নীড়ের খোঁজে ২ পর্ব-১৯

0
32

#নীড়ের_খোঁজে [২]
পর্বঃ১৯
#জান্নাতুল_বিথী

হেমন্তকালের মেঘলা আকাশ। চারদিকে শীতের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে৷ গাছের পাতা গুলো খসে পড়তে শুরু করেছে। শীত যেনো প্রকৃতিকে শূন্য করে দেয়। চারদিকে মানুষে গিজগিজ করছে। এয়ারপোর্টে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে শৈবাল তুহা। আজ শৈবালের ফ্লাইট। তুহা চোখের পানি লুকাতে ব্যর্থ হয়। সময় গুলো কতো তাড়াতাড়ি কেঁটে যায়। শুধুমাত্র তুহাকে সময় দিবে বলে শৈবাল আগেরবার টিকিট ক্যান্সেল করে দেয়। একমাস থাকে রমণীর কাছে। কিন্তু এভাবে কতোদিন চলবে। নিজের কর্মক্ষেত্রেও তো তাকে ফিরতে হবে। ঐ দিকে আবার সমুদ্রের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। চারদিক সামলাতে গিয়ে দিশেহারা হয় ছেলেটা। তারপরো তুহাকে যথেষ্ট সময় দেয়ার চেষ্টা করেছে। শৈবাল তুহার দিকে তাকায়। মেয়েটার মনের অনুভূতি বুঝার চেষ্টা করে। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে রমণী হুট করে জড়িয়ে ধরে তাকে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। শৈবালের মনে হয় তাঁর বুকে কেউ ছু*রি দিয়ে আঘাত করেছে। মেয়েটার কান্না নিতে পারেনা। সান্ত্বনা দিতে দুই হাত তুরে নিজেও জড়িয়ে ধরে। ফিসফিস করে শুধায়,

“আমি খুব দ্রুত চলে আসবো। এভাবে কাঁদে না মিসেস। আমাদের যোগাযোগ তো হবেই। তোমার যখন ইচ্ছা তখন আমাকে ভিডিও কর দিতে পারো!”

তুহা নাক টেনে বলল,

“শুধু আমার আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হবে? আপনার আমাকে দেখতে ইচ্ছে করবেনা?”

মৃদু হাসে শৈবাল। তার মন যদি এই রমণী পড়তে পারতো তাহলে তো মনে হয় বুক পিঞ্জিরা তে বদ্ধ করে রাখতো তাকে। এই রমণীকে কিভাবে বুঝাবে কতোটা কষ্ট নিয়ে সে এই দেশ ছেড়ে যাচ্ছে? তুহা মাথা হালকা উঁচু করে শৈবালের দিকে তাকায়। পরপর তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অভিমানী চোখে নিজের ভারী পেটে তাকিয়ে বলল,

“দেখেছিস বাবা, তোর বাবা আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তুই তাকে যেতে দিতে চাস?”

তুহার পাগলামি দেখে শৈবালের এত্তোটা খারাপ লাগে। যেকোনো সময় কেঁদে ফেলতে পারে ছেলেটা৷ চোখের পানি আটকাতে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। তুহাকে বেশ কোমল গলায় বলল,

“কে কাকে ছেড়ে যায় সেটা আমার প্রিন্সেস ভালো করেই জানে। আপনাকে এতো ঘটা করে মিথ্যা বুঝাতে হবেনা।”

তুহা বিস্মিত চোখে শৈবালের দিকে তাকায়। এই ছেলে সারাজীবন তাকে খোঁটা দিবে নাকি? ইনোসেন্ট ফেস করে বলল,

“আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে আর কতোদিন খোঁটা দিবেন?”

“যতোদিন কথাটা আমার মনে পড়বে ঠিক ততোদিন।”

অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে তুহা৷ নিজের উপরে রাগ হয় খানিকটা। কেনো সব কিছু না জেনে বুঝে এতো দূরে চলে এসেছে। শৈবাল তুহাকে তাড়া দিয়ে বিদায় নেয়। যাওয়ার সময় কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। অদূরেই দাড়িয়ে থাকা দিশারা কে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে তুহার কাছে আসতে বলে। তুহা শৈবালের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ তাকে দেখা যায়!
.
সমুদ্রের পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে শৈবাল। ছেলেটার নিস্তেজ শরীর হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে। একটু আগেই শৈবালকে ফোন করা হয়েছে। সমুদ্র নাকি কোনো কারণে অনেক বেশি ডেস্পারেট হয়ে গিয়েছে। অতিরিক্ত পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। তাকে কেউ সামলাতে পারছে না। অগত্যই শৈবালকে আসতে হয়েছে। তারপর ইনজেকশন দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। ছেলেটার মায়া ভরা মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শৈবাল। স্টুডেন্ট লাইফে কতো মেয়ে যে সমুদ্রের জন্য পাগল ছিলো বলার বাহিরে। অথচ ছেলেটা এক নারীতে আসক্ত ছিলো। পাপিয়া ছাড়া কিছু বুঝতো না। সমুদ্র সব সময় শান্তিপ্রিয় ছেলে ছিলো। বন্ধুদের সাথে যেটুকু সময় কাটাতো বেশিরভাগ সময় পাপিয়াকে নিয়েই কথা বলতো। অথচ শেষ পর্যন্ত কি হলো?

এমন নয় যে সমুদ্র দেখতে খারাপ। তাদের বন্ধুদের মাঝে সবচাইতে সুদর্শন পুরুষ হলো সমুদ্র। আর এখন? দাড়ি বড় হয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে কালচে রঙ ধারণ করছে। ঠোঁটে কালো রঙের আবরণ পড়ে গিয়েছে। তাও এসব তার সৌন্দর্যে বিন্দুমাত্র ভাটা ফেলতে পারেনি। যেকোনো মানুষ দেখলেই তার মায়া লাগবে ছেলেটার জন্য। শৈবাল সমুদ্রের মাথায় হাত রেখে চুল গুলো এলোমেলো করে দেয়। জেগে থাকলে তো ছেলেটার থেকে দশ হাত দুরত্ব বজায় রেখে চলতে হয়।

শৈবাল শুধু মনে মনে ভাবে, সমুদ্রর জন্য কি এমন কোনো মেয়ের জন্ম হয়নি যে তাকে ভালোবেসে যত্ন করে কাছে টেনে নিবে? ছেলেটা কি কখনো সুস্থ হবে না? কেনো সে বারবার ব্যর্থ হয়? সমুদ্রের পরিবারকে এখনো অবধি কিছু জানানো হয়নি। কখন জানাবে?
শৈবাল সমুদ্র কে রেখে উঠে দাঁড়ায়, ডাক্তারের সাথে দু একটা বাক্য বিনিময় করে সেখান থেকে বের হয়ে যায়। প্রিয়কে কলেজ থেকে পিক করার জন্য বের হয়।

কলেজ প্রাঙ্গণে শৈবাল উপস্থিত হতেই স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রিয়কে দুইটা ছেলে আর দুইটা মেয়ে মিলে হেনস্তা করছে। মেয়েটার মাথা ফেটে র*ক্ত বের হয়। দুইজন মেয়ে দুইদিক থেকে তার দুই হাত ধরে রাখছে। একটা ছেলে এতোক্ষণ এলোপাতাড়ি প্রিয়কে দেয়ালের সাথে বারি মেরেছে। ফলস্বরূপ মেয়েটার মাথা ফেটে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ে। ঘটনার আগা মাথা না বুঝেই শৈবাল দৌড়ে যায় বোনের কাছে। মেয়ে দুই জন শৈবালকে এগিয়ে আসতে দেখে প্রিয়র দুই হাত ছেড়ে দেয়। মেয়েটা নেতিয়ে নিচে পড়ে যায়। শৈবাল আগে প্রিয়কে আকড়ে নেয়। ততক্ষণে চারজন সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছে। প্রিয় নিভু নিভু চোখে ভাইয়ের দিকে একবার তাকায়। আধো আধো স্বরে বলল,

“ভাইয়া, সমুদ্র ভাইয়ার এক্সিডেন্টের পেছনে রিয়াদের হাত আছে। আমি জেনে যাওয়াতে তারা আমার উপরে হামলা করে!”

আধো আধো স্বরে বলা প্রিয়র সম্পূর্ণ কথা শৈবালের কর্ণগোচর হয় না। সে প্রিয়কে উঠিয়ে কোনো মতে রুমাল দিয়ে মাথা বেঁধে দেয়। কলেজ অনেক আগে ছুটি হওয়াতে আসেপাশে তেমন কেউ নাই। শৈবাল বোনের কপালের র*ক্ত মুছে দিতে দিতে বলল,

“গভীর ভাবে আঘাত লাগছে প্রিয়? দেখি উঠে দাঁড়াতে পারবি?”

প্রিয় মাথা নেড়ে হ্যা বলে। পুনরায় মুখ নেড়ে কিছু বলতে গেলে শৈবাল বাঁধা দিলে বলল,

“এখন কিছু বলতে হবেনা। চল আগে বাসায় যাই!”

শৈবাল প্রিয় কে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ফোন বেজে উঠে। ফোন বের করলে নজরে আসে ‘মিসেস’ দিয়ে সেভ করা নাম্বার টা। শৈবাল এক হাতে প্রিয়কে ধরে অন্য হাতে ফোন রিসিভ করে কানে দেয়। ওইপাশ থেকে কোনো কথা ভেসে আসেনা। অভিমানী মেয়ের মুখটা সামনে ভাসে। গত দুইদিন অতিরিক্ত ব্যস্ত ছিলো কারণে খুব বেশি কথা হয়নি। ফোন করে কেবল কেমন আছে কি করছে এসব ব্যাপার জিজ্ঞেস করে ফোন কেঁটে দিয়েছিলো। একারণে অভিমানী কন্যার অভিমান সে বুঝে। ফোন কানে নিয়ে কোনো মতে বলল,

“মিসেস আমি একটু ব্যস্ত আছি। প্রিয় অসুস্থ। বাড়িতে গিয়ে তোমাকে ফোন করব!”

তুহাকে প্রতিত্তর করার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেঁটে দেয় শৈবাল। কারণ মেয়ে এখন হাহারটা প্রশ্ন করবে প্রিয়র কি হয়েছে জানতে ছেয়ে। তার চাইতে ভালো ধীরে সুস্থে বাড়িতে গিয়ে বলবে৷ শৈবাল প্রিয়কে নিয়ে গাড়িতে বসে। ড্রাইভ করতে করতে আড় চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে আওড়ালো,

“ছেলে গুলো কারা? তোর উপর অ্যাটাক করছে কেনো?”

মন খারাপ হয়ে যায় প্রিয়র। ভাইয়া সব কিছু জানলে তার স্বাধীনতার বারোটা বাজবে। পণ্ডিতি করে আগে আগে কাজ করতে গিয়েছে। এতো রিস্ক নিয়েছে জানলে নিশ্চিত ক*বর দিবে। তাই সে আমতা আমতা করে বলল,

“আসলে ভাইয়া সমুদ্র ভাইয়ার যে এক্সিডেন্ট হয়েছে সেটা পূর্ব পরিকল্পিত ছিলো। কেউ ইচ্ছে করে তার এক্সিডেন্ট করাইছে। একথাটা আমি জানার পরে রিয়াদ নামের ছেলেটা তার বন্ধুদের নিয়ে আমার উপর আক্রমণ করে!”

চলবে,,,,,,,,,,,