নীড় ভাঙ্গা ঝড় পর্ব-০৬

0
254

#বড় গল্প
#নীড় ভাঙ্গা ঝড়
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী

বিকালের দিকে জিন্নাতআরা ছোটো ছেলে সায়ানকে নিয়ে তমাদের বাসায় হাজির হলেন। তমার বাবা মায়ের উষ্ণ আতিথেয়তা জিন্নাত আরা গ্রহন করলেন। নানারকম পিঠা পায়েসের স্বাদ উপভোগ করলেন। সর্বোপরি যে উদ্দেশ্যে আসা অর্থাৎ তমাকে উনার বেশ পছন্দ হলো। কেন যেন মনে হলো এই মেয়েটাই উনার ছেলেটাকে সুখী করতে পারবে। তাই আর দেরী না করে মোটামুটি বিয়ের কথা পাকা করলেন। সামনের শুক্রবার বিয়ের ডেট করতে চাওয়াতে তমার বাবা একটু আপত্তি করছিলেন। আজতো শনিবার,মাঝখানে মাত্র ছয়দিন। এতো অল্প সময়ে কিভাবে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করবেন? তবে জিন্নাত আরা সোবহান সাহেবকে বুঝিয়ে বলেন,
—-আমাদের ছেলেমেয়ে দুটোই তো ঘরপোড়া গরু। সুতরাং খুব বেশী লোক জানাজানির দরকার নেই। আর খুব সাধারণভাবেই আমি ওদের বিয়েটা সম্পন্ন করতে চাই। আমরা শুধু মন প্রাণ খুলে ওদের জন্য আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করবো। জগতের সব সুখ যেন আল্লাহপাক ওদের দান করেন।
এরপর তমার হাতে পাঁচহাজার টাকা গুঁজে দিয়ে জিন্নাত আরা মনে একরাশ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলেন। সেদিন রাতে ডিনার শেষ করে অয়নকে ডেকে বললেন,
—তমার সাথে তোর বিয়েটা পাকা করে ফেললাম।
—-আম্মু একটু তাড়াহুড়ো হলো নাতো? আরও কটা দিন দেখলে হতো।
—-শুভ কাজে দেরী করতে নেই। তাছাড়া তমাকে দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছে। মেয়েটা তোর সাথে নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিবে।
অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
—-ভালো হলেই ভালো।
একথা বলে অয়ন নিজের রুমে চলে যায়। জিন্নাত আরা ছেলের গমন পথের দিকে তাকিয়ে অতীতের ভাবনায় হারিয়ে গেলেন। যেদিন অয়নের সাথে রেশমার ডিভোর্স হয় সেদিনই অয়নের বাবা আমজাদ সাহেবের সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক হয়। সাতদিন আইসিইউতে থেকে না ফেরার দেশে উনি পাড়ি জমান। উনাকে একা করে আমজাদ সাহেব চিরতরে চলে গেলেন। সংসারের সব দায়িত্ব উনার কাঁধে ফেলে গেলেন। জিন্নাত আরা স্বামীর উপর খুব বেশী নির্ভর ছিলেন। দুই ছেলের দেখাশোনা করা, আর নিজের হাতে পরম যত্নে স্বামী সন্তানের জন্য রান্না করা,ঘর বাড়ি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা, এসবেই উনি ব্যস্ত থাকতেন। আমজাদ সাহেব চলে যাবার পর বাড়ির কর, সমস্ত বিল, লোন পরিশোধ থেকে শুরু করে বাজার সদাই সব কিছু উনাকেই করতে হচ্ছে। আজও উনার মনে পড়ে যেদিন বিয়ে হয়ে আমজাদের হাত ধরে বাপের বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন সেদিন উনার বাবা উনার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন,
“লাল শাড়ি পরে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছো। যদি ও বাড়ি থেকে কোনোদিন বের হতে হয় সাদা কাফন পরে বের হবে।”
হা জিন্নাত আরা অপেক্ষায় আছেন সাদা কাফন পরে বের হওয়ার জন্য। সে জন্য ছেলে দুটোকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে সংসারী করতে চাইছেন।
অয়নের উপর যে একটু নির্ভর করবেন সেই উপায়ও এতোদিন ছিলো না। রেশমা চলে যাবার পর থেকে ছেলেটা মানসিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত ছিলো। তমার সাথে পরিচিত হবার পর থেকে ওর মাঝে কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে আসতে শুরু করেছে। এই জন্য জিন্নাত আরা দেরী করতে চাইছেন না। তাড়াতাড়ি ছেলেকে বিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন।

বিয়ের দিন সকালে অয়নের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওর কেন যেন মনে হতে লাগলো এই মেয়েটার সাথেও ওর অ্যাডজাস্ট হবে না। হয়ত কোনো এক বসন্তে তমাও অন্য কারো হাত ধরে চলে যাবে। ও বিয়ের আয়োজন বন্ধ করতে মায়ের রুমে আসতেই ও মাকে কিছু বলার আগে মা জিন্নাত আরা অয়নকে বললেন,
—-মেয়েটাকে কষ্ট দিও না বাবা। তোমরা দুজনেই ঘর ভাঙ্গা মানুষ। তাই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করো। রওয়ানা দেওয়ার আগে যোহরের নামাজ পড়ার সময় আরো দু’রাকআত নফল নামাজ পড়ে নিয়ে আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করো,”আল্লাহপাক যেন তোমাদের ঘরটাকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দেন।”
না অয়ন মাকে আর কিছু বলতে পারলো না। মায়ের কথামতো নামাজ পড়ে নিজেদের গাড়িতে করে তমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। খুব বেশী জানাজানি করেননি জিন্নাত আরা। অয়ন আর সায়ানকে নিয়ে ঢাকা থেকে দুপুর একটার দিকে রওয়ানা দেন। গাইবান্ধায় তমাদের বাড়িতে পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে যায়।

তমাকে লাল বেনারশি পড়ানো হয়েছে। জিন্নাত আরা নিজের হাতে তমাকে সিতাহার পরিয়ে দিলেন। দুই কানে ঝুমকা হাতে গোলাপ বালা পরিয়ে দিলেন। তমার গায়ের রংটা আজ যেন আরো বেশী উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মেয়েটা শুধু চোখে মোটা করে কাজল দিয়েছে। আর ঘন কালো চুলগুলো আঁচড়ে একটা হাত খোঁপা করে নিয়েছে। এতেই যেন রুপ উথলে পড়ছে। ঢাকা থেকে তমার ভাই ভাবি আসছে। দূর থেকে তমার বাবা নিজের মেয়েকে এভাবে স্নেহের আঁচলে জিন্নাত আরা বাঁধতে দেখে মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। উনার মন বলছে এবার মেয়েটা তার সুখী হবে। বিয়ে পরানো শুরু হয়েছে। তমার ছোটো মা এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। ছল ছল চোখে তমা ওর ছোটো মায়ের দিকে তাকায়। ছোটো মা ওর চোখের পানি মুছিয়ে বলে,
—-আল্লাহপাকের উপর ভরসা করে কবুল বলো মা।
সাথে সাথে জিন্নাত আরাও বলে উঠেন,
—-আমি তোমার মা হয়তো কোনোদিন হতে পারবো না। তবে শাশুড়ী ও হতে চাই না। আমি তোমার মায়ের মতো হতে চাই।
জিন্নাত আরার কথায় তমার মনটা ভরে গেল। ও কবুল বলে ফেললো। বাকি সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ছেলে আর বউমাকে নিয়ে জিন্নাত আরা রাত বারোটার দিকে গাইবান্ধা থেকে ঢাকার পথে রওয়ানা দেন। তমার বাবার বুকটা আজ আনন্দে ভরে উঠে। ডিভোর্স হওয়ার পর মেয়েটাকে নিয়ে উনি খুব দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন। আল্লাহপাকের রহমতে আগের বিয়ের থেকে সব দিক থেকেই তমার এই বিয়েটা ভালো হয়েছে। তমাকে নিয়ে চিন্তা করতেন বলেই মাঝে মাঝে প্রেসারটা বেশ বেড়ে যেতো। তমার ছোটো মা এসে বলে,
—-এবার আপনি চিন্তা মুক্ত হন। নিজের শরীরের যত্ন ঠিকঠাকভাবে নিবেন।
ছোটো মায়ের কথা শুনে তমার ভাই হাসান বলে,
—-আব্বা ছোটো মা কিন্তু ঠিক কথাই বলেছে। তুমি এবার নিজের দিকে খেয়াল রাখবে।
তমার ভাবি জুলেখা বলে,
—-তমার তো রাজ কপাল। রাজপুত্রের মতো এবার স্বামী জুটেছে কপালে। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি গাড়ি সব আছে।
জুলেখার কথায় তমার ছোটো মা খুব বিরক্ত বোধ করে। কারণ মেয়েটা এমনিতেই বেশ দুঃখী। এভাবে বললে তমার সুখের কপালে নজর লাগতে পারে। সে কারনে বিরক্তভাব নিয়ে জুলেখাকে বলে,
—-বউমা এভাবে বলো না। ওর স্ট্রাগলটাও তোমার দেখতে হবে। রাতের পর যেমন দিন আসে তেমনি দুঃখের পর সুখ আসে। আমরা সবাই মিলে তমার জন্য দোয়া করি। আল্লাহপাক যেন সব দিক থেকে ওকে সুখে ভরিয়ে দেয়।
শাশুড়ীর কথায় জুলেখার খুব রাগ হলো। মনে মনে বলে,”মায়ের থেকে যেন মাসীর দরদ বেশী।”

গাড়ি আগাতে থাকে। আর তমার বুকের ভেতরটাও মোঁচড়াতে থাকে। আগেরবার শুধু মনে হয়েছিলো, একবার এ বাড়ি থেকে বের হতে পারলে সহজে আর এ বাড়ি মুখো হবে না। সহজে ওকে বাড়িমুখো হতে হয়নি। তালাকের মতো এক কঠিন দলিল নিয়ে বাপের বাড়িতে ফিরতে হয়েছে। তবে ফিরে এসে ওর ভুল ভেঙ্গেছে। বাড়ির প্রতিটি মানুষ ওকে কতো ভালোবাসে সেটা ও উপলব্ধি করতে পেরেছে। এটাও তো ওর জীবনের অনেক বড় পাওয়া। সে কারনেই বাপের বাড়ির মানুষগুলোর জন্য আজ বুকের পাঁজরগুলো যেন ভেঙ্গে পড়ছে। দুচোখের কোল বেয়ে নোনা পানি গড়িয়ে পড়ছে। অয়ন একসময় ওর হাতে টিস্যু পেপার ধরিয়ে দেয়।
ভোরের দিকে জিন্নাত আরা ঢাকায় নিজেদের বাড়িতে পৌঁছে যান। বাড়িতে পৌঁছে জিন্নাত আরা তমাকে একটা বড় ঘরে খাটের উপর বসিয়ে দেয়। পুরো ঘরটা তাজা ফুল দিয়ে সাজানো রয়েছে। ক্লসেট থেকে হালকা পিংক কালারের আড়ং এর একটা সুতী শাড়ি বের করে তমার হাতে তুলে দেয়। পেটিকোর্ট আর ব্লাউজ দিয়ে বলে,
—-ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নাও। আমি কিচেনে গিয়ে তোমাদের নাস্তার ব্যবস্থা করি।
তমা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। জিন্নাত আরা চলে যাবার পর তমা পুরো ঘরটায় চোখ বুলায়। বেশ পরিপাটি করে ঘরটা গুছিয়ে রাখা হয়েছে। দেওয়ালে ঝুলানো অয়নের ছবির দিকে তাকিয়ে বুঝে নিলো এই ঘরটা অয়নের। শাড়িটা নিয়ে তমা ওয়াশরুমে চলে যায়। সেখানে হাতমুখ ধুয়ে শাড়িটা বদলে নেয়। পুরো ওয়াশরুমটা ভিজিয়ে ফেলে। যদিও শাওয়ারের জায়গাটা কাঁচ দিয়ে ঘিরে রাখা রয়েছে। তারপরও ওর অসাবধানতায় ওয়াশরুমের মেঝেটা ভিজে যায়। বেনারশী শাড়িটা এনে ঘরে ডিভানের উপর ছড়িয়ে দেয়। তমা শাড়িটা কোনো রকমে গায়ে জড়ায়। আসলে মফস্বলে বড় হওয়াতে শহুরে হালচাল ওর অনেকটাই অজানা। এমন সময় দরজা নক করে অয়ন ঘরে ঢুকে। ডিভানের উপর এভাবে শাড়ি ছড়িয়ে দেওয়াতে মনে মনে তমার উপর খুব বিরক্ত হয়। ওয়াশরুমে গিয়ে পুরো বাথরুম ভেজা দেখে ওর মেজাজটা আরো তিরিক্ষি হয়ে উঠে। ওর মনে হতে লাগলো,তমাকে বিয়ে করে কি ও ভুল করলো? যার মাঝে কালচারের ক অবশিষ্ট নেই তাকে নিয়ে সারাজীবন কাটাবে কি করে?

চলবে