#নীড়ের_খোঁজে [২]
পর্বঃ২০
#জান্নাতুল_বিথী
সমুদ্রদের বাড়িতে এসেছে শৈবাল। ড্রয়িংরুমে বসে আছে সমুদ্রের ভাই ওয়াসিম সম্রাটের সাথে। নাতাশা মেয়েটা তাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসে। সম্রাট নাস্তা এগিয়ে দেয় শৈবালের দিকে। চোখ দিয়ে ইশারা করে বসতে বলে প্রিয়তমা স্ত্রীকে। নাতাশা পাশে বসতে বসতে নিরব শৈবালের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“ভাইয়া এতোদিন পর হঠাৎ? সমুদ্র ভাইয়ের খোঁজ পেয়েছেন কোনো?”
অপ্রস্তুত হয় ছেলেটা। মনে মনে কথা গুছিয়ে নেয়। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে ইতস্তত ভঙ্গিতে সম্রাটকে বলল,
“সমুদ্র আমার কাছেই ছিলো এতোদিন ভাইয়া। আমরা বান্দরবন যাওয়ার পরে সেখানে সমুদ্র সু*ই*সা*ই*ড এটেম্প নেয়। তার কিছু মাস পরে ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে!”
সম্রাট নাতাশা দুইজনে স্তব্ধ হয়ে কথা শুনে শৈবালের। ছোট ভাইয়ের মতো দেবরের এমন অবস্থা শুনে কেঁদে ফেলে নাতাশা। সম্রাট কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। ওর আদরের ভাই পা*গল হয়ে গিয়েছে কথাটা শুনে ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। শৈবাল নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদের রিয়েকশন জানা ছিলো ওর। বাকি আর কিছু বলার সাহস হয় না। সম্রাট নিজেই নিরবতা ভেঙে বলল,
“আমি যতোদূর জানি সমুদ্রের সাথে একটা মেয়ের সম্পর্ক ছিলো। তাঁর সাথে ব্রেক আপ হয়েছে এটাও শুনেছি। কিন্তু আমার ভাই এতোটা দুর্বল না যে একটা মেয়ের জন্য জীবন দিয়ে দিবে।”
শৈবাল জানে সমুদ্র ওর ভাইয়ের সাথে অনেক কিছু শেয়ার করে। কাজেই এটা যে ওকে বলবে একথা আগেই জানা ওর। তাই কিছুটা ভেবে বলল,
“ব্যাপারটা আমাকেও ভাবায় ভাইয়া। আমি তখনি খবর নিয়েছিলাম কিন্তু যুতসই কোনো জবাব পাইনি। তাছাড়া কিছুদিন আগে প্রিয়র ছোট খাটো একটা এক্সিডেন্ট হয়। সেদিন ও আমাকে জানায় সমুদ্রের ব্যাপারটা নাকি সু*ই*সা*ই*ড এটেম্প ছিলো না। কেউ ইচ্ছে করে এমন টা করেছে। তারপর আমি আরো ভালো করে যাচাই বাছাই করেছি।”
নাতাশা সম্রাট দুজনেই ভাবনায় পড়ে যায়। তাদের এমন কোনো শ*ত্রু নাই যারা ওর ভাইকে মে*রে ফেলতে চাইবে। ছেলেটা প্রশ্নবোধক চাহনিতে শৈবালের দিকে তাকায়। শৈবাল নির্লিপ্ত ভাবে আওড়াল,
“আপনি টেনশন করবেন না। ব্যাপারটা আমি দেখে নিবো। আমি ইতোমধ্যে অনেক কিছুই জেনেছি, শুধু ওদের মুখোশ টেনে খুলে ফেলার অপেক্ষা। আপনি কেবল ওর দায়িত্ব নেন। কিছুদিন পর আমার বউয়ের ডেলিভারি৷ আমাকে একটু জাপান যেতে হবে। ওখান থেকে ফিরে এসে বাকিটা দেখবো। ততোদিন ওকে একটু দেখে রাখবেন। চিকিৎসাধীন অবস্থাতে আছে এখনো!”
“আমি তোমাকে সবটুকু ভরসা করি শৈবাল, এতোদিন ওকে দেখে রেখেছো এখন নাহয় আমরা দায়িত্ব নিলাম। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুরে ফিরে আসো। বিয়ে করেছো কোনদিন জানা হলো না!”
“এইত বছর হয়ে এলো। হঠাৎ করে সব কিছু হলো আর সমুদ্রের এই অবস্থার কারণে অনুষ্ঠান করা হয়নি, তেমন কেউ উপস্থিত ছিলোনা বিয়েতে।”
শৈবাল আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে সম্রাট নাতাশার সাথে। সমুদ্রের বাবা আর মা এখনো বিদেশের মাটিতে পড়ে আছে। শৈবাল খুব করে না করেছে যেনো তাদেরকে কিছু জানানো না হয়। অনেক বেশি চিন্তা করবে। এছাড়া সমুদ্রের সকল ঔষধ সহ যাবতীয় সব কিছু গুছিয়ে দিয়েছে শৈবাল।
.
রাত তখন এগারোটা বাজে। শৈবাল ওদেরকে সব বুঝিয়ে বের হতে হতে এতক্ষণ হোলো। নির্জন রাস্তায় গাড়ি চালায়। চারদিকে জনমানবশূন্য। কারো দেখা পাওয়া ভার। হঠাৎ হঠাৎ দু একটা গাড়িকে শা শা করে চলে যেতে দেখা যায়। আকস্মিক তুহাকে প্রচণ্ড মনে পড়ায় এক হাতে ড্রাইভিং করে অন্য হাতে ভিডিয়ো কল দেয় বউকে। স্কিনে ভেসে উঠে তুহার অভিমানী মুখখানা। মৃদু হাসে শৈবাল। নিজেই প্রথমে কথা শুরু করে,
“কেমন আছো বউপাখি?”
“যেমন রেখে গিয়েছিলেন!”
“রেগে আছো?”
“রাগ করার জন্য মানুষটা নিজের হওয়া চাই!”
“এভাবে বলেনা মিসেস, বুকে লাগে!”
“ফোন করেছেন কেনো? আপনার বউ বাচ্চা চাই বুঝি? নিজের পেশাকে বিয়ে করে নেন!”
হাসে শৈবাল। এখন তুহা তার সামনে বসে থাকলে টপাটপ দুই তিনটা চুমু খেয়ে ফেলতো। কিন্তু হায়! রমণী যে হাজার মাইল দূরে অভিমান করে বসে আছে। ঈষৎ ইনোসেন্ট ফেস করে বলল,
“অনেক ভেজালে ছিলাম মিসেস। আজকে নিজেকে একটু মুক্ত লাগছে। সমুদ্র কে তার পরিবারের কাছে দিয়ে এসেছি। এখন তোমার কাছে এসেও শান্তি পাবো! তারপর তুমি আমি আর সে!”
কথাটা বলতে বলতে ডান চোখ টিপে দেয় শৈবাল। লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে তুহার মুখ। শৈবাল এক মনে তাকিয়ে আছে। কি আদুরে লাগছে মেয়েটাকে। ইশশ! ও এতো দূরে কেনো? তুহা নিজের অভিমানী গলা ছেড়ে এবার স্বাভাবিক ভাবে কথা বলা শুরু করে। নিজের চঞ্চল সত্তায় ফিরে আসে। নিত্য দিনকার কথা জানায়। হুটহাট বেবির নড়াচড়া অনুভব করার অনুভূতি শেয়ার করে। মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কেমন লাগে সবটা বলতে থাকে। প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি। এ যেনো স্বর্গীয় স্বাদ! শৈবাল হঠাৎ অন্যরকম ডেকে উঠে,
“শুনো মিসেস!”
কথার মাঝে বাঁধা পেয়ে থেমে যায় তুহা। শৈবালের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। ছেলেটা হঠাৎ কেমন করে জানি বলে উঠে,
“ভালোবাসি মিসেস। আমার এক জনম যেনো আমার বউ পাখি আর আমার প্রিন্সেসকে দেখে কেঁটে যায়। তুমিহীন একটা দিনও কাটাতে চাইনা আমি। এ যেনো মরণ ব্যথা। তোমাকে নিয়ে আমার বাকি পথ চলা। তোমার সব পরিস্থিতিতে আমাকে পাশে পাবে।”
তারপর কৌতুক করে গেয়ে উঠলো,
“ওহে কি করিলে বলো পাইবো তোমারে!”
অজানা অনুভূতিতে দোল খায় তুহা। বছর হতে চললো তাদের বিয়ের। অথচ ছেলেটা আজকেই প্রথম এই শব্দটা বলেছে। তুহা তৃপ্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি বাবুর আব্বু। আমরা দু’জন আপনার পথ চেয়ে বসে আছি। জলদি চলে আসেন!”
“আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবেনা জান। আমাকে পেয়ে যাবা। এখন রাখি কেমন?”
কথা শেষ করে মোবাইল রাখে শৈবাল। অনেকক্ষণ যাবত লক্ষ্য করে তাঁকে একটা বড় ট্রাক ফলো করে। সমুদ্রের ব্যাপারে অনেক অজানা তথ্য সে পেয়েছে। এগুলো ধামাচাপা দিতে আসেনি তো ওরা? এমন প্রশ্ন মনে উদয় হতেই গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয় শৈবাল। ওর ধারণা ঠিক করে ট্রাকটাও সমান তালে তাঁর দিকে ধেয়ে আসে। মিনিটের মাঝে বিকট শব্দ হয়। শৈবালের সমস্ত শরীর ঝাকি দিয়ে উঠে। নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। নিভু নিভু চোখটা কিঞ্চিৎ খুলতে চায়, কিন্তু সেই শক্তি হয়ে ওঠে না। বাম হাত নড়ে উঠে ছেলেটার। ফিসফিস করে শুধালো,
“তোমাকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি মিসেস। মাফ করে দিও!”
.
শীতের আবছা অন্ধকারে তুহা জানালার পানে একমনে তাকিয়ে থাকে। আজকে তার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। একবার ভেবেছিলো শৈবালকে কিছু না জানিয়ে দেশে চলে যাবে ও। কিন্তু কেনো জানি সাহস হয়ে উঠেনি। ডেলিভারির আর মাত্র এক সপ্তাহ আছে। এখন এইরকম রিস্ক নিতে সে রাজি না। এদিকে শৈবালের কোনো খোঁজ নাই। আফসানা বেগম আর প্রিয় এসেছে এখানে। কিন্তু যার আসার কথা তার কোনো খোঁজ নেই। শৈবালের বাবা বিভিন্ন কাজে বেশ কয়েকবার জাপানে আসা হয়। তাঁর ব্যবসাও আছে এখানে। সেখানকার বাসাতে আছে তুহা প্রিয়রা। তুহাকে ভেতরে ভেতরে ভয় আঁকড়ে ধরেছে। এদিকে আবার ছেলেটার খোঁজ নেই। তাঁর ডেলিভারির সময় যদি ছেলেটা পাশে না থাকে তাহলে সে এটা কখনো মেনে নিতে পারবে না। সেদিন শৈবাল বলেছিলো জলদি চলে আসবে৷ তাঁর জলদি আসা কোনদিন হবে কে জানে। অপেক্ষারত রমণী বন্ধ ফোনে আবারো কল লাগায়। যদি কল রিসিভ করে সেই আশায়। কিন্তু সে আশা গুড়ে বালি। সব সময়ের মতো এবারও ওপাশ থেকে ইংরেজিতে ভেসে আসে,
“আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা যাচ্ছে না, দয়া করে আবার চেষ্টা করেন!”
চলবে,,,,,,,,,