নীড় ভাঙ্গা ঝড় পর্ব-০৪

0
267

#বড় গল্প
#নীড় ভাঙ্গা ঝড়
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

তমা অধীর আগ্রহে সাব্বিরকে দেখার জন্য বসে আছে। কিন্তু ওর হাসব্যান্ড সাব্বিরের পরিবর্তে ও কাকে দেখছে? মানতেই হবে মানুষটা বেশ সুপুরুষ। আকাশি রঙের ফুল স্লিভ শার্ট পরিহিত, যেটা কব্জিতে ভাঁজ দিয়ে গুটিয়ে রাখা হয়েছে, শার্টের বোতাম সবগুলো লাগানো রয়েছে,চোখে রিমলেস চশমা, পরনে ছাই রঙা ট্রাউজার আর পায়ে কালো লেদার শ্যু। ভীষন ফরমাল লুকে প্রায় ছ’ফিটের মতো লম্বা তিরিশোর্ধ এক বলিষ্ট যুবক। নির্মেদ পেশীবহুল পেটানো শরীর যা পোশাকের উপর দিয়ে স্পষ্ট দৃশ্যমান। তমা যেন প্রথম দেখায় মানুষটার প্রেমে পড়ে গেল। তমা হা করে অয়নের দিকে তাকিয়ে আছে। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলো। আসলে প্রেম ভালোবাসা সবার জন্য নয়। তাছাড়া ওর কাছে কেমন যেন সব ধাঁধার মতো লাগছে। অয়ন কেবিনে এসে খুব সাবলীল ভঙ্গিতে বললো,
—-কেমন আছেন?
—-ভালো,
—-আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করেন অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
অয়নের কথা শুনে তমা বিড়বিড় করে বললো,
—-মরে গেলেই তো ভালো হতো।
—-কিছু বলছেন?
—-না,মানে আমি এখানে কিভাবে আসলাম?
—-ও এই কথা,আপনি তো আমার গাড়ির নীচেই পড়তে যাচ্ছিলেন। ভাগ্যিস হার্ডব্রেক কষেছিলাম। যদিও গাড়ির অবস্থা বারোটা বেজে গিয়েছে।
—সরি,
—-কেন,
—-,আমার জন্য আপনার বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেল।
—তা একটু হলো বৈকি,তবে মানুষের জীবনের মুল্য অনেক বেশী। যা কোনো কিছুর বিনিময়ে পাওয়া যায় না। বেঁচে থাকলে ওরকম বহু গাড়ি কেনা যাবে। আপনার বাসার ঠিকানাটা বলুন। উনাদের তো খবরটা জানাতে হবে। তমা ইতস্তত করতে লাগলো। আসলে ওর এই শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার খবর হয়তো এতোক্ষণে ওর বাসায় পৌঁছে গিয়েছে। সাব্বির আর ওর শাশুড়ী ওর নামে কি বলেছে কে জানে। তমাকে চুপ থাকতে দেখে অয়ন বললো,
—কি হলো বাড়ির ঠিকানাটা বলুন? ওহ্ আপনার নামটাই তো জানা হলো না।
—-তমা,
—-বাহ্ সুন্দরীতমা,কিংবা প্রিয়তমা। এবার ঠিকানা বলুন।
তমা ওর বাবার ফোনে কথা বলতে চায়। অয়ন ওর ফোনে তমাকে ওর বাবার সাথে কথা বলতে দেয়। তমা ওর বাবাকে হাসপাতালে আসতে বলে। সাক্ষাতে সব বলবে। ওর বাবা আর ওর ছোটো মা খবর পেয়ে হাসপাতালে চলে আসে। তমার মুখে সবটা শুনে ওর বাবা যদিও বলে,
“আলোচনা করে একটা সমাধান বের করবো। তোর ডিভোর্স হয়ে গেলে গায়ে তো খুঁত লেগে যাবে।”
তমার বাবার মুখে একথা শুনে ওর ছোটো মা রেগে গিয়ে বলে,
—-যে বাড়িতে আমাদের মেয়ের এতো অসম্মান হয়েছে সেখানে আলোচনা করার আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
তমা ওর ছোটো মায়ের কথাগুলো শুনে খুব অবাক হলো। সাথে সাথে ওকে অপরাধবোধ গ্রাস করতে লাগলো। ক’দিন আগে এই মায়ের গর্ভে ওর একটা বোন হয়। দেখাতো দূরের কথা কোনোদিন ফোনেও ওর বাবার কাছে বোনটার কোনো খোঁজ খবর করেনি। এমনকি এই মানুষটাকে আজ অবদি ও মা বলে ডাকেনি। কিংবা মায়ের সম্মানও দেয়নি। অথচ আজ উনি তমার ক্ষেত্রে যে কথা বললো ওর মা বেঁচে থাকলে একথাই বলতো। তমার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তমাকে কাঁদতে দেখে ওর নতুন মা বলে,
—-এখন কাঁদার সময় নয়। নিজেকে স্বাবলম্বী করে তৈরী করো। নিজের পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করে নাও। তুমি ঐ প্রতারককে ডিভোর্স দিয়ে লেখাপড়া আবার শুরু করো।
তমার মায়ের মুখে একথা শুনে তমার বাবা বলে,
—-ও ভিভোর্স দিলে তো ছেলের কাছে দেনমোহরের টাকা পয়সা কিছুই পাবে না।
বাবার মুখে এ কথা শুনে তমা বলে,
—-আব্বা আমি ওর কাছে এসবের কিছুই চাই না। শুধু মুক্তি চাই।
তখন তমার ছোটো মা ওর কাছে এসে বসে। এরপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
—-তোমার সাথে ছেলেটা এতোবড় অন্যায় করলো ওকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? ওর তো একটা শাস্তি হওয়া দরকার।
—শাস্তি দিতে হলে সাব্বিরের মাকে দেওয়া উচিত। ঐ মহিলাই সব কিছুর জন্য দায়ী। কিন্তু আমি এটা চাচ্ছি না। এমনিতেই আমার বিয়ে দিয়ে আব্বার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন কোর্ট কাছারী করতে গেলে আব্বার আরো টাকা পয়সা খরচ হবে। এর থেকে আমার লেখাপড়ার পিছনে আব্বা অর্থ ব্যয় করুক যাতে আমি নিজের পায়ে ভালোভাবে দাঁড়াতে পারি। আর আমার প্রতি সব অন্যায়ের বিচারের ভার আমি আল্লাহপাকের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।
দু’দিন পর তমা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়। বাড়ি যাওয়ার আগে অয়নের চেম্বারে ধন্যবাদ জানাতে আসে। সেদিন অয়ন ওর কাছে সেদিনের রাতের ঘটনা জানতে চায়। তমা বলে
—-আমি আমার বিষাক্ত অতীতকে আর মনে করতে চাই না। তারপরও যদি আপনার কৌতূহল হয়ে থাকে তাহলে একদিন সময় করে আমার সাথে দেখা করবেন। আমি আপনাকে আমার জীবনের সব কথাই বলবো।
অয়ন ওর কাছে মোবাইল নাম্বার জানতে চায়। তমা বলে,
—-এই মুহুর্তে আমার কাছে ফোন নাই। আপনার নাম্বারটা একটা কাগজে লিখে দিন। আমি যোগাযোগ করে নিবো।
অয়ন ওর মাম্বারটা একটা কাগজে লিখে তমার হাতে দিয়ে বলে,
—-দোয়া করি আপনার জীবনের চলার পথ যেন আল্লাহপাক অনেক সহজ করে দেন।
তমা অয়নের কাছে বিদায় নিয়ে ওর বাবা মায়ের সাথে বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়।
এরপর তমার সাথে সাব্বিরের ডিভোর্স হয়ে যায়। তমা আবারও পড়াশোনায় মনোযোগী হয়। ওর ছোটো মায়ের সাথে আস্তে আস্তে সম্পর্কটা সুদৃঢ় হতে থাকে। ছোটো বোন ঐশীও তমার খুব ভক্ত হয়।
তমার আজ মনে হয়ে মাঝে মাঝে জীবনে একটু কষ্ট পাওয়া ভালো। কষ্ট পেলে মানুষ বাস্তবতা সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে লড়াই করতে শিখে যায়। আর সবচেয়ে বড় প্রয়োজন মানুষ চিনতে শেখায়। তমা আজ ওর ছোটো মাকে চিনতে পেরেছে। এই পৃথিবীতে কখনও কেউ কারো মা হতে পারে না তবে মায়ের কাছাকাছি যেতে পারে। তমা বর্তমানে ওর ছোটো মা বোন ঐশী বাবাকে নিয়ে জীবনের সুন্দর সময় পার করছে।
ওদিকে অয়ন ওর ছোটোভাই সায়ানের কাছে সেদিনের অ্যাক্সিডেন্টের কথা সব বলে। ওদের দুভাইয়ের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। অয়ন সায়ানের কাছে তমার প্রতি ওর অনুভূতীর কথাও ব্যক্ত করে। এতে অবশ্য মনে মনে সায়ান খুশী হয়। কারণ ওর ভাবী ওভাবে চলে যাওয়ার পর অয়ন মানসিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত ছিলো। এখন যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে তাহলে ও ওর বাবা মা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারে।
গাইবান্দা সদর হাসপাতালে ডিউটি করে পাশাপাশি চেম্বারে রুগী দেখে অয়ন সপ্তাহের চারটা দিন পার করে। আর বাকি তিনদিন ঢাকায় ফিরে যায়। কিন্তু ও প্রতিদিন মোবাইলে নিজের অজান্তেই তমার ফোনের অপেক্ষা করতে থাকে। ফোন করে না দেখে মাঝে মাঝে ওর তমার উপর রাগ হয়। আবার নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে,তমা ওর কে হয়? কেনইবা তমা ওকে ফোন করতে যাবে? রেশমা চলে যাবার পর আজ অবদি কোনো মেয়ের জন্য ওর এমন অনুভূতী হয়নি। মেয়েটা দেখতে মোটামুটি সুন্দরী তবে রেশমার মতো ধাঁরালে সুন্দরী নয়। তারপরও মুখটাতে কেমন যেন একটা মায়া আছে। যে মায়াতে আজ অয়নের জড়িয়ে পড়তে বড্ড ইচ্ছে হয়।

মা জিন্নাত আরা ছোটো ছেলে সায়ানের কাছে তমার কথা জানতে পারে। যদিও উনি মনে মনে খুশী এই কারনে যে রেশমা চলে যাবার পর এই প্রথম অয়ন কোনো মেয়ের উপর নিজের অনুভূতী ব্যক্ত করলো। কিন্ত হঠাৎ দেখায় ভালোলাগা কি মোহ না ভালোবাসা সেটা আগে অয়নকে বুঝতে হবে। তাছাড়া মেয়েটির সম্পর্কেও খোঁজ খবর নিতে হবে। উনার ডিভোর্সি ছেলের জন্য একটা ডিভোর্সী মেয়েকেই বউ হিসাবে আনবেন। যদিও আত্মীয় স্বজন শুভাকাঙ্খীরা বলে পাত্র হিসাবে অয়ন প্রতিষ্টিত। সেক্ষেত্রে অনেক মেয়ের বাবাই অয়নের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবেন। তাই ডিভোর্সী মেয়ে আনার দরকার কি? কিন্তু জিন্নাত আরা উনাদের সাথে একমত নন। কারণ ডিভোর্স যদি একটা মেয়ের ক্ষেত্রে ত্রুটি হিসাবে ধরা হয় তাহলে ছেলেদের ক্ষেত্রে কেন নয়? উনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজের ডিভোর্সি ছেলের জন্য কোনো ডিভোর্সী মেয়েকেই বউ করে আনবেন।

চলবে