নীড় হারা পাখি পর্ব-২৬+২৭

0
262

#নীড়_হারা_পাখি
#২৬তম_পর্ব

বাবার সামনে গম্ভীর মুখে বসে রয়েছে রোদ্দুর। রাহাত সাহেবের এমন আগমনের কারণ সে একটু হলেও আঁচ করতে পারছে। তাই তার গম্ভীরতা বৃদ্ধি পেলো। রাহাত সাহেব আয়েশ করে কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তার আয়েশ আরোও অসহ্য লাগছে রোদ্দুরের। তাই বিনা ভনীতাতে বলল,
“আমি যদি বিয়ে করি তবে সে তুলিকা ব্যাতীত আর কেউ হবে না”

রোদ্দুরের এমন কথা শুনে রীতিমতো বিষম খেলেন রাহাত সাহেব। বিষমের ঠেলায় খক খক করে কাশতে লাগলেন। এতে রোদ্দুরের ভাবমূর্তির পরিবর্তন হলো না। সুন্দর একটি গ্লাসে পানি ঢেলে শান্ত চিত্তে এগিয়ে দিলো বাবার দিকে। ইতোমধ্যে রান্নাঘর থেকে শেফালি বেগম ও ছুটে এলেন। রাহাত সাহেব ছেলের থেকে পানির গ্লাসটি নেবার সময় আড়চোখে তাকালেন। ছেলের মুখশ্রী শান্ত, মস্তিষ্কে কি চলছে বোঝার উপায় নেই। রোদ্দুর আর পাঁচটা ছেলের মতো নয়। তার স্বভাব বড্ড বিচিত্র। যে বয়সে অন্য ছেলেরা ভিডিও গেমের জিদে খাওয়া ছেড়ে দিতো, সেই বয়সে রোদ্দুর নিজেকে ব্যস্ত রাখতো নিজের এবং মায়ের দেখভালে। খেলনা গুলো তার কাছে অহেতুক ছেলেমানুষী। সেই ছেলেমানুষী নিয়ে জেদ নাকি সময় নষ্ট। চাকরি সূত্রে বাবাকে থাকতে হয়েছে দেশের বাহিরে। এসেছে বছরে এক কি দু বার। ফলে ছেলে মানুষ রোদ্দুরটি কখনোই নিজেকে প্রকাশ করে নি। বরং সর্বদাই পরিপক্কতাই তার মাঝে প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেই স্বভাবের পাশাপাশি বরাবরই সে সর্বদাই মুখোরা স্বভাবের। নিজের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে সে লজ্জাশূন্য। যা পছন্দ নয়, তা তার পছন্দ নয়। যা ভালোলাগে, তা সে আগলে রাখার ক্ষমতাও রাখে। কথায় আছে শান্ত মানুষের জেদ মাত্রাতিক্ত। রোদ্দুর তাদের মাঝেই একজন। ফলে তার বড় খালা বিগত তিন বছর যাবত তার বিয়ের চেষ্টা করেও ব্যর্থতার ট্যাগ বয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে প্রতিবারের তুলনায় এবার যেনো রোদ্দুরের মাঝে দৃঢ়তা বেশি। তার মাঝে এবার সংযম নেই। বলে বাবার সামনে নিজের ভালোবাসার কথাও বলতে তার মাঝে জড়তা নেই। শেফালী বেগম কিঞ্চিত ক্ষেপে উঠলেন, হিনহিনে স্বরে বললেন,
“তোমার বাবার সামনে একটু সংযম হও”
“কেনো? আমি কি অন্যের বাবাকে বলছি। নিজের বাবার কাছে কিসের লজ্জা? আর বাবা তো আমার সাথে কুশলাদি বিনিময়ের জন্য এই সকাল বেলায় আমাকে ডাকে নি। সে মুলত শাহানা খালার ব্যর্থতার কৈফিয়ত চাইছেন। আর তুমি তাকে ডেকে এনেছো। কি ভুল বলেছি মা?”
“রোদ্দুর তোমার এমন উদ্ধত আচারণ আমার অসহ্য লাগছে”
“আমারও অসহ্য লাগছে। বিতৃষ্ণা জন্মাচ্ছে তোমাদের উপর। আমার ব্যাপারগুলো কি ছেড়ে দিলে হয় না? প্লিজ, অনুরোধ করছি”

রোদ্দুরের কথায় রোষের ছাপ। তার মাঝে উত্তেজনাও লক্ষ্য করা গেলো। শান্ত মানুষের ধৈর্য্যের বাধ ভাঙ্গলে তারা যেমন অতীষ্ঠ হয়ে যায় রোদ্দুরের মাঝেও তাই লক্ষ করা গেলো। রাহাত সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। খুব শান্ত কন্ঠে বললেন,
“মেয়েটি তো মানসিক ভাবে অসুস্থ, বিয়ে ভাঙ্গা নিয়ে আ/ত্ম/হ/ত্যার রটনাও আছে। তোমাকেও আঘাত করেছে। তার সাথে জীবনযাত্রা করাটাকি বুদ্ধিমানের হবে?”

রাহাত সাহেবের কথায় চোখ কুচকে গেলো রোদ্দুরের। শ্যাম কপালে পড়লো ভাঁজ। রোদ্দুরের প্রখর দৃষ্টিতে উপেক্ষা করে তিনি বললেন,
“আমার কোনো আপত্তি নেই তুলিকাকে নিয়ে, কিন্তু কিছু প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্ন, মেয়েটি সুস্থ নয়, তার সুস্থ হবার কি কোনো সুযোগ আছে? দ্বিতীয় প্রশ্ন, তার অতীত ঠিক কেমন যে তার পরিণতি এমন? তৃতীয় সে কি তোমাকে মেনে নিয়েছে তার গন্ডিতে? চতুর্থ প্রশ্ন, মেয়েটির অতীত ভবিষ্যতের উপর প্রভাব ফেলবে না? শেষ প্রশ্ন, যদি এমন কিছু হয় সামলাতে পারবে তো? মানলাম তুমি সামাজিক জীব নও, মানুষের কথায় তোমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু যার সাথে জীবনের পথচলা সেই মানুষটার কোনো বিষয়েও কি তোমার মাথাব্যাথা হবে না? দাম্পত্যজীবন, এই শব্দটিই অকথিত কমিটমেন্ট। আমার তোমার মায়ের অনেক কিছু বিরক্ত লাগে, আমার অনেক কিছু তোমার মায়ের অসহ্য লাগে। মাঝে মাঝে তোমার মা আমার দিকে খুন্তি নিয়েও ছুটে। কিন্তু আমার মন্দ লাগে না, বরং আমি সুখ খুঁজে পাই। কারণ কি জানো? এই মহিলা আমাকে বুঝে। আমার সব দুঃখ সুখে আমাকে গা/লি দিলেও সে আমার সাথে ছিলো, আছে, থাকবে। তুলিকার ক্ষেত্রে ঘটনাগুলো পৃথক হয়। হয়তো খুন্তি নিয়ে তাঁড়ার ব্যাপারখানা মিলে যাবে। কিন্তু সে অবুঝ। ধরো একটি অবুঝ বাচ্চা। সে নিজের গন্ডিতে আবদ্ধ। তোমার সুখ, দুঃখ, যন্ত্রণা, আবেগ, অনুভূতি সে কি বুঝবে? দাম্পত্যজীবন একা টেনে যাওয়া কিন্তু সহজ নয়। তুমি সেটাই করতে চাইছো। আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো আমাকে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি খুঁজে পেলেই যথেষ্ট। তারপর না হয় তার বাড়িতে সসম্মানে প্রস্তাব নিয়ে যাবো”
“তুমি কি পাগল হলে?”
“পাগল আমরা সবাই, শুধু সবার প্রকাশের ধরণ ভিন্ন”

বলে ঘর কাঁপিয়ে হাসলেন রাহাত সাহেব। শেফালী বেগম ছেলেকে দেখছেন। ভেবেছিলেন ছেলের হেলদোল হবে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার তার ঠোঁটের কোনায় প্রশান্তির হাসির প্রলেপ। সে পকেটে হাত গুজে উঠে দাঁড়ালো। যাবার জন্য পা বাড়ালো। একটু থেকে বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
“সসম্মানে প্রস্তাব দেবার প্রস্তুতি নাও। আমি তৃতীয় উত্তরটি খুঁজতে গেলাম”

শেফালী বেগম ক্রোধাগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলো। কিন্তু রাহাত সাহেবের ভ্রুক্ষেপ হলো না। সে তার চায়ের কাপে পুনরায় চুমুক দিলেন আয়েশ করে। শেফালী বেগম ক্রুদ্ধ স্বরে শুধালেন,
“এটা কি হলো?”
“শেফালী, তোমার ছেলেকে কি তুমি চিনলে না? এ যুদ্ধে তোমার হার নিশ্চিত, তাই ঢাল তলোয়ার ফেলে দিয়ে সন্ধ্যিচুক্তি করে নাও। গর্দান কাঁ/টা যাবার থেকে বন্ধু হয়ে ছত্রছায়ায় থাকা ভালো। বুড়ো বয়সে সন্তানচ্যুত হবার মানেই নেই”
“মেয়েটি পাগল”
“অন্তত পাগলের ট্যাগে তো কাজ কর্ম ঢাকা পড়বে। তুমি তো সেটাও পাও নি। মনে আছে যখন আমাদের নতুন নতুন বিয়ে হয়েছিলো, তুমি আমার দিকে কাপ ছু/ড়ে দিয়েছিলে। হাহাহা, এখনো মনে পড়লে হাসি পায়”
“তুমি আমাকে ঐ পাগলের সাথে মিলাচ্ছো?”
“আলবৎ নয়, আমি শুধু বোঝানোর চেষ্টা করছি মিয়া বিবি রাজী তো কেয়া কারেগা কাজি”

বলেই পুনরায় চায়ের কাপে চুমুক দিলেন তিনি। আহা! স্ত্রীর কড়া দৃষ্টিতে চায়ের সাধ যেনো বৃদ্ধি পেয়েছে। ঠান্ডা হলেও সাধ বর্ণনাতীত____________

*******
বারান্দার দিকে তীর্থের কাকের ন্যায় চেয়ে রয়েছে রোদ্দুর। কড়া রোদে ঝলসে যাচ্ছে দেহ, কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুক্তোদানা। চোখজোড়ায় পিপাসা। পিপাসা প্রেয়সীকে দেখার। কিন্তু পাষানী তো তার চিত্তেই ব্যাস্ত। ঘেউঘেউ করছে তুলতুল। ছোট কুকুরখানার দেহের প্রসস্থ বৃষ্টি পেয়েছে। গলার স্বরে প্রখরতা। রোদ্দুরের ক্লান্ত চোখ একনজর অক্লান্ত কুকুরটিকে দেখলো। বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“গরম বেড়েছে। চেচিয়ে গলা শুকাস নে। সে আসবে না”

কিন্তু তুলতুল শুনলো না। লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে ডাকতে লাগলো। হয়তো নিষ্পাপ প্রাণীর ডাকে মায়াবন বিহারিনীর দয়া হলো কিঞ্চিত। ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। রেলিং ধরে গোল গোল চোখে তাকালো নিচে। চোখাচোখি হলো রোদ্দুরের সাথে। কত দিনেই তৃষ্ণা, কত দিনের প্রতীক্ষা! রোদ্দুরের ক্লান্ত ঠোঁটে ঠাঁই পেলো অব্যক্ত প্রশান্তি। একটি কাগজ দলামোচা করে ইটে জড়িয়ে ছুড়ে মারলো। ঢিল এসে পড়লো যুবতীর পায়ে। অবুঝ যুবতী হাতে নিলো ঢিল। খুললো ধীর হাতে। কিছু লেখা। পড়তে কষ্ট হলো। বুঝলো না কিছু। গোলগোল ঘোলাটে চোখ রোদ্দুরের দিকে তাকালো। রোদ্দুর বুঝলো প্রেয়সী পড়তে পারে নি। ফলে ফোন বের করে একটি নাম্বারে ফোন লাগালো। কিছু বললো সে। ফলে মিনিট দুয়েকের মাঝে তিতিরের আগমণ ঘটলো। তুলিকার দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। তুলিকা প্রথমে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও কানে নিলো ফোনটি। সাথে সাথেই কানে এলো প্রগাঢ় দৃঢ় মিহি কন্ঠ,
“তোমাকে দেখেছিলাম কোনো নিভে যাওয়া সন্ধ্যায়, নিস্তব্ধ শহরতলীর বাতাসে উড়ছিলো তোমার লাল আঁচল। সেই রক্তিম লালিমা রাঙ্গিয়ে ছিলো আমার মন খারাপের নীলাম্বর। ওগো, মায়াবন বিহারিনী, তোমার অবুঝ মনে কি একটু ঠাঁই পাবো না? নীড় হারা পাখি যে একটু ঠাঁই চায়”

রমনী নিশ্চুপ। রোদ্দুর হেসে বললো,
“খুব কঠিন কিছু বলে ফেললাম?”
“হু”
“সোজা ভাষায় তোমার সর্বত্রে নিজের বিস্তার চাই। তোমার গন্ডিতে আমার বিচরণ চাই। তোমাকে চাই। শুধু রোদ্দুরের তুলিকাকে চাই”

রমনী কতটুকু বুঝলো জানা নেই। তবে তার মুখশ্রী রক্তিম হয়ে গেলো। তিতিরের হাতে মোবাইলটা দিয়েই ছুটলো ভেতরে। তিতির অস্থির কন্ঠে বলল,
“কি বলেছো তুমি আপাকে?”
“তুশির বিয়েতে আসছো তো?”
“আগে বল, কি বলেছো”
“ছোট মানুষ হয়ে বোনের প্রেমের মাঝে নাক গলাচ্ছ কেনো? সব কিছু কি সবার সামনে বলা যায়? লজ্জা করে না?”

রোদ্দুরের এমন কথায় তব্দা খেলো তিতির। খানিকটা রাগ হয়ে বললো,
“মুখ ঢেকে রাখো তবে”

বলেই ফোন রেখে দিলো। রোদ্দুর হাসলো। তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর যে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারলো___________

*******

জাকজমক সন্ধ্যা। আলোকসজ্জায় লিপ্ত সারা পাড়া। পাড়ার দক্ষিণের বিশাল ব্যাবসায়ী আরহাম মোহাম্মদের ছোট মেয়ে তুশির বিয়ে। টাকার প্রদর্শন যেনো এখন খুব সাধারণ ব্যাপার। ফলে সারা পাড়াকেই বউ এর মতো সাজিয়েছেন। প্রতিটি ব্যাক্তিকে দাওয়াট করেছেন তারা। বিয়েতে হিমা বেগম, শফিক সাহেব, তুলিকা এবং তিতির ও এসেছে। অভিলাষার শারীরিক ব্যাপারে সে আসে নি, সুরভী এবং তিমির সেকারণে তার নিকট থেকে গেছে। তুরানের কোন কালেই সামাজিকতা বজায় ভালো লাগে না। ফলে সেও আসে নি। ফলে আটজনের পরিবারে চার জন এসেছে। তুলিকাকে খুব সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে সুরভী। নীল শাড়ি, খোঁপার বাঁধনে কোকরানো কৃষ্ণকেশ, ঠোঁটে হালকা লিপ্সটিক। আজ অবশ্য তুলিকা জিদ করে নি। করেছে তিতির। তুলিকা শান্ত মেয়ের মতো শাড়ি পড়েছে। হিমা বেগম তাকে বেশ কড়া কন্ঠে বললো,
“আমার হাত ছাড়বে না। খেয়েই চলে আসবো”

তুলিকা শুনলো কেবল। কিন্তু সে তো জানতো না এখানে প্রগাঢ় চোখজোড়াও থাকবে। যে তার পিপাসা মেটাবে প্রেয়সীকে দেখে। শিহাব ভাইয়ের পাশে নিষ্প্রভ চিত্তে দাঁড়িয়ে ছিলো রোদ্দুর। ঠিক তখন ই চোখজোড়া আটকে গেলো তার। নীলাম্বরে রাঙ্গা রমনী ধীর পায়ে এলো ভিড়ের মাঝে। তার কাজলকালো ঘোলাটে চোখে ছিলো কিঞ্চিত ভীতি, বিস্ময়, কৌতুহল। রোদ্দুরের হৃদয় কিঞ্চিত কাঁপলো। হৃদস্পন্দন বাঁড়লো। তার স্নিগ্ধ মুখশ্রীতে নিজের সুখের ঠিকানা খুঁজে পেলো সে। এগিয়ে গেলো। সালাম বিনিময় করলো হিমা বেগম এবং শফিক সাহেবের সাথে। হিমা বেগম ম্লান হাসিতে উত্তর দিলেন। এর মাঝেই শোনা গেলো বর এসেছে। তীব্র জনসমুদ্র বর দেখার লোভে এগিয়ে গেলো। সেই সাথে তিতির ও জোর করলো। রোদ্দুর হেসে বলল,
“আন্টি আপনারা বসুন, ওদের আমি নিয়ে যাচ্ছি”

কিঞ্চিত অসম্মতি থাকলেও বাধা দিলেন না হিমা বেগম। তুলিকা, তিতির বর দেখতে এগিয়ে গেলো। আরহাম সাহেবের স্ত্রী মিষ্টি নিয়ে বরণ করছে বরকে। কিন্তু সেই সাথে লাগলো গেটের টাকা নিয়ে যুদ্ধ। তিতির আনন্দ পেলেও রোদ্দুর খেয়াল করলো, তুলিকার মুখখানা রক্তশূন্য। রীতিমতো কাঁপছে সে। খুব পর্যবেক্ষণে বুঝলো তার ভীত, আতংকিত, ত্রাস দৃষ্টি দেখছে বরের সাথে দাঁড়ানো একটি যুবককে…………

চলবে

#নীড়_হারা_পাখি
#২৭তম_পর্ব

কিঞ্চিত অসম্মতি থাকলেও বাধা দিলেন না হিমা বেগম। তুলিকা, তিতির বর দেখতে এগিয়ে গেলো। আরহাম সাহেবের স্ত্রী মিষ্টি নিয়ে বরণ করছে বরকে। কিন্তু সেই সাথে লাগলো গেটের টাকা নিয়ে যুদ্ধ। তিতির আনন্দ পেলেও রোদ্দুর খেয়াল করলো, তুলিকার মুখখানা রক্তশূন্য। রীতিমতো কাঁপছে সে। খুব পর্যবেক্ষণে বুঝলো তার ভীত, আতংকিত, ত্রাস দৃষ্টি দেখছে বরের সাথে দাঁড়ানো একটি যুবককে। তুলিকার মাঝে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলো। তার শরীর ঘামছে। চোখের ভীতি গাঢ় হলো। এক অদ্ভুত ছটফটানি তার মাঝে ঘূর্ণিপাক খেতে লাগলো। রোদ্দুর তার হাত ধরতে যাবার প্রয়াস করতেই ছিটকে সরে গেল সে। তার ভারসাম্য হারাতে লাগলো। দুহাত মাথায় চেপে ধরে সজোরে চিৎকার করে উঠলো সে। তার কাঁপা আর্তনাদে বিচ্ছেদ ঘটল জাকজমকপূর্ণ বিবাহ উৎসবে। সাথে সাথে তিতির আতংকিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপা, কি হয়েছে তোর? চিৎকার করছিস কেনো?”

উপস্থিত সকলের বিভ্রান্ত চোখজোড়া একগুচ্ছ কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো তুলিকার দিকে। খানিকটা চমকে উঠলেন আরহাম সাহেবের স্ত্রী। বিয়ে নামক শুভ অনুষ্ঠনে এমন বাঁধা যেনো তাদের কল্পনাতীত ছিলো। বর পক্ষের কিছু মুরব্বী গোছের মানুষের মাঝে কানাঘুষা শুরু হল। তাদের চোখের দৃষ্টি কিঞ্চিত তীক্ষ্ণ হতে থাকলো। এসব উপেক্ষা করে রোদ্দুর তুলিকাকে সামলাতে ব্যস্ত হলো। ধীরে ধীরে ভেতরের মানুষ ও জড় হতে লাগলো। তুলিকা রীতিমতো কাঁপছে। ভীত চোখ বারবার দেখছে যুবকটির দিকে। একসময় আঙ্গুল উচিয়ে বলল,
“ও মে/রে ফেলেছে, ও ভালো না। ও আমাকেও মে/রে ফেলবে। ও কে বের করে দাও। ও খু/নী”

তুলিকার এরুপ উক্তিতে আবার ও যেনো পরিবেশের স্তব্ধতা ভেঙ্গে চুরমার হলো। রোদ্দুর তার আঙ্গুল অনুসরণ করে তাকালো সেই যুবকের দিকে। যুবকের চোখে আশ্চর্য, তার কপালে তীব্র ঘন ভাঁজ পড়েছে। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাচ্ছে। মনে হচ্ছে গলা শুকিয়ে আসছে যেনো তার। কোথাও না কোথাও সুপ্ত ভয়ের প্রতিচ্ছবিও চোখের দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো যেনো। তুলিকার দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত। তার মুখে এক বর্ণনাতীত ভয় এবং যন্ত্রণা ফুটে উঠলো। তার প্রলাপের মাত্রা বাড়লো। রোদ্দুর তাকে ছুঁতে গেলেই সে আৎকে উঠছে। তিতির কেউ সে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। কাঁপা, ভীত স্বরে বলছে,
“ওকে চলে যেতে বল, ও আমাকে মে/রে ফেলবে। ও মে/রে ফেলেছে, আমি দেখেছি। আমি দেখেছি”

রোদ্দুর তুলিকার অশান্ত হাত ধরে অনুনয় করে বলতে লাগল,
“তুলিকা কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। ও ভালো ছেলে, তুলিকা এখানে সবাই আছে। ও যদি কিছু করার ও থাকে এখন করতে পারবে না। শান্ত হও। শান্ত হও”

রোদ্দুরের কথাগুলো তুলিকার কর্ণপাত হলো না। সে তার জগতেই আটকে গেলো। মুখে এক বুলি। নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকলো সে। চোখ বেয়ে নামছে অঝর ধারায় নোনাবারি। তার অশ্রুসিক্ত মুখখানা ব্যথিত করছে রোদ্দুরকে। ইতোমধ্যে হিমা বেগম এবং শফিক সাহেব ও চলে এলেন। হিমা বেগম মেয়ের এমন অবস্থা দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তড়িৎ গতিতে তাকে ছুতে গেলেই নিজের গায়ের গহনা গুলো ছুড়ে দিতে লাগলো তুলিকা। চিৎকার করে বললো,
“ছুবে না আমায়, তোমরা সবাই ওর সাথে মিলে গেছো। আমাকে মে/রে ফেলবে। ছুবে না”

নিজেকে বাচাতে নিজের গলার চেইন, চুড়ি গুলো খুলে ছুড়তে লাগলো। হিমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“মা আমার কথা শোন। মা শান্ত হ”

এদিকে বিয়ে বাড়ির পরিবেশে যেনো তালগোল পাকিয়ে গেলো। তাদের মাঝে অরাজকতা সৃষ্টি হলো। আরহাম সাহেব নিজের মেয়ের বিয়েতে এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা মোটেই মেতে নিতে পারছেন না। বরং রীতিমত কঠিন কন্ঠে বললেন,
“এই পাগল মেয়েকে কে দাওয়াত দিয়েছে? শফিক সাহেব নিজের মেয়েকে সামলান”

শফিক সাহেব বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। তার থেকে অভাগা পিতা যেনো আর একটিও নেই। এদিকে তুলিকাকে সামলানো যেনো মুশকিল থেকে মুশকিলতর হচ্ছে। সে রোদ্দুর, তিতির, হিমা বেগম কাউকেই চিনছে না। তার মাঝে এক প্রতিরোধ দেখা গেলো। যেনো সবাই তার শত্রু। ঘোলাটে চোখজোড়ায় ভয়ের সাথে জন্মালো ঘৃণা, যন্ত্রণা, প্রতিরোধের অগ্নি। হুট করেই উঠে দাঁড়ালো সে। ছুটে ছেলেটির গলা চে/পে ধরলো। তুলিকার এমন কাছে এক বিশৃঙ্খলা তৈরি হলো। ছেলেটি বাঁচার জন্য ছটফট করতে লাগলো। তুলিকার মাঝে যেনো ভর করল অশেষ শক্তি। কিছুতে ছাড়ানো যাচ্ছে না তাকে। এদিকে ছেলেটির নিঃশ্বাস ঘন হতে লাগলো। রোদ্দুর নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে অবশেষে ছাড়ালো তুলিকাকে। চেপে ধরে রাখলো তার হাত। শান্ত কন্ঠে বলল,
“তুলিকা শান্ত হও। ও কিছু করবে না তোমাকে”

কিন্তু তুলিকা থামলো না। সে রোদ্দুরের থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলো। চিৎকার করে বলল,
“ছাড়, আমাকে ছাড়। তোমরা সবাই খারাপ। আমাকে মে/রে ফেলবে। আমি জানি। আমাকে ছাড়। আমি বাঁচতে চাই”

একটা সময় নিজেকে ছাড়াতে কামড় বসিয়ে দিলো তুলিকা রোদ্দুরের হাতে। তীব্র যন্ত্রণায় কপালে ভাঁজ পড়ল। ক্ষত গাঢ় হচ্ছে কিন্তু খুব একটা ভাবান্তর হলো না রোদ্দুরের। ঠিক সেই সময় শিহাব ছাড়ালো রোদ্দুরের হাত, কড়া স্বরে বলল,
“অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছো নাকি। হাত লাল হয়ে র/ক্ত জমে গেছে”

রোদ্দুর এক নজর নিজের দিকে তাকাতেই তুলিকা ছুটে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। তিতির পেছন থেকে উৎকুন্ঠিত কন্ঠে ডাক দিলো তাকে। কিন্তু মেয়েটি ছুটতে লাগলো যেনো জীবন বাঁচানোর ইচ্ছেতে। তিতিরের কন্ঠে সম্বিত ফিরল। সে তাকাতেই দেখলো তুলিকা নেই। তার পিছু পিছু হিমা বেগম, তিতির এবং শফিক সাহেব ও ছুটলেন। রোদ্দুর যেতে নিলে শিহাব হাত ধরল, বিস্মিত কন্ঠে বলল,
“নিজের হাতের যা হাল তাতে এখন সেখানে মলম লাগানো দরকার, অথচ তুমি কি না এখন ওই মেয়ের পেছনে ছুটবে? আগেও বলেছি চকচক করলেই সোনা হয় না”
“আমার সোনার প্রয়োজন ও নেই। আমি ভাঙ্গা কাঁচেই নিজের সুখ খুঁজি”

বলেই সে হাত ছাড়িয়ে ছুটলো বাহিরের দিকে। শিহাব হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রোদ্দুরের যাবার পানে। এদিকে বিয়ের মহলে যেনো এক বিশ্রী পরিবেশের সৃষ্টি হল। আরহাম সাহেবকে ছেলেপক্ষের মুরব্বিরা এক দু কথা শোনালেন। কিছুটা গমগম হলো পরিবেশ। কিন্তু বর সামলে নিলো সবটা। সব কিছু ফাঁকে শিহাব সেই যুবককে শুধাল,
“তুমি কি তুলিকাকে চিনো?”

শিহাবের এরুপ প্রশ্নে চমকে উঠল যুবক। আমতা আমতা করে বলল,
“আমি ওই পাগলকে চিনতে যাব কেন? একেই আমার গলা চে/পে মে/রে ফেলার উপক্রম হয়েছিল। দেখুন দেখুন কেমন দাগ বসে গেছে”

শিহাব কথা বাড়াল না, একেই পরিবেশ গম্ভীর। নিজের বোনের বিয়েতে আর বাধা পরুক সে চায় না। ফলে কথা সেখানেই থেমে গেল।

********

কৃষ্ণ নীলাম্বরে সদ্য যৌবনে পা রাখা কিশোরীর ন্যায় চন্দ্রমাটা নিজের তীব্র সৌন্দর্য্য উজার করে প্রকাশ করছে। সেই সাথে দু একটা তারাও টিমটিমে আলোতে নিজেকে প্রকাশ করছে। এই শশীধরের এরুপ রুপে সাধারণত প্রেমিকেরা তাদের প্রেমিকাদের জন্য কাব্য রচনা করে। অথচ এই রাতে এক প্রেমিক পাগলের মতো পাড়ায় তন্য তন্য করে খুঁজছে তার প্রেয়সীকে। রোদ্দুরের শ্যাম কপালে মাঘের হীম শীতেও জমেছে ঘাম। চোখে মুখে উৎকুন্ঠা। হিমা বেগমের মেয়ের চিন্তায় অশ্রুসিক্ত হয়ে গেছে মুখখানা। তিতির তার বোনকে খুঁজছে। তার ভেতরটা উচাটনে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বোন যে তার সুস্থ নয়। এদিকে শফিক সাহেব শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পিচঢালা নোংরা রাস্তাটির দিকে। তার বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। আজ নিজেকে সবচেয়ে অসহায় লাগছে। সবচেয়ে দূর্বল বাবা।

ছুটতে ছুটতে রোদ্দুরের পা থেমে গেলো। পাড়ার শেষ মাথায় যে ময়লার স্তুপ রয়েছে সেখানেই হাটুগেড়ে কাচুমাচু করে বসে রয়েছে নীল শাড়ি পরিহিতা যুবতী। অবিন্যস্ত চুল মুখের এক পাশ ঢেকে দিয়েছে। চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। স্নিগ্ধ রুপালি চন্দ্রালোক তার কোমল মুখখানায় আছড়ে পড়ছে। শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে তার দাঁত। রক্ত জমেছে। যুবতীর এরুপ বুকে ভোঁতা আঘাত করলো রোদ্দুরকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সে। কোমল স্বরে ডাকলো,
“তুলিকা”

তুলিকা কন্ঠ শুনেই চমকে উঠল। ভীত মানবী হাতের কাছে যা পেলো ছুড়তে লাগলো। আবর্জনা, ইট, পাটকেল। পরোয়া করলো না রোদ্দুর। এগিয়ে গিয়ে হাটু গেড়ে বসল। তারপর নির্ভয়ে তাকে বক্ষস্থলে টেনে নিল। গভীর ভাবে মিশিয়ে রাখল তাকে। তুলিকা হাত ছুড়তে লাগলো, কামড় বসালো ঘাড়ে। কিন্তু রোদ্দুর এবার নড়লো না এক চুল। গাঢ় কন্ঠে বলল,
“তুলিকা আমি। আমাকে চিনছো না। আমি রোদ্দুর। তোমার পাগল প্রেমিক”

তুলিকা এবার কামড়ে জোর কমালো। কিছুটা শান্ত হল। ফ্যালফ্যাল নয়নে চাইল রোদ্দুরের দিকে। রোদ্দুরের ঠোঁটে এখনো স্নিগ্ধ হাসি। মেয়েটি এবার ফুপিয়ে কেঁদে দিলো। চোখ বেয়ে আবারো নোনা তরল গড়িয়ে পড়লো। কাঁপা স্বরে বলল,
“তুমি এসেছো, তুমি এসেছো। আমি কত ভয় পেয়েছিলাম জানো………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি