নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-১১

0
32

#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_দুই
পর্বঃ১১
#জান্নাতুল_বিথী

রাত প্রায় দুইটা বাজতে চললো। তুহা পড়ার টেবিলে বসে আছে। এতো দিনের পড়া গুছিয়ে নেয় কিছুটা। কালকে ভার্সিটি যাওয়ার ইচ্ছে আছে। শৈবাল তখন ছাদ থেকে এসে চেঞ্জ করে এই ঝুম বৃষ্টির মাঝেই বের হয়েছে। কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না। তুহা অবশ্যই জানার চেষ্টাও করেনি। এখনো বাড়িতে ফিরেছে কি না জানা নেই তার।

বই খাতা গুলো এক পাশে ঠেলে রেখে উঠে দাঁড়ায় সে। প্রচণ্ড ঘুম আসতেছে তার। স্টাডি রুম আর তাদের রুমের দূরত্ব অল্প একটু। তুহা রুমে ঢুকে লাইট জ্বালায়। আসে পাশে নজর দিতে গেলে চোখে পড়ে শৈবালকে। বেডের এক কোণে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। শরীর কাঁপছে থরথর করে। তাঁর অবস্থা বেগতিক দেখে চমকে যায় তুহা। দ্রুত পায়ে এগিয়ে শৈবালের গায়ে হাত দিতেই আরেক দফা চমকে উঠে সে।

জ্বরে সারা শরীর পুড়ে যায় যেনো। কপালের একপাশে ছোট্ট একটা ব্যান্ডেজ উঁকি দিচ্ছে। কখন কিভাবে আঘাত পেয়েছে কে জানে। তুহা একবার ভাবে মামনি কে ডেকে নিবে। পরক্ষণেই সেই চিন্তা বাদ দিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে মগে করে পানি এনে একটা রুমাল দিয়ে জল পট্টি দেয় শৈবালকে। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে হালকা কিছু খাবার খাইয়িয়ে দিয়ে ঔষধ দেয় তাঁকে৷ খেতে চায়না শৈবাল, বিরক্ত হয়ে তুহার হাত সরিয়ে দিতে চায়। তুহাও মেনে নেওয়ার পাত্রী নই। শৈবালকে একটা ধমক দিতেই ছেলেটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। তুহা কোনো রকমে তাকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে এসিটা বন্ধ করে কাঁথা এগিয়ে দেয় শৈবালকে।

শৈবালের অবস্থা দেখে কান্না আসে তুহার। নিজেকে সামলে শৈবালের মুখের দিকে তাকায়। ছেলেটার গোলাপি ওষ্ঠদ্বয় তিরতির করে কাঁপছে। সে কি কিছু বলতে চায় তুহাকে? প্রশ্নটা মনে উদয় হতেই এগিয়ে যায় তুহা। শৈবালের এলোমেলো চুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে ফিসফিস করে শুধালো,

“আঘাত পেয়েছেন কিভাবে শৈবাল শাহরিয়ার?”

শৈবাল চোখ পিটপিট করে তাকায় তুহার দিকে। কি নিষ্পাপ চাহনি ছেলেটার। বুকের ভেতর ধক্ করে উখে তুহার। শৈবাল শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া ওষ্ঠাদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে বলে,

“একটু ছুঁয়ে দাও মিসেস। সমুদ্র তার সবচাইতে প্রিয় বন্ধুটাকে কিভাবে আঘাত করেছে দেখো! তুমি ছুঁয়ে দিয়ে ব্যথা কমে যাবে।”

আরো একবার সমুদ্রের নাম শুনে ভ্রু কুচকায় তুহা। কে এই সমুদ্র? শৈবালকে আঘাত করার কারণ কি? তাও যদি হয় প্রিয় বন্ধু? তুহা শৈবালের দিকে তাকিয়ে তার সমস্ত প্রশ্ন উগলে দেয়,

“আপনি সমুদ্র ভাইয়ের প্রিয় বন্ধু হলে সে আপনাকে আঘাত করবে কেনো? সে কোথায় আছে? আপনাদের মাঝে কি ঝগড়া হয়েছে?”

তুহার কথার জবাব দেয় না শৈবাল, বিরবির করে কিছু একটা বলতে থাকে। তুহা নিজেকে শৈবালের আরো নিকটে নিয়ে গিয়ে মুখের কাছে কান দিলে শুনতে পায় কিছু অস্পষ্ট কথা,

“তুই আমাকে যতোবার খুশি আঘাত কর, আমি একটুও রাগ করবোনা তোর উপর। তাও তুই দ্রুত সুস্থ হয়ে যা। আমি যে আর এসব মানসিক অশান্তি নিতে পারছি না। তুই প্লিজ ফিরে আয়…. ”

শৈবাল অস্পষ্ট স্বরে আরো কথা বলে, যা তুহা পর্যন্ত পৌঁছায় না। যতোটুকু কথা শুনেছে তাতে সে এতোটুকু বুঝতে পারছে শৈবাল হয়তো তার বন্ধু সমুদ্রের সাথেই দেখা করতে গিয়েছে। কিন্তু তাকে আঘাত করার হিসেব কিছুতেই মিলাতে পারেনা। ছেলেটা তার প্রাণ প্রিয় বন্ধুকে কেনো আঘাত করতে যাবে?

ঘাড়ে উষ্ণ নিশ্বাস পড়লে চমকে উঠে তুহা। শৈবাল আর তার মাঝে যতোটুকু দূরত্ব ছিলো তা ইতোমধ্যে ঘুছিয়ে নিয়েছে ছেলেটা। শৈবাল তাকে দুইহাতে ঝাপটে ধরে। উদরে উষ্ণ আদরে ভরিয়ে দেয়। ছোট ছোট কামড়ে তিরতির করে কেঁপে উঠে তুহা। শৈবাল এগিয়ে এসে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় তুহার। ললাটে ললাট ঠেকিয়ে ফিসফিস করে আওড়াল,

“তোমাকে একটুখানি আদর করলে রাগ করবে মিসেস?”

জবাব দিতে পারেনা তুহা। শৈবাল জবাবের আশায় না থেকে ডুবে যায় তুহার মাঝে। সে নিজে নিজেকে প্রশ্ন করে,

“তোকে এই অ*সভ্য ছেলেটা একটুখানি ছুঁয়ে দিলে তুই রা*গ করবি তুহা?”

সঠিক যুতসই উত্তর মিলেনা তার নিকট। একটা সময় নিজেকে ছেড়ে দেয় শৈবালের নিকট।
.
পরেরদিন সকাল আটটা বাজতে চললো, অথচ এখনো শৈবালের জ্বর নামার নাম গন্ধও নাই। তুহা ভয় পেয়ে আফসানা বেগমকে ব্যাপারটা জানালে, আতিফ খন্দকার সহ ছেলেকে দ্রুত হসপিটালে এডমিট করায়।

তুহা একবার মনে করে হাসপাতালে যাবে না। আবার কি যেনো ভেবে রান্না করে রেডি হয়ে বিকেলের দিকে একবার যায়। সকালে নেওয়ার সময় একবার গিয়েছিলো। পরে প্রিয়কে রেখে চলে আসে। আফসানা বেগমকে সামলে নেয় প্রিয়। ভদ্রমহিলা একটু পর পর ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।

তুহা যখন যায় তখন দেখে শৈবালকে ঘিরে তার কয়েকজন কলিগ দাঁড়িয়ে। কেবিনে তারা ব্যাতীত অন্য কেউ নেই। প্রিয়, আফসানা বেগম বা আতিফ খন্দকার কোথায় জানা নেই তার। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের দেখে সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। শৈবাল তখন বেডে হেলান দিয়ে তাদের সাথে বাক্য বিনিময়ে ব্যস্ত ছিলো। তার এক হাতে স্যালাইনের নল ঝুলে আছে। তুহার দিকে নজর পড়ে তার মিনিট দুয়েক পরে।

তুহাকে দেখে গম্ভীর স্বরে বলল,

“ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে আসো!”

অবাক হয়ে তার কলিগেরা তাকায় তুহার দিকে। অপরিচিত চেখারা দেখে খানিকটা বিচলিত হয়ে আদিল নামের একটা ছেলে বলে বসে,

“স্যার উনি কে? কি হন আপনার?”

শৈবাল তাদের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে কিছুটা আদেশের স্বরে বলে,

“আপনারা একপাশে গিয়ে কাইন্ডলি আমার মিসেস কে জায়গা দেন!”

সবাই অবাক হয়ে শৈবালের দিকে তাকায়। মিসেস বলতে কি বুঝানো হয়েছে কারো বুঝতে বাকি নেই। কাজ পাগল, মেয়েদের দিকে চোখ তুলে না তাকানো ছেলেটার বউয়ের প্রতি কেয়ার দেখে বিস্মিত হয় সকলে। তুহাকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে এক পাশে সরে যায়। তুহা শৈবালের পাশে বসলে দিয়া নামের এক মেয়ে কলিগ বলল,

“সিরিয়াসলি মিস্টার শৈবাল শাহরিয়ার? উনি আপনার ওয়াইফ? আমার তো এখনো বিশ্বাস হয় না।”

“অবিশ্বাস করার মতো এখানে কিছু ঘটেনি মিস দিয়া।”

বিরক্ত স্বরে জবাব দেয় শৈবাল। দিয়া অবাক হয়ে বলে,

“আমি তা বলতে চাইনি, আপনি….”

দিয়াকে কথা শেষ করতে দেয় না শৈবাল। বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে শুধায়,

“আপনি আমাকে দেখতে এসেছেন, দেখা শেষ হলে যেতে পারেন। আমি আমার বউয়ের সাথে প্রাইভেট সময় কাঁটাবো।”

কথাটা দিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেও সকলের বেশ গায়ে লাগে। তারা কোনো মতে শৈবালের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায় কেবিন থেকে। এদিকে শৈবালের নির্লজ্জ, ঠোঁটকাটা কথাবার্তা শুনে লজ্জায় নেতিয়ে পড়ে তুহা। এতো গুলো মানুষের সামনে এভাবে কিভাবে কথাগুলো বললো। রাগত স্বরে শৈবালের দিকে তাকিয়ে বলল,

“অসভ্য পুরুষের মতো কথা বলেন কেনো? অসভ্য পুরুষ। এমন ভালোবাসা দেখাচ্ছেন মনে হয় আমাকে ছাড়া আপনি শ্বাসটাও ফেলতে পারেন না।”

তুহার বলার ধরনে হেসে ফেলে শৈবাল।

“সেরকম কিছু না, সুখী বিবাহিত পুরুষ হওয়ার অভিনয় করার চেষ্টা করলাম একটু। প্রথমবার হিসেবে ভালো ছিলো তাইনা?”

বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে তুহার। কথাটা একদমই আশা করেনি তার থেকে। সে কি একটু বেশিই ভাবে সব সময়? নয়তো এমন হয় কেনো তার সাথে? সে কি আগের জন্মে কোনো পা*প করেছে?

চলবে,,,,,,,,