নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-১৫

0
150

#নীড়ের_খোঁজে
#সিজন_দুই
পর্বঃ ১৫
#জান্নাতুল_বিথী

তুহা পাথর বনে দাঁড়িয়ে আছে। শৈবালের কথার পিঠে কি বলা উচিত খুঁজে পায় না। যুতসই জবাব না পেয়ে মেয়েটা দিশেহারা হয়। শৈবালের চোখের একেকটা পানির কণা যেনো এক সমুদ্র কষ্টের সমান তার কাছে। তাঁর বারবার মনে হচ্ছে কেউ একজন শক্ত করে তাঁর মুখ চেপে ধরে রেখেছে, আর মৃদু স্বরে আদেশ করছে যেনো চুপ থাকে। শৈবাল তখনো তাঁর দিকে তাঁকিয়ে। তুহা আসেপাশে এলোমেলো দৃষ্টিতে তাঁকায়। শৈবাল তুহার মুখখানা তাঁর দিকে ফিরিয়ে আবারো বলল,

“আমার প্রশ্নের উত্তর দাও মিসেস। কেনো এরকম করেছো?”

“আমি চাইনি আমার সন্তানের উপর আপনার ছায়া পড়ুক!”

আহত হয় শৈবাল। কস্মিনকালেও ভাবেনি নিষ্ঠুররাণী একথাটা বলতে পারে। কি অপরাধ করেছে সে? সে এমন কোনো দোষ করেনি যাতে এমন মৃত্যুসম বাক্য তাকে শুনতে হবে। মনের মাঝে রাগ হানা দেয়। তুহার কোনো অধিকার নেই তাঁকে এধরণের কথা বলার। সে তুহার কাছে কাছে ছুটে এসেছে দেখে মেয়েটা তাকে চ্যাঁছড়া ভেবেছে নাকি? রেগে যাবেনা ভেবেও বেশ খানিকটা রাগ হয় শৈবালের। তুহার দিকে তেড়ে গিয়ে বলে,

“আমি কি অপরাধ করেছি সেটা বলো, কাউকে খু*ন করেছি? নাকি আমার চরিত্রে সমস্যা আছে? আমার ছায়া আমার সন্তানের উপর পড়বে না কেনো?”

“আপনি চলে যান এখান থেকে!”

“আমার প্রশ্নের উত্তর দাও মিসেস৷ আমি তোমাকে না নিয়ে কোথাও যাবো না।”

“আমি আপনার সাথে কেনো যাবো? হু আর ইয়্যু?”

শৈবাল ভেবে পায় না কি বলবে। তুহার এতোটা কঠোরতা সে মেনে নিতে পারে না। এদিকে তুহাও তাকে সুযোগ দিতে রাজি না। সব দিক ভেবে দিশেহারা হয় শৈবাল। এই নিষ্ঠুর রমণীকে ভালোবাসে বলেই তো বারবার ছুটে আসে। সে কি একটু বুঝতে পারে না? কেনো বার বার তাকে দূরে সরিয়ে দিতে চায়। শৈবাল নিজেকে শান্ত করে তুহার দিকে এগিয়ে যায়। তাকে শক্ত করে বুক পিঞ্জিরাতে আবদ্ধ করে নেয়।

হঠাৎ এতোটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরায় হকচকিয়ে যায় তুহা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আরো শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় শৈবাল। যেনো ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে তার মনের রাণীকে। শৈবাল আবারো কেঁদে ফেলে। ভেজা গলায় শুধালো,

“আমার সাথে এমন করো কেনো মিসেস। আমি মরে যাবো! তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকাও আমার পক্ষে সম্ভব না! আর কতো শাস্তি দিবে আমাকে?”

পুরুষ মানুষ নাকি কাঁদে না। অথচ দুই দুইবার এই সুপুরুষ কে কাঁদতে দেখে অবাক হয়ে তাকায় তুহা। চোখ পিটপিট করে তাকায় তাঁর দিকে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এই মানুষটা তাঁর জন্য কেঁদেছে। তুহা নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। নিজেও কেঁদে ফেলে। শৈবালকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই আওড়ায়,

“আপনি আবার এসেছেন আমার সাথে অভিনয় করতে? আমাকে দেখে আপনার পুতুল মনে হয়? যেভাবে খুশি সেভাবে নাচাবেন? যখন খুশি হলো নিজের কলিগদের সামনে অভিনয় করবেন। আবার খুশি হলে বলবেন আপনি আমাকে কখনো ভালোই বাসবেন না। আমি আপনার দায়িত্ব হয়ে থাকবো! কেনো শৈবাল শাহরিয়ার? দায়িত্ব তো আমার বাবারও ছিলো আমার প্রতি। কিন্তু সে ভালোবেসে তাঁর মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছিলো। দায়িত্ব তো একটা কুকুরের প্রতিও তাঁর মালিকের আছে। আপনি আমার প্রতি কোন দায়িত্ব টা পালন করবেন শুনি? এতো দিন আমি আপনার বউ ছিলাম সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। এখন কি আমার বাচ্চার দায়িত্ব নেয়ার জন্য এসেছেন?”

শৈবাল নির্বাক বনে তাকিয়ে আছে। চুপচাপ তুহার সকল অভিযোগ শুনে। নিজের অজান্তেই তুহাকে এতোটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে আগে কখনো ভাবেনি। কিছু করার আগে তাঁর মাথাতেই থাকেনা তাঁর এই কথা বা কাজে কেউ কষ্ট পাবে কি না। তাঁর মিসেস তাহলে এতো গুলো কষ্ট বুকে পুঁজি করেই তাঁকে ছেড়ে চলে এসেছে? একবারো কেনো এসব ভাবেনি শৈবাল? কেনো তাঁর মনে হয়নি তাঁর দ্বারা তাঁর মনের রাণী দুঃখ পেয়েছে? শৈবাল বিচলিত হয়ে তুহার কাছে যেতে চাইলে সে পিছিয়ে যায়। ফলস্বরূপ মেয়েটা টি টেবিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে সোফার উপরে পড়ে যায়। ভারী শরীর নিয়ে পড়ে গেলে যে কোনো সময় বিপদ ঘটতে পারে৷ শৈবাল কিছুটা জোরে চিৎকার দিয়ে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যায়।

এতোক্ষণ ধস্তাধস্তি করে, জোরে কথা বলে ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়েছে তুহা। শরীরে শক্তি নাই বললেই চলে। শৈবাল পানি এগিয়ে দেয় তুহার দিকে। তাকে না নিতে দেখে নিজেই এগিয়ে গিয়ে খাইয়ে দেয়। চুপটি করে আছে রমণী। ঝড় হওয়ার পর পরিবেশ যেমন শান্ত থাকে এখনকার পরিবেশও শৈবালের নিকট তেমনি লাগছে। সে তুহাকে আর ঘাটাতে যায় না। খাবার এনে তুহাকে খাইয়ি দেয়। নেতিয়ে যাওয়া শরীরটাকে কোনো মতে টেনে তুলে তুহা। শৈবাল তাড়াতাড়ি তাঁকে ধরে ফেলে। কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,

“কোন রুমে যাবা? আমাকে বলো আমি দিয়ে আসি। তোমার একা যেতে কষ্ট হবে!”

“এতোদিন একা চলে এসেছি। এখনো পারবো!”

তুহার কথাটাকে পাত্তা না নিয়ে তাঁকে কোলে তুলে নেয় শৈবাল। উপায়ান্তর না পেয়ে সে বলে উপরের তিন নাম্বার রুমে যাবে। তুহার ওজন বেশ বেড়েছে। গাল গুলো ফুলে গিয়েছে। সারা শরীর জুড়ে মাতৃত্বের চিহ্ন বসে গিয়েছে। এই তুহাকে দেখে যেনো আরো একবার প্রেমে পড়ে গিয়েছে শৈবাল। মেয়েটা আরো গুলুমুলু সুন্দরী হয়েছে।

তুহাকে বেডে শোয়ায় দেয় শৈবাল। মাথার নিচে বালিশ এগিয়ে দেয়। তুহার একপাশে কোলবালিশ দিয়ে সরে যায়। মেয়েটা এক মনে শৈবালের দিকে ছেয়ে আছে। ছেলেটাকে দোরের ওই পাশে দেখেই তাঁর রাগ বা অভিমান অর্ধেক পড়ে গিয়েছে। কান্নাকাটি দেখে মন গলে গিয়েছে বহু আগেই। কিন্তু ছেলেটাকে বুঝতে দেয় না। তাঁকে উঠে যেতে দেখে খুব করে বলতে ইচ্ছে করে আরো একটু সময় তাঁর পাশে বসার জন্য। ব্যস্ত শৈবাল কি তাঁর মনের কথা বুঝতে পেরেছে? হয়তো, তাই বলেইতো ছেলেটা উঠে গিয়েও আবারো তুহার পাশে বসে পড়ে। চুলে আলতো হাতে বিলি কেঁটে দিতে দিতে বলল,

“তুমি একটু ঘুমাও, আমি তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ভালো লাগবে। আমি আছি, কোথাও যাবোনা তোমাকে ছেড়ে!”

ইশশ কি সুন্দর করে কথা বলে তার ব্যক্তিগত পুরুষ। মনে মনে তৃপ্তির হাসি হাসে মেয়েটা। খুব করে চায় শৈবাল যেনো তাঁকে রেখে না যায়। তাঁর এই অসভ্য বলুক বা বেয়াদব যাই বলে। এই পুরুষ মানুষটার জন্য মন পুড়ে। তাঁকে ছেড়ে থাকতে পারেনা। এই যে সে তাঁর পাশে বসে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এতে যেনো পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ মনে হয় নিজেকে। তুহা মনে মনে আওড়ালো,

“আমার সুখ ধরে রাখবেন শৈবাল সাহেব। আপনাকে ছাড়া থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। আপনি আমার হয়ে থাকেন। আমাকে ভালোবাসেন। আপনিহীন আমিটাকে আমি খুঁজে পাইনা। সে সব সময় আপনাতে বিচরণ করে।”

শৈবাল তুহার কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। তুহা চুল কেটেছে মনে হয়। কপালের উপরে এক গাচি চুল এসে পড়েছে। শৈবাল সেগুলোকে কোমল হাতে সরিয়ে দেয়। তুহার পেটে চুমু এঁকে দেয়। কান পেতে তাঁর বেবির নড়াচড়া অনুভব করতে চায়। এ যেনো স্বর্গীয় সুখ। এতো সুখ তাঁর কপালে সইবে তো? তুহা তাঁকে ক্ষমা করতে পারবে? মেয়েটার অভিমানের পাহাড় কিভাবে ধ্বসিয়ে ফেলবে সেই চিন্তায় আছে শৈবাল। মেয়েটার আঙুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে ফিসফিস করে শুধালো,

“তোমাকে ভালোবাসি বলেই তুমুল অরাজকতার ভেতরও বৈশাখের মৌ মৌ ঘ্রাণ পাই।
তোমাকে ভালোবাসি বলেই অভিযোগ পাশ কাটিয়ে আর ক’টা দিন একসাথে বেশি বাঁচতে চাই।”

চলবে,,,,,,,,,,,