#বড় গল্প
#নীড় ভাঙ্গা ঝড়
পর্ব- তিন
মাহবুবা বিথী
নিঃশ্বাস নিচ্ছে নাকি মরে গেছে সেটা দেখার জন্য অয়ন অচেতন মেয়েটার নাকের কাছে আঙ্গুল নিয়ে দেখতে লাগলো। কিন্তু কোনো উষ্ণ বাতাসের স্পর্শ পেলো না ডাক্তার অয়ন। তবে কি মেয়েটা মরে গেল নাকি? কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়। শীর্ণকায় দেহের হাতের কব্জি ধরে পালস বোঝার চেষ্টা করে। খুব ধীর হলেও পালস চলছে
টিপ টিপ করে। নাড়ীর গতি পেয়ে ডাক্তার অয়ন মনে মনে বললো,যাক বাবা ভীষণ বাঁচা বেঁচে গিয়েছি। অতঃপর মেয়েটা বেঁচে আছে। মেয়েটার মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দেখে রক্তে পুরো মুখ মাখামাখি। টিস্যু দিয়ে মুখের রক্ত মুছিয়ে দিতেই মায়াভরা মুখটার দিকে ডাক্তার অয়নের চোখদুটো আটকে যায়। কতক্ষণ ঐ মুখটার দিকে তাকিয়েছিলো কে জানে? ফোনের শব্দে ডাক্তার অয়নের সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন সজাগ হয়। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখে সায়ান ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করেই অয়ন বললো,
—-সায়ান তুই কাল গাইবান্ধায় চলে আয়। আমি আজ ফিরতে পারবো না। এখানে জরুরী কাজে আটকে গিয়েছি।
—-কি এমন জরুরী কাজ,
—-এখন বলার মতো সময় হাতে নেই। কাল চলে আয় তখনি সব জানতে পারবি।
ফোনটা রেখেই অয়ন অস্থির হয়ে উঠে। এদিকে হার্ড ব্রেক কষতে গিয়ে গাড়িটা একটা গাছের সাথে ধাক্কা খায়। সাথে সাথে সামনের দিকটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে। এখন এই মেয়েটাকে হাসপাতালে কিভাবে নিবে? এদিকে মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই ওর শুধু মনে হতে থাকে মেয়েটা যেন ওর বহুদিনের আপন। প্রায় পাঁচ বছর হলো ওর জীবন থেকে রেশমা চলে গেছে। আজ অবদি কোনো মেয়ের উপর এতোটা আকর্ষণ ও অনুভব করেনি। দূর থেকে একটা গাড়ি আসতে দেখে মোবাইলের লাইট অন করে হাতের ইশারায় অয়ন থামতে বললো। কাছাকাছি আসতেই অয়ন দেখে এতো পুলিশের গাড়ি। মনে মনে বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই যেন সন্ধা হয়। কাছে এসে গাড়িটা থামিয়ে দু’জন পুলিশ বের হয়ে আসে। অয়ন পুলিশকে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে,
—-সামনে একটা গরু চলে আসাতে হার্ডব্রেক কষতে গিয়ে গাড়িটা একটা গাছের সাথে ধাক্কা খায়। আমাকে এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে। একটা লিফট দিলে ভালো হয়। আর গাড়িটা আপনারা থানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরে আমি থানা থেকে সংগ্রহ করে নিবো।
—-ওকে আসুন,
—+না মানে আমি তো একা নই। সাথে আমার ওয়াইফ আছে। সে বেশ আঘাত পেয়েছে। এখন অজ্ঞান হয়ে আছে।
দু’জন পুলিশের মধ্যে একজন বলে উঠলো,
—-একথা আপনি আগে বলেননি কেন? যান আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আসুন।
এতো সহজে বিষয়টা রফা হওয়াতে অয়ন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যদিও ওরা কেস করতে চাইছিলো কিন্তু অয়ন বেশ মোটা টাকা ওদের হাতে গুঁজে দেয়। সে কারনে ওরা আর কোনো উচ্চ্য বাচ্য করেনি। অয়ন মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠলো। পুলিশ মেয়েটার মুখের পানে তাকাতেই অয়ন বললো,
—-এক্সিডেন্টের কারনে ট্রমাটাইজড হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আমাকে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।
অয়ন নিজেকে এভাবে অবলীলায় মিথ্যা বলতে দেখে অবাক হলো। অথচ ও কখনও মিথ্যা বলে না। আজ এই মেয়েটার জন্য ও সাবলীলভাবে মিথ্যা কথা বলে গেল।
সামনের হাসপাতালে যেতে আধঘন্টা সময় লাগে।
হাসপাতালে পৌছে অয়ন রিসিপশনে খবর দিতেই দু’জন ওয়ার্ড বয় স্ট্রেচার নিয়ে এসে মেয়েটাকে নামিয়ে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যায়। পুলিশ ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে নিজেদের গন্তব্যের দিকে চলে যায়। পুলিশ দুটো চলে যেতেই অয়ন ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের ছয় নম্বর কেবিনে চলে যায়। সেখানে ডক্টর শায়লা মেয়েটাকে চেকআপ করছে। ভালোমতো দেখে অয়নকে বললো,
—-মাথায় বেশ রক্তক্ষরণ হয়েছে। সে যাই হোক আমি দেখছি। তুমি এতো চিন্তা করো না।
অয়নও এই হাসপাতালের মেডিসিনের ডক্টর। এখানে ওর চেম্বার আছে। সপ্তাহে দুদিন এখানে ডিউটি করে। সেই সুবাদে ডক্টর শায়লা ওর পূর্ব পরিচিত।
শায়লা মেয়েটাকে ভালো করে চেকআপ করতে লাগলো। বেডের উপর শুয়ে থাকা ঐ অচেতন মেয়েটার মুখটা অয়নের কাছে বড্ড বিষন্ন লাগে। বড় বড় আঁখি পল্লবে ঢাকা চোখ দুটোতে যেন বিষাদের সাগর জমে আছে। চোখ দুটো খুললেই সেই কষ্টের স্রোত যেন রক্তিম গালে আঁছড়ে পড়বে।
শায়লাকে যে নার্সটা সাহায্য করছে সে হঠাৎ বলে উঠে,
—-মেয়েটাতো এক্সিডেন্ট করেছে। পুলিশকে ইনফর্ম করলে ভালো হতো।
আর কিছু বলার আগেই অয়ন বললো,
—-আমাকে এখানে পুলিশই নিয়ে এসেছে। সুতরাং আপনাকে এই ভাবনাটা না ভাবলেও চলবে।
ডক্টর শায়লা নার্সটার উপর বিরক্ত হয়ে বলে,
—-সিস্টার শেফালী আপনাকে যা করতে বলা হয়েছে আপনি তাই করুন। অনর্থক সময় নষ্ট করবেন না।
সিস্টার শেফালী টেস্ট করার জন্য রক্ত কালেক্ট করে চলে যেতেই অয়ন শায়লাকে বলে,
—-শেফালী কিন্তু ভুল কিছু বলে নাই।
—-কিন্তু তুমি তো ইচ্ছা করে এক্সিডেন্ট করোনি। মেয়েটাই তোমার গাড়ির উপর এসে পড়েছে। ভাগ্যিস তুমি রিস্ক নিয়ে হার্ডব্রেক কষেছিলে। তা,না হলে মেয়েটার অনেক বড় ক্ষতি হতে পারতো। তুমি তো চাইলেই মেয়েটাকে পথের ধারে ফেলে চলে আসতে পারতে। কিন্তু তুমি তা করোনি। মানবতার খাতিরে ওকে সাথে করে নিয়ে এসেছো। তুমি ওয়েটিং রুমে বসে বিশ্রাম নাও। মেয়েটাকে নিয়ে এতো চাপ নিও না। ও ঠিক সেরে উঠবে।
শায়লার কথায় আশস্ত হয়ে অয়ন কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। শায়লা অয়নের গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভাবে আজকের এই অয়ন ওর কাছে বড্ড অচেনা। একবছর ধরে ও অয়নের পিছনে লেগে আছে। কিন্তু আজ অবদি ও অয়নের মন পায়নি। অথচ এই মেয়েটার মাঝে অয়ন কি এমন খুঁজে পেল যে ওর জন্য এতো ভাবনা?
অয়ন কেবিনের বাইরে এসে করিডোরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে আজ রুপার থালার মতো চাঁদ উঠেছে। আজ মনে হয় পূর্ণিমা। এরকম এক পূর্ণিমা রাতে রেশমা ওকে ফেলে প্রেমিকের হাত ধরে আমেরিকার পথে পা বাড়িয়েছিলো। অথচ ওদের পাঁচ বছর রিলেশনের পর নিজেরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। শুধু আমেরিকা যাওয়ার কারনে রেশমা ওকে চিরদিনের মতো ফেলে রেখে চলে গেল। পাঁচ বছরের সম্পর্ক বিয়ের পর দুবছরের সংসার জীবন রেশমার সাথে কাটিয়েছে। অথচ অয়ন ঘূর্ণাক্ষরে বুঝতে পারেনি রেশমা যে বিবাহবর্হিভূত সম্পর্কে লিপ্ত আছে। যেদিন অয়ন রেশমার এই সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে পারলো সেদিন নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হয়। তারপর থেকে পৃথিবীর সমস্ত মেয়েদের উপর থেকে ওর বিশ্বাস উঠে যায়। না এরপর থেকে ও আর কোনো সম্পর্কে জড়ায়নি। কিংবা জড়াতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হয়নি। অথচ আজ এই মেয়েটার জন্য ওর কেন কষ্ট হচ্ছে ও বুঝতে পারছে না। মেয়েটার চেহারায় কেন এতো বিষাদ জমে আছে? আচ্ছা ও কেন মেয়েটাকে নিয়ে এতো ভাবছে বুঝতে পারছে না। রাত প্রায় শেষ হতে চললো। শায়লা ওর ডিউটি শেষ করে চলে গিয়েছে। নতুন একজন সিস্টারকে অয়ন মেয়েটার কেবিনে দেখতে পেলো।
ভোর চারটার দিকে সিস্টার এসে অয়নকে জানালো পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। ওদিকে তমার জ্ঞান যখন ফিরে আসে ও তখন সিস্টারকে বলে এখানে ও কিভাবে এসেছে। সিস্টার ওকে বলে,
—-আপনার হাসব্যান্ড আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি উনাকে খবর দিয়েছি। এখুনি চলে আসবে।
তমা খুব অবাক হলো। ও তো কাল বাড়ি থেকে পালিয়েছে। তাহলে সাব্বির ওর খোঁজ কিভাবে পেলো? রাত্রির অন্ধকারে যতটুকু ওর মনে পড়ে ও একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। এমন সময় কেবিনের দরজাটা কে যেন নক করছে। নক করার শব্দ শুনে সিস্টার বললো,
—-ঐ বুঝি আপনার হাসব্যান্ড এলো। ভাগ্য করে এমন স্বামী পেয়েছেন। আপনার টেনশনে করিডোরে চেয়ারে বসেই উনি কাটিয়ে দিলেন। চাইলে উনি বিশ্রাম নিতে পারতেন।
তমা অবাক হয়ে সিস্টারের কথাগুলো শুনছে আর ভাবছে সত্যি কি ওর এমন ভাগ্য হবে?
চলবে