো চেষ্টা বৃথা যাচ্ছে। অয়নের ধারণা এই দুইজন সকল চেষ্টা শেষে হয়তো স্নেহার নিকটও যাবে কম্পলেইন ফেরত নেওয়ার আবদার নিয়ে। কিন্তু তারা যদি নির্লজ্জতার এ-ই পর্যায়ে পৌঁছানোর হিম্মত দেখায়, তাহলে অয়নও ছেড়ে দিবে না। সামিউলের উপর দিয়ে এটার হিসাব তুলবে সে।
__________
স্নেহার ইদানিং একটু বেশি-ই মেজাজ খারাপ থাকে। ক্যাম্পাসে কিংবা রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় সকলেই তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। চেহারার একাংশে ছিলে যাওয়া দাগের কারণেই বোধহয়। কিন্তু স্নেহা বুঝে পায় না, এতে এরকম চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার কি আছে? একটা মানুষ ব্যথা পেতেই পারে, সেটার দাগ থাকতেই পারে। সময়ের সঙ্গে সে-ই দাগ চলে যাবে না-হয়। তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকবে? মানুষের এই স্বভাবটা স্নেহার মোটেও পছন্দ না।
তবে ভাগ্য ভালো যে তার স্টুডেন্ট পড়াতে গিয়ে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় না। তারা এক্সিডেন্টের ঘটনা শুনে আর বেশি খুটিয়ে কিছু জানতে চায় নি। এমনকি নিতুনকে পড়াতে গিয়েও এখন অব্দি স্নেহাকে অস্বস্তিতে পড়তে হয় নি। অয়ন লোকটা বুদ্ধিমান। বাসায় কখনো স্নেহার মুখোমুখি হয়ে গেলেও তাকে মোটেও বিব্রতবোধ করায় না। আর না তো সেদিনের প্রস্তাবের পর থেকে গায়ে পড়ে স্নেহাকে বিরক্ত করেছে। উল্টো স্নেহা যখন টাকা ফিরিয়ে দেয় তখন চুপচাপ সেটা গ্রহণ করে নিয়েছে। যাক, এই এক মুসিবত থেকে তো বাঁচা গেল। কিন্তু স্নেহা কি জানতো তার জন্য নতুন মুসিবত এসে দাঁড়িয়ে আছে?
ক্যাম্পাস থেকে বের হতেই কোথা থেকে মোমিনা বেগম ছুটে এলেন। সঙ্গে রয়েছে শায়না। দেখেই বুঝা যাচ্ছে শায়নাকে স্কুল থেকে নিয়ে সরাসরি এখানে এসেছেন তিনি। স্নেহা দেখেও না দেখার ভান করলো। তবে মোমিনা বেগম অনেকটা গায়ে পড়েই স্নেহার সঙ্গে কথা বলতে এলো। খপ করে স্নেহার এক হাতের কনুই চেপে ধরে বলতে শুরু করে,
“আমার সঙ্গে থানায় চল তুই। তোকে পেলে টেলে বড়ো করে দিছি না? আমার ছেলেরে জেল থেকে বের কর।”
মোমিনা বেগম স্নেহার হাতের ঠিক সে-ই জায়গাটাই চেপে ধরেছে, যে-ই জায়গাটা সামিউলের কারণে রিকশার সঙ্গে লেগে কেটে গিয়েছিল। ব্যথাটা এখনো রয়েছে অনেকটা। তবে স্নেহা সেটা প্রকাশ করলো না। বরং ঝাড়া মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মোমিনা বেগমকে সতর্ক করে,
“একদম আমাকে ডমিনেট করার চেষ্টা করবেন না। চেপে ধরার জন্য হাত আমারও আছে, বলার জন্যও মুখ আছে। আমি শুরু করলে কিন্তু মা, মা ডেকে পালাতে বাধ্য হবেন। আই ওয়ার্ন ইউ। আমার থেকে দূরে থাকুন।”
ছেলের জেলে যাওয়ার শোকে মোমিনা বেগমের মাথাটাও বোধহয় আউলে গিয়েছে। তাই তো তিনি চেঁচিয়ে উঠে,
“বান্দির ঝি, এতোদিন আমার খেয়ে আমার পরে আমাকে জোর দেখাস? এতো তেল হয়ে গেছে তোর শরীরে? অকৃতজ্ঞের বাচ্চা কোথাকার।”
আশেপাশের মানুষ তামাশা দেখছে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। অন্যায়ের সামনে স্নেহা মোটেও ভদ্রতা বজিয়ে চলতে পারে না। তার মনে ইচ্ছে জাগে সে যদি এখন এই মহিলাকে এক চড়ে উল্টে দিতে পারতো? তাহলে নিশ্চয়ই উনার এই দূর্গন্ধযুক্ত মুখটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হতো? মনে এই ইচ্ছা জাগলেও সেটা আর করা হয় না। বরং স্নেহা আজেবাজে কথার বিপরীতে চেঁচিয়ে বলে,
“খবরদার মা তুলে গালি দিবেন না। আমার মা আর যা-ই হোক একটা মানুষ জন্ম দিয়ে গিয়েছে। আপনি কী পেটে ধরেছেন? কুলাঙ্গার একটা গাঞ্জুটে, পোটেনশিয়াল ক্রিমিনাল। আবার সে-ই জানোয়ারের বাচ্চার জন্য আমার সাহায্য চান। কত্তবড় সাহস আপনার! সাহায্য দূরে থাক, ওই জানোয়ারের উপর থুথু মারতেও যাবো না আমি।”
মোমিনা বেগম রেগেমেগে স্নেহার উপর চড়াও হতে নেন। ঠিক সে-ই মুহূর্তে কোথা থেকে দু’জনের মধ্যে অয়ন এসে দাঁড়ায়। মোমিনা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ভিক্টিমকে প্রেশারাইজ করার একটা চার্জ বসাবো না-কি আপনার নামে? হুম? বলেন।”
স্নেহা এক মুহূর্ত অয়নকে দেখে নিয়ে তাকায় শায়নার পানে। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে স্নেহার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে কিছুটা ভয়ের ভাব। এক্ষুণি বুঝি কেদে দিবে। শায়নার সামনে ঝামেলা বাড়ানোর ইচ্ছে হয় না স্নেহার। সে চলে যাওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু তার আগেই মোমিনা বেগম একটা জঘন্য কথা বলে বসেন। অয়নের সঙ্গে স্নেহাকে মিলিয়ে খুবই বিশ্রী কিছু কথা বলেন তিনি। স্নেহার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে। অয়নও অপ্রস্তুত এবং হতভম্ব হয়ে যায়। উৎসুক জনতা মজা লুটছে। বাঁকা চোখে দেখছে স্নেহাকে।
স্নেহার ইচ্ছে করে আখের শরবত তৈরীর ওই মেশিনটার ভেতর মোমিনা বেগমের জিভ রেখে উনার সকল বিষ বের করতে। কিন্তু মনের ইচ্ছা এরকম হলেও তার প্রতিক্রিয়া হয় ভিন্ন। মোমিনা বেগমের চোখে চোখ রেখে কঠিন স্বরে বলে,
“সামিউলকে দেখে আমি কখনোই অবাক হই না। ওর এরকম নোংরা হওয়াটাই স্বাভাবিক। আপনার ছেলে হাজার হোক।”
মোমিনা বেগম আজেবাজে বকতেই থাকে। স্নেহা উনাকে পাত্তা না দিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। প্রস্থান করে অয়নও। ওই মহিলার জঘন্য কথায় ওর মনে হচ্ছিলো যেকোনো সময় ওর কান দিয়ে রক্তক্ষরণ হবে। ওই মহিলার লজ্জা না থাকুক, অয়নের তো আছে।
__________
সে-ই ঘটনার প্রায় মাস খানেক পেরিয়েছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ সাভার মডেল থানার ভেতরটা বেশ ফাঁকা। দুপুরের এই অলস সময়টায় খুব একটা ভীড় নেই বললেই চলে। ঠিক সে-ই সময়ই থানায় প্রবেশ করতে দেখা গেলো একটা পরিচিত মুখকে। ওসি মনিরুল সাহেব তখন একজন অফিসারের সঙ্গে জরুরী আলাপ করতে করতে বের হতে নিচ্ছিছিলন। কিন্তু প্রবেশদ্বারে স্নেহাকে দেখতেই তিনি এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। মনে করার ভান করে বলে,
“আপনি? সামিউলের বোন না? ওই যে মাদকাসক্ত এবং নির্যাতন কেস!”
সামিউলের বোন সম্বোধনটা স্নেহার পছন্দ হলো না। সে থমথমে গলায় জবাব দেয়,
“স্নেহা তাসমিয়া। মনে রাখার হলে আমাকে আমার নাম দিয়ে মনে রাখবেন। অমুক তমুকের বোন ট্যাগে মনে রাখার ব্যাপারটা আমার পছন্দ না।”
জুনিয়র অফিসারের সামনে স্নেহার তরফ থেকে এমন রূঢ় জবাব পেয়ে ওসি সাহেবের মুখটা চুপসে গেলো। তবুও তিনি প্রশ্ন করেন,
“আজকে কী প্রয়োজন? আপনার ভাই তো এখন জেলে। এখন কী নালিশ করতে এসেছেন?”
স্নেহা আশেপাশে চোখ বুলাতে বুলাতে জবাব দেয়,
“মামলা করতে এসেছি। ইভটিজিং তথা উত্যক্ত করার মামলা। ইভটিজারকে জেলের ভাত খাওয়াবো ভাবছি।”
ওসি সাহেব অবাক হোন। ইভটিজিং কেস! কি এক ঝামেলা! এটা মেয়ে নাকি মুসিবতের পাহাড়! কখনো মাদকাসক্ত কেস, কখনো নির্যাতন কেস, এখন আবার ইভটিজিং। ওসি সাহেব কিছু বলার পূর্বেই স্নেহা প্রশ্ন করে,
“এএসপি সাহেব আছেন?”
“এএসপি সাহেব? মানে অয়ন স্যার? উনাকে কেন খুঁজছেন? মামলা করতে হলে সোজা হেঁটে ডানে যান। ওখানে পুলিশ অফিসার আছেন। এসব ছোটখাটো ব্যাপারে এএসপি সাহেবকে খুঁজবেন না।”
স্নেহা বোধহয় ভদ্রলোকের কথাকে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না। বরং পাশের জনকে জিজ্ঞেস করলো,
“এএসপির রুমটা দেখিয়ে দিন।”
ওসি মনিরুল এবার কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে,
“কী আজব! এএসপি স্যারের রুম খুঁজেন কেন? থানার অফিসাররা মরে গিয়েছে না-কি?”
স্নেহাকে উত্তেজিত হতে দেখা যায় না। সে সরাসরি নিজের ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে কন্ট্যাক্ট লিস্টে গিয়ে শীতল স্বরে হুমকি ছুড়ে,
“রুমটা দেখিয়ে দিবেন নাকি সরাসরি আপনাদের সার্কেল স্যারকে কল করবো?”
স্নেহার এহেন হুমকি কার্যকরী হয়। এ-ই মেয়ের কাছে স্যারের নাম্বার থাকার মানে হলো তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা আছে। ওসি মনিরুল অহেতুক ঝামেলা করে নিজের কাধে বিপদ আনতে চায় না। তাই তিনি সুরসুর করে স্নেহাকে ডাইরেকশনটা বলে দিয়ে বিদায় হয়। ওসি সাহেবের দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুযায়ী হেঁটে স্নেহা পৌঁছে যায় কাঁচের দেয়াল ঘেরা কেবিনের দরজার সামনে। রুমের বাহিরে একপাশে একটা নেমপ্লেটে লেখা শব্দগুলোয় সে নজর বুলায়।
AYON MAHMUD
Assistant Superintendent Of Police
Savar Circle, Dhaka District
নেমপ্লেট থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে স্নেহা কাঁচের দরজা ঠেলে কেবিনে প্রবেশ করে। অয়ন তখন কিছু রিপোর্ট ফাইল পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত ছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত কারো বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিয়ে যে-ই না সে উচ্চবাচ্য করতে চোখ তুলে, সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টি শিথিল হয়ে আসে। উবে যায় রোদ তপ্ত দুপুরের ক্লান্তি এবং গরম মেজাজ। এক পশলা বৃষ্টি যেন তাকে কেবল ভিজিয়ে দিয়ে গেলো সেরকম প্রাণবন্ত স্বরে বলে,
“স্নেহা! আপনি! কী আশ্চর্য! আসুন, বসুন। চা খাবেন নাকি কফি?”
অয়নের এরকম প্রতিক্রিয়া এবং চা কফির আয়োজনকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে স্নেহা এসে অয়নের মুখ বরাবর চেয়ার টেনে বসতে নেয়। তবে ভদ্রলোক অয়ন স্নেহাকে সে-ই সুযোগ দেয় না৷ বরং নিজে দ্রুত উঠে গিয়ে স্নেহার জন্য চেয়ারটা টেনে ধরে। অয়ন হবে হয়তো আগাগোড়া জেন্টালম্যান পুরুষ। কিন্তু তার জেন্টাল আচরণ কেন যেন স্নেহার হজম হয় না। কেমন সন্দিহান দৃষ্টি মেলে তাকায় সে। পুরুষ মানুষের অতিরিক্ত ভালো মানুষিকে সে সবসময় সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখে। স্নেহার ধারণা এরা উপরে উপরে ভালো মানুষীর মুখোশ পরে, পেটের ভেতর শয়তানি পাকায়।
মনের খচখচানি মনে চেপে গিয়ে স্নেহা বিনাবাক্য ব্যয়ে চেয়ারে বসে। অয়ন দ্রুত নিজের কেবিনে চলমান এসির তাপমাত্রাটা রিমোট চেপে কমিয়ে দেয়। এই মাথা নষ্ট গরমের ভেতর স্নেহার ঘেমে যাওয়া অবস্থাটা সে লক্ষ্য করেছে। তাই স্নেহার অপেক্ষায় না থেকে সে নিজেই কাউকে টেলিফোন করে বলে দেয়, তার রুমে ঠান্ডা ঠান্ডা আখের শরবত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে।
অয়নের মুখোমুখি বসে থাকা স্নেহা ভালো করেই জানে এতো ব্যস্ততা এবং আয়োজন তার আগমন উপলক্ষেই। কিন্তু স্নেহার হাতে খুব একটা সময় নেই। তাই সে দ্রুত নিজের কথা শুরু করে বলে,
“জরুরী কাজে এসেছি। পাঁচ মিনিট সময় এবং মনযোগ দিলে ভালো হতো। আমার যেতে হবে।”
স্নেহার প্রতি এভাবেই অয়নের মনযোগ ছিল। তবে স্নেহার কথার পিঠে সে-ই মনযোগের পরিমাণ যেন আরো গাঢ় হলো। সে সোজা হয়ে বসে বলে,
“জি, বলুন। জরুরী কাজটা কী? নিতুন আবারও কোনো বাদড়ামি করেছে?”
পিতা মাতার আদরের দুলাল দামড়া বাবুর আই-কিউ লেভেল আবারও স্নেহাকে হতাশ এবং বিরক্ত করে। নিতুনের ব্যাপারে নালিশ করার হলে সেটা স্নেহা সরাসরি নীলা বেগমের কাছে করবে। নিতুনের মা’কে রেখে ভাইয়ের কাছে নালিশ করতে আসবে সে কোন দুঃখে? এই গরমে স্নেহার ইচ্ছে হলো না এই সাধারণ ব্যাপারটা বুঝিয়ে, বাড়তি শব্দ খরচ করে নিজের গলার তৃষ্ণা বাড়াতে। তাই সে সরাসরি বলে,
“একটা মামলা করতে এসেছি। মামলাটা আপনি নিবেন? ডায়েরিতে নোট করবেন?”
স্নেহার মুখে মামলার কথা শুনে অয়ন চিন্তিত এবং বিচলিত হয়। স্নেহাকে ভালো করে দেখে নিয়ে সে প্রশ্ন করে,
“ঠিক আছেন আপনি? কিছু হয়েছে? নতুন করে কোনো কিছু ঘটেছে?”
“ইভটিজিং কেস।”
অয়নের ভোলাভালা মুখটা মুহূর্তেই রাগী রূপ ধারণ করে। রাগে নাকের পাটাও ফুলে উঠে তার। সরল চোখ দুটোয় খুন করে ফেলার মতো ক্রোধ লক্ষণীয় হয়। জানতে চায়,
“কে? কে টিজ করেছে আপনাকে? আকাশ? নাম বলুন। ওকে চৌদ্দ শিকের ভেতরের দুনিয়া চিনিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। পুরো ঘটনা খুলে বলুন আমাকে।”
“আপনি ডায়েরিতে লিখুন। আমি বলছি।”
অয়নের তড় সইছে না। তার ইচ্ছে করছে এক্ষুণি গিয়ে ইভটিজারকে ধরে আখের ছাঁল দিয়ে পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে ফেলতে। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে সে ডায়েরি খুলে কলম হাতে নেয়। স্নেহা বলতে শুরু করে,
“ইভটিজার বিগত একমাস ধরে আমাকে ফলো করছে…”
অয়ন অবাক হয়। একমাস ধরে এরকম একটা ঘটনা ঘটছে অথচ সে টের পেলো না! কীভাবে সম্ভব এটা? একবার হলেও তো অয়নের চোখে পড়ার কথা। মনে মনে অয়ন নিজের প্রতি বিরক্তও হয়। তার দায়িত্বশীলতার ঘাটতিতেই কী কেউ স্নেহার কাছে ঘেঁষে বিরক্ত করার সুযোগ পেয়েছে? স্নেহা বলে যাচ্ছে,
“আমার ক্যাম্পাস এবং হলের আশেপাশে প্রায়ই তার আনাগোনা দেখছি। আমি শেষ স্টুডেন্টকে পড়িয়ে বাসায় ফেরার পথে প্রায়ই লক্ষ্য করি আমাকে আড়াল হতে স্টক করা হচ্ছে। স্টক করতে করতে হলের গেইট অব্দি পৌঁছে যায়। ভয়ংকর ব্যাপার না? আরো ভয়ংকর ব্যাপার কী জানেন? এই ইভটিজার মুখোশধারী লোক। সাধারণ ভালো মানুষের মুখোশ পরে আড়ালে আমাকে উত্যক্ত করে চলেছে। তার ধারণা এই উত্যক্ত করার ঘটনা যেমন লোকচক্ষুর আড়ালে, তেমন বুঝি আমারও আড়ালে। কিন্তু উপরওয়ালার রহমতে আমি তো অন্ধ নই। চোখ কান খোলা রেখেই চলাফেরা করি। তাই সকলের গতিবিধিই আমি লক্ষ্য করি।”
অয়নের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখটা ধুপ করেই কেমন ফ্যাকাসে হতে শুরু করে। দূর্ভাগ্যক্রমে স্নেহার সম্বোধন করা ইভটিজার আসলে কে তা বুঝতে তার অসুবিধা হয় না। এবং সেটা বুঝতে পেরেই সে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। দৃষ্টি কিছুটা নিচু করে নেয়। হাতের কলম থেমেছে বহু আগেই। মিনমিনে স্বরে বলে,
“ইভটিজার কেন বলছেন? আপনাকে ফলো করেছে, হ্যারাসমেন্ট নয়। ভদ্রলোকের নিয়ত খারাপ না-ও হতে পারে।”
স্নেহা এবার শীতল গলায় বলে,
“এটাকে ইভটিজিং এর কাতারে ফেলবেন নাকি স্টকিং সেটা আমার মাথাব্যথা নয়। আইনের লোক যেহেতু আপনি, সেহেতু আপনার এসব ভালো বুঝার কথা। আপনার আইন এবং ভদ্রলোকের নিয়ত না-হয় আপনিই বুঝুন। আমি সেসব বুঝতে আগ্রহী নই। আমি শুধুমাত্র এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছি। দ্যাট’স ইট। এখন কীভাবে কী করবেন সেটা আপনিই ভালো জানেন।”
স্নেহা এতদূর বলতেই কেবিনের দরজায় ঠকঠক শব্দ হয়। বাহির থেকে কেউ বলে উঠে,
“স্যার, আসবো?”
অয়ন কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতেই জবাব দেয়,
“আসুন।”
একটা পনেরো-ষোল বছর বয়সী ছেলে শরবতের একটা গ্লাস হাতে রুমে প্রবেশ করে। অয়নের ইশারা অনুযায়ী গ্লাসটা এনে স্নেহার সামনে রাখে। অয়ন সামান্য হেসে ছেলেটার হাতে একটা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বিদায় জানায়। ছেলেটা চলে যেতেই স্নেহা তার সামনে টেবিলে রাখা গ্লাসের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে অয়নের চোখে চোখ রেখে বলে,
“সাভারে ইভটিজারদের আনাগোনা বেড়েছে। দায়িত্ব পালন করুন। মেয়েদের আশপাশ থেকে এদের ছাঁটাই করুন।”
কথাটুকু শেষ করে স্নেহা নিজের ব্যাগ কাধে তুলে নিয়ে অয়নকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। অয়ন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি মেলে কতক্ষণ শরবতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে রয়। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে নিজেই গ্লাসটা থেকে এক ঢোকে সবটুকু শরবত খেয়ে নেয়। অতঃপর অসম্পূর্ণ মামলার বয়ান সম্পূর্ণটা লিখে ফেলে সে। বেশ যত্ন নিয়েই ডায়েরী হতে কাগজটা ছিড়ে তা ভাজ করে নিজের শার্টের বুকপকেটে রেখে দেয়। চেয়ারে পিঠটা সামান্য এলিয়ে দিয়ে দু চোখ বুজে নেয় সে। আপনমনে বিড়বিড়িয়ে বলে,
“নিজের নামে নিজেই মামলা লেখার অভিজ্ঞতা মন্দ নয়। তবে, ভুক্তভোগীর বয়ানে সামান্য ভুল আছে। ভালো মানুষ এবং ইভটিজারের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে শিখেন নি উনি।”
চলবে…
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]