নীড়বৃষ্টি পর্ব-২৫

0
2

নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৫.

আজ ঘুমটা দেরি করে ভেঙেছে স্নেহার। হাই তুলতে তুলতে উঠে বসে সে ফোনে সময়টা দেখে নেয়। দুপুর প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে। স্নেহার মধ্যে বিশেষ তাড়াহুড়ো দেখা গেলো না। সে আস্তে-ধীরে বিছানা ছেড়ে নামে, গিয়ে একেবারে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে। স্নেহার আজ ছুটির দিন। পূজার বন্ধ চলছে ক্যাম্পাসে। হলে স্টুডেন্ট বলতে গেলে একদমই নেই। বন্ধে সকলেই সকলের বাড়ি ফিরে গিয়েছে। স্নেহার রুমমেটও আজ দু’দিন হলো হলে নেই।

একাকী, নীরব হল জীবনটা স্নেহার অবশ্য মন্দ লাগছে না। বরংচ সে বেশ আরামেই আছে। আজ যেহেতু ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দুপুর হয়েই গিয়েছে তা-ই স্নেহা আর নাস্তার তাড়া দেখালো না। সরাসরি ব্যাগ খুলে নিজের নতুন একটা থ্রি পিস বের করলো সে। গত সপ্তাহে এই কলাপাতা রঙের থ্রি পিসটা কিনেছিল। স্নেহা ঠিক করেছে এখন থেকে সে প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক টাকা নিজের পিছনে খরচ করবে। পুরো জীবন সবাই তার পিছনে খরচ করতে যতটুকু কার্পণ্য করেছে, স্নেহা সেটা ঘুচিয়ে দিবে। নিজের জন্য যদি এতটুকুও সে না করে, তাহলে নিজেকেই খুব ঠকানো হবে। এতটুকু স্নেহার, এতটুকু তার প্রাপ্য।

আরেকটা স্বস্তির ব্যাপার হলো আজ স্নেহার কোনো টিউশনিও পড়াতে যেতে হবে না। তার একটা স্টুডেন্ট আছে হিন্দু ধর্মের। ওই বাচ্চাটা এখন পূজা উদযাপনে ব্যস্ত। নিতুন বন্ধ উপলক্ষে নিজের নানা বাড়ি ঘুরতে গিয়েছে। বাকি দু’জন স্টুডেন্টও এই সুযোগে একটু ঘুরাঘুরি করছে। সব মিলিয়ে স্নেহা ভালোই একটা ছুটি পেয়েছে। এই ছুটির দিনটা সে একটু ভিন্নভাবে কাটাবে, একটু নিজের মতো করে।

সুন্দর করে কামিজটা পরে নিয়ে, স্নেহা মুখে সামান্য নিভিয়া ক্রিম মাখলো। নিজের এই শ্যাম মুখে এর থেকে বেশি কিছু লাগানো তার পছন্দ না। মানায় কি-না সেই সম্পর্কে অবশ্য স্নেহার ধারণা নেই। কারণ কখনো আয়োজন করে মুখে সামান্য পাউডারের ছোঁয়াও তার লাগানো হয় নি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল আঁচড়ে পিঠে ছেড়ে রাখলো সে। পরে শুকালে রাস্তায় একটা ঝুটি করে নেওয়া যাবে।

আপাতত নিজের টোটে ব্যাগে ফোন, পানির বোতল এসব ভরে নিয়ে স্নেহা বেরিয়ে যায় হল থেকে। আজ স্নেহা হলের বা ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে যায় না। এই মাসে বিভিন্নভাবে তার হাতে কিছু টাকা রয়ে গিয়েছে। নিজের প্রয়োজনের টাকা আলাদা করে যতটুকু টাকা রয়ে গিয়েছে তা দিয়ে স্নেহার নিজেকে একটা সুন্দর দিন উপহার দিতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার সুন্দর দিনের সূচনাটাই হয় অয়নের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে। নাহ, আজ আর এই লোক আড়ালে নেই। বরং বেশ ভাবটাব মেরে তৈরী হয়ে তার হলের বাহিরেই বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে একটা ধূসর রঙের শার্ট এবং কালো প্যান্ট। চোখে ঝুলিয়েছে রোদচশমা। তবে ভদ্রলোকের এতো ভাব জলে ডুবেছে তীব্র রোদের কারণে। ঘেমেটেমে একাকার অবস্থা।

স্নেহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু কদম এগিয়ে যায়। কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বলে উঠে,

“মেয়েদের হলের বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ইমেজ নষ্ট করতে খুব মজা লাগছে?”

অয়ন স্বতঃস্ফূর্তভাবে জবাব দেয়,

“ইমেজ নষ্ট হতো যদি আমি হলের বাহিরে দাঁড়িয়ে মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাতাম। আমি সেরকম কিছুই করছি না। তাহলে ইমেজ নষ্ট হওয়ার মতো কিছু দেখছি না এখানে।”

“চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে রেখেছেন। কোনো মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন না-কি কীভাবে বুঝা যাবে? সানগ্লাস পরাটা ধরা না খেয়ে মেয়ে দেখার একটা মাধ্যম হতে পারে।”

অয়ন চোখ থেকে সানগ্লাস না খুলেই কিছুটা নিচু স্বরে জবাব দেয়,

“সানগ্লাসের ভেতরে থাকা আমার চোখ দুটো শুধুমাত্র স্নেহা তাসমিয়ার উপর আটকে আছে।”

স্নেহা কিছুটা অস্বস্তি এবং বিরক্তি অনুভব করে। তার আসলে কথা বলা উচিত হয় নি এই লোকের সঙ্গে। পাশ কেটে চলে যাওয়া উচিত ছিল। কেন যে সে কথা বলতে এলো! স্নেহা অয়নকে এড়িয়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই অয়ন বলে উঠে,

“আপনি না ঋণ রাখতে পছন্দ করেন না? আমার কিন্তু আপনার উপর ঋণ আছে। পরিশোধ করবেন না?”

স্নেহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“কোন ঋণ? একশো নিরানব্বই টাকা? আপনি তো আবার এক টাকা বেশি নেন না।”

অয়ন মাথা নেড়ে বলে,

“উঁহু, অন্য ঋণ। আপনাকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম, আপনাকে সময় দিয়েছিলাম। এটাকে ঋণ মনে হয় না আপনার? টাকা বাদে সময়ও কি ঋণের কাতারে পড়ে না? আমার সময় আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না?”

স্নেহা কিছুটা বিরক্তবোধ করে। সে কি বলেছিল তার পিছনে সময় দিতে? লোকটা তো নিজেই নিজের সময় ব্যয় করেছিল। এখন আবার ফেরত চাইতে আসছে। কি এক জ্বালা! স্নেহা হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভুলটা আসলে তারই। একটা দিন নিজের মতো করে কাটানোর কথা ভাবাটা তার ভুল হয়েছে। তার আগেই বুঝা উচিত ছিল, এসব তার জন্য নয়। সুখ কখনো তার জীবনে বৃষ্টি হয়ে নামবে না। স্নেহা সরাসরি জিজ্ঞেস করে,

“সময়ের বদলে সময় চাই? হসপিটালে ডাক্তার দেখাতে যাবেন? সাথে যেতে হবে?”

“না, অসুস্থ তো নই। তাই হসপিটালে যাওয়ার প্রয়োজন দেখছি না। তবে আপনার যেখানে ইচ্ছে সেখানেই সঙ্গে যেতে পারি। শুধু সময় আমাকে দিন। তাতেই চলবে।”

স্নেহা এক মিনিট নীরব রয়। তারপর কিছুটা কপাল কুচকে বলে,

“পুরান ঢাকা যাচ্ছিলাম আমি। যাবেন?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। কোনো অসুবিধা নেই। আপনি বলে পুরান, নতুন যেকোনো ঢাকাতেই যাওয়া যায়। দেরি না করি। চলুন, বাইকে যাবেন?”

স্নেহা সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকিয়ে তাকায়। অয়ন ছোট করে একটা ভীত ঢোক গিলে বলে,

“সরি, ভুলভাল ইন্টেনশন নেই আমার। আপনাকে রিকশা ডেকে দিচ্ছি। আমি বাইকে আপনার পিছু চলছি।”

পিছু চলার কথা বললেও অয়ন পিছু চলে না। সম্পূর্ণ রাস্তা সে স্নেহার রিকশার পাশাপাশি চলে। স্নেহা ব্যাপারটাতে মনে মনে বিরক্ত হয়। কিন্তু জাহির করারও সুযোগ পায় না। পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারের কাজী আলাউদ্দিন রোডে এসে রিকশা থেকে নামে স্নেহা। অয়ন ইচ্ছে করেই রিকশা ভাড়া সাধে না। জানে স্নেহা ক্ষেপে যাবে। ক্ষেপে তাকে পাশের খাবারের দোকানে থাকা উনুনে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবে না।

অয়ন নিজের বাইকটা এক কোণে পার্ক করে রেখে নামে। স্নেহা ততক্ষণে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞেস করছে, হাজীর বিরিয়ানির দোকান সম্পর্কে। দোকানটা দেখিয়ে দিতেই স্নেহা সেদিকে এগিয়ে যায়। অয়নও যায় পিছু পিছু। পুরান ঢাকায় এসে বেশি মাতাব্বরি করছে না সে, কারণ এখানে এর আগে কখনো আসা হয় নি তার। দোকানে গিয়েই স্নেহা একজন কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করে বিরিয়ানির প্লেট কত করে। লোকটা ২৪০ টাকা দাম জানাতেই স্নেহা দুই প্লেট অর্ডার করে। ভিতরে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে অয়নকে জিজ্ঞেস করে,

“কাঁঠাল পাতায় সার্ভ করবে খাবার। আপনার অসুবিধা আছে? কাঁচের প্লেট লাগবে?”

স্নেহা স্বাভাবিক স্বরেই প্রশ্নটা করেছে। কিন্তু অয়নের ভালো লাগে না প্রশ্নটা। স্নেহা কি ভাবে অয়ন আকাশে পা তুলে বসে থাকা লোক? অয়নের আচার আচরণে কি উনি এখনো বুঝেন নি যে, অয়নও তার মতো সাধারণই একটা মানুষ? বুঝে নি যে কৃত্রিম চাকচিক্যের ভেতর অয়ন বাঁধা নেই?

অয়ন ছোট করে জবাব দেয়,

“কাঁঠাল পাতা, প্লাস্টিক, মেলামাইন, স্টিল, কাঁচ কোনটাতেই আমার অসুবিধা নেই। সব পাতেই খেয়ে বড়ো হয়েছি। আমাকে বিগড়ে যাওয়া বড়লোক ভাবা বন্ধ করুন।”

স্নেহা তাচ্ছিল্যের সহিত হেসে বলে,

“বেশি ভেবে ফেললেন। আমি আপনাকে নিয়ে ভাবি নি কখনো। তাই ভাবাভাবি বন্ধ করার প্রশ্নই আসছে না। অবশ্য আপনার সেল্ফ কনফিডেন্স প্রবল তা আগেই বুঝেছিলাম। যখন আপনি বলেছিলেন, দু দিন আপনাকে নিয়ে ভাবলেই প্রেমে পড়ে যাবো।”

অয়ন অপমানিত বোধ করে না। বরং কিছুটা কৌশল করে জিজ্ঞেস করে,

“বুঝতে পেরেছি। আপনার ভয় করছে। প্রেমে পড়ে যাওয়ার ভয়েই আমাকে নিয়ে ভাবছেন না, তাই না?”

খাবার চলে এসেছে ততক্ষণে। স্নেহা বিরিয়ানির উপর লেবু চিপতে চিপতে হেসে জবাব দেয়,

“আবারও অভার কনফিডেন্স!”

“অভার কনফিডেন্স হলে আমাকে ভুল প্রমাণ করুন।”

স্নেহা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলে,

“নট ইন্টারেস্টেড।”

অয়ন আর কিছু বলে না। সে খাবারে মনযোগ দেয়। ছোট ছোট টুকরো করে কাটা খাসির মাংস অল্প মশলায় এবং সরিষার তেলে রান্না করা বিরিয়ানির একটা লোকমা মুখে দিতেই অয়নের মন ভালো হয়ে যায়। চমৎকার স্বাদ এটার। এখানে সেখানে কত জায়গায় সে ভুয়া হাজীর বিরিয়ানি খেয়েছে। কিন্তু একটার স্বাদও এটার ধারেকাছে নেই। অয়ন লক্ষ্য করে স্নেহা চোখ কুচকে বিরিয়ানি থেকে বেছে বেছে তিনটা ছোট পিস আলাদা করে ফেলেছে। তিনটাই হাড্ডির টুকরা। বেচারি দুইশো চল্লিশ টাকার প্লেটে তিনটা হাড্ডি পেয়ে খুবই ক্ষিপ্ত।

অয়ন জানে ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নয়। অনেকসময় পরিবেশনের সময় পাতে এরকম দুয়েকটা হাড্ডির টুকরা উঠতেই পারে। কিন্তু স্নেহার জন্য ব্যাপারটা মন খারাপেরই। মেয়েটাকে গত কয়েক মাসে সে শখ করে দাঁড়িয়ে একটা আইসক্রিম অব্দি খেতে দেখে নি। সে-ই হিসেবে আজ প্রথম নিজ থেকে নিজের জন্য সময় বের করার এই আয়োজনে, এমন অভিজ্ঞতা হওয়াটা বিরক্তিকরই বটে। অয়ন নীরবে নিজের পাত থেকে বেছে চারটা সলিড পিস স্নেহার পাতে তুলে দেয়। স্নেহা এতে কপাল কুচকে তাকাতেই অয়ন আমতা আমতা করে বলে,

“আমি আসলে খাসির গোস্ত খুব একটা খাই না।”

স্নেহা আর কিছু বলে না। মনে মনে অয়নের প্রতি বিরক্ত বোধ করে। আলালের ঘরে দুলালদের এসব নখড়ার শেষ নেই। খাবার নিয়ে এদের বাছাবাছি দেখলেই স্নেহার মন চায় ঘুরিয়ে একটা লাগাতে। খাবার খাবারই, এটা নিয়ে বাছাবাছি কেন করতে হবে? যা-ই হোক, যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই এ নিয়ে স্নেহা আর কমেন্ট পাস করতে যায় না। সে মন দিয়ে খেতে থাকে। খাওয়ার ফাঁকে কিছু কাঁচা মরিচও কামড়ে খায়। অয়ন তা দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। দ্রুত একটা গ্লাসে পানি ঢেলে স্নেহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“মাথা খারাপ না-কি? কাঁচা মরিচ খাচ্ছেন কেন এভাবে? পানি খান দ্রুত।”

“মরিচ খাওয়ার জিনিস। না খেয়ে কি মাথায় দিবো? তাছাড়া বিরিয়ানির সঙ্গে কাঁচা মরিচ এবং কাঁচা পেঁয়াজ ভালো লাগে।”

অয়ন কিছুটা চুপসে যায়। খাওয়া শেষে দু’জন হাত ধুয়ে বিরিয়ানির দোকান থেকে বের হয়। অয়ন বাইকের কথা বলতে গিয়েও আর বলে না। বরং স্নেহার সঙ্গে পুরান ঢাকার অলি গলিতে ঘুরঘুর করতে থাকে। স্নেহা হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে,

“আপনি যান নি নানুর বাড়ি?”

অয়ন সপ্রতিভ হাসে। তার হাসি দেখে মনে হচ্ছে, স্নেহা তার কাছে নানুর বাড়ির খবর জানতে চায় নি। বরং আই লাভ ইউ বলে বসেছে। সে চটপট উত্তর দেয়,

“আপনার সঙ্গে ঘোরা শেষে যাবো।”

স্নেহা বাঁকা চোখে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

“আমার সঙ্গে ঘুরার জন্য যান নি?”

“না, না। ঋণ উসুল তুলতে হবে বলে যাই নি। উসুল তুলেই রওনা হবো।”

স্নেহা আর কিছু বলে না। ব্যাটা মানুষ এভাবেই হয় নাচুনি বুড়ি। এদের সামান্য সুযোগ দিলেই এরা মাথায় উঠে নাচা শুরু করবে। স্নেহার মাথা স্টেডিয়াম নয়। তাই সে কাউকে নাচতে দিতে চায় না। অয়ন সাহস করে নিজ থেকেই কথা বাড়ায়,

“সামিউলের আব্বু-আম্মু আপনার সঙ্গে আর যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল?”

স্নেহা এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,

“ওর আব্বু কল করে কান্নাকাটি করেছিল। ছেলের জামিন করাতে সাহায্য চাইছিল। আমি এক মিনিট শুনে কল কেটে দেই। আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। তাছাড়াও গন্ডারের চামড়া আমার, কান্নাকাটি সহজে গায়ে লাগে না।”

অয়ন এই ব্যাপারে আর কথা আগায় না। স্নেহার মুড খারাপ হতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে দু’জন একটা বাখরখানির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। গরম গরম বাখরখানি এবং মালাই চায়ের ঘ্রাণে চারিপাশটা মৌ মৌ করছে। স্নেহা জিজ্ঞেস করে,

“খাবেন?”

অয়ন পাল্টা জিজ্ঞেস করে,

“আপনি খাবেন?”

“হু, এজন্যই জিজ্ঞেস করছি। খাসির গোস্তের মতো এগুলো খেতে অসুবিধা নেই তো? না-কি আপনি গুড়ো দুধের চা বাদে অন্য চা খান না?”

“আপনি কিন্তু আমাকে বারবার খোঁচাচ্ছেন।”

“আমি শুধু শিওর হয়ে নিচ্ছি।”

অয়ন কিছুটা মুখ ফুলিয়ে উত্তর না দিয়ে নিজেই এগিয়ে গিয়ে দুটো মালাই চা এবং বাখরখানি দিতে বলে। দোকানের ভেতরে বসার জায়গা নেই। বাহিরে দুটো টুল পেতে স্নেহা এবং অয়নকে বসতে দেওয়া হলো। স্নেহার চুল শুকিয়েছে বহু আগে। কিন্তু সেটা আর খোপা করা হয় নি। তবে এখন বাহিরে যে-ই গরম, তাতে আর চুল খোলা রাখা সম্ভব নয়। তাই দ্রুত ব্যাগ থেকে একটা ব্যান্ড বের করে সে সবগুলো চুল পিছনে নিয়ে খোপা করে ফেলে। অয়ন কয়েক হাত দূরেই চা বানানো উনুনের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। গরমে ঘেমে তার সারা শরীর দিয়ে তরতর করে পানি ঝরছে। উনুনের তাপে মুখটাও লাল বর্ণ ধারণ করেছে। তবে সে-সব দিকে তার ধ্যান নেই। সানগ্লাসের ভেতর থাকা তার চোখ দুটো আটকে আছে স্নেহার চুল খোপা করার দৃশ্যের পানে।

আজব তো! সামান্য চুল খোপা করার দৃশ্য এতটা নান্দনিক হয় না-কি? স্নেহার শ্যাম মুখটা রোদের আলোয় আরো ঐশ্বরিক লাগছে। অয়নের এটাও দেখতে ভালো লাগে। তবে হুট করে স্নেহা চোখ তুলে তাকাতেই অয়ন দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। তার ভয় হয়। মনে হয় সানগ্লাস পরে থাকা সত্ত্বেও স্নেহা টের পেয়ে যাবে। ধরা খেলে যদি মেয়েটা রেগেমেগে তাকে ফুটন্ত চায়ের কেটলিতে চুবায়?

অয়ন দোকানদারের সঙ্গে দাঁড়িয়ে বেশ অনেকক্ষণ গল্প করে। ফিরে আসে দুটো ছোট মটকায় ভর্তি মালাই চা এবং বাখরখানি নিয়ে। স্নেহাকে একটা মটকার কাপ এবং বাখরখানি ধরিয়ে দিয়ে অয়ন নিজেও দাঁড়িয়ে চায়ে বাখরখানি চুবিয়ে খেতে শুরু করে। কিছুক্ষণ আগের চাপা রাগ এখন আর তার মধ্যে নেই। সে বেশ আগ্রহ নিয়ে বলতে শুরু করে,

“বাখরখানির মজার একটা ইতিহাস জেনে এলাম। এই-যে এই খাবারটা, এটার নামকরণ নাকি করা হয়েছে নবাবপুত্র বাকের খান এবং নর্তকী খানী বেগমের নামে। দুজনের মধ্যে বেশ প্রেম ছিল। কিন্তু জয়নাল নামে একজন না-কি তাদের প্রেমে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। নবাবপুত্র বাকের খান না-কি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুদণ্ডও পেয়েছিলেন। বহু কষ্টে উনি নিজের জীবন বাঁচিয়ে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন। তবে গিয়ে দেখে যে জয়নাল নামক লোকটা ততক্ষণে খানী বেগমকে মেরে ফেলেছে। তারপর নিজেদের এই প্রেমকে অমর করতে ভোজনরসিক নবাবপুত্র এই বিশেষ রুটির নাম রাখেন ‘বাখরখানি’।”

স্নেহা বিশেষ একটা পাত্তা না দিয়ে বলে,

“এসব বেশিরভাগ গল্পই বানোয়াট হয়।”

অয়ন ঘেমে গিয়েছে বিধায় সানগ্লাসটা খুলে বুকে শার্টের কাছে ঝুলিয়েছে। মুখ লটকে সে বলে,

“নিজে প্রেমে বিশ্বাস করেন না, ভালো কথা। অন্যের অমর প্রেমকাহিনীকে বানোয়াট বলবেন না। বাকরখানি খেতে খেতে এর নামকরণের পিছনে থাকা দু’জন প্রেমিক প্রেমিকাকে অপমান করছেন আপনি।”

স্নেহা চোখ তুলে দেখে অয়নের মুখটা। অভিমানে লটকে রাখা মুখটা দেখে ভদ্রলোককে নেহাৎই বাবু বলেই মনে হচ্ছে তার। তার উপর দীঘির মতো টলটলে চোখ দুটোতেও অভিমান উপচে প্রকাশ পাচ্ছে। ঘেমে টেমে বেচারার লাল বর্ণ ধারণ করা শুভ্র মুখটা হয়তো কিছুটা আদুরেও লাগছে। স্নেহা বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকে না। চোখ ফিরিয়ে নেয়।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা অব্দি বোখারি রেস্তোরাঁর চিকেন চাপ, বিসমিল্লাহ কাবাব ঘরের গরুর মগজ ভুনা, রাস্তার ধার থেকে ভেলপুরি, ফলের দোকান থেকে ছোট কমলা এবং বিখ্যাত বিউটি লাচ্ছি খেয়েই কাটিয়ে দিলো দু’জন। অবাক হয়ে দু’জনই আবিষ্কার করলো যে তারা দু’জনই কতটা ভোজনরসিক মানুষ। স্নেহা অবশ্য কখনো দিনের তিন বেলার খাবার ব্যতীত আলাদা করে তেমন কিছু একটা খায় না। তবে আজ তো তার ছুটির দিন। আজ তার মন খুলে নিজের পিছনে টাকা উড়ানোর দিন। তাই সে পেটপুরেই সব খেলো।

অয়ন যখন স্নেহাকে হল অব্দি পৌঁছে দিয়েছে তখন রাত প্রায় নয়টা বাজে। স্নেহা রিকশা থেকে নেমে রিকশা ভাড়া মেটায়। অয়নও নামে নিজের বাইক থেকে। স্নেহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

“সময়ের ঋণ মিটে গিয়েছে। আর বিরক্ত করবেন না কখনো। পরের বার মামলাটা আর আপনার খাতায় না বরং ওসি সাহেবের খাতায় তুলবো তাহলে।”

অয়ন কিছু বলে না। তার হাতে একটা কাগজের প্যাকেট ছিল। এটা কোন ফাঁকে অয়নের হাতে এসেছে স্নেহার জানা নেই। খুব সম্ভবত ফেরার পথে যখন তারা রাস্তায় জ্যামে বসে ছিল তখনই কিছু কিনেছে। কিন্তু অবাক হওয়ার ব্যাপার হলো যে অয়ন সে-ই প্যাকেটটা খুলে ভেতর থেকে একটা গাদা ফুলের মালা বের করলো। স্নেহাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সেটা স্নেহার ব্যাগের হাতলের অংশে বেধে দিলো। স্নেহা কিছু বলার পূর্বেই অয়ন বলে উঠে,

“এবার ধুতুরা ফুল দেই নি। গাদা ফুল দিয়ে চেষ্টা করছি। এবার আশা করছি কপালে শনি লেখা নেই। ভয় কাটিয়ে আমাকে নিয়ে দুটো দিন ভাবুন। প্রেমে পড়লে জানাবেন।”

স্নেহাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অয়ন বাইকে গিয়ে উঠে বসে। অপেক্ষা করে স্নেহার হলের গেটের ভিতরে যাওয়ার। স্নেহা সময় অপচয় করে না। চুপচাপ গেটের ভিতরে চলে যায়। অয়ন বাইকটা স্টার্ট দিতেই ধীরে ধীরে গেট থেকে পিছনের দিকে মাথা বের করে স্নেহা। তাকিয়ে থাকে বাইকে থাকা মানুষটার পানে। ততক্ষণ অব্দি যতক্ষণ না মানুষটা দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে যায়।

স্নেহা স্মৃতিচারণ করে আজ সারাটা দিনের। না চাইতেও অনেক কিছুই সে লক্ষ্য করেছে আজ সারাটা দিন। রাস্তায় হাঁটার পথে অয়নের তাকে ভেতরের দিকে হাঁটার সুযোগ করে দিয়ে নিজে বাহিরের দিকে থাকা, পুরান ঢাকার ভীড় ঠেলে চলার পথে অয়নের বলিষ্ঠ হাতে তাকে লোকের ধাক্কা থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলা, বাখরখানির দোকানের বাহিরে স্নেহার মুখে রোদ এসে পড়ায় স্নেহাকে রোদ থেকে ছায়া দিতে নীরবে সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ানো, কমলা খাওয়ার সময় নিজ থেকেই একটা গোটা কমলা ছিলে স্নেহার দিকে এগিয়ে দেওয়া, স্নেহা না বলা সত্ত্বেও তাকে হল অব্দি পৌঁছে দেওয়া, হলে পৌঁছানোর পর স্নেহার গেটের ভেতরে ঢুকে পড়া অব্দি অপেক্ষা করা। এগুলো সহ সূক্ষ্ণ অয়নের অসংখ্য আচরণ স্নেহার মনে ছাপ ফেলেছে।

এমন না যে অয়ন নিজ থেকে একবারও স্নেহার মনযোগ পাওয়ার জন্য কিছু করেছে। কিন্তু পুরোটা সময় অয়নের মধ্যেকার এরকম বহু আচরণ স্নেহার মনযোগ কেড়েছে। পুরোটা সময় তার মনে হয় নি সে কোনো অপরিচিত লোকের সঙ্গে আছে। উল্টো অদৃশ্য একটা মিষ্টি উষ্ণতা, একটা শীতল পাটির আরাম, একটা গাছের ছায়া অনুভব করেছে সে। এই অনুভূতির সঙ্গে নীড় থাকা মানুষ গুলো পরিচিত। স্নেহাও প্রথমবার টের পাচ্ছে নীড়ের উষ্ণতা, শীতলতা, কোমলতা। হলের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে হাঁটতে হাঁটতে স্নেহা বিড়বিড়িয়ে উঠে,

“ইউ আর রং অয়ন মাহমুদ। আপনার প্রেমে পড়ার জন্য আপনাকে নিয়ে দু’দিন ভাবার থিওরিটা ভুল। আপনার সঙ্গে দুই ঘন্টা সময় কাটানোই যথেষ্ট।”

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]