নীড় হারা পাখি পর্ব-৩২+৩৩

0
329

#নীড়_হারা_পাখি (কপি করা নিষেধ)
#৩২তম_পর্ব

তিতিরের হাতে একখানা পত্র। সাদা কাগজে গুটি গুটি করে লেখা। সে কাগজটি হাতে নিয়ে বসে আছে। পড়বে কি না সেই দ্বিধায় সে পিষছে। কারণ কাগজের নিচের নামটি তার সহ্য হয় না। “সৌভিক” নামক ব্যক্তির লেখা এই পত্র দিয়ে দ্বিধা চরম সীমায় পৌছালো। মস্তিষ্ক বলছে “খবরদার, ওই আ/হা/ম্ম/ক, বেকার, টোটোকোম্পানির ম্যানেজারের চিঠি তুই পড়বি না”। এদিকে হৃদয় বলছে “আরে, চিঠি ই তো। পড়লে কি ক্ষতি! এমন তো নয় যে, চিঠি পড়লেই প্রেমে পড়ে যাবি। ছেলেটা কত কাঠ খড় পুড়িয়ে তোকে চিঠি দিয়েছে, না পড়লে কাগজ, কালি, আবেগ তিনই অপচয়”

হ্যা, অনেক কাঠখড় পুড়িয়েই পত্রখানা তিতির অবধি পৌঁছেছে। তিতিরের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো। তাই কদিন ঘর থেকে বের হয় নি। সব টিউশন ছিলো বন্ধ। কলেজেও আসতো পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষা দেবার পর পর ই বেরিয়ে যেত। এর পর থেকে যখন আবারো স্বাভাবিক রুটিন শুরু হয়েছিলো আপার বিয়ে নিয়ে তখন হট্টগোল। একদিকে, ছোট ভাবি অসুস্থ, বড় ভাবির ও শরীর আগের মত নেই। দুদিন দুদিন পর পর এক এক ডাক্তারের নিকট নিয়ে যায় ভাইয়া। ফলে একসপ্তাহ পড়া কামাই করেছে সে। একদিকে শান্তি ছিলো যে সৌভিক নামক মানুষটির সাথে সাক্ষাৎ হচ্ছে না। মাঝে কলেজে একদিন পিছুও ডেকেছিলো সে। তবে তিতিরের হাতে সময় ছিলো না। তাই কথা না বলেই চলে আসতে হয়েছিলো। পেছনে তাকালে হয়তো দেখতে পেতো যুবকের মিয়ে যাওয়া মুখখানা। তারপর ই বান্দা তার বান্ধবী লাবণ্যের মারফতে এই পত্র পাঠিয়েছে। সরাসরি নয়, প্রথমে পত্রটি লিটনের মারফতে শামীমের কাছে পৌছে। শামীমের হাত থেকে তার বোন শাহানা। শাহানার হাত থেকে তার বান্ধবী চিত্রা, চিত্রার হাত থেকে তার বোন লাবণ্য। আর আজ লাবণ্যের হাত থেকে চিঠিটি পৌঁছেছে তিতিরের কাছে। লোকটাও পাড়ে, এতো কি কঠিন কথা যে এতো কাঠখড় পোড়ালো? আর তো তিনদিন তারপর অরবিন্দ স্যারের ব্যাচ। ওখানেই নাহয় বলত। না মহাশয়ের কি তর সয়? দ্বিধাদ্বন্দের এক পর্যায়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করলো তিতির।

“প্রিয় ট্রিয় এর ধার ধারছি না, কারণ তুমি আমার মোটেই প্রিয় নও। নিতান্ত অপ্রিয়, ঝগড়ুটে, বেকুব, হিংসুটে, নিষ্ঠুর মেয়ে,
এই তোমার কি মনে দয়া টয়া নেই? নাকি হৃদয়টা পাথর দিয়ে তৈরি। শুনেছি ছেলে প্রজাতি অর্থাৎ পুরুষ প্রজাতিটা চোখ থাকিতেও অন্ধ। তাদের সম্মুখে নারী চিৎকার করে হৃদয়ের হাল জাহির করলেও তারা বুঝে না। অপরদিকে নারী প্রজাতির চোখে ঈশ্বর প্রদত্ত দূরবীক্ষণ যন্ত্র থাকে। তারা দশ ক্রোশ দূর থেকেই বুঝে যায় তাদের কেউ পছন্দ করে কি না। তাহলে তোমার ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম কেন? এই যে বিগত ছয়টা মাস আমি তোমার পেছনে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ঘুরছি চোখে পরে না তোমার? বারে বারে পথিকের মতো হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ছি নজরে পরে না? তুমি সত্যি হৃদয়হীনা। অথবা তুমি নারী প্রজাতির বহির্গত। এই দুটোর কোনটির মাঝে পড়ো, সেই আলোচনা না হয় অন্যদিন করবো। এবার আসি মুল কথায়।

তোমার আশা পূরণ হয়েছে। আমি আর কখনো তোমার পিছু নিবো না। আসলে তোমার হৃদয়ে স্থান নেবার জন্য আমি তোমার পিছু নিতাম না। নিতাম উত্যক্ত করার জন্য। তুমি যখন নাক ফুলিয়ে চোখ রাঙিয়ে চলে যেতে আমার মনে এক অদ্ভুত শান্তি লাগতো। মৃদুমন্দা হাওয়া যখন ঘর্মাক্ত ব্যক্তিকে ছুয়ে যায় ঠিক তেমন শান্তি। ধীরে ধীরে এই ক্ষুদ্র শান্তিটা মনের খোড়াকে পরিণত হতে লাগলো। আমি তোমাকে ভালোবাসি না, কিন্তু তোমাকে না দেখলে ভেতরে উথাল পাথাল হয়ে যায়। এতোটা আকর্ষণ আমার ইহ জীবনে হয় নি বিশ্বাস কর। আমি ছটফট করি। সিগারেটের ধোঁয়াও সেই উন্মাদনা কমাতে পারে না। উদ্রান্তের মতো রাস্তায় চেয়ে থাকি। খুব পছন্দের চাটাও বিষাক্ত লাগে। নাহ, তোমায় আমি ভালোবাসি না। তবে তুমি আমার তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের খোড়াক। সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এই চাহিদাটা মেটার নয়।

আমি চলে যাচ্ছি তিতির। আমার স্কোলারশিপ হয়ে গেছে। ভিসাটা এতোকাল আটকে ছিলো। ভেবেছিলাম হবে না। কথায় আছে না, “যাহা চাই তাহা পাই না”। আমার ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম নয়, আমি যখন বাহিরে যাবার জন্য ছুটতাম তখন ভিসা পাই নি। আর এখন যখন মোটেই চাই নি আমার ভিসাটা হোক, ভিসা চলে এসেছে। আমার যেতে হবে। নয়তো আমার হি/ট/লা/র আব্বা আমাকে আস্তো রাখবে না। আমি এই মাসের শেষ শুক্রবার ঢাকায় চলে যাচ্ছি। আমার টিকিট পনেরো তারিখ। উদ্ভ্রান্ত হৃদয়টা তোমাকে একবার দেখতে চায়। আসবে হৃদয়হীনা?

ইতি
ছা/গ/লের কান মুলে বন্ধুকে বগল দাবা করা আ/হা/ম্ম/ক

চিঠিটা দুবার পড়লো তিতির। সে মোটেই এই অসহ্য লোকটিকে পছন্দ করে না। না করে না। কিন্তু বক্ষস্থলে চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে। খুব বাজে ব্যাথা। কেনো হচ্ছে এই ব্যাথাটা? তবে কি সত্যি সৌভিক তার বাজে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে?

*********

ডাক্তারের সম্মুখে বসে রয়েছে সুরভী এবং তুরান। শেষ আশার কিরণের অপেক্ষায় আছে দম্পতি। না দম্পতি নয়, শুধু সুরভী। তুরানের অপেক্ষা শুধু মেয়েটির মুখে হাসি ফোটার। জীবনের অংকগুলো সবটাই এক এক করে মিলছে। বামপক্ক, ডানপক্ষ মিলে প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে। তবে এই অংকটার কেনো সমাধান পাবে না! তাই তো শেষ আশা পূরণে ডাক্তার ইয়াসমিনের কাছে আসা। মহিলা অভিলাষারও রেগুলার ডাক্তার। সব পরীক্ষার রিপোর্ট খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন তিনি। একটি আল্ট্রাসোনোগ্রাফিও করিয়েছে। সুরভী উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“অপারেশনে ইউট্রাস কাটা ছাড়া কি অন্য উপায় আছে?”

ইয়াসমিন কিছুটা চিন্তিত স্বরে বলল,
“ইউট্রাস কাটতে হবে কেন?”
“টিউমারগুলো নাকি অনেক বড়, বাকিরা তাই ই বলেছে”
“দেখুন, এটা ঠিক টিউমারগুলো বড়। কিন্তু আপনি তো মনে মেডিসিনের ভেতর আছেন?”
“জি”
“সেকারণেই এখন আপনার অবস্থা অনেকটা ভালো। আর জরায়ু কাটার প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। হ্যা, তবে অপারেশন করাতে হবে। আশা রাখছি ভালো কিছুই হবে”
“আমি মা হতে পারবো”

বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করে বসল সুরভী। তার প্রশ্নে মৃদু হাসল ইয়াসমিন। সম্মতিসূচক হাসি হেসে বলল,
“ইনশাআল্লাহ। আমি তো মানুষ মাত্র। উপরে যিনি আছেন তিনি চাইলে সবটাই হবে আশা রাখছি”

সুরভীর চোখ ছলছল করছে কিন্তু ঠোঁটে স্বচ্ছ হাসি। সেই হাসি মুগ্ধ নয়নে দেখছে তুরান। অশান্ত হৃদয়টা আজ শান্ত, বিক্ষিপ্ত স্বপ্নগুলো আজ জড়ো করার পালা যে। মেয়েটিকে সেদিন চূর্ণবিচূর্ণ হতে দেখেছিলো। আজ মেয়েটি আবার বাঁচার আশা খুঁজে পেয়েছে, তুরান পেয়েছে তার হৃদয়হরণীর হারিয়ে যাওয়া সুখ________

********

ল্যাপটপের সামনে বসে আছে রোদ্দুর। এই ছেলের আজ রাতে হলুদ। অথচ বিয়ের ঝঞ্ঝাটকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সে হাসপাতালে এসে বসে আছে। গভীর মনোযোগে কিছু একটা দেখছে। দরজায় চারবার কড়া নেড়েও তার থেকে কোনো প্রকার সাড়া না পেয়ে হনহন করে ঢুকে পড়লো রবিন ভাই। মেজাজ তিরিক্ষি। বাসার বিদ্যুৎ বিল দিতে গিয়েছিলো। একেই লম্বা লাইন। উপরে টোকেন রুপে এসেছে একশত আটাশ ডিজিটের একটা নাম্বার। যা চাপতে চাপতেই দিশেহারা হয়ে গেলো রবিনভাই। পারলে অফিসের লোককেই মে রে বসত। খুব কষ্টে নিজেকে সংযত রাখল সে। হাসপাতালে এসেই দেখে অবস্থা বেগতিক। দুইশত তিন নম্বর কেবিনের প্যাশেন্ট দ্বিতীয় বারের মতো হাসপাতাল মাথায় করেছে। সে নিজেকে দাবি করছে কবি কালীদাস। বিনা নোটিশে আসর বসাচ্ছেন কবিতার। এদিকে শীঘ্রই বিবাহবন্ধনে জড়িত হবে রোদ্দুরের সেদিকে মোটেই নজর দিচ্ছে না। ফলে ধৈর্য্যহারা রবিন ভাই চেঁচিয়ে বললেন,
“না বর মশাই, আপনি যদি বিয়ের শপিং করতেই ব্যস্ত থাকেন তবে হাসপাতালে আসার কি মানে?”

রবিন ভাই এর ধমকে চমকে উঠল রোদ্দুর। বুকে থু থু দিয়ে উলটো ঝাড়ি মে/রে বলল,
“চেঁচাচ্ছো কেনো, একটু হলেই তো আত্মা খাঁচা ছাড়া হত”
“তা কি এতো মনোযোগে দেখছো তুমি? যে কোনো দিকেই খেয়াল নেই”
“জাল পাতছি ঘুঘু ধরব”

রবিন সন্দিহান চোখে তাকাল ল্যাপটপের দিকে। সেখানে পাঁচটা ছেলের ছবি। একজনের উপর ক্রস করা। রবিন ভাই অবাক কন্ঠে শুধাল,
“কারা এরা?”
“তুলিকার আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী”………………

চলবে

#নীড়_হারা_পাখি (কপি করা নিষেধ)
#৩৩তম_পর্ব

হাসপাতালে এসেই দেখে অবস্থা বেগতিক। দুইশত তিন নম্বর কেবিনের প্যাশেন্ট দ্বিতীয় বারের মতো হাসপাতাল মাথায় করেছে। সে নিজেকে দাবি করছে কবি কালীদাস। বিনা নোটিশে আসর বসাচ্ছেন কবিতার। এদিকে শীঘ্রই বিবাহবন্ধনে জড়িত হবে রোদ্দুরের সেদিকে মোটেই নজর নেই। ফলে ধৈর্য্যহারা রবিন ভাই চেঁচিয়ে বললেন,
“তা বর মশাই, আপনি যদি বিয়ের শপিং করতেই ব্যস্ত থাকেন তবে হাসপাতালে আসার কি মানে?”

রবিন ভাই এর ধমকে চমকে উঠল রোদ্দুর। বুকে থু থু দিয়ে উলটো ঝাড়ি মে/রে বলল,
“চেঁচাচ্ছো কেনো, একটু হলেই তো আত্মা খাঁচা ছাড়া হত”
“তা কি এতো মনোযোগে দেখছো তুমি? যে কোনো দিকেই খেয়াল নেই”
“জাল পেতেছি ঘুঘু ধরব”

রবিন সন্দিহান চোখে তাকাল ল্যাপটপের দিকে। সেখানে পাঁচটা ছেলের ছবি। একজনের উপর ক্রস করা। রবিন ভাই অবাক কন্ঠে শুধাল,
“কারা এরা?”
“তুলিকার আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী এই মানুষরুপী পশুগুলো”

কঠিন কন্ঠে কথাটা বলল রোদ্দুর। রোদ্দুরের কন্ঠে সুপ্ত ক্ষোভ। চোখে প্রখরতা। রবিন কিছু সময় তাকিয়ে রইলো রোদ্দুরের দিকে। তার বিস্ময় আকাশ ছুঁয়েছে। আরো একবার ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত স্বরে বলল,
“এদের কিভাবে পেলে তুমি? ডাক্তারি ছেড়ে কি গোয়েন্দাগিরি শুরু করলে নাকি?”
“রবিন ভাই তুমিও না। আমি কোনো গোয়েন্দাগিরি টিরি করি নি। আমার বন্ধু এদের খুঁজে বের করেছে”
“কিভাবে?”
“তোমার মনে আছে আমি তোমাকে বলেছিলাম তুলিকার মেন্টাল ব্রেক ডাউনের কথা?”
“হ্যা তো?”
“এই ছেলেটাকে দেখেই ওর ট্রমা এট্যাক হয়েছিলো”

ক্রস করা ছেলেটিকে দেখিয়ে কথাটা বলল রোদ্দুর। ছেলেটির সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত সেখানে রয়েছে। তার নাম রিজবি শাহাদাত। পেশায় সে এক ছাত্রনেতার বিশিষ্ট সাগরেট। সারাদিন নেতার পেছনে ঘুরে এবং জয়গান করে। বিভিন্ন সমাবেশে তার পকেট ভারী হয়। সেদিন যখন তুলিকা ছেলেটিকে দেখে নিজের ভারসাম্য হারিয়ে তার গলা চে/পে ধরেছিলো তখন কিঞ্চিত সন্দেহ হয়েছিলো রোদ্দুরের। কিন্তু তুলিকার অবস্থার অবনতির জন্য ব্যাপারটা আমলে নেয় নি। রাতে বাসায় যেয়ে বারবার চোখের সম্মুখে ভাসছিলো তুলিকার বিধ্বস্ত অবস্থা, সাথে ওই ছেলেটার ভয়ে মিশ্রিত মুখশ্রী। মনোবিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ থাকার দরুন রোদ্দুরের পড়াশোনার ঘাটতি নেই। পাঠ্যপুস্তক ব্যাতীত অনেককিছু নিয়েই সে পড়াশোনা করে। যেমন অঙ্গভঙ্গি এবং মুখোভাব। ছেলেটির আতংকিত মুখশ্রীটা তাই তাকে প্রচন্ড ভাবাচ্ছে। এমনটা হতেই পারে ছেলেটি অতর্কিত হামলায় চমকে গেছে। কিন্তু অতর্কিত হামলায় চমকানো এবং নিজের দুষ্কর্ম ফাঁস হবার ভীতি দুটো ভিন্ন। সন্দেহের ভিত্তিতেই রোদ্দুর তার বন্ধু ইকরামের সাথে কথা বলে। ইকরাম বর্তমানে মধুপুর থানার অসিরুপে রয়েছে। ফলে তার খেঁচরের অভাব নেই। সেই মানুষগুলোকে দিয়েই রিজবির সমস্ত ডিটেইলস যোগাড় করা। রাজনৈতিক ভাবে জড়িত থাকার কারণে তার নাম্বার খুব সহজেই যোগাড় করে ইকরাম। কৌশলে তার ফোন ট্যাপিং করা হয়। সেটাই হয় ঘুঘুর প্রথম ফাঁদ। একটা কথা আছে, কলুষিত মানুষের ভয় বেশি। তাদের হৃদয়ে দুষ্কর্মের জন্য ফাঁটল ধরতে থাকে। মানুষকে ভয় দেখিয়ে নিজেকে সর্বশক্তিমান প্রমাণ করলেও ভেতরে ভেতরে তারা থাকে চরম ভীতু, কাপুরুষ। রিজবির ক্ষেত্রে অন্যথা হলো না। সেও ভয় পেয়েছে। দুবছর পূর্বের সেই রাতে নিজের পুরুষত্ব দেখাতে যেয়ে যে ঘৃণ্য কাজগুলো করেছিলো সেই কৃতকাজের বিষাক্ত ছোবল তো খেতেই হতো। তাই তো লেজ গুটিয়ে বন্ধুদের সতর্ক করতে ফোন করেছিলো সে। তারা ভেবেছিলো শাফিনের মতো তুলিকাও হয়তো পরাজিত হয়েছে মৃত্যুর কাছে। অবশ্য তুলিকাকে ম/রার জন্যই ফেলে গিয়েছিলো। সৌভাগ্য কিংবা দূর্ভাগ্য তুলিকা বেঁচে আছে। সর্বস্ব হারিয়ে অবুঝ মেয়েটি বেঁচে আছে।

রিজবি সকলের সাথে কথা বলতেই সন্দেহ বাস্তবে পরিণত হলো। সেদিনের ঘটনার সাথে রিজবি জড়িত। তার সাথে আরোও চারজন রয়েছে। নিশাদ আল মামুন, অপূর্ব দাস, আতিউর রহমান আরিফ এবং এই গ্যাং প্রমুখ জাহিদুল ইসলাম। জাহিদুল ইসলাম শহরের ক্ষমতাবান ব্যাবসায়ীর একমাত্র পুত্র। বর্তমানে বাবার ব্যাবসায় তার অবস্থান। মধুপুর বাজারে তার বড় বড় চারটে গোডাউন আছে। সেদিন এই পাঁচজন ই জড়িত ছিলো ঘটনাটিতে। কিন্তু ইকরাম বুঝতে পারছিলো না ঠিক কি করে ওদের ধরা যায়। জাহিদুল ইসলামের বাবার উঠাবসা শহরের নামীদামী লোকের সাথে। এমন কি সিস্টেমেও তার পরিচিতির অভাব নেই। এই কেসটি রফাদফা করতে দু মিনিট লাগবে না। উপরন্তু তুলিকাদের তেমন প্রভাব ও নেই। ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবার। তুরান যদিও সরকারি চাকুরীজীবী কিন্তু তাকে মিথ্যে কেসে ফাঁসাতে সময় লাগবে না। তাই যা করতে হবে বুঝে শুনে।

কিন্তু একটি কথা আছে, পাপের ঘড়া পূর্ণ হলে পাপী শাস্তি পাবেই। হয়তো এই পাপীদের ও পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে। তাই তো পুলিশের থাকে একটি প্রমাণ এসে লেগেছে। খেঁচরদের একজন গতপরশু অপূর্বের মোবাইল চুরি করেছিলো। ইকরামের হাতে মোবাইলটি দিতেই সেটাকে সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হয়। মোবাইলের ভেতরটা তল্লাশী করতেই একটি ভিডিও হাতে পায়। মানুষ কতটা জঘন্য হলে নিজের পাশবিক বর্বরতাকে মোবাইল বন্ধ করে। ভিডিওটিতে তুলিকার সাথে হওয়া অবমাননা এবং শাফিনের উপর হওয়া নির্মমতাগুলো নিপুন ভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। ইকরাম যখন ভিডিওটি দেখেছিলো তার লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। এতোটা জঘন্য মানুষ হয়! ফলে অপূর্বের বিরুদ্ধে এরেস্ট ওয়ারেন্ট বের করে সে। অপূর্বকে গ্রফতার করা হয়েছে। পুলিশের থার্ড ডিগ্রিতে সে সবকিছু স্বীকার ও করেছে। ফলে বাকিদের ও গ্রেফতার করা হয়েছে। এখানে পুলিশ বেশ চতুরতার প্রমাণ দিয়েছে। যদিও জাহিদ, আরিফ, নিশাদ নিজেদের কুকৃর্তী স্বীকার করে নি। সেজন্য দ্বিতীয় ফাঁদ পাতা। রবিন ভাই কৌতুহলী স্বরে বলল,
“এখন কি করবে? ওদের তো পাওয়ার কম নয়। উচু পর্যায়ে তাদের উঠা বসা। উপরন্তু তুলিকা মানসিক ভাবে অসুস্থ, ওর সাক্ষী তো গ্রান্ট ই হবে না। আর ওর পরিবার কি চাইবে এই ঝামেলায় জড়াতে”
“নাহ চাইবে না। এজন্যই তো আস্তে আস্তে এগুচ্ছি। ইকরাম ভিডিও থেকে শাফিনের খু/নের ক্লিপটা কাট করে ভাইরাল করে দিয়েছে। শাফিনের বাবা-মা ছেলের খু/নীদের শাস্তি দেবার জন্য মরিয়া হয়ে আছেন। ফলে তাদের এখানে জড়াতে আপত্তি নেই। আর তাদের যথাযথ পুলিশ প্রটেকশন ও দেওয়া হচ্ছে। আজকের খবরটা পড়েছো? পড়লে জানলে পারতে। নিউজের এখন হট টপিক “শাফিনের খু/ন”
“তাহলে তুমি তুলিকার ব্যাপারটা আনবে না সামনে?”
“না, এখন তো না। বিয়েটা ভালোই ভালোই হয়ে যাক। এরপর বাকিটুকু দেখবো”
“তোমার বাসায় এই ঘটনা জানে?”
“আমি জানি, এটুকু যথেষ্ট”
“কখনো অচেতন মনে চিন্তা আসে না? মেয়েটির কালো অতীতটা তোমায় ভাবায় না?”

রবিনের প্রশ্নে স্মিত হাসল রোদ্দুর। হেলান দিয়ে গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে। তারপর স্মিত স্বরে বলল,
“চাঁদে দাগ থাকলেও চাঁদ কিন্তু অমূল্য। আমার চাঁদেও দাগ আছে, কিন্তু সে নিষ্কলঙ্ক”

রবিন বুঝল প্রেমিক ছেলেটির যায় আসে না কিছুতেই। সে শুধু প্রেয়সীকে নিজের করে পাবার জন্য তীর্থের কাকের মতো দিন গুনছে______

*****

আলোকিত হলুদ সন্ধ্যায় মুখরিত পরিবেশ। আনন্দের জোয়ার আছড়ে পরছে প্রতিটি জীবনের অন্তরে। দেওয়ালে পোস্টারে লেখা “তুলিকার গায়ে হলুদ”। সুরভী নিজ হাতে হলুদ বেটেছে। অভিলাষা নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে আনন্দে মেতেছে। ঠিক কতদিন পর নীড় হারা পাখিদের নীড়ে সুখের জোয়ার এসেছে জানা নেই। তিমিরের সাথে অভিলাষার শীতল যুদ্ধ এখনো চলমান। অভিলাষা এখনো বুটিকের কাজটা করছে। ফলে মনোমালিন্যটা গাঢ় হচ্ছে। তিমিরের মাঝে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে অভিলাষা। কিছু একটা নিয়ে সে চিন্তিত। অভিলাষা জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে জানার উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে। এদিকে হলুদ সন্ধ্যায় তুলিকাকে হলুদে রাঙ্গানো হয়েছে। হলুদ শাড়ি, চুলে হলুদ গাদার মালা। রঙ্গটি তার শুভ্র দেহে মিশে আছে যেন। ঘরোয়া ভাবেই অনুষ্ঠান তাই লোক নেই বললেই চলে। ক্ষুদ্র পরিসরে অনুষ্ঠানটির আয়োজন। তুলিকাকে বসানো হলো খাটে। সামনে ডালা। বাটা হলুদের বাটিটা রাখল তার সামনে। হলুদ লাগানোর পর্ব শুরু হতেই কলিংবেল বেজে উঠল। দরজাটা খুলতেই দেখা গেল হলুদ পাঞ্জাবী পরিহিত বর মশাই দাঁড়িয়ে আছে। তিতির অবাক কন্ঠে শুধাল,
“তুমি এখানে?”
“তুমি অনেক প্রশ্ন কর, বলেছি না বড় বোনের প্রেমের মধ্যে নাক গলাবে না। আমার বউটি কোথায়?……..

চলবে