নীড় হারা পাখি পর্ব-২৪+২৫

0
287

#নীড়_হারা_পাখি
#২৪তম_পর্ব

রিপোর্টগুলো সুক্ষ্ণভাবে দেখছেন প্রতাপ। সব দেখে দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন তিনি। তারপর শান্ত কন্ঠে বললেন,
“আপনাকে একটু শক্ত হতে হবে তুরান সাহেব”

প্রতাপের কথা শুনতেই খানিকটা খটকা লাগলো তুরানের। তার চোখে মুখে ভেসে উঠলো নির্বাক উৎকন্ঠা। একটু নড়ে চড়ে বসলো সে। কিছু সময় কাটলো নিস্তব্ধতায়। হৃদয়ের ভেতরে অজানা কালবৈশাখী ঝড় বিনা নোটিশেই এলোমেলো করে দিচ্ছে মন্থর মনের গতি। কিঞ্চিত বিচলিত কন্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে ডাক্তার? খারাপ কিছু?”
“খুব খারাপ নয়, তবে খুব ভালোও নয়। সুরভীর আল্ট্রাসোনোগ্রাফি বলছে তার জরায়ুতে টিউমার হয়েছে। এটাকে মায়োমা বা ফাইব্রয়েড বলা হয়। মেয়েদের এই টিউমার হবার একটি সম্ভাবনা থাকে। এটা খুব ক্ষতিকর নয়। ক্যান্সার হবে এমন চান্স নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটো সমস্যা হয়ে পারে, এক. মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত, ফলে রক্তশূন্যতা। আর দুই. বন্ধ্যাত্ব। সুরভীর টিউমার একটি নয়, বরং তিনটি। আকারেও সেগুলো খুব বড় হয়ে গেছে। সুরভীর এই দূর্বলতা, গায়ে ব্যাথা, অরুচি এই সময় কিছু ওর রক্তশূন্যতার জন্য হচ্ছে। ওর হিমোগ্লোবিন কিন্তু কম। তাই আমার মতে অপারেশন করাটা বেটার হবে। তবে যে পজিশন রয়েছে তাতে জরায়ু কেটে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের হবে। ফলে দ্বিতীয় সমস্যাটি হবে। মা হবার সুযোগহারা হবে সে। তাই ডিসিশন তোমাকে নিতে হবে। যদি টিউমার সংখ্যা কম হতো তাহলে জরায়ু ফেলে দেবার প্রশ্ন আসতো না। কিন্তু এখন আসছে”

প্রতাপের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তুরান। তার চোখজোড়া নিষ্প্রাণ লাগছে, ঠিক যেনো পরাজিত সৈনিক। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে সে। প্রতাপ শান্ত কন্ঠে বললো,
“তোমার মনোস্থিতি বুঝতে পারছি, কিন্তু এছাড়া বোধকরি উপায় নেই”
“মেয়েটির যে বাচ্চার খুব শখ, ছোট্ট একটি পরিবার। সে, আমি আর একটি তুলতুলে প্রাণ। বিশাল পৃথিবীর মাঝে আমাদের ছোট্ট পৃথিবী। এতোদিন আবার অনীহায় সেই স্বপ্ন পূরণ হয় নি, তবুও আশার কিরণ তো ছিলো। সেই ঠুঙ্কো আশায় প্রহর গুনতো। এখন সেই আশাটিও ম রে গেলো। আমি কি করে ওকে বলবো? ও রাজি হবে না”

নিষ্প্রভ কন্ঠ কথাগুলো বললো তুরান। তার কন্ঠ দলা পাঁকাচ্ছে। প্রতাপ তার চশমাটা খুললো। বা হাতে চোখের কোন চেপে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার ধীর স্বরে বললো,
“টিউমার গুলো রাখা বুদ্ধিমানের হবে না। অলরেডি রক্তশূন্যতায় ভুগছে সুরভী। অবস্থা আরোও খারাপ হলে আমাদের হাতে উপায় থাকবে না। ওকে রাজি করাও। বলতে গেলে ওর ভাগ্যটা খারাপ। সাধারণত আশি শতাংশ মানুষের এমন কোনো ইস্যু হয় না। কেউ কেউ তো টিউমার নিয়েও গর্ভধারণ করেছে। কিন্তু ঐ যে, আমাদের হাতে কিছুই নেই। ভাগ্য নামক নির্মম নির্মাতার কাছে সবাই ধরা। সেই নির্মিত চলচিত্রে আমরা সবাই কাঠের পুতুল, সবাই দড়ি একজনের হাতেই। তিনি ই পূর্বনির্ধারিত করে রেখেছেন কখন কি হবে”

তুরান উত্তর দিলো না। উঠে দাঁড়ালো সে। খুব ক্লান্ত লাগছে। চোখজোড়া জ্বলছে। এমন তো কখনো হয় নি। খুব কঠিন সময়েও সে শক্ত ছিলো। প্রাচীর হয়ে আগলেছে সবাইকে। আজকেই মনে হচ্ছে প্রাচীরটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে পড়ছে। পাথর অনুভূতিহীন মানুষটার হৃদয় আজ টলমল করছে। নিষ্ঠুর হৃদয় তবে সত্যিই ভালোবাসতে শুরু করেছে। সত্যিই সেই নির্জীব, মৃত হৃদয়জমিনে প্রেমপুষ্পের বীজ রোপিত হয়েছে, শুধু সমইয়ের হিসেবটা গুলিয়ে গেছে। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নীলাম্বরের দিকে চাইলো তুরান। দক্ষিণকোনে কাল উপেক্ষা করে কালো মেঘের দল সতেরো বছরের কিশোরীর মতো গাল ফুলিয়ে বসে রয়েছে। আজ বোধ হয় বৃষ্টি হবে______________
******

মাঘ মাসে বৃষ্টি খুব ই দূর্লভ ঘটনা। মাঘের শীত বাঘের গায়ে লাগে। সে তীব্র ভয়ংকরী হিম শীতের ঝুমঝুমে সন্ধ্যাটি যদি বৃষ্টিস্নাত হয়ে তবে শীতের প্রকোটতা কতটা বাড়ে সেই অনুমান করতে পারছে না তিতির। থেকে থেকে হীম বাতাসে নাকখানা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। হাতে হাত ঘষেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। একটু আগে বের হলে এখন বাসায় চলে যেতে পারতো, কিন্তু শফিক স্যার আজ একটি দেরী করে ফেললেন। রসায়নের বিক্রিয়া বুঝাতে বুঝাতে তিতিরের বাসায় যাবার ক্রিয়ায় পানি পড়ে গেলো, পানি নয় পানি নয়, বৃষ্টির শীতল পানি। তিতির এদিক ওদিক দেখলো, একটি রিক্সার টিকিও দেখতে পাচ্ছে না। সমস্যা হলো, এই গলির জায়গাটায় রিক্সা পাওয়া যায় না। ফলে হেটে অনেকটা পথ যেতে হয়। তার উপরে যদি বৃষ্টি হ্য তবে হেটে যাবার ও উপায় থাকে না। উপায়ন্তর না পেয়ে একটি চায়ের দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে তিতির। হীম বাতাস বারবার তাকে অর্ধভেজা শরীরে কম্পন তৈরি করছে। এর মাঝেই লিটনের বাইক থামলো দোকানের সামনে। তড়িৎ গতিতে লিটন লামলো। ফ্যাঁসফেঁসে কন্ঠে বললো,
“মামা দুটো বেনসন দাও তো?”
“বেনসন নাই মামা”
“তাইলে গোল্ডলিফ দাও”

লিটনের কথাটা শেষ হবার আগেই বাইকে বসা কাকভেজা সৌভিক বললো,
“এই আমি গোল্ডলিফ খাবো না। তুই খা, আমার জন্য আদা চা বল”

তিতির চোখমুখ কুঁচকে তাকালো যুবকের দিকে। আদ্যোপান্ত ভিজে চুবচুবে হয়ে আছে। হেমমেটহীন মানুষটির ভেজা চুলগুলো কপালের উপর বড্ড অবহেলায় পড়ে আছে। মোটা কালো জ্যাকেটটির উপর পানির উপস্থিতি। হাতজোড়া ঝাড়া দিয়ে বা হাতে ভেজা চুল গুলো টেনে পেছনে নিলো। শ্যাম মুখশ্রীটা মুছলো একটি রুমাল দিয়ে। কিন্তু কাজে দিলো না। কারণ সেটিও ভেজা। তারপর হাত ঘষতে ঘষতে এসে দাঁড়ালো তিতিরের পাশে। এতো জায়গা থাকতে তার তিতিরের গায়ের কাছেই ঘেষে দাঁড়াতে হলো। ফলে মেজাজ তিরিক্ষি হলো তিতিরের। একটু সরে দাঁড়ালো তিতির। একেই বৃষ্টির ছিটা ক্রমশ গায়ে আঁছড়ে পড়ছে। সোয়েটারটা কেমন ভেজা ভেজা হয়ে গিয়েছে। তার মাঝে এই লোকের অ”স”ভ্য”তা। তিতিরের মাঝে অস্থিরতা দেখা গেলো। কিন্তু সেই অস্থিরতা বাড়লো যখন পাশে দাঁড়ানো বিরক্তিকর মানুষটি তার ওড়না নিয়ে নিজের মাথা মোছা শুরু করলো। রীতিমতো তব্দা খেলো তিতির। কন্ঠস্বরে চরম বিস্ময় নিয়ে শুধালো,
“কি করছেন?”
“মাথা মুছছি। দেখছো না ভিজে গেছি”

নিতান্ত ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো সৌভিক। যার ফলে মেজাজ আরোও বিগড়ালো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“এটা কোন ধরনের অ”স”ভ্য”তা?”
“এটাকে পরোপকারীতা বলে। একটা অসহায় ভেজা মানুষকে নিজের ওড়ণা দিয়ে সাহায্য করাটা তোমার নৈতিক দায়িত্ব। ভাবো, এখন তোমার শুকনো ওড়ণাটা দিয়ে মাথা মুছলে তোমার কি কোনো ক্ষতি হচ্ছে? তোমার কি কিছু যায় আসবে? উত্তর না আসবে না। এমনিও তোমার ওড়ণা ভিজবে ওমনিও। কিন্তু এখন ভাবো, আমি যদি মাথা না মুছি তাহলে কতোটা ক্ষতি হবে! আমার মাথা ভেজা থাকবে, জ্বর আসবে, নিউমোনিয়া হতে পারে, শ্বাসকষ্ট হবে, আমাকে হসপিটালে ভর্তি হতে হবে, আইসিউতে এডমিট করবে। একটা সময় আমি মারা যাবো। সেটা কি খুব ভালো হবে? তুমি ই বলো কোনটা ভালো? তোমার ওড়ণাটা একটু ভেজা নাকি আমার মারা যাওয়া?”
“আমার ওড়ণা না দিলে আপনি মারা যাবেন?”
“যেতেও পারি। বলা তো যায় না। তখন আন্দোলন হবে, মানুষের শোকসভা হবে, নিউজ হেডলাইন হবে, “কঠিন হৃদয়িনীর পাষাণ কার্যে নিরীহ যুবকের মৃত্যু”।”

তিতির বেকুবের মতো চেয়ে রইলো। এই লোক কোথা থেকে কি বলছে! তিতিরের হতবাক দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই সৌভিক তার কাজ সম্পাদন করলো। ইতোমধ্যে লিটন আদা চা নিয়ে হাজির হলো। ভেজা ঠোঁটে উষ্ণ চায়ের চুমুক দিয়েই দৃষ্টি দিলো ঝুমঝুমে বৃষ্টিস্নাত সন্ধাভেজা গলিতে। ঠোঁটে কোমল হাসি ফুটিয়ে বললো,
“আমি মরে গেলে তুমিও খুব একটা খুশি হবে না। যদিও মনে মনে ভাবছো, মরলে আপদ বিদেয় হবে। কিন্তু বাস্তবে তা কিন্তু নয়। আমি কিন্তু তোমার অভ্যাস হয়ে গেছি। বড্ড বাজে অভ্যাস। তুমি এখন চাইলেও আমাকে না দেখে থাকতে পারবে না”

কথাখানা শুনেই চমকে উঠলো তিতির। চোখজোড়া বিস্ফারিত হলো। বিড়বিড় করে বললো,
“মোটেই না”

বলেই ব্যাগটা মাথায় নিয়েই পা বাড়ালো তিতির। অসহ্য লোকটার পাশে দাঁড়াবে না সে। এর মাঝেই কানে এলো,
“সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা
তোমার বেলায় নেব সখি তোমার কানের সোনা
সখি গো, আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি
তোমার কাছে পয়সা নিব না”

পায়ের গতি বাড়ালো তিতির। ভিজে যাচ্ছে তার দেহ। সেই সাথে বৃষ্টির বেগ বাড়লো। বৃষ্টির দাপটে ঝাপসা হতে লাগলো সৌভিকের কন্ঠ। কিন্তু রেশ এখনো কানে লেগে আছে, এখনো মনে হচ্ছে কাকভেজা যুবক চায়ে চুমুক দেওয়া ছেড়ে শুধু তার যাবার পানেই চেয়ে রয়েছে আর গান গাইছে_____________

********

ঘড়ির দিকে একবার তাকালো সুরভী। এগারোটার বেশি বাজে। অথচ এখনো ঘরে ফিরে নি তুরান। আজ তার এতো দেরি হবার কথা নয়। তবুও দেরি হচ্ছে কেনো বুঝতে পারছে না সুরভী। বিছানায় এলোমেলো হয়ে থাকা শুকনো কাপড়গুলো গুছিয়ে আলমারীতে তুলে রাখলো। বাসার সবার খাওয়া শেষ। শুধু সেই খায় নি। তুরান এলে খাবে। তুলিকা বেশ কবার জিদ করছিলো, কিন্তু সে শুনে নি। মানুষটাকে ছেড়ে খেতে ভালো লাগছিলো না। তুরানকে ফোন করার জন্য ফোন হাতে নিতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। তড়িৎ গতিতে দরজা খুলতেই দেখলো তুরান দাঁড়িয়ে আছে তার কাপড় অবিন্যস্ত। এলোমেলো শার্ট, চুল গুলো উশখোখুশখো। সুরভী কিছু বলার আগেই সে নিঃশব্দে নিজ ঘরে চলে গেলো। সুরভী দরজা আটকে তার পিছু গেলো। নরম গলায় বললো,
“আজ দেরী হলো কেনো?”

উত্তর দিলো না তুরান। ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখেই ধপ করে বসলো বিছানায়। এই প্রথম তুরানকে বেশ অন্যরকম ঠেকলো সুরভীর কাছে। সুরভী তার কাছে যেতেই হাতখানা খপ করে ধরলো। মাথা ঠেকালো সুরভীর বুকে। তারপর দুহাতে বেশ শক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো তাকে। সুরভী কিছু বলার আগেই বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও”……………

চলবে

#নীড়_হারা_পাখি
#২৫তম_পর্ব

সুরভী দরজা আটকে তার পিছু গেলো। নরম গলায় বললো,
“আজ দেরী হলো কেনো?”

উত্তর দিলো না তুরান। ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখেই ধপ করে বসলো বিছানায়। এই প্রথম তুরানকে বেশ অন্যরকম ঠেকলো সুরভীর কাছে। সুরভী তার কাছে যেতেই হাতখানা খপ করে ধরলো। মাথা ঠেকালো সুরভীর বুকে। তারপর দুহাতে বেশ শক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো তাকে। সুরভী কিছু বলার আগেই বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও”

তুরানের কথাটা কেমন যেনো ঠেকলো। আক্ষেপ, অপরাধবোধের মিশ্রিত কন্ঠটি কোথাও যেনো আঘাত হানলো সংগোপনে। সুরভী অনুভব করলো তার দৃঢ় বন্ধনের হাঁসফাঁস। তার মনটা আকুপাকু করতে লাগলো নিমিষেই। ভালোবাসার মানুষটিকে এমন ভঙ্গুররুপে পূর্বে কখনোই দেখে নি। সর্বদা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আজ যেনো সর্বাধিক নিঃসহায়। কোমল হাতজোড়া আপনাআপনি রুক্ষ্ণ গালে চলে গেলো। তুললো আলতো করে। তুরানের মুখখানা তুলতেই থমকে গেলো সুরভী। ঝিলের ন্যায় শান্ত চোখজোড়ায় চিকচিক করছে নোনাজল। বিধ্বস্ত হয়ে গেলো যেনো অন্তরখানা। শান্ত মনসাগরে উঠলো ঝড়। বিচলিত স্বরে শুধালো,
“কিছু হয়েছে? ক্ষমা চাইছো কেনো? এমন তো তুমি নও। এতোটা উতলা, এতোটা ভঙ্গুর। আজ কি হয়েছে?”

তুরান নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুরভীর দিকে। মেয়েটির কোমল মুখের উদ্বিগ্নতা তাকে আরোও বেশি তলিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটির শান্ত চোখগুলো তার জন্য বিচলিত। খোঁপা থেকে খুলে আসা চুলগুলো কোমল মুখখানার মাঝে বাধা সৃষ্টি করছে। অথচ এই খোঁপাতেই বেধে রাখার কথা ছিলো রাজ্যের সুখ। চোখের নিচের ক্লান্তির ছাপের বদলে থাকার কথা ছিলো কালো কাজল। মেয়েটিকে সে শেষ করে দিয়েছে। সেই চুপচাপ, শান্ত, তুলতুলে মেয়েটিকে সে নিঃস্ব করে দিয়েছে। অথচ মেয়েটিকে তার আগলে রাখার কথা ছিলো। সুরভীর ক্লান্ত চোখগুলোয় আজও নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে তুরান। কথাগুলো বলতে ইচ্ছে হলো কিন্তু বলতে পারলো না। কিভাবে বলবে, “আমি তোমার স্বপ্নকে হ/ত্যা করতে চলেছি”। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো সে। ফলে টুপ করে গড়িয়ে পড়লো বিষাদের স্রোত। সেই স্রোতে উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিলো সুরভী। কোমল ওষ্ঠজোড়া ঠেকালো তুরানের চোখে। গভীর চুম্বন আঁকলো দুচোখে। তুরানের অশান্ত চিত্তে যেনো নিমিষেই শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো সেই স্পর্শ। ফ্যালফ্যালিয়ে যখন বিধ্বস্ত মানুষটি তাকালো, সুরভী স্মিত কন্ঠে বললো,
“সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। আঁধার তো আসবে, আঁধারের পড়েই তো সোনালী প্রভাত। ভয় কিসের?”
“আমার মতো অপদার্থের মাঝে কি খুঁজে পেয়েছো? আমি তোমাকে শেষ করে দিয়েছি সুরভী। কেনো আমাকে ছেড়ে যাও নি তুমি। সুখি হতে, খুব সুখি হতে।”
“আমার সুখের কেন্দ্রবিন্দু যে তুমি”
“এই মানুষটি আজ তোমাকে নিঃস্ব করে দিলো”
“মানে?”

তুরান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর অপরাধী কন্ঠে বলল,
“ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, রিপোর্ট চলে এসেছে তোমার”

নিরব ঘরটি নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে। চোখ থেকে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুমালা। সুরভীর অভিমানী চিত্ত আজ হাহাকারে লিপ্ত। আশায় বাঁচা আর নিরাশায় লিপ্ত হবার মাঝে রাত দিন তফাৎ। আশা মানুষের নিঃস্ব, নির্জীব, মৃতপ্রায় হৃদয়কে বাঁচার উদ্দীপনা দেয়। সেই আশাই যখন ম/রে যায় তখন বাঁচার শেষ ইচ্ছেটুকুও শেষ হয়ে যায়। সুরভীর ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটলো। এতোকাল, কোথাও একটি সুপ্ত আশা ছিল, একটা সময় তুরানের জিদের প্রাসাদ ভাঙবে। কিন্তু সেই জিদের প্রাসাদ ভাঙ্গার পূর্বেই সব শেষ হয়ে গেলো। সুরভী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর চোখ মুছতে মুছতে কঠিন স্বরে বলল,
“আমি কোনো অপারেশন করাবো না”
“জিদ করো না”
“আমি জিদ করছি না, আমার শরীর তাই সিদ্ধান্তটিও আমার।”

সুরভীর কন্ঠ কাঁপছে। তার মুখখানা অশ্রুসিক্ত কিন্তু কঠিন। তুরান গাল ফুলিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। সুরভীর সাথে আজ কোনো তর্কে জড়ালো না সে। বরং আলতো হাতে ছুঁলো তার অশ্রুসিক্ত কঠিন মুখখানা। অভিমানিনী মুহূর্তেই সরিয়ে দিলো তার হাত। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সে। তুরান তার তবুও জোর করে তার মুখখানা নিজের দিকে ফেরালো। কাতর কন্ঠে বললো,
“তুমি চাইলে আমাকে ঘৃণা কর, আমাকে বকো, মারো; কিন্তু নিজেকে নিয়ে অবহেলা কর না। আমার জন্য নিজের উপর এতোটা নিষ্ঠুর হয়ো না”

তুরানের চোখ টলমল করছে। কন্ঠ কাঁপছে। দলা পাকাচ্ছে অনুভূতিগুলো। সুরভীর অভিমানের বাধ ভাঙ্গলো। জোর গলায় বলল,
“কেনো হবো না, আমি নিষ্ঠুর হব। আমি চরম নিষ্ঠুর হব। তোমার ক্ষেত্রে সব খুন মাফ, আর বেলায় জেদ? এতো ভেদাভেদ কেন? আজ জিতে গেলে তুমি। এটাই তো চেয়েছিলে। এটাই হল। আমি কখনো মা হতে পারবো না। আজ সত্যি তুমি জিতে গেলে”

সুরভীর উত্তেজনা বাড়লো। শান্ত মেয়েটি আজ কোনো বাঁধা শুনবে না। তার সকল অভিযোগ অশ্রু রুপে ব্যাক্ত করছে সে। তুরান মাথা নত করে শুনলো সব অভিযোগ। টু শব্দ করলো না। কিন্তু নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না যখন সুরভী বলে উঠলো,
“আমি তোমার আর কোনো কথা শুনব না। আমি কোনো অপারেশন করাবো না। সবসময় বলতে না কেনো তোমায় ছেড়ে গেলাম না। যাও তোমার মনোকামনা পূরন হল। খুব তাড়াতাড়ি মুক্তির দোয়ার খুলবে”

কথাটা শুনতেই বিচলিত হয়ে উঠলো তুরান। জড়িয়ে ধরলো সে সুরভীকে বক্ষমাঝে। সুরভী যত নিজেকে ছাড়াবার প্রচেষ্টা করলো, তত বেশি সেই বন্ধন দৃঢ় হলো। সিক্ত কন্ঠে বললো,
“আমি নিঃসন্তান থাকতে পারবো। কিন্তু সুরভীহীন নয়। দোহাই লাগে”
“মিথ্যে বলছো তুমি, তুমি পাষান, হৃদয়হীন”

অবশেষে নিষ্প্রভ কন্ঠে বলে উঠলো সুরভী। কিন্তু তুরান তাকে ছাড়লো না। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“আমি মিথ্যে বলি না সুরভী। তোমার সাথে একেবারেই নয়”
“আমার “মা” শোনা হবে না তুরান। আমার যে খুব সাধ ছিলো একটি ছোট্ট প্রাণ আমার কোলে থাকবে। আমার সাথেই কেনো এমন হল, আমি কি মানুষটা খুব খারাপ? আমাকে কেনো শাস্তি দেওয়া হলো? আমি কি মা হবার যোগ্য নই?”
“কে বলেছে তোমায় তুমি মা হবার যোগ্য নও। যে মানুষটির মাঝে এতো মায়া, তার থেকে ভালো মা আর কে হতে পারবে? আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি নামক মানুষটার সাথে না জড়ালে খুব সুখী হতে তুমি”

সুরভীর কান্নার বেগ বাড়ল। তুরানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদলো সে। তুরানের চোখেও পানি চিকচিক করছে। সুরভী মাথা তুলে বাচ্চাসুলভ জিদ করে বললো,
“কোনো উপায় কি নেই? ডাক্তারদের কাছে তো উপায়ের শেষ নেই। উনাকে বলো না, আমাকে মাতৃত্ব থেকে বঞ্চিত না করতে”

সুরভী অশ্রুসিক্ত মুখখানায় অধর ছোঁয়াল তুরান। গাঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি বলব, দরকার হলে অন্য ডাক্তার দেখাবো। তুমি চিন্তা কর না। তুমি শান্ত হও”

কিন্তু সুরভী শুনলো না। এখনো কাঁদছে সে। ক্ষণে ক্ষণে ঢুকরে উঠতে লাগল সে। তুরান তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। একটা সময় সুরভী কাঁতর স্বরে বললো,
“আমায় একটু ভালোবাসবে তুরান?”

সুরভীকে আজ ফিরিয়ে দিতে পারলো না তুরান। হৃদয়ের এক কোনে জমায়িত সুপ্ত ইচ্ছেগুলো তালা ভাঙ্গলো। অসংখ্য চুমু আঁকলো সুরভীর মুখে। রাতের নিস্তব্ধতার সাথে বাড়লো নিষিদ্ধ ইচ্ছে। বিষাদ, যন্ত্রণা রুপ নিলো প্রগাঢ় প্রণয়ের। তপ্ত নিঃশ্বাস জানান দিলো অবাধ্য কামনার। সময় গড়ালো। নিগুঢ় রাতের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেলো তপ্ত নিঃশ্বাস। কিছু যন্ত্রণা, কিছু সুখ, কিছু ইচ্ছে বিস্তার করলো শান্ত ঘরে। একটা সময় ক্ষান্ত হলো সব ইচ্ছের জোয়ার। ক্লান্ত শরীর জোড়া লেপ্টে রইল একে অপরের সাথে। নিষ্প্রভ পুরুষ চাহনী দেখতে থাকলো ঘুমে লিপ্ত নারীটিকে। তার চুলগুলো বিছিয়ে আছে বিছানায় তাতে এসে ঠাঁই পেয়েছে পূর্নচন্দ্রমার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না। শুষ্ক অধর কপালে ঠেকালো সে। তারপর বুকের সাথে মিশিয়ে রাখলো। কিছু সময় বাদে তলিয়ে গেলো গভীর ঘুমে___________

**********
তপ্ত চুলায় চা বসানো। একটা সময় উতলে যাবার জোগাঢ় হলো। তিতির এসে তাড়াতাড়ি বন্ধ করলো চুলা। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
“ভাবি কি ভাবছো?”

সম্বিত ফিরল সুরভীর। ম্লান কন্ঠে বললো,
“কিছু না”

তিতির সন্দিহান চোখে তাকালো ভাবীর মুখোপানে। ক্লান্ত মুখখানায় সুক্ষ্ণ বিষাদের ছায়া। তপ্ত সূর্যালোকে আঁছড়ে পড়ছে সেই মুখে। বোকাও বুঝবে ভাবীর মনখারাপ। মানুষটাকে প্রাণোজ্জ্বল লাগছে না। মনে হচ্ছে ভেতরটাই যেনো ফাঁকা। তিতির আবার শুধালো,
“ভাবি, কিছু হয়েছে? তোমাকে এতো বিষন্ন লাগছে কেনো?”
“তোর চোখের ভুল”
“আমি ছোট ঠিক, কিন্তু অবুঝ নই। আমি কিন্তু আপা নই”

সুরভী হাসলো। তারপর গাল টেনে বলল,
“খুব বড় হয়ে গেছিস? কলেজ নেই?”
“আছে, কিন্তু যাবো না। পরীক্ষা সামনে। তাই বাসায় পড়ব”

এর মাঝেই রান্নাঘরে অভিলাষার আগমণ ঘটল। মোটা পেটটা নিয়ে ধীর পায়ে আসলো সে। তাকে দেখেই অস্থির হল সুরভী। কঠিন কন্ঠে বলল,
“তুমি এখানে কেনো অভিলাষা? আমি তো চা নিয়ে যেতাম ই”
“ভালো লাগছে না ভাবি। কতক্ষন শোয়া যায়। তিমির এদিকে আমাকে নড়তেও দিচ্ছে না। মাজা ধরে এসেছে। শুয়ে থাকা এতোটা কষ্টের হবে আগে কখনো বুঝি নি”
“এসব খামখেয়ালী, ডাক্তারের কথা অমান্য করার কি মানে?”
“ তুমি অন্তত বকো না”

অসহায় কন্ঠে কথাটা বলল অভিলাষা। সুরভী চা বেড়ে তিতিরকে দিয়ে তিমিরের ঘরে পাঠালো। তিতির যেতেই অভিলাষা বলল,
“ভাবি, তোমার সাথে কিছু কথা আছে”
“কি কথা?”
“তুমি তো জানোই তিমির এখন পড়াশোনা করছে। পরীক্ষা দুটো ভালোও হয়েছে। কিন্তু ভাইয়ার উপর তো চাপ বেড়ে গেছে। তাই আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে, কিন্তু তিমিরকে বললে ও কখনোই শুনবে না। আবারো পাগলামি করবে”
“কি ভাবছো বলোতো?”
“আমি না হাতের কাজ পারি ভাবি, আমি তো বসেই থাকছি। বসে বসে যদি একটু একটু করে কিছু করা যায়। আমার এক বান্ধবীর বুটিকের দোকান আছে। ও বলেছে আমি যদি কাজ করে দেই ও আমাকে টাকা দিবে। প্রতিটা কাজে তিনশত টাকা। শুধু তোমার একটু সাহায্য চাই। সাহায্য করবে?”

অভিলাষার দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকালো সুরভী। অন্য সময় হলে বাধা দিতো না। কিন্তু এখন অভিলাষার অবস্থাও ভালো নয়। এটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে!

*********

পড়ন্ত বিকেলে সোনালী রোদে এসে ঠাঁই নিয়েছে তুলিকার অবিন্যস্ত কেশে। হাটু গেড়ে কোমল নারীটি বসে রয়েছে বারান্দায়। বহুদিন বাদ আজ খোলা আকাশ দেখছে। বহুদিন বাদ মেঘের সাথে কথা বলছে। কত শত কথা, বেশির ভাগ রোদ্দুরকে নিয়ে। হ্যা, সেই প্রেমিক পুরুষকে নিয়েই তার সব কথা। অবুঝ মনজুড়ে চুপিসারে নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে সে। অথচ অবুঝ প্রেয়সী তার প্রেমপুষ্প ফিরিয়ে দিয়েছিলো। লম্বা নেত্রপল্লব ক্ষণে ক্ষণে বুজে আসছে শান্ত সমীরের ঝাপটায়। তন্ময় হৃদয় তবুও আনমনে বিড়বিড় করছে সেই অচেনা পুরুষের অভিযোগে। লোকটিকে দেখার আক্ষেপ জমেছে। কিন্তু উপায় নেই। বাড়ি নামক কারাগার থেকে বের হওয়া অসম্ভব। সে বলেছিলো মুক্ত আকাশ দিবে কিন্তু ভীত মনটা তাকে ফিরিয়ে দিলো। তুলিকা ম্লান দৃষ্টিতে চাইলো পথের দিকে। এর মাঝেই তিতির বলল,
“আপা, ঠান্ডা লাগবে তোর। ভেতরে আয়”

বিষন্ন দৃষ্টিতে চাইলো সে তিতিরের দিকে। তিতির বোনের এই বিষাদের কারণ জানে। ধীর পায়ে এগিয়ে তার পায়ে বসলো। ধীর স্বরে বলল,
“রোদ্দুর ভাইকে মনে পড়ছে?”
“তুই জানিস কি করে?”
“আমি জানি। খুব পছন্দ তাই না রোদ্দুর ভাইকে?”
“আমার ওর কাছে ভয় লাগে না”

বিড়বিড় করে বললো তুলিকা। তুলিকার কথায় হাসলো তিতির। তারপর শুধালো,
“তাহলে তার মন ভাঙ্গলি কেন?”
“সে বলল যে আমাকে ভালোবাসে। ভালো ছেলেরা কি ভালোবাসে? এসব বলতে আছে। ভালোবাসা খারাপ, বিশ্রি”

অবুঝ বোনের কথার কি উত্তর দিবে জানা নেই তিতিরের। তবে সে তাকে জড়িয়ে ধরলো। কাধে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
“ঠিক বলেছিস, একদম ঠিক বলেছিস। ভালোবাসা খারাপ, বিশ্রী। জানিস এই শুক্রবার তুশি আপুর বিয়ে। সবার দাওয়াত। আমরা শাড়ি পড়বো। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা”

**********

বাবার সামনে গম্ভীর মুখে বসে রয়েছে রোদ্দুর। রাহাত সাহেবের এমন আগমনের কারণ সে একটু হলেও আঁচ করতে পারছে। তাই তার গম্ভীরতা বৃদ্ধি পেলো। রাহাত সাহেব আয়েশ করে কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তার আয়েশ আরোও অসহ্য লাগছে রোদ্দুরের। তাই বিনা ভনীতাতে বলল,
“আমি যদি বিয়ে করি তবে সে তুলিকা ব্যাতীত আর কেউ হবে না”…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি