#নীড়ের_খোঁজে [২]
পর্বঃ২১ শেষ
#জান্নাতুল_বিথী
কাক ডাকা ভোরে জেগে উঠেছে তুহা। চারদিকে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে কেবল। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। নিষ্ঠুর পুরুষের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েটা সবে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। এখনো ঘুম ঘুম ভাব কাটেনি, তার আগেই মাথা ঘুরে উঠে। পেটে প্রচন্ড পরিমানে পেইন হয়। আকস্মিক এমন হওয়াতে বেশ ঘাবড়ে যায় রমণী। কোনো মতে বেডে বসে দুর্বল স্বরে প্রিয়কে ডাক দেয়। মেয়েটা তার সাথে ঘুমায় কখন কি বিপদ হয় ভেবে। দুই তিন বার ডাক দিতেই প্রিয় উঠে বসে। ততক্ষণে তুহা নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিয়েছে। চোখে পানির কণা জমতে শুরু করেছে। আফসোস হচ্ছে এই মুহূর্তটাতে তার সবচাইতে প্রিয় মানুষটা পাশে নেই।
তুহার অবস্থা দেখে বেশ ভয় পায় প্রিয়। তড়িঘড়ি করে ফোন করে বসে আফসানা বেগমকে। আফসানা বেগম আর শৈবালের বাবা দুজনে মিলে তুহাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। গাড়িতে ওঠার সময় রমণী কেবল একটা কথা বারংবার বলে,
“মামনি তোমার ছেলে আমার কাছে আসেনি। আমি তাকে শেষ দেখাও দেখবো না? আমার ভাগ্য এতো খারাপ কেনো? আমি শৈবাল শাহরিয়ারের কাছে যেতে চাই, এনে দাও না তোমার ছেলেকে। ও মামনি দাওনা!”
আফসানা বেগম নিরবে কেঁদে ফেলে। ছেলের চিন্তায় তিনি নিজেও অস্থির। এদিকে আবার মেয়েটার এই অবস্থা। আফসানা বেগম তুহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শুধোয়,
“চিন্তা করিস না মা। তোর কিছু হবেনা। শৈবাল খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে!”
কিন্তু এতোসব কথা তুহার মাঝে কোনো প্রভাব ফেলে না। মেয়েটা এক নাগাড়ে বলে যায়,
“কোথায় আপনি শৈবাল, কেনো আসেন না। আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আপনি বলেছিলেন না আপনার প্রিন্সেসকে সবার প্রথমে আপনি কোলে নিবেন? আসেন না কেনো? ইউ মিসড ইয়্যু শৈবাল!”
সারা রাম্তা জুড়ে তুহা বিলাপ করে গিয়েছে। প্রিয়, আফসানা বেগম দুজনেই ওর সাথে সমান তালে কেঁদেছে। শৈবালের বাবা একটু পর পর ওদেরকে ধমক দিয়ে থামায়। সাথে তুহাকে দু একটা উপদেশ দেয়।
.
তুহাকে যখন ওটিতে ঢুকানো হয় তার ঠিক দুই মিনিট আগে শৈবাল ছুটে আসে। এই শীতের মাঝেও ছেলেটার কপালে ঘামের কণাগুলো মুক্তোর মতো চকচক করে। ওর কপালে, হাতে ব্যান্ডেজ উঁকি দেয়। রমণী ব্যাকুল হয়ে দেখে শৈবালকে। ছেলেটা ফ্লোরে বসে পড়ে। তুহার এক হাত আঁকড়ে ধরে কপালে, গালে ঠোঁটে এলোপাতাড়ি চুমু খেতে থাকে। ঠোঁট এলিয়ে কেঁদে ফেলে রমণী। শৈবালের কপালে ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
“আমি ভেবেছিলাম আপনাকে হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। আল্লাহর কাছে একটা দোয়াই করেছি। আমি যেনো আমার হাজবেন্ডকে শেষ বারের জন্য হলেও দেখি। আমাকে মাফ করে দিবেন আপনি। আপনার সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি।”
শৈবাল নিজেকে শক্ত রাখে। ভেতরে ভেতরে সে অর্ধেক গুড়িয়ে গিয়েছে। ডেলিভারি ডেইটের দুইদিন আগেই তুহার পেইন উঠেছে। ভয় পেয়ে যায় শৈবাল। তুহাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
“তুমি আমাকে এভাবে একা করে চলে যেতে পারোনা মিসেস। এ হয় না। তুমি ভয় পেয়ো না। আমার মিসেসের কিছু হবেনা! তোমার শৈবাল শাহরিয়ার সব সময় তোমার পাশে আছে বলেছি না। আমার ভালোবাসা এভাবে হেরে যাবে না!”
শৈবালকে কথা শেষ করতে দেয় না। ওদিকে ডাক্তাররা তাড়া দেয়। শৈবাল তুহাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। একজন নার্স এগিয়ে এসে ওকে ভেতরে নিয়ে যায়। ওটির দোর বন্ধ হবার আগে রমণীর সিক্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
“শৈবাল আপনার মিসেস আপনাকে অনেক ভালোবাসে।”
ধফ করে নিচে বসে পড়ে শৈবাল। চোখ দিয়ে টপাটপ জল গড়ায়। বিরবির করে শুধোয়,
“বেবির বাবাও তোমাকে অনেক ভালোবাসে মিসেস। এতোটা ভালোবাসে যে তোমার বিকল্প খুঁজে পায়না। তোমাকে ততোটা ভালোবাসে যতোটা বাসলে অন্য কাউকে ভালোবাসার ইচ্ছে ম*রে যায়। লাভ ইয়্যু মিসেস!”
শৈবালের বাবা ছেলের দিকে এগিয়ে আসে। ওর মাথায় সান্ত্বনার হাত রাখে। এতে যেনো ছেলেটা আরো আহ্লাদী হয়ে উঠে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। ওর বাবা ছেলের পিঠ চাপড়ে বলল,
“কেঁদে লাভ নাই বাপ। আল্লাহর কাছে দোয়া করো যেনো সব ঠিকঠাক হয়। তুমি আ*ঘা*ত পেয়েছো কিভাবে?”
আ*ঘা*তের কথা শুনে চারদিন আগের ঘটনা মনে পড়ে যায় শৈবালের। কি নৃ*শংস ওরা। চোখ বুঁজে জোরে নিশ্বাস ফেলে শৈবাল। বাবাকে কোনো জবাব না দিয়ে নিজে উঠে দাঁড়ায়। ওজু করে আবার ফিরে আসে। প্রিয়কে বলল,
“আমি সামনেই আছি।ফোন করবি!”
প্রিয় মাথা নেড়ে সায় জানায়। একটা ভালো জায়গা খুঁজে সেখানে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। সব কিছু যেনো সঠিক ভাবে হয় এই আশাতে।
.
চারদিন আগের ঘটনা,
শৈবাল যখন শিওর হয় ট্রাকটা ওকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসে তখন লাস্ট মুহূর্তে গাড়ি থেকে লাফ দেয়। কংক্রিটের বুকে আঁচড়ে পড়ে। মাথায় অনেক বড় আ*ঘা*ত লাগে। নিজের গাড়ি ব্লা স্ট হতে দেখে গড়িয়ে রাস্তা ছেড়ে পাশের ঝোপঝাড়ে চলে যায়। কিন্তু মাথায় আ*ঘা*ত লাগার কারণে অতিরিক্ত র*ক্ত ক্ষরণ হয়। যার ফলে জ্ঞান হারায় শৈবাল। তাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যায় জিহাদ। শৈবাল তখন তুহার ফোন কেটে আগে জিহাদকে ছোট্ট একটা মেসেজ করে নিজের লোকেশন শেয়ার করে দেয়। ওইদিকে গাড়ি ব্লা স্ট হওয়াতে ওরা ভেবে নেয় গাড়িতে পু*ড়ে ম*রে গিয়েছে শৈবাল।
শৈবালের জ্ঞান ফিরে ঘন্টা দুয়েক পরে। জিহাদ তার মাথার পাশে বসে ছিলো। তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“সমুদ্র ঠিকাছে?”
“হ্যাঁ, সম্রাট ভাইকে দেখে বেশি পাগলামি করছে। ভাই নিজেও ভ*য় পেয়েছে। একারণে আমি যাওয়াতে অল্প কথার মাঝে ওকে দিয়ে দিয়েছে।”
চোখ মুখ লাল হয়ে আসে শৈবালের। নিজের ক্রোধ সামলাতে পারেনা। সম্রাটকে দুই তিনটা গা*লি দিয়ে বলল,
“ওই মাদার*বোর্ড নিজের ভাইয়ের হাত কেঁটে সেটাকে সু*ই*সা*ই*ড এটেম্প বলে চালিয়ে দিয়েছে। শেষমেশ আমার উপর অ্যাটাক করেছে। কু*ত্তার বাচ্চারে এমনি এমনি ছেড়ে দিবো না আমি!”
জিহাদ কিছু বলতে পারেনা। সেদিন বান্দরবানে সম্রাট গিয়েছিলো। সমুদ্রের ডিপ্রেশনকে কাজে লাগিয়ে ওকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করে। সমুদ্র আপন ভাইয়ের বে*ঈমানি নিতে পারেনা। আপন মানুষ গুলোর দুইরকম বেঈমানি নিতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। শৈবাল সম্রাটের কাছে সমুদ্রকে দিয়ে এসেছে শিওর হওয়ার জন্য। এবং কি নিজের উপরেও রিস্ক নিয়েছে। এর বিনিময়ে নিজের জীবনও চলে যেতে পারতো। সব কিছুর বিনিময়ে এখন আসল সত্য সামনে এসেছে।
সম্রাট সমুদ্র আর শৈবালের উপর অ্যাটাক করার অভিযোগে ১৪ বছরের জে*ল হয়। সাথে তাকে রাব্বি ছেলেটা ওকে সাহায্য করাতে ওর দুই বছরের জে*ল হয়। সব কিছু করেছে পারিবারিক সম্পত্তি একা ভোগ করার জন্য। শৈবাল আর জিহাদ দুজনে সমুদ্রের মা বাবাকে সব কিছু সম্পর্কে অবগত করে। দু’জনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। অতি শীগ্রই ওরা দেশে আসবে। বড় ছেলের উপরে ভরসা করে ছোট ছেলেকে রেখেছিলো, অথচ বড় ছেলে নিজেই বে*ঈমানী করেছে। স্বামীর কৃতকর্মের কথা শুনে নাতাশা নিজেও ভেঙে পড়ে। দুজনে একসাথে সংসার করেছে এতো বছর অথচ নিজের স্বামীর মনের খবর কিছু টের পায়নি। সব কিছুতে মেয়েটা অনেক বেশিই ভেঙে পড়ে।
শৈবাল এদিকের কাজ শেষ করতে ওর দুইদিন সময় লেগে যায়। দৌড়াদৌড়ির কারণে নতুন করে মোবাইল কেনা হয়নি। তুহার সাথে কথা বলাও হয়নি। মেয়েটা তার কণ্ঠস্বর শুনলেই বুঝে যেতো সে অসুস্থ। তাই ওর থেকে দূরে ছিলো। সব শেষে যখন জাপান যায় তখনি শুনে তুহাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তড়িঘড়ি করে শৈবাল হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলো।
পরিশিষ্টঃ
শৈবাল হাসপাতাল থেকে এসেছে মাত্রই৷ নিজ কামরায় ঢুকে দেখে তার মিসেস এক হাতের উপর ভর দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আরেক হাতে ওদের রাজকন্যা ইরতিজা আহলাম তুনায়াকে আগলে রেখেছে। তুনায়া ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত দুইটা মুখে নিয়ে নিজে নিজে হাসে। ওদের দুজনকে একসাথে দেখে তৃপ্তির হাসি হাসে শৈবাল। নিজেকে পরিপূর্ণ পুরুষ মনে হয় আজ। ছেলেটা নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে তুনায়াকে কোলে তুলে নেয়। মেয়েটা পাপাকে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে। পা-পা পা-পা করে ডেকে উঠে। শৈবাল হাসে। তুনায়া হাসলে ওর ইস্টুস গালে কি সুন্দর টোল পড়ে। তুহা তো সব সময় গাল ফুলিয়ে বলবে,
“মেয়েকে দশমাস পেটে রেখে জন্ম দিয়েছি আমি, আর ও দেখতে হয়েছে আপনার মতো। জন্ম থেকেই পাপা ভক্ত, বড় হলে তো মনে হয় বাপ মেয়ে মিলে আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন!”
তুহার কথা শুনে তুনায়া কি বুঝে কে জানে। কিন্তু মায়ের কথা শেষ হতেই পা-পা বলে চিৎকার দিবে। যেনো বাবার কাছে মায়ের নামে বিচার দিচ্ছে। তা দেখে পুনরায় আবার গাল ফুলায় তুহা।
বাবা মেয়ের হাসি ঠাট্টাতে ঘুম ভাঙে তুহার। ঘুম ঘুম চোখে একবার শৈবালের দিকে তাকায়। ছেলেটা তখন ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ওকে তাকাতে দেখে ডেকে উঠে,
“চলে আসো মিসেস। আমাদের সাথে অংশ নিবে!”
অলস ভঙ্গিতে উঠে বসে তুহা। হাই তুলতে তুলতে কোনো মতে আওড়ালো,
“আপনাদের বাবা মেয়ের মাঝে আমি কাবাবের হাড্ডি হতে চাইনা। তুনায়াকে আমার কাছে দিয়ে আপনি ফ্রেশ হয়ে নেন!”
শৈবাল উঠে এসে তুনায়াকে মায়ের কোলে দিতে গেলে চিৎকার করে কেঁদে উঠে মেয়েটা৷ তুহা মুখ ভোঁতা করে তাকায় শৈবালের দিকে। মেয়েকে শাসিয়ে উত্তর দিতে ভুলেনি,
“বাবা না থাকলে আমার কাছে আসলে মা*ইর একটাও মাটিতে পড়বেনা। শা*লা বেঈ*মান!”
তুহার কথায় চোখ পাকিয়ে তাকায় শৈবাল। ধমক দিয়ে বলে উঠে,
“ছিহ! মিসেস, এভাবে বলে কেউ? তুমি না দিনকে দিন বাচ্চা পোলাপান হয়ে যাচ্ছো!”
“তো কি করবো? আমার জামাই অথচ আমাকে একটুও আদর করতে দেয় না। আবার বাবার সামনে মাকে চিনেনা….”
তুহা কথা শেষ করতে পারেনা, তার আগেই দরজায় নক পড়ে। প্রিয় এসেছে তুনায়াকে নিয়ে যেতে। প্রিয়র কোলে শৈবাল মেয়েকে তুলে দিতেই আবারো কেঁদে উঠে। প্রিয় আর সেখানে দাঁড়ায় না। যেতে যেতে বলল,
“ভাই এই কোন নেওটা বানিয়েছো তোমার? তোমাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা ধুর!”
শৈবাল সেদিকে আর কথা না বাড়িয়ে দোর লক করে দেয়। তুহা তখনো মুখ ভার করে বসে ছিলো৷ শৈবাল এগিয়ে এসে বসে রমণীর পাশে। এক হাতে কাছে টেনে নেয়। গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল,
“বাবা মেয়েকে হিংসে করো মিসেস? ছিঃ তোমার তো জে*ল হয়া উচিত।”
অভিমানে শৈবালকে দূরে সরিয়ে দেয় তুহা। বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“কাছে আসেন কেনো? জে*লে দিয়ে আসেন!”
মৃদু হাসে শৈবাল। মেয়েটা কারণে অকারণে অভিমান করতে শিখেছে। মা মেয়ে দুজনেই এক রকম। শৈবাল তুহাকে কাছে টেনে নেয়। গলায় মুখ লুকিয়ে চুমু খায়। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘনিষ্ঠ হয়। জোরে নিশ্বাস ফেলে তুহা। শৈবাল রমণীর ঠোঁট ছুয়ে বলল,
“আমি তোমার গোলামী রঙা ঠোঁটে বারবার হারিয়ে যাই মিসেস। তোমাকে দেখে নষ্টালজিক হয়ে যাই। তোমার ছোট বড়, কারণে অকারণে করা অভিমান গুলোকে ভালোবাসি। সর্বপরি পুরো তুমিটাকেই ভালোবাসি। আমার মিসেস! আমাকে বাবার হওয়ার মতো সুখ দিয়েছো। আমি তোমাতে হারিয়ে যাই মিসেস!”
শৈবালের এতো কথার ভীড়ে তুহা মুখ লুকায় সুপুরুষ মানুষটার বুকে। মৃদু স্বরে শুধোয়,
“ভালোবাসি! আমাকে একটা শান্তির নীড় খুঁজে দেয়া মানুষটাকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি!”
সমাপ্ত