নীড় ভাঙ্গা ঝড় পর্ব-০২

0
3771

#বড় গল্প
#নীড় ভাঙ্গা ঝড়
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

আয়েশা খাতুন ছেলেকে ফেরাতে পারলেন না। ছেলে সাব্বির তার কথার বাইরে গিয়ে দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে শিলাকেই নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিলো। মনে মনে যদিও ছেলের উপর ফুঁসে ছিলেন কিন্তু রাগ ঝাড়লেন নিজে পছন্দ করে আনা ছেলের বৌ এর উপর। রেগে গিয়ে তমাকে বলেন,
—-যে নারী স্বামীকে নিজের আঁচলে বাঁধতে পারে না তার কপালেই এমন দূর্গতি হয়। ঘরের বউ তো হতে পারলে না তাই দাসী হয়েই থাকতে হবে এখন।
—-,আপনি জানতেন না আপনার ছেলে যে শিলাকে ভালোবাসে?
—জানলে কি আর তোমাকে বৌ করে আনি? এখন কিচেনে গিয়ে রান্নাগুলো সেরে ফেলো।
তবে ওর ধারণা শাশুড়ী ঠিকই সবটা জানতো। জেদের বশবর্তী হয়ে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে শুধু শুধু তমার জীবনটা নষ্ট করলেন। তমা আর কথা বাড়ালো না।যদি এই আশ্রয়টুকু হারিয়ে যায় সে কারনে সব কিছু মুখ বুঁজে সয়ে নেয়। তমা দুপুরের রান্নাগুলো শেষ করে ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করে আসে। এরপর একটা সুতি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নেয়। সাব্বির গতরাত এগারোটায় বের হয়ে গেছে এখন বেলা দুটো বাজে, কিন্তু তার বাড়িতে ফেরার নামগন্ধ নেই। কলিং বেলটা যেন আজ আর্তনাদ করে বেজে উঠে। তমা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে সাব্বির আর পাশে একটা মেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বুঝতে অসুবিধা হলো না। এ হচ্ছে শিলা। দরজা থেকে তমা সরে দাঁড়ায়। সাব্বির শিলাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে। এমন সময় তমার শাশুড়ী আয়েশা বেগম চিৎকার করে বললেন,
—তমা,কে আসলো?
ও কিছু বলার আগেই সাব্বির বলে,
—-আমি এসেছি মা। দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।
আয়েশা খাতুন নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। শিলা সাথে সাথে উনাকে সালাম করে। উনিও শিলাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তমা দূর থেকে উনাদের নাটকগুলো দেখতে থাকে। আয়েশা খাতুন তমাকে ডেকে টেবিলে ভাত বেড়ে দিতে বলেন। যদিও তমার সাথে সাব্বির এর কোনো দাম্পত্য সম্পর্ক নেই তারপরও শিলাকে দেখে তমার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। এতোদিন এ বাড়িতে মুখবুজে সব কাজ করেছে এই ভেবে যে এখানে ওর একটা পরিচয় আছে। কিন্তু আজ ওর চোখের সামনে থেকে পুরো পর্দা সরে যায়। ও বুঝতে পারে এ বাড়িতে ওর স্থান কোথায়। চোখ দিয়ে অনবরতো পানি ঝরছে। চোখের পানি মুছে তমা টেবিলে ভাত বেড়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শিলা সাব্বির আর আয়েশা বেগম ভাত খেতে বসেছে। শিলা ভাতের লোকমা মুখে তুলে বলে,
—-মা মাছের দোপেয়াজাটা কি আপনি করেছেন?
—-না,আমার এখন আর রান্নার এনার্জি নাই। এখানে যা কিছু দেখছো সব তমাই রান্না করেছে। ওর রান্নার হাত বেশ ভালো।
একথা শুনে শিলা সাব্বির এর দিকে তাকিয়ে বলে,
—ওতো ভালোই রাঁধে। তাই বলছিলাম,
—-কি বলবে বলো, এতো ধানাই পানাই করছো কেন?
—-,তুমি বলছিলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিবে।
—-তোমার সাথে সেরকম কথাই হয়েছিলো। নাকি সতীনের সংসার করবে বলে ঠিক করেছো?
—-কি যাতা বলছো? মানে আমি তো এখন সংসারের কাজকর্ম তেমন করতে পারবো না। তাই বেবি হওয়ার আগ পর্যন্ত ও থাকুক এ বাড়িতে। এরকম একজন ফুলটাইম কাজের লোক পেতে হলে অনেক টাকা গুনতে হবে। তার থেকে বিনা বেতনে ঐ আমাদের শ্রম দিয়ে যাবে।
আয়েশা খাতুন কুটনী হাসি হেসে বলে,
—-তোমার মাথায় বুদ্ধি দেখি ভালোই আছে।
শিলাও গর্বিত হাসি হেসে মনে মনে বলে,বুদ্ধি আছে বলেই আপনার সাথে টক্কর দিয়ে যাচ্ছি। খাওয়া শেষ করে আয়েশা খাতুন তমাকে ডেকে বলে,
—-টেবিল গুছিয়ে তুমি ভাত খেয়ে নাও। আর আজ থেকে তুমি কিচেনের পাশে স্টোর রুমটাতে তোমার থাকার জায়গা করে নাও। ও ঘরে এখন থেকে সাব্বির আর শিলা থাকবে। তুমি যখন তোমার রুপ যৌবন দিয়ে আমার ছেলেকে আটকাতে পারলে না তখন সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়াটা বুদ্ধি মানের কাজ।
শাশুড়ীর কথাশুনে তমা মনে মনে বলে,
“কপালে বুঝি তার এই লেখা ছিলো।” ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের সব কথাই শুনতে পায়। আজ ওর গলা দিয়ে কোনো খাবার নামে না। সব গুছিয়ে রেখে রান্না ঘরে মাদূর পেতে শুয়ে পড়ে। ও কিচেন থেকেই শিলার হাসির শব্দ পায়। নিশ্চয় সাব্বির কোনো হাসির কথা বলেছে। তমা শোয়া থেকে উঠে বসে। এরপর শাশুড়ীর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে উনি ঘুমোচ্ছেন। তমা সদর দরজা খুলে ও বাড়ি থেকে চিরদিনের তরে বের হয়ে আসে। কিন্তু হাতে কোনো টাকা পয়সা নিয়ে বের হতে পারেনি। এদিকে পৌষের বেলা। উত্তরের হিমেল হাওয়ায় তমার গায়ে কাঁটা দিতে লাগলো। বিকেলের শেষ আলোটাও নিভে যেতে বসেছে। তমা শুন্য দৃষ্টি মেলে চারিদিকে তাকাচ্ছে। এখান থেকে ওর বাড়ি যেতে প্রায় ঘন্টাখানিকের পথ। সন্ধার অন্ধকার তখন নামতে শুরু করেছে। তমার খুব ভয় হতে থাকে। ওকে এভাবে আলুথালু বেশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক অটোচালক এসে বলে,
—-আপু কোথায় যাবেন?
—পলাশবাড়ি,
—-সে তো ম্যালাদূর
তমা একটু সাহস করে বলে,
—-যাবেন কিনা সেটা বলেন।
—-ঠিক আছে উঠে পড়ুন।
অটোওয়ালা কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ী মেইন রাস্তা থেকে একটা গলির মতো চিকন রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে নেয়। তমার কেমন যেন সন্দেহ লাগে। ও অটো ড্রাইভারকে বলে,
—আপনি মহাসড়ক দিয়েই যেতে পারতেন।
—তা পারতাম। কিন্তু অনেক সময় লাগতো। এমনিতে শীতের রাত। এদিক দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি যেতে পারবেন।
কিন্তু তমার ভয় লাগতে শুরু করে। কেননা অটোটা যতই ভিতরের দিকে যাচ্ছে ততই চারিদিকে ও শুধু জঙ্গল দেখতে পাচ্ছে। ও আবার অটোড্রাইভারকে বলে,
—-আপনি ঠিক রাস্তায় এসেছেন তো?
—-হ্যা আপু একদম সঠিক রাস্তায় এসেছি।
আরো কিছুদূর এগিয়ে গভীর বাশঝাঁড়ের জায়গায় এসে অটোটা থামলো। তমা রেগে গিয়ে বললো,
—-আপনি আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছেন?
—+,মাগী তুই আগে গাড়ি থেকে নাম
একথা বলে অটোচালক তমার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলো। এতে তমার হাতের কাঁচের চুড়িগুলো ভেঙ্গে ঐ শয়তানটার হাতে বিঁধলো। শয়তানটা হাতের মুঠি আলগা করতেই তমা নিজের হাত ছাড়িয়ে উর্ধশ্বাসে দৌড়াতে লাগলো। দুপায়ে কাঁটা ফুটতে লাগলো। তবুও ও আজ থামছে না। কেন যেন মনে হতে লাগলো থামলেই শয়তানটা ওকে টেনে নিয়ে যাবে। ও পিছনে পিছনে সেই অটোটা ফিরে আসার শব্দ শুনতে পারছে। আজকের রাতের মতো এতো ভয়ঙ্কর রাত ওর জীবনে আর কখনও আসেনি। তমা এই জঙ্গল থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজছে। অটোর শব্দ পেয়ে তমার ঘন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। এদিকে পায়ে কাঁটা ফুটেছে। ঠোঁটটা কামড়ে ধরে ব্যথা সহ্য করে যাচ্ছে। অটোটা দৃষ্টির আড়াল হতেই তমা আবার দৌড়াতে লাগলো। মেঠোপথ পেরিয়ে পায়ে যেন ইট মোড়ানো পথের ছোঁয়া পেলো। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু কোরাস গানের মতো ঝিঁ ঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছে। আর তার সাথে হাড় কাঁপানো হিমেল বাতাস। একসময় পিচঢালা পথের সন্ধান পায় তমা। হন্ত দন্ত হয়ে বিপদ সংকুল পথে দৌড়াতে দৌড়াতে তমা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অবসন্ন দেহে তমা একসময় একটা প্রাইভেট কারের সাথে যেন প্রচন্ড ধাক্কা খায়।
অন্ধকারে অয়ন বুঝতে পারে না গাড়ির সামনে হঠাৎ কি এসে পড়লো। ও হার্ড ব্রেক কষে গাড়ি থামায়। গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে এসে দেখে গাড়ীর সামনে একটা মেয়ে পড়ে আছে। একবার মনে হলো এই আপদকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়াই ঠিক হবে। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় অয়ন সেটা করতে পারে না। তমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে গাড়ীর ভিতরের সিটে শুইয়ে দেয়।

চলবে