নীড় হারা পাখি পর্ব-২৮+২৯

0
273

#নীড়_হারা_পাখি
#২৮তম_পর্ব

তুলিকা কন্ঠ শুনেই চমকে উঠল। ভীত মানবী হাতের কাছে যা পেলো ছুড়তে লাগলো। আবর্জনা, ইট, পাটকেল। পরোয়া করলো না রোদ্দুর। এগিয়ে গিয়ে হাটু গেড়ে বসল। তারপর নির্ভয়ে তাকে বক্ষস্থলে টেনে নিল। গভীর ভাবে মিশিয়ে রাখল তাকে। তুলিকা হাত ছুড়তে লাগলো, কামড় বসালো ঘাড়ে। কিন্তু রোদ্দুর এবার নড়লো এক চুল। গাঢ় কন্ঠে বলল,
“তুলিকা আমি। আমাকে চিনছো না। আমি রোদ্দুর। তোমার পাগল প্রেমিক”

তুলিকা এবার কামড়ে জোর কমালো। কিছুটা শান্ত হল। ফ্যালফ্যাল নয়নে চাইল রোদ্দুরের দিকে। রোদ্দুরের ঠোঁটে এখনো স্নিগ্ধ হাসি। মেয়েটি এবার ফুপিয়ে কেঁদে দিলো। চোখ বেয়ে আবারো নোনা তরল গড়িয়ে পড়লো। কাঁপা স্বরে বলল,
“তুমি এসেছো, তুমি এসেছো। আমি কত ভয় পেয়েছিলাম জানো”

মেয়েটির মায়াভরা আকুতি রোদ্দুরের হৃদয়কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিলো। চিনচিনে তীক্ষ্ণ ব্যাথা তাকে তাড়া করতে লাগলো। তবুও মুখশ্রীতে তৃপ্তির হাসি লেপ্টে আছে। সান্ত্বনা একটিই তার প্রেয়সী তাকে চিনতে পারছে। রাতের গভীরত্বে চন্দ্রমার রুপ যেনো অধিক বৃদ্ধি পেলো। সেই রুপালী জ্যোৎস্না অবুঝ প্রেয়সীর ব্যাথিত মুখে আঁছড়ে পড়ছে। এক নজর দেখলো তুলিকার কোমল বিধ্বস্ত মুখশ্রী। শীতল হীম হাওয়া কৃষ্ণ চুলগুলো ছুয়ে যাচ্ছে। কিছুসময় নিমেষহীন চোখজোড়ায় ধারণ করে অবিন্যস্ত চুলগুলো রুক্ষ্ণ হাতে নমনীয়তার সাথে কানের পেছনে গুজে দিলো রোদ্দুর। আলতো হাতে চোখজোড়া মুছে দিলো তুলিকার। কোমল কন্ঠে বলল,
“আমি ছিলাম, আছি। ভয় নেই। কেউ তোমাকে ছোঁবে না। কথা দিচ্ছি”
“কথা রাখবে তো? একা করে দিবে না?”
“না, কখন না”
“কিভাবে মানি? অন্যদের মতো তুমিও মিথ্যে বল”
“একবার করেই দেখো, শেষ নিঃশ্বাস অবধি তোমার বিশ্বাস আগলে রাখবো”

অবুঝ মেয়েটি আবারো ডুকরে উঠলো। তার চোখজোড়া পুনরায় ভিজে গেল। রোদ্দুর বাধা দিলো না। কাঁদুক না, জমা পাথর গলুক। হৃদয়ে ক্রমাগত আঘাত করার চেয়ে সেগুলো অশ্রুরুপে বিসর্জিত হওয়া ঢের ভালো_____

*********
সুরভী দরজা খুলতেই তার আক্কেলগুড়ুম হবার যোগাড়। তুলিকাকে পাঁজাকোল করে তুলে রেখেছে রোদ্দুর। অবুঝ মেয়েটি গভীর ঘুমে মগ্ন। এদিকে হিমা বেগম, তিতির এবং শফিক সাহেবের মুখে নেমে এসেছে আষাঢ়ের মেঘমেদুর। হিমা বেগমের চোখ মুখ বসে গেছে। চোখের কাজল লেপ্টে আছে। তিতিরের অবস্থাও খারাপ। সুরভী কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই শফিক সাহেব বললেন,
“এক গ্লাস পানি হবে বৌ মা?”
“দিচ্ছি বাবা”

সুরভী যেতে পা বাড়াতেই রোদ্দুর পিছু ডাকল,
“ভাবি, ওকে শুইয়ে দিবো”

সুরভী তিতিরকে ইশারা করলো। ফলে তিতির তাকে নিজেদের ঘরে নিয়ে গেলো। অভিলাষা উঠে এলো। তার চোখে মুখে বিশাল কৌতুহল। তিতিরকে শুধালো,
“তুলিকার কি হয়েছে?”
“ওর ট্রমাটাইজ হয়ে গিয়েছিলো। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলিছিলো ক্ষণিকের জন্য”

তুলিকাকে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বলল রোদ্দুর। অভিলাষা খেয়াল করল রোদ্দুর খুব সাবধানতা বজায় রাখছে। যেনো এটা কোনো মোমের পুতুল। একটু অযত্ন হলেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে। অভিলাষা সাথে সাথেই শুধালো,
“ও তো খুব ভালো মনে গিয়েছিলো তাহলে ট্রমাটাইজ কেনো হবে?”

অভিলাষার প্রশ্নটা শুনতেই কপালে ঘন ভাঁজ পড়লো রোদ্দুরের। কথাটা একটু আগঅবধিও ভাবে নি সে। তুলিকা যথেষ্ট স্বাভাবিক ছিলো। তুলিকার মতো রোগীদের এতোটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যাবার জন্য কিছু হলেও ট্রিগার করতে হয়। সাথে সাথেই চোখে ভেসে উঠল, বরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটির মুখশ্রী। তুলিকা বারে বারে তাকে “খু/নী” বলছিলো। একটা সময় তার গলাও চে/পে ধরেছিলো। রোদ্দুরের মনে সাথে সাথেই একটি প্রশ্ন উদয় হলো,
“ছেলেটি কি কোনোভাবে তুলিকার সাথে ঘটিত ঘটনার সাথে জড়িত?”

প্রশ্নটির উত্তর কেবল দুজন মানুষ দিতে পারবে, তুলিকা এবং সেই ছেলেটি। রোদ্দুর একবার তুলিকার মুখশ্রীর দিকে তাকালো। শুকিয়ে গেলে মুখখানা, চোখজোড়ার কাজল লেপটে আছে চোখের নিচে। অশ্রুর শুষ্ক দাগ এখনো দেখা যাচ্ছে। কিছু কৃষ্ণ চুল বিশৃঙ্খল ভাবে মুখের উপর পড়ে আছে। ঠোঁটগুলো ফেটে গিয়েছে। একটু লালচে রক্তের চিহ্নও তাতে আছে। চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রোদ্দুর। অভিলাষার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুলিকার ঘুমের প্রয়োজন। আমরা বাহিরে কথা বলি?”

অভিলাষা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। তিতির থেকে গেলো সেখানেই। বোনের গা থেকে উচ্ছিষ্ট গহনা খুলতে ব্যস্ত হলো______

******

বাহিরের ঘরে পিনপতন নীরবতা। সকলের কপালে বিশ্রী ভাঁজ। তুরান এবং তিমির ক্ষণিকের জন্য বাহিরে গিয়েছিল। তারা এসেই দেখল রোদ্দুর বসে রয়েছে। রোদ্দুরকে দেখেই তুরানের শ্যাম কপালে ভাঁজ পড়ল। ছেলেটিকে তার ভালো লাগে না এমন টি নয়। কিন্তু নিজের অসুস্থ বোনকে তার সাথে বড্ড বেমানান লাগে। শুধু তাই নয়। তুলিকাকে নিজের পরিবার আগলে রাখলেও সেই পরিবার আগলে রাখবে না। যে মহিলা তার বোনকে অপমান করতে সাঁঝবেলায় ছুটে আসেন তার কাছে আর কি আশা করা যায়। তাই খুব স্পষ্ট ভাবেই তাকে বুঝিয়েছিলো তুরান। ভাইয়ের মত, কঠিন কন্ঠে বলেছিলো,
“আমার বোনকে উত্যক্ত করবে না”

কিন্তু ছেলেটি পুণরায় তার বোনের পেছনে হাত ধুঁয়ে পড়ে আছে। তুরান কিছু বলতে যাবার আগেই সুরভী ধীর স্বরে বলল,
“তুলিকা ট্রমা এট্যাক হয়েছিলো”

সুরভীর কথাটি শুনতেই জমে থাকা হুংকার তরল পানি হয়ে গেলো। গম্ভীর স্বরে বলল,
“তুলি কোথায়?”
“ঘুমাচ্ছে, ওকে ঘুমাতে দেওয়াই বুদ্ধিমানের হবে”

সুরভীর পূর্বেই রোদ্দুর কথাটা বলল। তুরান তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে রোদ্দুর বলল,
“আমি আগেই তিমিরকে বলেছিলাম তুলিকার চিকিৎসার প্রয়োজন। ভালো হয়ে যাবার যথেষ্ট চান্স আছে তার। কিন্তু তিমির তা অগ্রাহ্য করেছে”
“আমি তো তোমাকে কারণগুলো বলেছি ডাক্তারবাবু”

তিমিরের কথায় যেনো ধৈর্য্যচ্যুত হলো রোদ্দুরের। কঠিন স্বরে বলে উঠল,
“হ্যা, কিন্তু তোমার কারণগুলো আজ ভুল প্রমাণিত হল। তুলিকার অতীত তাকে সব সময় তাড়া করছে। ওকে যদি স্বাভাবিক জীবনে না আনা হয় একটা সময় ও নিজেকেই হারিয়ে ফেলবে। সেটা কি খুব ভালো হবে? ওর মানসিক অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হবে। কত দিন ওকে ঘরে বন্দি করে রাখবে। কতদিন কয়েদি করে রাখবে”
“আমাদের মেয়ে আমরা বুঝে নিবো”

রোদ্দুরের প্রতিবাদে বাঁধ সাধলো তুরান। ফলে প্রচন্ড মেজাজ বিগড়ালো রোদ্দুরের। কিন্তু মুরুব্বিদের সম্মান করে বিধায় নিজেকে সংযত রাখলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
“বুঝে নেবার নমুনা আজ সবাই দেখেছে তুরান ভাই। জিদের চোটে মেয়েটির জীবন নিয়ে খেলো না”
“তুলিকা সুস্থ হলেও স্বাভাবিক হবে তার গ্যারান্টি কি? কি গ্যারান্টি ও জীবনে এই কালো আঁধার কেটে যাবে। কি গ্যারান্টি ও একটি সাবলীল, প্রাণোচ্ছ্বল জীবন পাবে?”
“আমি গ্যারান্টি। আমি বিয়ে করতে চাই তুলিকাকে………………

চলবে

#নীড়_হারা_পাখি (কপি করা নিষেধ)
#২৯তম_পর্ব

রোদ্দুরের প্রতিবাদে বাঁধ সাধলো তুরান। ফলে প্রচন্ড মেজাজ বিগড়ালো রোদ্দুরের। কিন্তু মুরুব্বিদের সম্মান করে বিধায় নিজেকে সংযত রাখলো। শান্ত কন্ঠে বলল,
“বুঝে নেবার নমুনা আজ সবাই দেখেছে তুরান ভাই। জিদের চোটে মেয়েটির জীবন নিয়ে খেলো না”
“তুলিকা সুস্থ হলেও স্বাভাবিক হবে তার গ্যারান্টি কি? কি গ্যারান্টি ও জীবনে এই কালো আঁধার কেটে যাবে। কি গ্যারান্টি ও একটি সাবলীল, প্রাণোচ্ছ্বল জীবন পাবে?”
“আমি গ্যারান্টি। আমি বিয়ে করতে চাই তুলিকাকে। আগলে রাখতে চাই নিবিড়ভাবে”

রোদ্দুরের স্পষ্ট উত্তরে মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে পরিবেশ। শফিক সাহেবের মুখখানা দ্বিধাদ্বন্দে ঘিরে গেলো। হিমা বেগম ও বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন ছেলেটির দিকে। তুরানের কপালের ভাঁজ ঘন হলো। প্রচন্ড বিস্মিত হলেও কঠিন মুখশ্রী তা প্রকাশ করলো না। মস্তিষ্ককোষগুলো রেষারেষি করছে। বিয়ে, মাত্র দু অক্ষরের শব্দটি ছোট হলেও সেই শব্দের গাম্ভীর্য্য অনেক। এই ভার নেবার স্পর্ধা দেখানো কি এতোটাই সহজ! আজকালকের যুবসমাজ এই ভারের নাম শুনলেই দুকদম পিছিয়ে যায়। কারণ তারা দায়িত্ব নেবার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকে না। উপরন্তু অর্ধাঙ্গিনী যদি হয় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তবে তো কথাই নেই। লেজ গুটিয়ে চপ্পল বগল দাবা করে দশ ক্রোশ দূরে গা ঢাকা দেয়। সেখানে এই যুবক কিনা বিনা ভনীতায়, সরল ভাষ্যে বলে দিলো সে তুলিকাকে আগলে রাখতে চায়। এদের মাঝে তিমির এবং সুরভীর মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেলো না। তারা ছিলো ভাবলেশহীন। তিমির আগ থেকেই আন্দাজ করেছিলো ডাক্তারবাবু আজ বো/ম্ব ফাঁটাবার তালেই আছে। এতোদিনের জোরপূর্বক চেপে রাখা মনের ভাবটা আজ সকলের সম্মুখে সে সাহসের সাথেই জাহির করেছে। সুরভীর ভাবলেশহীনতার কারণ ভিন্ন। সে পুরোপুরি ভাবলেশহীনও নয়। মনে মনে সে বড্ড প্রসন্ন আজ। প্রসন্নতা তুরানের সম্মুখে প্রকাশ করলে ধরা পরে যাবে। কারণ সে তো জানে না। এতোদিন তার অজান্তেই তুলিকার বেরং জীবনটাকে রঙ্গিন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে সুরভী। সকলের অজান্তে রোদ্দুরের সাথে সে কথা বলেছে, তুলিকাকে নিয়ে গেছে তার সাথে দেখা করাতে। ছেলেটি বরাবর ই দায়িত্ববান। ঘটনার প্রারম্ভ হয়েছিলো তুলিকার কা/ম/ড়ে। সেদিন ও বেশ বুদ্ধিমত্তা এবং ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছিলো সে। শেফালী বেগমের প্রচন্ড ক্রোধের অনলে শীতল বারিধারার মত বর্ষিত হয়ে সেদিন সবটা সামলেছিলো। এরপর থেকে যতবার ই তুলিকার জীবনে তার আগমণ হয়েছে সে তুলিকাকে সামলেছে। তিতিরের কাছ থেকে সবটা শুনে কোথাও না কোথাও একটি আশার কিরণ দেখেছিলো। তবে নিশ্চিত ছিলো না। মোহ বলে গা ঝাড়া দেওয়া মানুষদের মাঝে স্বচ্ছ মনের মানুষ পাওয়া আজকাল দুর্লভ। আজ সেই খচখচে মনটা শান্ত হয়েছে সুরভীর। তুরান ঠোঁট গোল করে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর ভরাট কন্ঠে বলল,
“তুমি ক্লান্ত রোদ্দুর, বাড়ি যাও। তোমার রেস্টের প্রয়োজন, বুঝতে পারছি অনেক ধকল গেছে তোমার উপর। তাই তো কি বলছো না বলছো বুঝতে পারছো না”
“আমার তো মনে হচ্ছে না আমি প্রলাপ বকছি!”
“বিয়ে কোনো ফাজলামি নয়। সকালে উঠলাম, দেখলাম কোনো কাজ নেই। কি করা যায়? বিয়ে করে ফেললাম। জীবনটা এমন নয়। তুলিকাকে তোমার ভালো লাগতে পারে, তুমি মোহগ্রস্থ তার প্রতি। তোমার তার প্রতি যে অনুভূতি তাকে সহানুভূতি বলে, আবার ইনফ্যাচুয়েশন ও বলতে পারি। ক্ষণ সময়ের মায়া। কিন্তু যত সময়ের গভীরতা বাড়বে এই মায়া বিষাক্ত হবে। তখন এই মায়াই তিতকুটে অনুভূতি রুপে তোমাকে উত্যোক্ত করবে। তাই বলছি, বাড়ি যাও। ঘুম দাও”

তুরানের কথাগুলো খুব শান্তভাবেই শুনলো রোদ্দুর। কিছুসময় বাদে ঠোঁটের কোনায় বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো। শার্টের হাতাটা কনুই অবধি টেনে ধীর স্বরে বলল,
“ইনফ্যাচুয়েশন নিশ্চয়ই এর পর ও থাকার কথা নয়। এই প্রথম শুনলাম কেউ আহত হবার পরও মোহগ্রস্থ থাকে। যদি সেটা হয়েও থাকে তুমি তাকে মোহগ্রস্থ বলতে পারো না। সে যন্ত্রণা সইছে তার একটি লেজিট কারণ থাকবে। আমারো আছে। সেটা দয়া, সহানুভূতি বা ইনফ্যাচুয়েশন তো নয়। অন্তত এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আর আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে তুমি মনোস্থিতি বোঝাচ্ছো তুরান ভাই? কাইন্ড অফ আইরনি হয়ে গেলো না?”

তুরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। তার কপালের ভাঁজ এখনো আগের মতোই ঘন। রোদ্দুর তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে শফিক সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,
“সাধারণত বিয়ের কথা ঘরের মুরব্বিগোছের মানুষেরাই বলে। কিন্তু আমাদের ঘটনাটি ব্যতিক্রম। যদিও বাবার এতে আপত্তি নেই। তবে মায়ের এই ব্যাপারে আকাশসম সমস্যা। এতে আপনাদের চিন্তা হবে স্বাভাবিক। শুধু এটুকু বলব, আমি থাকতে আমার বাড়িতে তুলিকার অসম্মান হবে না, ওর যত্নের অভাব হবে না। এটুকু বিশ্বাস রাখতে পারেন”

রোদ্দুরের কন্ঠে কোনো জড়তা নেই। একদম স্পষ্ট ভাষায় কথাটা বলল। হিমা বেগম তার মুখের দিকে তাকালেন। চোখজোড়া স্বচ্ছ, প্রতীক্ষিত আশাবাদী কিছু শোনার জন্য। এর মাঝেই কানে ভেসে এলো তীব্র আর্তনাদ। আর্তনাদটি আসছে তুলিকার ঘর থেকে। ফলে নিস্তব্ধতার বধ করে সবার মাঝে তৈরি হলো দমবন্ধ অস্থিরতা। সুরভী সবার আগেই ছুটল ঘরের দিকে। ঘরে যেতেই দেখলো কাঁচুমাচু হয়ে সন্ত্রস্থ যুবতী হাটু আঁকড়ে বসে আছে। তিতির তাকে ছুঁতে গেলেও তার আপত্তি। নিজেকে আঁড়াল করার চেষ্টায় সে লিপ্ত। সুরভী আলতো হাতে স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠলো। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো সে। তার চোখের ভীতি বুকে কামড় বসাল। তবুও শান্ত কন্ঠে বলল,
“তুলি, আমি ভাবি”

তুলিকা চোখের ভাষা জানান দিচ্ছে সে তাকে চিনতে পারছে না। অবুঝ চোখজোড়া হাতড়ালো আশেপাশে। যেনো প্রিয় মানুষটিকে খোঁজার প্রচেষ্টা। এর মাঝেই রোদ্দুর এগিয়ে এলো। স্মিত কন্ঠে বলল,
“ভয় পেয়েছো কি?”

সবাইকে অবাক করে তার দিকে হাত বাঁড়িয়ে দিলো তুলিকা। অভিযোগের স্বরে বলল,
“কোথায় ছিলে তুমি? তুমি না বললে আমাকে ছেড়ে যাবে না?”
“আমি তোমায় ছেড়ে যায় নি। ও ঘরে ছিলাম। তাই তো তুমি ডাকতেই চলে এলাম”
“কোথাও যেও না তুমি”

অবুঝ হাতজোড়া আঁকড়ে ধরল রোদ্দুরের বাহু। রোদ্দুর ও তাকে ছাড়ালো না। অবিন্যস্ত চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“বোকা মেয়ে। উঠলে কেন?”
“কিছু দেখলাম”
“ওসব মিথ্যে, ঘুমিয়ে যাও”
“তুমি কি চলে যাবে?”
“তুমি না ঘুমানো অবধি যাবো না”
“কথা দিচ্ছ”
“হ্যা”

তুলিকা শান্ত হল। চুপচাপ শুয়ে পড়ল সে। তবে রোদ্দুরের হাত এখনো অবধি তার হাতে। রোদ্দুর ও আলতো ভাবে তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। ধীরে ধীরে শান্ত ঘুমে তলিয়ে গেল তুলিকা। তুলিকা ঘুমিয়ে গেলে সুরভীকে ধীর স্বরে বলল,
“ভাবি, ও এখনো ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে নি। আশাকরছি সকাল অবধি ঠিক হয়ে যাবে”

বলেই উঠে দাঁড়াল সে। হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। এক পলক দেখে নিলো ঘুমন্ত প্রেয়সীকে। তারপর শফিক সাহেবের কাছ থেকে বিদেয় নিল। রাত এখন অনেক। মায়ের ফোনের পর ফোন আসছে। রোদ্দুর দেখেও উপেক্ষা করল। একেবারে বাসায় গিয়েই উত্তর দিবে।

রোদ্দুর যাবার পর ঘরে পুনরায় বৈঠক বসল। হিমা বেগম ইতস্তত কন্ঠে বলল,
“কি করবে তুরানের আব্বা?”
“আমার ছেলেটিকে পছন্দ। কিন্তু তার মায়ের যা স্বভাব। চিন্তা তো হচ্ছেই”

শফিক সাহেবের কথা শেষ হতে তুরান ভরাট কন্ঠে বলল,
“আমার মনে হয় ছেলেটি তুলিকার ব্যাপারে সিরিয়াস। আর তুলিকাও তাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। তবে বিয়ে তো মুখের কথা নয়। ওদের পরিবার থেকে তারা অগ্রসর হয় তবেই বোনের বিয়ে আমি সেখানে দিব। কারণ বিয়ের পর রোদ্দুর ঘর ছাড়া হবে এটা আমি কখনোই আমার কাম্য নয়। দেখাই যাক ও কি করে”

তুরানের কথাই যেনো বেদবাক্য। ঘরের কেউ ই তার কথার অমত করল না। তুরান ঠিক করল আগামীকাল এই কথা রোদ্দুরকে জানিয়ে দিবে সে। দেখাই যাক ভালোবাসার জন্য পরিবারকে রাজি করাতে পারে কি না________________

********

দিবার শেষ প্রহর। সূর্য অস্তগামী। নীলাম্বরের পশ্চিমকোনে গাঢ় রক্তিম বর্ণ ছড়িয়ে আছে। চুপিসারে সেই রঙ্গ শুষে নিচ্ছে নিঝুম সন্ধ্যে। আকাশের পূর্ব দিকে থালার ন্যায় চাঁদ নিজেকে পূর্ণ বিকাশিত করেছে। এদিকে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে। লোহার রডের ফাঁকে চাঁদের সৌন্দর্য্য যেনো বেড়ে গেছে। অবশেষে ফাইনাল পরীক্ষার পাঠ চুকিয়েছে তিমির। আশা রাখছে ভালোই ফলাফল হবে। শত চিন্তার মাঝেও একটি আশার কিরণ পেয়েছে। বড় ভাই একটা টিউশন যোগাড় করিয়ে দিয়েছে। যদিও দূরত্ব অনেক কিন্তু ফি খারাপ নয়। অভিলাষার ঔষধের খরচ চলে যাবে। এখন সময় ঘনিয়ে এসেছে। ঔষধ লাগছে বেশি। উপরন্তু মেয়েটিকে আয়রণ ইঞ্জেকশন দেওয়া লাগছে। কারণ রক্তশূন্যতা। তাই অমত করে নি তিমির। চটজলদি লুফে নিয়েছে। ভাই সে টাকা দিয়েছে সেটা রিক্সায় খরচ না করে দুটো মিষ্টি কিনেছে। অভিলাষার কালোজাম খুব প্রিয়। মেয়েটির হাস্যজ্জ্বল মুখখানা দেখার লোভ তার এতোটা হাটার ক্লান্তিটাও উধাও করে দিয়েছে। এর মাঝেই একটি জিপ বিকট শব্দ করে থামলো তিমিরের সামনে। আকস্মিক ঘটনায় চমকে উঠলো তিমির। হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা পড়ে গেলো। খানিকটা রাগ ও হল। কিন্তু সেই রাগ দেখাতে পারল না। তারপূর্বেই ভয়ে মুখখানা শুকিয়ে আসল। কারণ তার সম্মুখে দাঁড়াল, তার সেই কোম্পানির ডিরেক্টরের ছোট ভাই…………

চলবে