নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-০৭

0
29

#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_দুই
পর্বঃ০৭
#জান্নাতুল_বিথী

রুমের এক কোণে বসে বাবার সাথে কথা বলছে তুহা। আজ কতোগুলো দিন পর কথা হচ্ছে তার সাথে। তুহার মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা তাকে সব সময় আগলে রেখেছে। তাদের সম্পর্ক বন্ধুর মতো৷ সুখে দুঃখের হাজারটা কথা বলে। তার বাবা শৈবালের কথা জিজ্ঞেস করলে তুহা বাবাকে অনেক কথা বলে। প্রয়োজনে কিছু কথা গোপনও করে। সে যতোই খারাপ হোক তার হাজবেন্ড হয়। তাদের হাজবেন্ড ওয়াইফের সম্পর্কে যতোটুকু গোপনতা বজায় রাখা উচিত ততোটুকু গোপন করেই বাকিটা বলে নিজের পিতাকে। সব শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় নুরুল পাটোয়ারী। মেয়ের সুখের জন্য বিয়ে দিয়েছে অথচ তিনে ভাবেইনি মেয়েকে এক নরক থেকে বাঁচিয়ে আরেক নরকে সঁপে দিয়েছে? নুরুল পাটোয়ারী মেয়েকে শুধায়,

“কি করবি তুই? আমি চাইনা তুই ওখানে থাক। চলে আয় বাবার বুকে।”

ভিডিও কলের ওইপাশে বাবার ভেজা চোখ দেখে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে তুহার। তারপরো নিজেকে কঠোর করার চেষ্টা করে সে বলে,

“ আমাকে তুমি সাহায্য করবা বাবা।”

“তোর সুখের জন্য আমি সব কিছু করতে পারবো মা। কি চাস তুই?”

”আমি আগামী এক মাস পর জাপান যেতে চাই। সেখানে বাকি পড়া লেখা করবো। তুমি যা যা প্রয়োজন সবটা করো।”

“আমার তোকে বিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি। দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দিতাম তোর ফুপির কাছে এটাই ভালো হোতো!”

“এখন এসব ভেবে তো আর লাভ নাই। তুমি বরং সব ব্যবস্থা করো। খুব বেশি সময় লাগার কথা না। আমার পাসপোর্ট তো করা আছেই।”

“ঠিক আছে। আমি দেখছি ব্যাপার টা।”

এইটুকুতেই থেমে থাকেনি তুহা। বরং সাথে আরো একটা শর্ত যোগ করে। কেউ যেনো এই বিষয় টা সম্পর্কে অবগত না হয়। বাবার সাথে কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায় তুহা। কালকে বিয়ে আর আজকে গায়ে হলুদ। তাকে রেডি হতে হবে। কনের বাড়িতে তাদেরকে হলুদ নিয়ে যেতে হবে। শৈবাল যাবে কি না নিশ্চিত না। হয়তো নাও যেতে পারে। বন্ধুর পাশে থাকতে হবে তো।

তুহা হলুদ শাড়ি পরে নেয় বাঙালি স্টাইলে। বাবার আদরের মেয়ে হলেও প্রায় সব কাজই হাতে হাতে শিখে নিয়েছে সে। হয়তো কখনো কাজ করা হয়নি। কিন্তু শিখে তো নিয়েছে। আর এখন কাজেও লেগে গিয়েছে। হলুদ শাড়ি পরে বিয়ে বাড়ির সাজের মতোই একটু গর্জিয়াস সাজ দেয়।

জিহাদের কাজিন কণা এসে ডেকে যায় তুহাকে একবার। জানায় সবাই অপেক্ষা করছে। উঠে দাঁড়ায় তুহা, তাকে এখন বের হতে হবে। একবার ভেবেছে শৈবালকে বলে যাবে। আবার মনে হলো থাক না কি দরকার বলার। সেই ছেলেটা তাকে কি কোনো কাজ বলে করে নাকি? বাহিরে গাড়ির কাছে যেতে যেতে বেশ কয়েকজন প্রশংসা করে তার। অনেকে হয়তো জানে জিহাদের বন্ধুর বউ সে। নাহলে তো চেনার কথা না।

কণা সহ আরো দুইজন তার জন্য অপেক্ষা করছে। তুহা সেখানে উপস্থিত হতেই অদূরে তাকিয়ে দেখে শৈবাল সবার সাথে এটা ওটা কাজ করছে। তাকে হয়তো খেয়াল করেনি। সে সবার সাথে আলাপ করে গাড়িতে বসতে যাবে সেই সময় শৈবাল এসে উপস্থিত হয়। তুহা তার দিকে ভ্রু কুচতে তাকাতেই সে বললো,

“এভাবে কোথায় যাচ্ছো? আমাকে তো কিছু বলোনি!”

“প্রয়োজন বোধ করিনি!”

তুহার ডান হাত চেপে ধরে তাকে দূরে সরিয়ে আনে শৈবাল। মুগ্ধ হয় সে, এই মাথা নষ্ট করা সাজে কিছুতেই সে তুহাকে বাহিরে যেতে দিবেনা। বিয়ে বাড়িতে কতো ধরণের ছেলে পেলেরা থাকে। এমনিই সুন্দরী বউ তার উপর কখন কি ঘটে যায় বলা যায় না। তুহা শৈবালের দিকে রাগি লুকে তাকিয়ে বলে,

“কি সমস্যা আপনার সেটা বুঝাবেন আমায়?”

“তোমার মতো ঘাড়ত্যাড়া মেয়েকে বুঝানোর মতো ধৈর্য্য আমার নেই।”

তারপর কণার দিকে ইশারা করে জানায়,

“তোমরা যাও, আমার মিসেস যাবেনা কোথাও!”

আমার মিসেস শব্দটা শুনে কেঁপে উঠে তুহা। এর রূপ ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। কখন কি করে নিজেই হয়তো জানেনা। জানলে একেরবার একেক রূপ দেখাতো বুঝি? তুহা ভাবে, এই মানুষটার বাম পাঁজরের হাড় থেকে তাকে তৈরি করা হয়েছে। তবে তাদের মাঝে এতো বৈসাদৃশ্য কেন? মানুষটা কেনো ভালো হয়ে তার জীবনে আসেনি? কেনো এমনটা হলো তার সাথে? এসব দীর্ঘশ্বাসের উত্তর কি কারো কাছে আছে? মনে হয় না।

শৈবাল তুহার কাধ জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে,

“আমার থেকে দূরে যেতে চাও জান? যতো দূরে যেতে চাইবে ততো কাছে আসবে!”

কেঁপে উঠে তুহা। একবার ভাবে তার প্ল্যানের কথা শৈবাল জেনে যায়নি তো? না জানলে এভাবে কথাটা বলেছে কেনো? এই ছেলে কি মন পড়তে জানে? নাকি আড়াল হতে শুরে নিয়েছে বাবা মেয়ের আলাপ? কে জানে? তবুও তুহা নিজের কঠোরতা বজায় রেখে আওড়ায়,

“আপনার মতো মানুষের জীবনে কেউ থাকবেনা মিস্টার শৈবাল শাহরিয়ার। আপনি মানুষ কে আগলে রাখতে জানেন না!”

“কাউকে আগলে রাখার প্রয়োজন নেই। যে থাকার সে এভাবেই থেকে যায়!”

শৈবালের কথা শুনে তুহা হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,

“আপনার এই ভাবনার জন্য একদিন খুব পস্তাবেন শৈবাল শাহরিয়ার।”

কথা বলতে বলতে রুমে যায় তারা। শৈবাল কিছু বলেনা। তার কাছে এসব কথার মূল্য নাই। তার জীবন, তার ভাবনা হয়তো আরো আলাদা। সে সেসব কথায় কান না দিয়ে তুহার উদরে হাত রেখে কাছে টেনে নিয়ে ঠোঁটে গভীরভাবে স্পর্শ করে। তার ঠোঁটে, গলায়, ঘাড়ে ছোট ছোট চুমু খায়। তুহা বাঁধা দিতে গেলে এক হাত দিয়ে তাকে আটকে দেয় শৈবাল। আস্তে আস্তে শৈবালের স্পর্শ গভীর হতে থাকে। হারিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে।
.
সমুদ্র সম্রাট, দুই ভাইয়ের মাঝে সে ছোট। বড় ভাই ওয়াসিম বিয়ে করে বউ নিয়ে আমেরিকায় সেটেল হয়েছে। ওয়াসিম সম্রাট মায়ের সাথে করুণ কন্ঠে কথা বলে। আজ এক বছর হতে চললো ছোট ভাইটার কোনো খোঁজ নাই। সে কোথায় আছে কেমন আছে আজো খুঁজে পায় নি। পুলিশের সাথে কথা বলেও কোনো কূল কিনারা হয়নি। তার কোনো বন্ধুর সাথেও যোগাযোগ করতে পারছে না।

তারা পুরো ফ্যামিলি তখন আমেরিকায় ছিলো। শুধু সমুদ্র সম্রাট দেশে ছিলো। বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছিলো বান্দরবান। তারপর আর তার সাথে যোগাযোগ হয়নি। তার সবচাইতে কাছের বন্ধু শৈবালের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছে না। যাদের সাথে কথা হয়েছে তারা কেউ সমুদ্র সম্পর্কে কিছু জানেনা৷ বরং তারা জানায় তারা কেউ সমুদ্রের সাথে ঘুরতে যায়নি৷

ওয়াসিম সম্রাট হতাশ হয়ে পড়ে। তার সবচাইতে কাছের মানুষ, তার বন্ধুর মতো ভাইটা হারিয়ে গিয়েছে। তাকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ কিভাবে এই সত্যি টা নিজের জন্মদাত্রীকে বলবে ওয়াসিম? বউ নাতাশার দিকে করুণ চোখে তাকালে সে বলে,

“তুমি চিন্তা করোনা অনুজের বাবা। ঠিক পেয়ে যাবা ছোট ভাইকে।”

এই একই বাক্য গত এক বছর ধরে শুনে আসছে সে। তাও কথাটায় যেনো আরেকটু ভরসা আরেকটু শান্তি পায়। মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করে তার ভাই যেখানেই থাকুক যেনো সুস্থ সবল থাকে। তার যেনো কিছু না হয়!

তবে সমুদ্র সম্রাট কি সত্যিই সুস্থ আছে? সত্যিই কি সে আবার ফিরে আসবে নিজের আপন নীড়ে? যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে বেশ কয়েকটা প্রাণ।

চলবে,,,,,,,,,,,