নীড় হারা পাখি পর্ব-২২+২৩

0
287

#নীড়_হারা_পাখি
#২২তম_পর্ব

এমন সময় ফোনটি বেজে উঠলো সুরভীর। ইয়াসমিন নিজ কাজে চলে গেলো। ফোনের স্ক্রিনে “তুরান” নামটি ভেসে উঠলো। ফোনটি ধরতেই তার গাঢ় কন্ঠ শুনলো সুরভী,
“আমি কিন্তু তোমার আবদার রেখেছি, এবার তোমার পালা”

তুরানের কথাটি শেষ হবার পূর্বেই শুষ্ক ঠোঁটে হাসির জোয়ার খেললো সুরভীর। চোখজোড়ায় জমলো অনাকাঙ্খিত সুখের মেঘ। যদিও তুরানের উপর পূর্ণবিশ্বাস ছিলো তার, কিন্তু নির্দয় ভাগ্যের উপর বিশ্বাস নেই সুরভীর। যখন তখন নিজের পাশা পালটে দেয়। নিজেকে সামলে উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললো,
“তিমির কোথায় এখন?”
“আমার সাথেই আছে মহাশয়। বাবা-মাকে বলে দিও আমরা বাড়ি আসছি”

বাড়ির কথা শুনতেই বাধ সাধলো সুরভী। ধীর স্বরে বললো,
“বাড়ি যাবার আগে একটু হাসপাতালে আসো”
“হাসপাতালে কেনো?”
“অভিলাষার শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আমি, বাবা আর রোদ্দুর ধরাধরি করে নিয়ে এসেছি”
“এখন কেমন আছে ও?”
“ডাক্তার বেড রেস্ট দিয়েছেন। বিপদমুক্ত এখন। তোমরা এখানেই এসো। রোদ্দুরকে তাহলে বাড়ি যেতে বলে দিবো”
“আমার কথা আছে ওর সাথে। ওকে যেতে বলো না। আমরা আসছি। আর আমার আবদারের কথাটি মনে রেখো”

বলেই ফোনটা কেটে দিলো তুরান। সুরভীর উত্তরের অপেক্ষা করলো না। ফোনের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো সুরভী। ঠোঁটের কোনে হাসিটা এখনো অক্ষত। লোকটি তার কথা রেখেছে এখন নিজের কথা রাখার পালা। তীব্র শীতের সেই রাতে সুরভী তুরানের কাছে একটি আবদার করেছিলো। আবদারটি নিজের জন্য নয়, আবদারটি তিমিরের জন্য। যে চোরাবালিতে তিমির জড়িয়েছে সেই চোরাবালি থেকে মুক্তি দেবার ক্ষমতা সুরভীর ছিলো না। যদি কারোর থেকে থাকে সেই মানুষটি তুরান। কিন্তু মানুষটির জেদ প্রচন্ড, জেদ একবার মস্তিষ্ক ঘিরে ধরলে তাকে বোঝাবার সাধ্য কারোর নেই। তিমিরের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে। জেদের কারণেই তিমিরের সকল বিষয়ে উদাসীনতা তুরানের। সে হাজারবার বারণ করেছে, বারবার বুঝিয়েছে, “না বুঝে নিজেকে কোথাও জড়িয়ে ফেলিস না। টাকা জিনিসটা আয় করা সহজ, কিন্তু সৎভাবে আয় করা দুষ্কর”

কিন্তু তিমির শুনে নি, অজান্তেই একটি চোরাবালির কবলে পড়ে গেছে। তুরানের চাকরির সুবাদে ভালো ভালো স্থানে যোগাযোগ রয়েছে। ফলে এই চক্র থেকে তাকে বের করার উপায় এই লোকটি ঠিক খুঁজে নিতে পারবে। আবদার যেহেতু রেখেছে এখন পালা সুরভীর, তুরানের আবদার রাখার_______

******

তুরানের সম্মুখে নতমস্তক দাঁড়িয়ে আছে তিমির। স্কুলে পাঁজি ছেলেটি যখন বিশাল বড় দোষ করে স্যারের মা/রের ভয়ে কাচুমাচু হয়ে থাকে তখন তার মুখভাবের যে হাল থাকে তিমিরের অবস্থা তার চেয়ে একাংশেও ভালো নয়। সে ভয়ে শিটিয়ে আছে। না জানি ভাইয়ের মুখ থেকে কি বের হয়! অবশ্য কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা তাকে অবাক ই করেছে। সে ভেবেছিলো সে ফেসে গেছে। কালাপানির ভেতর ই তাকে কাটাতে হবে বাকিটা জীবন। কিন্তু তাকে অবাক করে আবদুল্লাহ কেবল ই ভেতরের কথাগুলো জানতে চাচ্ছিলো। তার সাথে কোনো প্রকার খারাপ আচারণ করা হয় নি, অথচ তার বন্ধু বিশালকে যেভাবে থার্ড ডিগ্রী দেওয়া হয়েছে তা বর্ণনাতীত। বন্ধুকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছিলো না তিমিরের। যতই হোক ছেলেটি তার ছেলেবেলার বন্ধু। যে বন্ধুর সাথে আম চুরি করার কিচ্ছ্যা রয়েছে তাকে মার খেতে দেখা যায় না। অবশেষে বিশাল মুখ খুলেছে। মারের ভয়েই হোক সে সব বলে দিয়েছে পুলিশকে। এই ইয়াবার কাঁচামালের সাথে তার সম্পর্কটি নেই বললেই চলে। সে কেবল ই ক্রেতার সাথেই কথা বলতো, অর্ডার নিতো। হ্যা, এ অবশ্য ঠিক সে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি জানতো। শুধু অর্থলোভ আজ তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। অথচ তিমির এসবের কিছুই জানতো না। যখন জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলো, এস.আই আবদুল্লাহ স্মিত কন্ঠে বললো,
“আপনাকে কিন্তু আবারো ডাকতে পারি। আশাকরি আমাদের সাহায্য করবেন। এই কেসটা অনেক জরুরি। আপনার মতো অনেক তরুনকে এভাবে বেআইনি কাজে জড়িয়ে ফেলা হয়। আর আপনাদেরও বলিহারি টাকার লোভে এতোই অন্ধ হয়ে যান যে একটি বার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক অবধি করেন না। ভাগ্যিস আপনার ভাই আমাদের জানিয়েছিলো। নয়তো এই চক্রকে ধরা যেতো না”

ভাইয়ের কথা শুনতেই নিভে গেলো তিমির। বুঝতে রইলো না কেনো বিশালকে থার্ড ডিগ্রী এবং তাকে এতোটা জামাই আদর। এসব তুরান করিয়েছে। তুরান উকিলের সাথেও কথা বলে নিয়েছিলো তন্মধ্যে। সে উকিল সমেত ই সেখানে এসেছিলো। ফলে এবার বাড়ি ফেরার পালা।

তুরান গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। গম্ভীরতা অক্ষুন্ন রেখে শুধালো,
“কিছু বলার নেই তোমার?”
“সরি ভাইয়া”
“সরি শব্দটি আমার সহ্য হয় না, ভুল করে সরি করে হাত ধুঁয়ে ফেলা। আবার সেই একই ভুল। তোমাকে আমি বহুবার বলেছিলাম, টাকা আয় করা সহজ, কিন্তু সৎভাবে আয় করা দুষ্কর”
“মা যেভাবে শুরু করেছিলো………”
“নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে দিবে না তিমির, অতি বাজে কাজ। দোষটি তোমার, মায়ের নয়। মা তো চাইবেই তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত। এতে তার কি দোষ! বিয়ে করার সিদ্ধান্ত তোমার, পড়াশোনা সিঁকে তুলে চাকরি করার সিদ্ধান্ত তোমার; মাকে টানবে না এখানে”
“তুমি ই বলো আমি কি করতাম? আমার সন্তান আসছে পৃথিবীতে। আমার করার কি ছিলো? মায়ের কথামতো ওকে মে/রে ফেলতাম? নাকি স্বার্থপরের মতো তোমার উপর বোঝা হতাম? কোনো বাবাই চায় না তার সন্তান একটি অনিশ্চিত পৃথিবীতে আসুক। আমিও চাই না, আমি ওকে সুখের চাঁদরটি না দিতে পারি, একটুকরো সুখে মোড়ানো কাপড় তো দিতেই পারতাম”
“আজ যদি তোমাকে এই চক্রের কারণে জেলে পুরা হতো তাহলে তোমার সন্তানের ভবিষ্যত কি খুব নিশ্চিত হতো?”

তুরানের পালটা প্রশ্নে থমকে গেলো তিমির। উত্তর হাতরালো কিন্তু ব্যর্থ হলো। মৌন থাকলো সে। বুক কাঁপছে তার। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ভয়ে। সেই মূহুর্তে তুরান তাকে অবাক করে কাধে হাত রেখে বললো,
“আমি তোকে তখন ও বলেছি, আজও বলবো। তিনটে বাচ্চাকে পালতে যেহেতু আমার কষ্ট হয় নি, আর দুজনকে পালতেও কষ্ট হবে না। টানাপোড়েন তো চলবেই, না বলে কি নিজের জিনিসকে ফেলে দিবো?”
“ভাইয়া কিভাবে পারবে তুমি? সামনে যে অনেক খারাপ সময়। আজ অভিলাষা হাসপাতালে। টাকা ছাড়া কিভাবে সামনের দিন চলবে?”
“তুই পরীক্ষাটা ভালো করে দে। আমার উপর ছেড়ে দে বাকি টা”
“আমি কখনো ভাবি নি, তুমি আমাকে এভাবে চক্র থেকে বাঁচাবে”
“ভাবিস না তোর জন্য করেছি, হয়তো একদিন জেলেও রাখতাম তোকে। শুধু ওই মেয়েটি, মেয়েটি আমার কাছে প্রথম আবদার করেছে কিভাবে ফিরাই!”

তুরানের ঠোঁটে শান্ত হাসি। তিমির বুঝলো এ কার্য তার ভাবীর। কিছু বললো না, তবে আজও মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। যাবার সময় একটিবার দেখা করলো বিশালের সাথে। তার এক চোখ ফুলে উঠেছে। ঠোঁট ফেটে নির্গত রক্ত শুকিয়ে গেছে। বিষাক্ত ব্যাথায় গা ঝাঝরা হয়ে আছে। সে এখনো জেলের ভেতর। তিমির কাছে গিয়ে ধীর স্বরে বললো,
“তুই সাক্ষী হয়ে যা, দেখবি তোকে আর কিছু বলবে না”
“তোর মনে হয় ওরা আমাকে ছেড়ে দিবে? জেলে আছি ভালো আছি। তুই ও সাবধানে থাকিস, ওরা তোকেও ছাড়বে না………

চলবে

#নীড়_হারা_পাখি
#২৩তম_পর্ব

যাবার সময় তিমির একটিবার দেখা করলো বিশালের সাথে। তার এক চোখ ফুলে উঠেছে। ঠোঁট ফেটে নির্গত রক্ত শুকিয়ে গেছে। বিষাক্ত ব্যথায় গা ঝাঁঝরা হয়ে আছে। সে এখনো জেলের ভেতর। তিমির কাছে গিয়ে ধীর স্বরে বলল,
“তুই সাক্ষী হয়ে যা, দেখবি তোকে আর কিছু বলবে না”
“তোর মনে হয় ওরা আমাকে ছেড়ে দিবে? জেলে আছি ভালো আছি। তুই ও সাবধানে থাকিস, ওরা তোকেও ছাড়বে না”

বিশালের সতর্কবাণী মনোযোগ দিয়েই শুনল তিমির। কথাগুলো ফাঁকা ভয় নয়, তিমির জানে এমন কিছু হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এতদিনের একটু একটু করে বানানো প্রাসাদ এক ঝটকায় গুড়িয়ে পড়লো শুধুমাত্র তিমিরের জন্য, তার হিসেব তো দিতেই হব। ভয় যে করছে না তা নয়, ভয় করছে। প্রচণ্ড ভয় করছে। অস্থিমজ্জা অবধি সেই ভয়ের কম্পন অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা আছে; ভয়ের অস্তিত্ব ভয় পাওয়ার মাঝে, ভয় পাওয়া ছেড়ে দিলে সেই ভয়ের কোনো অস্তিত্ব থাকে না। তাই তিমির মৃদু হাসল। ধীর স্বরে বলল,
“আমার চিন্তা করিস না, ইনশাআল্লাহ আমার কিছু হবে না। তুই একটু সাহস করে দেখ, আর এই জালে আটকে থাকবি?”
“আম্মাকে বলিস আমার অপেক্ষা যেন না করে”

বলেই হু হু করে কেঁদে উঠলো বিশাল। নিস্তব্ধতায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার আর্তনাদ। একটি সন্তানের পক্ষে সেই সময়টা সর্বাধিক কষ্টের হয় যখন সে অনুভব করে সে তার মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে পারবে না। সে তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারবে না। বিশাল আজ সেই তিক্ত বেদনাটাই অনুভব করতে পারছে। সে আর নিজের মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারবে না। মা হয়তো এখনো ছেলের আধ-খাওয়া প্লেটটির দিকে চেয়ে রয়েছেন। নিঃশব্দে অশ্রুধারা বাহিত করছেন। যতই দোষী হোক না কেনো, সন্তান তো সন্তান ই। তিমির দাঁড়ালো না, বন্ধুকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা নেই আবার তার অশ্রুও ভালো লাগছে না। তাই সরে পড়াই শ্রেয়।

পুলিশ স্টেশন থেকে বের হতেই দেখল দুজন উকিল সমেত কোম্পানির ডিরেক্টর প্রবেশ করছেন। তার ছোট ভাইকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে ছাড়াতেই আসা বিধায়। তিমিরের মুখদর্শন হতেই কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তিনি। চোখাচোখি হল। তিমির পাশ কাটিয়ে যেতেই নিতেই ধীর রোষাগ্নি কণ্ঠে বলল,
“কাজটা ভালো হল না”

তিমিরের মনে হলও তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল রক্তের স্রোত। হিংস্র হায়েনার সম্মুখে নিরহ শিকারের বুকে যে ভীতির উপস্থিতি দেখা যায় তিমির ও সেই ভীতি অনুভব হলো। এর মাঝেই তুরানের ডাক কানে এলো,
“কি রে যাবি না? সুরভীরা অপেক্ষা করছে”

তুরানের কণ্ঠ ঔষধের মতো কাজ করলো। সূর্যের তীব্র এক ফালি কিরণ যেমন তমসার গাঢ়ত্বের মাঝে ছেদ করতে সক্ষম, তুরানের কণ্ঠ ও তিমিরের ভয়ের গাঢ়ত্বে ছেদ ঘটাল। মুহূর্তেই ভয় উবে গেলো। হিংস্র বাঘকে উপেক্ষা করেই এগিয়ে গেলো সামনে। ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলল,
“চলো”
“কি বলছিল ওই লোক?”
“ভয় দেখাচ্ছিল”
“ভয় পেয়েছিস?”

তিমির হাসলো। তার হাসির ভাষা তুরান ঠিক ই বুঝল। প্রতিত্তোরে সেও স্মিত হাসলো। গম্ভীর মানুষগুলোর হাসি হয় সুন্দর, নদীর স্নিগ্ধ লহরের ন্যায়। তুরানের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। তিমির গম্ভীর বড়ো ভাইয়ের হাসি দেখল অনিমেষ নয়নে। তারপর যাত্রা করলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। সেখানে যে তার প্রেয়সী অপেক্ষায় রয়েছে।

*****

রিসিপশনের সামনে বসে রয়েছে সুরভী। তার মুখখানা মিয়ে আছে। অভিলাষার ডিসচার্জের কাগজ তৈরি করতে যেয়ে বেশ বিপাকে পড়লো সে। বিল হয়েছে হাজার পাঁচেক। কিন্তু তার কাছে সেই টাকাটি নেই। বাসা থেকে বের হবার সময় হাজার খানেক টাকা নিয়ে বেরিয়েছে। মাথায় ও ছিলো না হাসপাতাল মানেই খরচের ভার। সুরভী দাঁত দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটখানা কামড়ালো। বুঝে উঠতে পারছে না টাকাটা কিভাবে দিবে। এদিকে তুরান ও আসে নি। পেপার তো বানিয়ে ফেলেছে এখন সেটা তো বাতিল করা যাবে না। বাতিল করলে আরেকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে অভিলাষাকে। কিন্তু এতে লাভের লাভ হবে না। বরং খরচা বাড়বে। সুরভীর স্বভাব বরাবর ই সাশ্রয়ী স্বভাবের মেয়ে। প্রতিমাসে কিছু কিছু করে সে জমায়। একটা অংশ তুলিকার চিকিৎসা, একটি অংশ এমনিই। সে বার যখন তিমিরের এক্সিডেন্ট হলো সেই জমানো টাকাটাই তুরানের হাতে তুলে দিয়েছিলো সে। আজও অন্যথা হয় নি। তুরান যখন তিমিরের জন্য পুলিশ স্টেশনে যাচ্ছিলো সুরভী তার জমানো টাকা তার হাতে তুলে দিয়েছে। ফলে এখন তার কাজে ডিসচার্জ করার মতো টাকা তার কাছে নেই। রিসিপশনে বসা পুরুষটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুরভীর দিকে। মহিলা হন্তদন্ত হয়ে ডিসচার্জ পেপার তৈরি করতে বলেছেন। অথচ এখন বিলের কাগজটির দিয়ে তাকিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছেন। কি অদ্ভুত! পুরুষটি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ম্যাডাম টাকাটা, বিল না দিলে পেপার আমরা পাঠাবো না। প্রসেসিং এ আধা ঘণ্টা লাগবে।”
“কত টাকা হয়েছে?”

রোদ্দুরের কণ্ঠ শুনতেই চমকে উঠলো সুরভী। তার চিন্তার পরদে ছেদ পড়লো। পাশে তাকাতেই দেখল ছেলেটি তার ব্যাংকের কার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সুরভী কিছুটা বিব্রত হলো। অপ্রস্তুত এবং লজ্জিত কণ্ঠে বলল,
“একি তুমি টাকা দিচ্ছো কেনো?”
“টাকাই তো ভাবি, আপনি দিন বা আমি একই কথা। অভিলাষার যা অবস্থা ছিলো তাতে টাকাটা না আনাই স্বাভাবিক”
“না না, তোমার ভাই আসছেন উনি ই টাকা দিবেন। ঋণী করো না রোদ্দুর”
“ঋণী করার ইচ্ছে থাকলেও তা হবার নয়। যার কাছে আমার মূল্যবান সম্পদ গচ্ছিত সে সামান্য পাঁচ হাজার টাকার জন্য ঋণী হবে না ভাবি। একই জায়গায় যাবো, বাড়ি যেয়ে না হয় দিয়ে দিবেন।”

স্মিত কণ্ঠে কথাটা বলল সে। তারপর কার্ড দিয়ে বিল চুকিয়ে দিলো। সুরভীর বেশ লজ্জা লাগছে। সে জানে ছেলেটি কোন মূল্যবান সম্পদের কথা বলছে। অথচ সে চাইলেও সেই সম্পদ তাকে দিতে পারবে না। ফলে ধীর কণ্ঠে বলল,
“সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু এর বিনিময়ে আমাদের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয় রোদ্দুর”
“জানি ভাবি, চিন্তা করবেন না। আমি কিছুর বিনিময়ে কিছুই করছি না। শুধু একটা আবদার, ওকে বলবেন একটু বারান্দায় আসতে। তৃষ্ণার্ত চোখজোড়া প্রতীক্ষায় থাকে”

বলে ছেলেটি পা বাড়াল করিডোরের দিকে। সুরভী উত্তর দিলো না। তুলিকা সেদিনের পর থেকে একটি বার রোদ্দুরের সামনে যায় নি। যে মেয়েটির বিকাল কাটতো বারান্দায় অবেলার আকাশের পানে চেয়ে, সেই মেয়েটি এখন ঘর-বন্দি করেছে নিজেকে। তুলতুল মাঝে মাঝে বাড়ির সামনে এসে ঘেউঘেউ করে। কিন্তু মেয়েটি বের হয় না। নিজেকে আবারো চার দেওয়ালে আটকে ফেলেছে সে। মুক্ত আকাশের স্বপ্নটা বুঝি অন্দরমহলের সিন্দুকে আটকে রেখেছে অবুঝ মেয়েটি, অথচ এটুকু বুঝছে না রাজকুমার এখনো তার সম্মতির প্রতীক্ষায় রয়েছে, তার কাছেই যে আছে মুক্ত নীলাম্বর________________

********

পা টিপে টিপে কেবিনে প্রবেশ করলো তিমির। ক্লান্ত মেয়েটি এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। ক্লান্তি তার অবসন্ন চোখজোড়াই জানান দিচ্ছে। আলতো উষ্ণ পরশ গালে লাগলেই চোখ মেললো অভিলাষা। স্তব্ধ চোখজোড়া নিমিষেই টলমল করে উঠলো। শুষ্ক গোলাপী ঠোঁট কেঁপে উঠলো ঈষৎ। গদগদ মনটা ভারাক্রান্ত হল। কাঁপা স্বরে বলল,
“তুমি কি সত্যি এসেছো, নাকি এ শুধু আমার কল্পনা?”
“কি মনে হয়?”

মেয়েটি একমুহূর্ত অপেক্ষা করলো না। তিমিরকে জড়িয়ে ধরলো সে, বুকে মুখ গুজে অশ্রু ছেড়ে দিলো। কাঁপা স্বরে বলল,
“আমায় একবার বললে না কেন? আমি কি এতোটা অযোগ্য যে তোমার দুশ্চিন্তা ভাগ করে দিতে পারবো না? এতোটাই অযোগ্য কি আমি? আমি ঠিক বুঝেছিলাম তুমি কোনো বিষয়ে চিন্তিত। কতবার জিজ্ঞেস করলাম। উত্তর দিলে না। আমি কি এতোটাই অযোগ্য, এতোটাই ব্যর্থ?”

মেয়েটির অভিযোগী কথাগুলো চুপ করে শুনলো তিমির। শুধু তার কৃষ্ণ চুলে উষ্ণ অধর ছোঁয়াল। মেয়েটির চুলে একটি সুন্দর গন্ধ আছে। যা বেশ প্রশান্তি দেয় তিমিরকে। কিছুসময় মাঝে অভিমানের লহর ক্ষান্ত হলো, কান্নার বেগ কমল। এখনো ফুপাচ্ছে মেয়েটি। তিমির এবার দুহাতে কোমল গাল ছুঁলো। মুখখানা একটু তুললো। দু চোখে অধর ছোঁয়াল। তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“তুমি নও, আমি অযোগ্য। আমি ব্যর্থ। তোমার স্বামী হিসেবে, আমাদের সন্তানের পিতা হিসেবে। আজ ভাই না থাকলে আমার কি হত জানা নেই। ভাবতেই বুক কাঁপে। ভয় হয়। দেখো না, আবার মুখ থুবড়ে পড়লাম। আবার তোমাকে কটুক্তির বান সইতে হবে। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাকে কুয়ো থেকে বাঁচাতে গিয়ে অথৈ সমুদ্রে ফেলে দিয়েছি। আমি কখনোই তোমাকে অযোগ্য ভাবি নি, শুধু তোমাকে চিন্তিত করতে চাই নি। এই দেখো না আজ আমার জন্য তোমার আর বাবুর কত বড় অঘটন ঘটতে গিয়েছিলো। কতটা অপদার্থ আমি বল, নয়তো কে নিজের গর্ভবতী স্ত্রীকে এতোটা টেনশন দেয়? আমি আবার বেকার হয়ে গেছি অভিলাষা। আমি সত্যি বুঝছি না সামনে কি হবে? খুব অসহায় লাগছে”

তিমিরের কন্ঠে আক্ষেপের রেষ। পরাজিত সৈনিকের মত সে তার অপরাগতা স্বীকার করছে। অভিলাষা শুধু চেয়ে রইলো। সান্ত্বনা দেবার ভাষা নেই। ভুল তো মানুষটার নয়। অজান্তেই দূর্বলতা হওয়া, পায়ের শিকল হওয়ার কাজটি সে করেছে। এখন আরোও একজন ও সামিল হয়েছে। তাদের দুজনের জন্যই আজ হন্নে হয়ে চোরাবালির মতো একটা ফাঁদে পা দিয়েছিলো তিমির। অভিলাষা মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলো। খুব কঠিন সিদ্ধান্ত।

******

সব ফর্মালিটি শেষ করে অবশেষে বাড়ি ফিরলো অভিলাষা। সূর্য তখন মাথার উপরে। বিক্ষিপ্ত তেজী রশ্নিতে শীতের প্রকটতাকে হার মানিয়ে নিজেকে জাহির করছে সে। সিএনজি থেকে নেমে তিমির এবং সুরভী অভিলাষাকে ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে গেলো। শফিক সাহেব ছেলে এবং ছেলের বউ বাড়ি ফেরায় বেশ খুশি। ভারী কন্ঠে হিমা বেগমকে ডাকতে ডাকতে প্রবেশ করলেন তিনি,
“হিমা, হিমা, দেখো আমরা এসেছি”

এদিকে রোদ্দুর এবং তুরানের মুখ দেখা গেলো গম্ভীর। তুরান ফাঁকে রোদ্দুরের সাথে কথা বলতে তাকে আলাদা করে নিয়ে গেলো। কি কথা হলো জানে না সুরভী। জিজ্ঞেস করেছিলো একবার। কিন্তু গম্ভীর মানুষটা কাঠকাঠ কন্ঠে বললো,
“পুরুষদের মধ্যের কথা মহিলাদের জেনে কি লাভ?”

কথাটা আঁতে লাগলো। তাই দ্বিতীয়বার শুধালো না। তুরান ও বলল না কিছু। রোদ্দুর সরাসরি নিজের বাসার নিয়ে পা বাড়ালো। শুধু একবার দক্ষিণের নির্জন বারান্দাটির দিকে চাইলো। ভেবেছিলো বোকা মেয়েটির দর্শন বুঝি পাবে। কিন্তু হায় প্রেমিক! প্রেয়সী যে নিজেকে আটকে রেখেছে___

বাড়ির কলিংবেল চাপতেই দরজা খুললেন শেফালী বেগম। ছেলের অবসান্ন মুখখানা দেখেও উপেক্ষা করলেন। বরং প্রশ্ন করলেন,
“আজ হাসপাতালে যাও নি?”
“না”
“কেনো?”

মায়ের এমন প্রশ্নে কিছুটা বিরক্ত হলো রোদ্দুর। জুতা না খুলেই মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। অবাক স্বরে বললো,
“ইচ্ছে হয় নি, এতো প্রশ্ন কেনো করছো?”
“অদ্ভুত, আমার কাজ পাগল ছেলে হাসপাতালে যাবার কথা বলে বের হলো অথচ চারঘন্টা পর ঘরে ফিরে এলো, জিজ্ঞেস করবো না?”
“না করবে না। কারণ আমি তোমার বাচ্চা ছেলেটি নই”
“এটাই সমস্যা। তুমি আমার বাচ্চা ছেলেটি নও। এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছো। এখন আর মার কথার দাম থাকবে কেন?”

মায়ের কথার মর্মার্থ খুব ভালো করেই বুঝলো রোদ্দুর। জুতো খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে। তবে যাবার পথে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“অহেতুক নাটক করো না মা, তোমার ওই পছন্দের পাত্রীকে আমি দেখতে যাচ্ছি না”
“এখনো তুমি ওই পাগলিতেই পড়ে আছো? ওই মোহ ছাড়ো নি?”
“আমি তুলিকার মোহতে জড়াই নি, আমি প্রতিনয়ত ওর প্রেমে পড়ি। তাই মোহ ছাড়া বা না ছাড়ার প্রশ্নটাই অবান্তর।“

বলেই নিজের ঘরে চলে গেলো সে। এদিকে শেফালী বেগমের মুখে ফুটে উঠলো রাজ্যের অসন্তোষ। তার মুখ হয়ে উঠলো কঠিন। তিনি জলদি ফোন হাতে নিলেন। অপাশ থেকে রিসিভ করতেই বললেন,
“তুমি একটু তাড়াতাড়ি আসো”

ঘরে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোদ্দুর। নিস্তব্ধ ঘরটার শুন্যতা ভালো লাগছে না। হাসপাতালে গেলে হয়তো ভালো লাগতো। রবিন ভাই এর সাথে একটু খোঁচাখুঁচি করে সময় কাটতো। শতরঙ্গায় রঙ্গিন রোগীগুলোও তাকে প্রশান্তি দিতো। কিন্তু ইচ্ছে হলো না। এই ইচ্ছে নামক জিনিসটি খুব অদ্ভুত। হুটহাট করে এই ইচ্ছে নামক দোয়ারটি নিজের গায়ে তালা দিয়ে দেয়। ফলে তখন চাইলেও কোনো কাজে মন বসানো যায় না। আজ রোদ্দুরের ও কিছু ইচ্ছে হচ্ছে না। জ্যাকেটটা খুলে টেবিলে বসলো সে। মনোরোগবিদ্যার বইগুলোর ফাঁকথেকে একটি বাদামী রঙের ডাইরি বের করলো। পাতা উল্টোতে উল্টোতে একটি ছবি বেরিয়ে এলো। অনিমেষ চোখে দেখলো রোদ্দুর। হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রীটি হৃদয় কম্পিত করলো। আলতো হাত ছুঁয়ে দিলো ছবির স্তব্ধ রমনীর গোলাপী ওষ্ঠ। তারপর একটি কলম হাতে নিলো, গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো,

“তুমি পাষান মায়াবন বিহারিনী………
কেন এলে চৈত্রের শেষে, বুকের উচাটনে?
কেন এলে হীম শীতে, হৃদয় কাপাতে?
কেন এলে বুকের ভেতর সাইরেন বাজিয়ে!
লোমশ বুকের কম্পন হয়ে!
তুমি জানো, প্রেয়সী! বুকের উচাটনে শুধুই তুমি।
কীট যেমন ফুল কেটে ছেটে, ফুলের ভেতর প্রবেশ করে,
তুমি তেমনি প্রবেশ করলে আমার এ হৃদয়ে।
বুকের ভেতর তীব্র ব্যাথা হয়, প্রেয়সী।
তুমি কেন এত উদাসী?
সম্ভিত ফিরাও, তৃষ্ণা মিটাই দৃষ্টির,
তুমি কেন এলে হয়ে অনাবৃষ্টি।
উত্তরের হীমবাহ, পূবের রূপোলী আলো,
তুমিহীনে আমি বড্ড অগোছালো।
হাত ধরবে? পথ হাটবো বিস্তীর্ণ এ পথে,
থাকবে কি তুমি রাতের নিশাচরী হয়ে?
প্রেয়সী! ব্যাথা কেন দাও, বুকে?
তুমি আছো, মাথা রাখো শুনে নাও কম্পনে! (জান্নাতুল মিতু)

লিখতে লিখতে থেমে গেলো কলম। প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাস বের হলো অচিরেই। হায় অবুঝ প্রেয়সী যদি বুঝতো!

**********

ডা. প্রতাপের চেম্বারে বসে রয়েছে তুরান। গতকাল সে এবং সুরভী এখানে এসেছিলো। তার আবদার স্বরুপ ডাক্তারের সাথে আসতে বাধ্য হয়েছে সুরভী। প্রথম গাইগুই করছিলো বটে, কিন্তু তুরানের জেদের কাছে হার মানলো। ডা. প্রতাপ সুরভীর সকল লক্ষন শুনলেন। তার প্রথম প্রশ্ন ছিলো,
“প্রেগন্যান্সি টেস্ট করিয়েছেন?”

প্রশ্নটায় দম্পতি বেশ অপ্রস্তুত হলো। যাদের মাঝে অদৃশ্য দেয়াল টানা সেখানে দৈহিক সম্পর্কের অবকাশ নেই। ফলে এই প্রশ্নটি অবান্তর। সুরভী কিঞ্চিত হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। তারপর বললো,
“জি না”
“ওটা আগে করান। আমার মনে হচ্ছে আপনি প্রেগন্যান্ট। আরোও কিছু টেস্ট দিচ্ছি। দেখা যাক কি হয়”

প্রতাপের কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি বিস্তার পেলো সুরভীর ঠোঁটে। আজ টেস্টের রিপোর্ট এসেছে। তাই তো তুরান এসেছে। সুরভীকে আনতে চেয়েছিলো। কিন্তু সে আসবে না। অভিলাষা বেড রেস্টে আছে। এই রিপোর্ট দেখানোর নামে সে সময় নষ্ট করবে না। ফলে একাই আসতে হলো তুরানকে। রিপোর্টগুলো সুক্ষ্ণভাবে দেখছেন প্রতাপ। সব দেখে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন তিনি। তারপর শান্ত কন্ঠে বললেন,
“আপনাকে একটু শক্ত হতে হবে তুরান সাহেব…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি