নীড়বৃষ্টি
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২৬. ( উপসংহার )
নানুর বাড়িতে পৌঁছেছে অয়ন প্রায় রাত এগারোটার দিকে। আম্মু তখন চিন্তায় নাজেহাল। ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই তিনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন ‘বাবা, বাবা’ ডেকে। অয়নের আগমনে নানু বাড়িটা যেন সরব হয়ে উঠলো। খালামণিরা, মামারা সবাই এতোদিন পর ভাগ্নেকে দেখে এসে জড়িয়ে ধরলো। অয়নের মনটা শান্তিতে ভরে যায়। তার দুটো নানুবাড়ি আছে। দুটো বাড়িতেই সে সমান আদর এবং ভালোবাসা পায়। বরং এই বাসায় সদস্য সংখ্যা একটু বেশি বলে এখানে আদরটা আরো বেশি যেন জমা হয় তার ভাগে।
খালামণি এবং মামাদের ভীড় ঠেলে নীলা বেগম ছেলেকে টেনে বের করলেন। সবাইকে ধমকে অয়নকে দুটো মিনিট ফ্যানের নিচে বসতে দিলেন। ছেলেটা ঘেমে পুরো কাঠের কয়লা হয়ে ফিরেছে। একটু জিরিয়ে নেওয়া আবশ্যক। নীলা বেগম কাকে যেন ডেকে বললেন ছেলের জন্য পানি গরম বসাতে। অয়ন ছোট বেলায় গরম পানি ছাড়া গোসল করতে পারতো না। আম্মু আদরে আদরে সবসময় তাকে পানি গরম করে দিয়ে বিগড়েছে। এই একটা বদভ্যাস এখনো সে ছাড়তে পারে নি।
পানি গরম করার কথা বলে নীলা বেগম চলে যায় ছেলের জন্য একটু পানি আনতে। অয়নের মামা, খালাদের কড়া করে বলে যায় যেন এখন কেউ ছেলেটার মাথা না খায়। কিন্তু মামা, খালারা এই কথা মানলেও কি বাচ্চা পার্টি এসব মানে? সবগুলো কুইচ্চার দল হুড়মুড় করে খালি রুমে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দেয়। ঘেমে ভিজে থাকা অয়নকে ঘিরে বসে সবাই ব্যস্ত হয়ে জানতে চায়,
“বাবু ভাইয়া, আমরা না-কি শীঘ্রই ভাবী পেতে চলেছি?”
বাড়ির সব বাচ্চাদের মধ্যে অয়নই সবার বড়ো। বড়ো বলতে একটু বেশি-ই বড়ো। তাই সবাই তাকে বাবু ভাইয়া ডাকে। কিন্তু এই কুইচ্চা গ্যাং এর মুখে ভাবীর ঘটনা শুনে অয়ন কিছুটা অবাক। সে সরাসরি তাকায় নিতুনের দিকে। নিতুন কিছু না বুঝার ভান করে বসে বোম্বে রিং চিপস খেতে ব্যস্ত। তবে তার এই নিষ্পাপ সাজাতে খুব একটা লাভ হয় না। ফট করে কুইচ্চা গ্যাং এর আট বছরের সদস্য ফাহিম বলে উঠে,
“নিতুন ভাইয়া বলেছে, তুমি নাকি ভাইয়ার মিসের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো?”
একটুখানি বাচ্চাদের এসব পাকনা কথা শুনে অয়নের মেজাজ খারাপ হয়। সে কটমট করে তাকায় নিতুনের দিকে। নিতুন কিছুটা ভাবলেশহীন গলায় বলে,
“তুমি প্রেমে পড়তে পারবে আর আমি বলতে পারবো না?”
নিতুনের কথা শেষ হতেই সতেরো বছরের ফিমা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ভাইয়া, তুমি নাকি আজ ভাবীর সাথে ঘুরতে গিয়েছ? কী কী করেছ? ভাবী কি তোমার উপর ফল করেছে?”
অয়ন বুঝতে পারে নিতুন আদিঅন্ত কিছুই বলার বাকি রাখে নি এদের। সে ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“হ্যাঁ, গিয়েছিলাম ঘুরতে। আমরা পুরান ঢাকার অলিগলি হেঁটে হেঁটে মানুষের পকেট মেরেছি। ফল মানে? তোর ভাবী আমার উপর ফল-ফুল সব করেছে।”
অয়ন যে মজা করছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না কারো। কিন্তু সকলে নাছোরবান্দা। তারা নিজেদের ভাবীর সঙ্গে অয়নের দিন করেন কেটেছে তা জানতে আগ্রহী। অয়ন বাধ্য হয়ে বলে,
“আমার মনে হয় আগামী বিশ বছরেও উনি আমার প্রেমে পড়বেন না। উনার মধ্যে প্রেম নামক সফটওয়্যার ইন্সটলই হয় নি। আর এখন ইন্সটলের জন্য প্লে স্টোরই খুঁজে পাচ্ছি না।”
নিতুন কিছুটা রয়েসয়ে প্রশ্ন করে,
“আগে বলো সারাদিনে মিসকে অফেন্ড করেছ কয়দফা? দেখো ভাইয়া, আমি আগেই বলে দিচ্ছি। উল্টাপাল্টা কাজ করে মিসের মটকা গরম করে দিবে না তুমি। তোমার রাগ মেটাতে যদি আমাকে পিটায়? খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।”
অয়ন মুখ বেজার করে বলে,
“তোর মিসের মটকা ২৪/৭ ই গরম থাকে। ওটা আলাদা করে গরম করার কিছু নেই। আর মাইর খাওয়ার জন্য তোর পড়ালেখাই যথেষ্ট।”
“একদম বাজে বকবে না তুমি। আমি এখন মন দিয়ে পড়ি। মিস আমাকে মারা দূরে থাক, খুব একটা বকারও সুযোগ পায় না।”
অয়ন আর কথা বাড়ায় না। কেবল সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বলে,
“বাড়ির আর কেউ যেন এই কথা না জানে।”
ছয় বছর বয়সী নাদিয়া ফোকলা হেসে বলে,
“আমি শুধু আব্বুকে বলেছি, বাবু ভাইয়া। তুমি চিন্তা করো না। আব্বু সব সিক্রেট শুধু আম্মুকে বলে। আর আম্মু শুধু খালামণিদের বলে।”
অয়ন হতাশ। হতাশের থেকে আরেকটু বেশি হতাশ। সত্যি বলতে অনেক বেশি-ই হতাশ। এই কারণেই আম্মু এবং বাকিদের আচরণে কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ্য করেছে সে? সবাই ইতিমধ্যে সব জেনে গিয়েছে? হাহ! যার মন পাওয়ার কথা তার খবর নেই, এদিকে পাড়া পড়শী সব জেনে বসে আছে। উত্তম! অতি উত্তম!
__________
আজকের আবহাওয়াটা কোমল। কিছুটা বৃষ্টি বৃষ্টি। পুরান ঢাকা থেকে ঘুরে আসার আজ এক সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছে। স্নেহার দিনগুলো খুব একটা আহামরি ভালো না গেলেও, একেবারে খারাপও যাচ্ছে না। পড়াশোনা, টিউশনি, ফাঁকেঝুকে কখনো অয়নকে নিয়ে দু একটা ভাবনা – মন্দ নয় সব মিলিয়ে। স্নেহা লক্ষ্য করেছে, অয়ন নামক ভদ্রলোকটা আগাগোড়া একটা স্বস্তির প্রতীক৷ লোকটাকে নিয়ে হুট করে দু একটা ভাবনা মাথায় উঁকি দিলে আরাম বোধ করে সে। মনটা শান্ত শান্ত লাগে। দীঘির মতো চোখ দুটো মনে পড়লে কেমন গভীর, আদুরে, কোমল লাগে। মোটকথা সামান্যতম নেগেটিভিটিও অয়নের উপস্থিতিতে যেন দূর হয়ে যায়।
কিন্তু মনের ভাবনা গুলো স্নেহার মন অব্দিই সীমাবদ্ধ থাকে। আর বলা হয় না অয়নকে। বলতে যাবে কোন দুঃখে? জানালে লোকটা সাহসী হয়ে উঠবে। স্নেহাকে পাওয়ার চেষ্টা করবে। স্নেহাও যদি তখন লোভী হয়ে পড়ে? সে-ও যদি একটু সুখ, শান্তি কুড়িয়ে নেওয়ার লোভ দেখায়? উঁহু, লোভ করা যাবে না। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। এতো সহজ জীবন কখনো স্নেহার ঝুলিতে নামার নয়।
এসব ভাবতে ভাবতেই স্নেহা ক্যাম্পাস থেকে হলে ফিরছিল। হুট করে কোথা থেকে মোমিনা বেগম ছুটে এলেন। ভরদুপুর হওয়ায় রাস্তাটা নীরব, শুনসান। মোমিনা বেগমকে দেখে স্নেহা অবাক হলো না। বরং বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই দাঁড়ালো। মোমিনা বেগম আজ উত্তেজিত নয়। তিনি এসে সাবলীল ভঙ্গিতেই বললেন,
“তোমার সঙ্গে কথা আছে।”
“আমি আগ্রহী নই।”
মোমিনা বেগম জানে এই মেয়ে খুব একটা পাত্তা তাকে দিবেন না। তাই তিনি সরাসরি কাজের কথায় আসেন। কণ্ঠে মধু রেখে, অন্তরের বিষ ঢেলে দিয়ে বলেন,
“আমার ছেলেকে জেলে পাঠিয়ে খুব শান্তিতে আছো? তুমি ভাবছো তুমি সুখে থাকতে পারবে? মনে করে দেখো তো, জীবনে সুখ দেখেছ তুমি? জানো, সুখ দেখতে কেমন? উঁহু, জানো না। কারণ তোমার সেটা পাওয়ার যোগ্যতা নেই। বাড়িঘর নেই, যাযাবরের মতো একা জীবন কাটাও। এক কথায় বাজারী মেয়ে মানুষ। তোমার মতো মেয়েদের জীবনে সুখ আসে না কখনো। কোনো ভদ্রলোকের সন্তান কখনো চোখ তুলেও দেখবে না তোমার মতো ময়লা মেয়ে মানুষকে। পুরোটা জীবন মানুষের উষ্ঠা লাত্থি খেয়েই জীবন পাড় হবে। আমার মেয়েকে আমি ঠিকই একটা ভালো ঘরে তুলে দিবো। ওর শিক্ষাগত যোগ্যতা, গায়ের রঙ, গুণ, মাথার উপর পরিবার কোনো কিছুরই অভাব নেই। তোমার কী আছে এই এক জাহাঙ্গীরনগরের সার্টিফিকেট বাদে? এরকম আলিক্ষি মেয়ে মানুষের কখনো সুখ হয় না।”
বলেই মোমিনা বেগম বিশ্রী হাসি হাসেন। হাসে স্নেহাও। ভদ্রমহিলা এতদূর এসেছেন নিজের মধু কণ্ঠের বিষ ঢালতে। বিষ স্নেহার গায়ে লেগেছে। সে জ্বলছেও। কিন্তু প্রকাশ করলো না৷ উল্টো মোমিনা বেগমের থেকে বেশি মধু কণ্ঠে মিশিয়ে বলে,
“উফ, কে বলেছে আমার কিছু নেই? এই-যে, আপনি আছেন আমার জন্য। আহারে, কত চিন্তা করেন আমার! এতো চিন্তা করার একটা মানুষ আছে আমার। আমার তো আনন্দে কাঁদতে মন চাচ্ছে।”
মোমিনা বেগম আরো কিছু বলতে দেন, কিন্তু স্নেহা উনাকে থামিয়ে দেয়। কিছুটা ভাবলেশহীন গলায় বলে,
“আপনার হয়তো এখানে সেখানে ঘুরে বিষ ছড়ানোর মতো অফুরন্ত সময় আছে। কিন্তু আমার নেই। আশা করছি, আর কখনো দেখা না হোক।”
বলেই স্নেহা সেখান থেকে প্রস্থান করে। মোমিনা বেগম দাঁড়িয়ে চিড়বিড় করতে থাকে। উনার উদ্দেশ্য ছিল স্নেহাকে জ্বালিয়ে একটু নিজের কলিজাটা তৃপ্ত করা। কিন্তু মেয়েটা তো তার কোনো কথাকে দামই দিলো না। অতৃপ্ত হৃদয় নিয়ে মোমিনা বেগম রিকশায় চড়ে বসেন। মনে মনে স্নেহাকে দেয় অসংখ্য বদদোয়া। তার ছেলেকে রিহ্যাব এবং জেলে পৌঁছানো এই মেয়েটা যেন জীবনের প্রতিটা পদে জ্বলে ছারখার হয়ে যায়, সে-ই বদদোয়া।
__________
স্নেহা হনহনিয়ে নিজের রুমে এসে দরজাটা আটকে দেয়। তার মেজাজ খুব খারাপ। এই মহিলার কথাবার্তা তার কাছে বিষের মতো লাগে। এতটা আত্মবিশ্বাস ওই মহিলার? স্নেহা সুখে থাকবে না? এটাই দেখতে চান উনি? স্নেহা উনার এই মনের ইচ্ছা কখনো পূরণ হতে দিবে না। তার মনে জেদ চেপে বসেছে। সে দেখিয়ে দিবে সুখে থেকে। সে দেখিয়ে দিবে, যে সে কোনো অলক্ষী মেয়ে মানুষ নয়।
ওই মহিলা যেন কী বলে গিয়েছে? কোনো ভদ্র ঘরের সন্তান স্নেহার দিকে চোখ তুলেও তাকাবে না? উনি কি জানেন যে একটা ভদ্রলোক অয়ন মাহমুদ স্নেহাকে চোখে হারায়? উনার কি ধারণা আছে, অয়ন মানুষটা কতটা ভদ্র? উঁহু, উনি জানেন না। কিন্তু স্নেহা উনাকে এটা দেখিয়ে দিবে।
স্নেহা এই মুহুর্তে অনুধাবন করলো, যে-ই সুখকে সে নিজে প্রাপ্য নয় ভেবে দূরে সরিয়ে রেখেছিল, সেটা তার আসলেই খুব দরকার। ওইটুকু জিনিস হাতছাড়া করা উচিত হবে না। এইটুকু স্বস্তি স্নেহার লুফে নেওয়া উচিত। ভাবাভাবির পালা শেষ করে স্নেহা নিজের ফোনটা হাতে নেয়। সরাসরি ডায়াল করে অয়নের নাম্বারে। অয়ন তখন কাজে ছিল। তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করা সম্ভব হলো না তার পক্ষে। স্নেহা ফোন রেখে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রায় আধ ঘন্টা পর অয়ন কলব্যাক করে। বেশ অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে,
“স্নেহা? কল দিয়েছেলেন?”
স্নেহা চটপট জিজ্ঞেস করে বসে,
“দেখা করতে পারবেন?”
অয়ন আরো অবাক হয়। বিস্মিত গলায় বলে,
“এখন?”
“যদি আপনি ব্যস্ত না হোন।”
অয়ন বেশ সংকোচে পড়ে গিয়েছে। স্নেহা এভাবে নিজ থেকে তাকে কল করে দেখা করতে বলছে। কিন্তু অয়ন এখন খুবই জরুরী কাজে ব্যস্ত। চাইলেও ছুটে গিয়ে দেখা করা সম্ভব না তার পক্ষে। সে কিছুটা আমতা আমতা করে বলে,
“আমি তো থানায়… একটু ব্যস্ত। এই মুহূর্তে সম্ভব হবে না।”
“আচ্ছা, ফ্রি হবেন কখন?”
অয়নকে কেউ একজন ডাকে। সে একটু তাড়ায় আছে। উত্তর দেয়,
“অনেক রাত হয়ে যাবে। আপনি জরুরী কিছু বলার হলে ম্যাসেজ দিয়ে রাখুন। আমি ফ্রি হয়ে দেখছি। আজ বোধহয় দেখা করা সম্ভব হবে না। আমার যেতে হবে। এখন রাখি… আল্লাহ হাফেজ।”
কলটা কেটে যায়। স্নেহার মেজাজ খারাপ হয়। পুরুষ জাত! একটা মেয়ে পটে যাওয়ার আগ অব্দি এদের ডেডিকেশন পুরাই অন্য লেভেলের থাকে। অথচ একবার মেয়েটা পটে গেলেই এদের নাটক শুরু হয়। তখন জগতের সব ব্যস্ততা এদেএ ঘাড়ে এসে জুড়ে বসে। শালা, এতদিন এই ব্যস্ততা কই ছিল? স্নেহার পিছনে যখন লাট্টুর মতো ঘুরতো, তখন এসব জরুরী কাজ ছিল না?
নাহ, স্নেহা নিজেকে ঠান্ডা রাখে। এতো উতলা হলে চলে না-কি? কাজ থাকতেই পারে। স্নেহাও তো আজাইরা নেই। সে-ও এই সুযোগে নিজের হাতের কাজগুলো মিটিয়ে নেক। কাল না-হয় কথা বলা যাবে।
__________
কিন্তু এই কাল আর আসে না। রাতেই হুট করে নিতুনের কল আসে স্নেহার নিকট। নিতুন এই রাতে ধুম করে কেন কল করলো স্নেহার জানা নেই। কলটা রিসিভ করতেই নিতুন হুড়মুড়িয়ে বলে দিলো,
“মিস, ভাইয়া হসপিটালে। বাজেভাবে কেউ মেরেছে। মাথায় বারোটা সেলাই লেগেছে…”
স্নেহার সময় সেখানেই থমকে গেলো। এটা কেন হলো? কী কারণে হলো? স্নেহা একটু নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে চেয়েছে বলেই? স্নেহা একটু নিজের জন্য সুখ চাওয়ার দুঃসাহস করেছে বলে? তাকে দুঃখী বানানোর ষড়যন্ত্র এসব? উঁহু, স্নেহা হবে না দুঃখী। তার জানা নেই নিতুন ঠিক কী কারণে নিজের ভাইয়ের খবর নিজের মিসকে জানানোর তৎপরতা দেখালো। হয়তো ছেলেটা নিজের ভাইয়ের পেটের খবর জানে। তাই সে সাহস করে জিজ্ঞেস করে,
“এখন কী অবস্থা?”
নিতুন চিন্তা নিয়ে জবাব দেয়,
“খুবই খারাপ, মিস। ভাইয়া জ্বর ট্বর নামিয়ে বসে আছে। সেলাইয়ের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আছে।”
“আচ্ছা। অসুবিধা নেই। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তোমার হোমওয়ার্ক করে রেখো। আগামীকাল এসে কিন্তু আমি ম্যাথগুলো চেক করবো।”
বলেই স্নেহা কল কেটে দেয়। নিতুন তখন খুবই হতবাক। এটা কী হলো? সে ভেবেছিল ভাইয়ার অবস্থা শুনে মিস হয়তো এক বিন্দু হলেও প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু মিস পাষাণের মতো হোমওয়ার্কের কথা বলে কল কেটে দিলো? একটুও তার বাবু ভাইয়ার পরোয়া করলো না? নিতুন রাগে ফুঁসে। করবে না সে হোমওয়ার্ক। এই মিসকে সে মোটেও ভাবী হিসেবে মেনে নিবে না। তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে যার একটুও মায়া হয় না, সে তার ভাবী হওয়ার যোগ্য না।
__________
পরের দুটো দিন কাটলো অয়নের জ্বরে এবং স্নেহার টাইম টু টাইম নিজের রুটিন অনুযায়ী। নিতুনকে এই দু’দিন স্নেহা পড়াতে গিয়েছে। তবে একটিবারও অয়নের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চায় নি সে। নিতুনের ঠিক পাশের রুমেই পড়ে থাকা অসুস্থ মানুষটার দিকে একবার উঁকি অব্দি দেয় নি সে। নিতুন এবং নীলা বেগম হতাশ চোখে দেখে স্নেহার এই অনাগ্রহ। নীলা বেগম মনে মনে কিছুটা রুষ্টও হোন। তার এই মায়া মায়া ছেলেটার উপর এই পাষাণের বুঝি একটুও মায়া হয় না? তার ছেলের থেকে ভালো দ্বিতীয় কে আছে? ওরকম একটা ছেলে, যাকে সবাই ভালোবাসতে বাধ্য, তাকে স্নেহা কীভাবে উপেক্ষা করছে?
সকলের হতাশা, রুষ্টতা এবং অভিমানের ভীড়ে তৃতীয় দিনের মধ্যে অয়ন কিছুটা সুস্থ হয়। নিতুনের গুণেগুণে তার কানে সবই এসেছে। স্নেহা তাকে কতটা অপছন্দ করে, সে যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। জ্বর সেড়ে উঠা অয়ন মন খারাপ নিয়ে গায়ে একটা শার্ট চাপায়। সবুজ রঙের এই শার্টটা আয়রন করা হয় নি। অয়নের সেদিকে ধ্যান নেই। সে আজ আয়োজন করে হাতে ঘড়ি, চোখে সানগ্লাস, গায়ে পারফিউম কিছুই মাখে নি। কেবল আলমারি খুলে একটা মূল্যবান বস্তু হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। মা’য়ের নিষেধ মেনে বাইকে না চড়লেও, রিকশায় উঠে সে। পকেট থেকে ফোন বের করে স্নেহাকে ম্যাসেজ পাঠায়,
“হলের বাহিরে আম গাছের নিচে অপেক্ষায় আছি।”
__________
অয়নের অপেক্ষা শেষ হয় ঘন্টা দুয়েক পরে। স্নেহা ক্যাম্পাসের ক্লাস শেষে এসেছে কেবল। অয়নের মুখোমুখি আম গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছেন?”
স্নেহার প্রশ্নটা অয়নের কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো কাজ করে। সে তবুও ভদ্রভাবে উত্তর দেয়,
“ভালো। আপনি?”
“খারাপ নই।”
অয়ন নিজের সঙ্গে করে নিয়ে আসা ছাতাটা স্নেহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা রাখুন। এটা হারায় নি। আমি মিথ্যা বলেছিলাম, আপনার সঙ্গে যোগাযোগের বাহানা রাখতে। আপনি বোধহয় আগ্রহী নন। তাই অহেতুক আপনাকে বিরক্ত করার মানে হয় না।”
অয়নের কণ্ঠে সে কী অভিমান! স্নেহার হাসি পায়। সে হাসে না। এক কদম এগিয়ে হাত তুলে অয়নের চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। সামান্য উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করে মাথার সেলাই। অয়ন অবাক হয়। বিস্ময়তায় জমে যায়। তবে কয়েক সেকেন্ডেই স্নেহা নিজের হাত সরিয়ে, ছাতাটা নিয়ে নেয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“আকাশ তবে ভালোই মেরেছে আপনাকে।”
“আপনি কীভাবে জানেন যে আকাশ ছিল?”
স্নেহা কিছুটা রহস্যময় হেসে বলে,
“জিজ্ঞেস করেছি ওকে। বুকের পাটা ফুলিয়ে জানিয়েছে সে-ই করেছে। আপনার সাথে না-কি হিসাব মেটানোর ছিল।”
“আপনি ওর কাছে কেন গেলেন? শিট, আপনার সাথে আজেবাজে বিহেভ করে নি তো? কিছু করেছে ও?”
স্নেহা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে উল্টো প্রশ্ন করে,
“ও কী করবে? যা করার করেছি আমি। এজন্যই আসতে দেরি হয়ে গেলো।”
“কী করেছেন আপনি?”
“বেশি কিছু না। হাতে একটা কাঁচের স্প্রাইটের বোতল ছিল। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভুল করে বোতলটা আমার হাত থেকে পড়ে যায়। কপাল খারাপ হওয়ায়, বোতলটা নিচ তলায় দাঁড়িয়ে থাকা আকাশ-বাতাসের মাথায় পড়েছে।”
অয়ন চরম হতবাক। সে কিছু বলার মতো ভাষা পাচ্ছে না। কেবল কোনরকমে উচ্চারণ করলো,
“স্নেহা, আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? আপনি এটা কী করলেন? ওই ছেলে ঠিক আছে?”
“মাথা থেকে রক্ত ঝড়ছিল। সবাই ধরেটরে হসপিটালে নিয়ে গেলো। বোধহয় দশ বারোটা সেলাই লাগতে পারে।”
অয়ন ভীত গলায় বলে চলেছে,
“এটা কী করলেন? এখন যদি আপনার নামে অভিযোগ করে! শিট, শিট, শিট!”
স্নেহা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে হাই তুলতে তুলতে বলে,
“আপনি আছেন কেন? সামলান এখন ঝামেলা। আকাশ এখন রেগে ক্ষতি করতে পারে আমার। তাই আমার শেল্টার প্রয়োজন। শেল্টার দেওয়ার দায়িত্ব এখন আপনার।”
“শেল্টার? আমি? মানে…”
“কেন? আপনি না বলেছিলেন বিয়ে করতে চান? এখন কি নিয়ত বদলে গিয়েছে?”
অয়ন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে আছে। সে এলোমেলো ভঙ্গিতে কেবল বলে,
“না… হ্যাঁ… মানে…”
“স্পষ্ট উত্তর দিন।”
“হ্যাঁ, চাই তো করতে। কিন্তু আপনি? আপনি শেল্টারের জন্য বিয়ে করতে চাইছেন?”
অয়নের চোখেমুখে দ্বিধা। স্নেহা জবাব দেয় না। ব্যাগ হাতড়ে ওয়ালেট বের করে। দুটো একশো টাকার নোট অয়নের হাতে ধরিয়ে দেয় সে। অয়ন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাতেই স্নেহা বলে,
“একশো নিরানব্বই টাকার ঋণ ছিল। আমি দুইশো টাকা ফেরত দিলাম। আপনার আমার এখন শুধু এক টাকা ঋণের সম্পর্ক। কিন্তু সেদিন পুরান ঢাকা থেকে ফিরে আপনাকে নিয়ে আমি দুই মিনিট ভাবি। এবং ভেবে উপলব্ধি করি যে নতুন কোনো সম্পর্কের মাধ্যমে, আপনার সঙ্গে এই ঋণের সম্পর্ককে মিটিয়ে দেওয়া যায়। আমি আপনাকে নিয়ে দুটো দিন নয়, দুটো মিনিট ভেবেছি। আপনি মন্দ নন।”
হাওয়ার তেজ বেড়েছে। এই বুঝি বৃষ্টি নামলো বলে। অয়ন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টলটলে চোখ মেলে দেখছে স্নেহার মুখটা। এই মেয়েটা তাকে নিয়ে ভেবেছে? ও আল্লাহ! অয়ন বুঝি পাগল হয়ে যাবে। এসব সত্যি তো? না-কি অয়ন এখনো জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে? অয়নের মনের দ্বিধা দূর করতে ঝুম করে বৃষ্টি নামলো। বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা অয়নের খুশিতে যেন নৃত্য করছে। অয়ন সে-ই নৃত্যে ভেজার সুযোগ পেলো না। তার আগেই স্নেহা নিজের হাতের ছাতাটা খুলে অয়নের হাতে ধরিয়ে দিলো। অয়ন মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে। স্নেহা ভিজছে। অয়ন সব কথা ফেলে আপাতত বললো,
“ছাতার নিচে আসুন।”
স্নেহা গেলো না। আরো দুই কদম পিছিয়ে সে গাছের নিচ ছেড়ে, খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিলো। চোখ বুজে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে জবাব দেয়,
“আমাকে ভিজতে দিন। এ-ই বৃষ্টিতে আমার নীড়ে জ্বর নামুক আজ। আমার এখন মাথায় জলপট্টি দেওয়ার মানুষ আছে। আমার আপনি আছেন। আছেন না?”
অয়ন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থেকে বিড়বিড়িয়ে উঠে,
“আছি, আছি, আছি।”
সমাপ্ত
[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]