#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_দুই
পর্বঃ ১২
#জান্নাতুল_বিথী
তুহা যখন হাসপাতাল থেকে ফিরে আসে তখন রাত দশটা বাজে। সারাটা দিন হাঁসফাঁস করে কেঁটেছে তাঁর। মানুষটা হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে। কিছুতেই যেনো স্বস্তি মিলছে না তাঁর। কেউ একটা পশুর সাথে কিছুদিন থাকলেও তাঁর প্রতি মায়া জন্মে যায়। সেখানে সে তো জলজ্যান্ত মানুষ।
শৈবালের জ্বর বেড়ে যাওয়াতে তাকে বাড়িতে আসার অনুমতি দেয় না ডাক্তার। আরো দুদিন পরে ফিরে আসে শৈবাল। এর মাঝে একটিবারের জন্যেও তুহা তাকে দেখতে যায়নি। যার কাছে তার বউয়ের কোনো মূল্য নাই, সবার সামনে বসে ভালোবাসার নাটক করে তাঁকে দেখতে যাওয়ার কি দরকার। তুহার নিকট সবার আগে নিজের আত্মসম্মান। শৈবাল যেদিন বাড়ি ফিরে সেদিন থেকে শুরু হয় তাঁকে এড়িয়ে চলা। তুহা শৈবালের সামনে যায় না আজ আঠারো দিন হলো। শৈবাল নিজেও বাড়িতে থাকেনা। নিজের ব্যস্ত সময় কাটিয়ে যে দু একদিন রাতে বাসায় ফিরে সেদিনও তুহাকে দেখতে পায়না।
সেদিন হাসপাতালে শৈবালের শেষ কথার প্রতক্ষ্যদর্শী ছিলেন আফসানা বেগম। ছেলের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়েন যেনো তিনি। তুহার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে মায়া হয়। ফলস্বরূপ তুহা যখন শৈবালকে এড়িয়ে চলে তখন সেটা তিনি দেখেও না দেখার ভান করেন।
আজকে তেরো তারিখ। দুইদিন পরে তুহার ফ্লাইট। তার চলে যাওয়ার কথা এখনো নুরুল পাটোয়ারী ছাড়া কেউ জানেনা। তুহা সিদ্ধান্ত নেয় আজকে এবাড়ি থেকে চলে যাবে। ছেলেটা তিনদিন আগে চট্টগ্রামে গিয়েছে কোনো একটা কাজে। আজকে আসার কথা৷ শৈবাল বাড়ি না থাকাকালীন সব কিছু গুছিয়ে আফসানা বেগমের কাছে যায় তুহা। আফসানা বেগম রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলো। আজ তিনদিন পর ছেলে চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি ফিরছে। ভালো মন্দ কিছু রান্না না করলে চলে? তুহা আফসানা বেগমের কাছে এসে মৃদু স্বরে শুধালো,
“মামনি তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো।”
অবাক হয় আফসানা বেগম। তুহা কেবল শৈবালকে এড়িয়ে চলেনা সাথে তাদেরকেও যথা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। সেখানে আজ হঠাৎ সেধে কথা বলতে আসায় অবাক হন বটে। তরকারিতে মশলা দিতে দিতে বলল,
“মামনিকে কিছু বলার প্রয়োজন আছে নাকি? আমাদেরকে তো দূরে ঠেলে দিয়েছো।”
তুহা কথা বাড়াতে চায়না, তাই সেদিকে না গিয়ে সরাসরি আওড়ায়,
“এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। আমি কালকে চলে যেতে চাই!”
“অসুবিধা নাই। বাড়ি যাও গিয়ে ঘুরে ফিরে আসো।”
“গেলে তো আর ফিরে আসবো না মামনি!”
তাচ্ছিল্য হেসে জবাব দেয় তুহা। চোখের কোণে জল গড়ায়। আফসানা বেগম হেসে বলে,
“বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি মেয়েদের সব মা। এভাবে বলেনা!”
“সরি টু সে মামনি। আমি তোমার মতামত শুনতে পারবো না। কারণ আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। তোমার ছেলে এতো অপরাধ করার পরও তোমরা তাকে সাপোর্ট করে যাও তাই তোমাদের নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু আমি এসব স*হ্য করে এখানে থাকতে পারবো না। একটা মেয়ে বিয়ের পরে স্বামীর যত্ন, ভালোবাসার ছায়াতলে থাকে। আমাকে যত্ন করে বা ভালোবেসে তোমার ছেলে তার ভালোবাসাকে অপমানিত করবে না হয়তো। তুমি চেয়েছো তোমার ছেলের সাথে আমি সুখে সংসার করি। আমিও চেয়েছিলাম। কিন্তু আসল যে ব্যক্তি সে চায়নি। তাই সংসার আগায়নি। এই বন্ধন আজ হলেও ভাঙবে কাল হলেও তোমার ছেলে ভেঙে দিবে। শুধু শুধু থেকে মায়া বাড়িয়ে তো কোনো লাভ নেই তাই না?”
স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আফসানা বেগম। ছেলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি অবগত। কিন্তু কখনো চায়নি তাঁদের সম্পর্ক টা ভেঙে যাক। মন প্রাণ থেকে সব সময় দোয়া করেছে। শেষ পর্যন্ত তবে এটাই লেখা ছিলো তাঁদের ভাগ্যে? তুহাকে বাঁধা দেওয়ার কথা মনে আসলেও চেপে যায়। মেয়েটা বড্ড জেদি। হয়তো নাও শুনতে পারে।
.
শৈবাল বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া করে রুমে আসে বারোটা নাগাদ। তুহা বেডের এক কোণে ঘুমের ভান ধরে শুয়ে আছে। ইচ্ছে করে আজকে এই রুমে এসেছে। ভোর বেলা যদি চলে যেতে হয় তাহলে এই রুমে তাকে আসতেই হোতো। আর তখন শৈবালের রুমের দোর বন্ধ থাকে। তাই বাধ্য হয়ে এখানেই থাকতে হলো তাঁকে। শৈবাল রুমে ঢুকে তুহাকে দেখে খানিকটা অবাক হয়। এতো এতো ব্যস্ততার মাঝেও এই নারীকে সব সময় মনে পড়েছে তাঁর। কিন্তু রমণী যে জেদ ধরে ছিলো, নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো তাঁর সাথে দেখা দিবেনা। আজ হঠাৎ এখানে কেনো? প্রশ্ন মনে আসলেও কথা আগায়না শৈবাল। তুহার দিকে এগিয়ে গিয়ে অন্য টপিকে প্রশ্ন তোলে,
“কি ব্যাপার মিসেস? তুমি নাকি ভার্সিটিতে যাওনা? ভার্সিটি যাওয়ার জন্য মাস দুয়েক আগেও তো আমার সাথে ঝগড়া করেছো!”
জবাব দেয়না তুহা। নিজেকে ঘুমন্ত মানুষে প্রমাণ করতে ব্যস্ত সে। শৈবালও নাছোড় বান্দা, সে বুঝতে পেরেছে তুহা ইচ্ছা করে তাকে ইগ্নোর করছে। তুহার মুখের উপর থেকে বালিশ সরিয়ে এক হাতের আঁজলে তার গাল ধরে, অন্য হাত গলিয়ে দেয় তাঁর চুলের ভাঁজে। শৈবালের স্পর্শে তুহার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। সে নিরবে শুয়ে আছে চোখ বুঁজে। ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। মনে মনে দোয়া করে,
“এই সুপুরুষ কখনো আমার জন্য নিষিদ্ধ না হোক। সারাজীবন আমি তাঁর হয়ে থাকতে চাই।”
নিজের অজান্তেই এসব ভেবে নাকের পাটা ফুলে উঠে তার। নিজেকে ধিক্কার জানায়। মাথা থেকে এক ঝটকায় শৈবালের হাত সরিয়ে দিয়ে শুধালো,
“আমি ঘুমাবো, ডিস্টার্ব করবেন না!”
“এতোদিন পরে ভালোবাসার মানুষের মুখ দেখেছো, কোথায একটু চুমু টুমু খাবে তা না করে পালাতে চাইছো।”
“আপনাকে ভালোবাসার আগে আমার ম*রে যাওয়া উচিত!”
“অনুভূতি লুকানো যায় না মিসেস। নিজেকে লুকিয়ে রেখে অনুভূতি লুকানোর বৃথা চেষ্টা কোরো না!”
চমকে উঠে তুহা। এভাবে কথা বলছে কেনো শৈবাল? সে কি কিছু জানতে পেরেছে? তার কেনো বারবার এটা মনে হয় শৈবাল সব কিছু জানে! কেনো মনে হয় শৈবাল তাকে ফলো করে সব সময়? তুহা নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লে শৈবাল বাঁধা দেয় তাকে। আগলে নেয় বুকের মাঝে।
“তুমি আমাকে ভালোবেসে যাও মিসেস। আমি তোমার দায়িত্ব নিবো সারাজীবনের জন্য। শুধু ভালোবাসতে পারবো না।”
কথাটা বলতে যতোটুকু সময়। এরপর আর অপেক্ষা করে না। তুহাতে মত্ত হয়ে পড়ে। শৈবালের এক একটা স্পর্শে মেয়েটা নিরবে কাঁদে। দায়িত্ব নিবো কিন্তু ভালোবাসতে পারবো না কথাটা বলে আরো একবার তুহাকে খণ্ড বিখণ্ড করে দেয়। ছেলেটার বুকে আগলে নেওয়া দেখে ভেবেছিলো কোথাও যাবে না। কিন্তু দিন শেষে প্রতিবার শৈবাল তাকে ভুল প্রমানিত করে। নিজের কাছে হেরে যায় বার বার। নিজেকে আর সময় দিবে না সে। অনেক হয়েছে।
.
শৈবাল ঘুম থেকে উঠে সাড়ে সাতটার সময়। সাড়ে আটটায় বের হতে হবে তাকে। পাশে তাকিয়ে তুহাকে খুঁজে পায়না। সাধারণত মেয়েটা এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে না। আজ হঠাৎ কি হলো কে জানে। এসব ভেবেই ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নেয়। তার কল্পনায় বিচরণ করা রমণীর খোঁজ পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। মেয়েটা বড্ড ভাবায় তাঁকে। যতোবার মনে করে এই মেয়েকে নিয়ে ভাববে না ততোবার তাঁর কথাই মনে পড়ে।
শৈবাল দ্রুত শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে রেডি হয়। তখনো খুঁজে পায়না তুহাকে। বিরক্ত হয়ে গায়ে পারফিউম মাখতে মাখতে আবারো আসে পাশে খোঁজে। কিন্তু সেই রমণীর দেখা পাওয়া যে বড় কঠিন ব্যাপার। শৈবাল রেডি হয়ে মোবাইল নিতে গেলে দেখে মোবাইলের নিচে একটা খাম রাখা। মোবাইল হাতে নিতেই খামের উপরে গুটিগুটি অক্ষরে নিজের নাম দেখে শিওর হয় এটা তার জন্য। হাতে নিয়ে খামটা খুলতেই বের হয়ে আসে একটা চেক। শৈবাল অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে বিশ লক্ষ টাকার চেক টা। যেটা সে তুহাকে তাদের বিয়ের রাতে দিয়েছিলো। সাথে একটা চিরকূট। তাড়াহুড়ো করে সেটা মেলে ধরে চোখের সামনে,
“আজ আর আপনাকে সম্মোধন করতে ইচ্ছে করছে না। এই নিন আপনার বিশ লক্ষ টাকা৷ যে টাকা আমাকে কাবিন দেওয়াতে দিনের পর দিন খোঁচা শুনতে হয়েছে। আপনি নিজেই কাবিনের টাকাটা আমাকে দিয়েছিলেন। আজ সেই টাকা আপনাকে ফেরত দিয়ে বলতে চাই আমি আপনাকে মুক্ত করে দিয়েছি। আপনার খোঁচা থেকে নিজেকে মুক্ত করেছি। আপনাকে কষ্ট করে আমার দায়িত্ব নিতে হবে না। আমিই আপনার জীবন থেকে সরে যাচ্ছি। জানি কখনো খুঁজবেন না। তারপরো বলছি খোঁজার বৃথা চেষ্টা করবেন না। কারণ যে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু যে নিজে থেকে হারায় তাকে খুঁজে পাবেন না। সর্বোপরি ভালো থাকবেন। তুহা নামক বেড়াজাল থেকে আপনাকে মুক্ত করে দিলাম।”
–তুহা পাটোয়ারী
চলবে,,,,,,,,,,,