নীড় হারা পাখি পর্ব-৩৪+৩৫

0
325

#নীড়_হারা_পাখি (কপি করা নিষেধ)
#৩৪তম_পর্ব

তুলিকাকে বসানো হলো খাটে। সামনে ডালা। বাটা হলুদের বাটিটা রাখল তার সামনে। হলুদ লাগানোর পর্ব শুরু হতেই কলিংবেল বেজে উঠল। দরজাটা খুলতেই দেখা গেল হলুদ পাঞ্জাবী পরিহিত বর মশাই দাঁড়িয়ে আছে। তিতির অবাক কন্ঠে শুধাল,
“তুমি এখানে?”
“তুমি অনেক প্রশ্ন কর, বলেছি না বড় বোনের প্রেমের মধ্যে নাক গলাবে না। আমার বউটি কোথায়?”

অকপটে তুলিকাকে নিজের বউ বলে দাবি করে বেহায়ার মতো ঠোঁটের কোনায় দুষ্টু হাসি এঁকে রেখেছে রোদ্দুর। তিতির কিছু সময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ভাব গুরুগম্ভীর রোদ্দুর ভাইকে এমন রোড সাইড হ্যাংলা রোমিওদের রুপে দেখবে সে কল্পনাও করে নি। করবে কি ভাবে! পাগলের ডাক্তার নামে প্রখ্যাত এই লোকের পাড়ায় বেশ দাপট। পাড়ার অবিবাহিত এবং কিশোরী মেয়েদের কোন এককালের ভালোলাগা। অথচ সেই সকল নারীর হৃদয়কে চূর্ণ বিচূর্ণ করে চুপচাপ, গম্ভীর, নির্লিপ্ত চিত্তের এই লোকটি তার বোনের প্রণয়ে মেতেছে। শুধু মেতেছে বললে নিতান্ত ভুল হবে, রীতিমতো হাবুডুবু খেয়ে ডুবেছে। তাই তো হলুদের দিন লজ্জার মাথা খেয়ে বউ এর হলুদে উপস্থিত। তিতির দরজা থেকে নড়ল না, এক দফা ভেতরে দেখল। তারপর দরজা ভিজিয়ে বাহিরে এলো। রোদ্দুরের কাছে গিয়ে আকুতির স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আপার হলুদ হচ্ছে, তোমার এখানে কি কাজ?”
“বাহ! আমার বউ এর হলুদে আমি থাকবো না? মানে সবাই আমার বউকে হলুদ দিবে আর আমি হাতের উপর হাত দিয়ে বসে থাকব?”
“মানে কি! তুমি আপাকে হলুদ দিবে?”
“ আলবৎ দিবো। আমার অধিকার”
“বড় ভাইয়া বাসায় আছে। ঘরে মুরব্বীরাও আছে। আমি বলি কি! আর তো দুটো দিন। তারপর আপা তোমার বাড়ি। তখন হলুদ, মরিচ সব লাগিও। আজ আর কান্ড করো না। তোমার আর আপার কান্ডে আমি সুপারির মতো পিষছি। একমাত্র শালি তোমার একটু রহম কর”

মিনতি করে কথা খানা বলল তিতির। রোদ্দুর চিবুকে হাত দিয়ে কিছু সময় ভাবলো। গভীর ভাবনা। তিতির ভাবল, বান্দার বুঝি সুবুদ্ধি হল। কিন্তু না তাকে ভুল প্রমাণ করে রোদ্দুর হাসি মুখে বলল,
“সরি শালিকা। পারলাম না। কত দিনের শখ জানো! সেই প্রতীকের বিয়ে থেকে আমি এই দিনের প্রতীক্ষায় ছিলাম। প্রথমে তোমার বোন ভেটু দেয়, তারপর তোমার ভাই। কত সাধনার পর আমার বউ আমার হচ্ছে। এখন তুমি এসেছো ভেটু দলের সর্দার হয়ে”

রোদ্দুরের কথায় সরু চোখে তাকালো তিতির। নিজের এতোদিনের পোষা ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে ধোঁয়ায় উঁড়িয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। হতাশ কন্ঠে বলল,
“আজ নিজের ভ্রান্ত ধারণাটা ভাঙ্গলো। সবাই বলে তোমার পার্সোনালিটির কি প্রশংসা করে! তারা তো জানে না, তুমি আসলে একটা ছ্যা/চ/ড়া”
“ওই ছ্যাঁ/চ/ড়া বল, আর গোছড়া বল; যাই বল না কেনো আমি গা মাখাচ্ছি না। গ্রন্থে আছে প্রেমিকদের মান অপমানবোধ থাকতে নেই। তাদের হতে হয় বেহায়া, নির্লজ্জ। আমি তেমন ই। এবার পথ ছাড়”
“তোমার মা জানে তুমি এখানে?”
“না জানে না। তবে হলুদ দিতে আসলে জেনে যাবে। আর কোনো প্রশ্ন?”

তিতির তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। না আটকানো গেলো না প্রেমিক মহাদয়কে। সে তার বউকে দেখবে এবং নিজ হস্তে হলুদ দিবে। তিতির আটকালো না। রোদ্দুর যেতে যেয়েও থামলো। পেছনে ফিরে ফিসফিসিয়ে বলল,
“অবদান উধার রইল, তোমার প্রেমের বেলায় সুদে আসলে দিব। পেশায় ডাক্তার হলেও হিসেবে আমি পুক্ত”

কথা খানা শুনতেই গালে রক্ত জমল তিতিরের। লজ্জায় রক্তিম মুখখানা কথা হারিয়ে ফেলল। রোদ্দুর হাসি বিস্তৃত করে চলল ভেতরে। গায়ে হলুদে রোদ্দুরকে দেখে মুরব্বীদের মাঝে কানাগোসা শুরু হল। রোদ্দুরের এরুপ লাজহীন কাজে তারা আপত্তি এবং টিপ্পনী উভয় ই কাটলেন। তবে কিছু যায় আসলো না রোদ্দুরের। সুরভী মিটিমিটি হেসে ঠাট্টা করে বলল,
“বর মহাশয় আর মাত্র দুদিন, একটু ধৈর্য্য রাখাই যেত”
“তা অবশ্যই যেতো বটে, কিন্তু হলুদ তো একবার ই হয়। বারবার কি সেই সুখ পাওয়া যায়?”

হিমা বেগম কিছু বললেন না। বরং কোথাও না কোথাও তার হৃদয়ে আনন্দের লহর উঠছিল। তার অভাগা মেয়েটি যে এতোটা ভালোবাসা পাবে ভাবতেও শীতলতা বয়ে যাচ্ছে। আবার বুকের কোনো এক প্রকোষ্ঠ্যে ভয় ও উঁকি দিচ্ছে। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। হিমা বেগমের ক্ষেত্রে অন্যথা নয়। মেয়েটির নিষ্ঠুর ভাগ্যটি একবার তাকে ঠকিয়েছে, আবারো তেমন হলে যেটুকু বাঁচার শক্তি আছে তাও নিঃস্ব হয়ে যাবে। ফাঁপা, নিঃস্ব মেয়েটি তখন জীবন্ত লাশে পরিণত হবে। ভাবনাটা মানসপটে ধরা দিয়ে কেঁপে উঠে হৃদয়। পর মুহূর্তে রোদ্দুরের এমন প্রণয়মাখা কাজকর্মে নিজেকে স্বান্তনা দেন হিমা বেগম। রোদ্দুর যখন তুলিকার পাশে গিয়ে বসল, মেয়েটি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ঘনঘন পলক ফেলল। তারপর কৌতুহল নিয়ে শুধাল,
“তুমি এখানে কেন?”
“তোমাকে কা/ম/ড়া/তে এসেছি”

নির্বিকার চিত্তে কথাখানা বলল। অবুঝ নারী খানিকটা চমকাল, তার বিস্ফারিত নয় নিষ্পলকভাবে দেখছে রোদ্দুরকে। যুবকটির ঠোঁটে হাসি। দুর্বোধ্য হাসির মর্মার্থ বুঝলো না সে। নিজের শাড়িটা দু হাতের ভেতর নিষ্পেষিত করতে করতে শুধাল,
“তুমি মিথ্যে বলছ, তাই না?”
“একেবারেই না, তোমার কা/ম/ড়ের দাগ এখনো জীবন্ত। আমি ছাড়ার পাত্র নই, শোধটা তোলা বাকি আছে। সুযোগ বুঝেই আদায় করব”

এবার কিঞ্চিত ভয় পেলো তুলিকা। ঠোঁট কামড়ালো। কিছু একটা ভাবলো বেশ তন্ময় হয়ে। অসহায় দৃষ্টিতে খুঁজলো সুরভীকে। কিন্তু ভাবী তো তখন ব্যস্ত হলুদের আয়োজনে। এর মাঝেই রুক্ষ্ণ হাত ছুলো নরম গাল। গালের হলুদের স্পর্শ পেতেই তুলিকা চট করে রোদ্দুরের দিকে তাকাল। রোদ্দুর নির্লিপ্ত হেসে বলল,
“এটা হল সুদ, আসল টা বিয়ের রাতে দিবো”

বলেই সে দাঁড়িয়ে বলল। পা বাড়ালো বাহিরের দিকে। হলুদের সূচনা হল, একে একে হলুদ রাঙা হল সবাই। শুধু তুলিকার ঘোলাটে নিখাদ চোখজোড়া খুঁজলো একজনকেই। দক্ষিণ হাওয়ার মত এসে বেরং হৃদয়ে যে এক মুঠো বসন্ত ছুইয়ে দিয়েছে__________

**********

বাতাসে বহু প্রতীক্ষিত সুখের সুবাস, আনন্দের ঝলকানি যেনো তীব্র সোনালি রোদে। বসার ঘরে মানুষের ভীড়। প্রাণোচ্ছল দুপুরে বিয়ের আয়োজন। পরিবেশ দ্বিগুন মুখোরিত করেছে রাহাত সাহেব। ফাগুনের শেষ শুক্রবারে রোদ্দুর এবং তুলিকা নামজোড়ার মিলন ঘটল। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর পর দোয়া করলেন। খুরমা খাওয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হল বিয়ে। তুলিকা স্বাক্ষরের বদলে টিপসই নেওয়া হল। লাল বেনারসিতে নিজ প্রেয়সীকে বিনিদ্র নয়নে বহুবার কল্পনা করেছিলো রোদ্দুর। কিন্তু বাস্তবে তাকে দেখে হৃদয়ে সেতার বাজবে কল্পনা করে নি। শুভ্র বদনে লাল রংখানা মিলেমিশে কৃষ্ণচূড়ার রুপ ধারণ করেছে। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম কৃষ্ণচূড়া। ঘোলাটে বেড়াল চোখে নিজের প্রতিবিম্বকে দেখে মনে মনেই হাসল সে। যখন তাদের দুজনকে একা একা রাখা হল আলতো হাতে কোমল হাতখানা নিজ হাতে নিল। আজ অনুমুতি চাইলো না। আদুরে ভাবে যখন আঙুলে আঙুল গলাচ্ছিলো, নারীর শরীর ঈষৎ কম্পিত হচ্ছিল। রোদ্দুর বুঝল ব্যাপারখানা। অবুঝ মেয়েটি বড্ড ভীতু। আর তার ভয় মিশ্রিত চোখের চাহনী সর্বাধিক আদুরে ঠেকে। ফলে ভয়ের মাত্রা বাড়াতে ধীর কন্ঠে বলল,
“আজ রাতের জন্য প্রস্তুত তো?”
“রাতে কি হবে?”

আতংকিত কন্ঠে তুলিকা শুধালে উত্তরে রোদ্দুর স্মিত হেসে বলে,
“সময় এলেই জানতে পারবে”……………………

চলবে

#নীড়_হারা_পাখি (কপি করা নিষেধ)
#৩৫তম_পর্ব

খুরমা খাওয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হল বিয়ে। তুলিকা স্বাক্ষরের বদলে টিপসই নেওয়া হল। লাল বেনারসিতে নিজ প্রেয়সীকে বিনিদ্র নয়নে বহুবার কল্পনা করেছিলো রোদ্দুর। কিন্তু বাস্তবে তাকে দেখে হৃদয়ে সেতার বাজবে কল্পনা করে নি। শুভ্র বদনে লাল রংখানা মিলেমিশে কৃষ্ণচূড়ার রুপ ধারণ করেছে। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম কৃষ্ণচূড়া। ঘোলাটে বেড়াল চোখে নিজের প্রতিবিম্বকে দেখে মনে মনেই হাসল সে। যখন তাদের দুজনকে একা একা রাখা হল আলতো হাতে কোমল হাতখানা নিজ হাতে নিল। আজ অনুমুতি চাইলো না। আদুরে ভাবে যখন আঙুলে আঙুল গলাচ্ছিলো, নারীর শরীর ঈষৎ কম্পিত হচ্ছিল। রোদ্দুর বুঝল ব্যাপারখানা। অবুঝ মেয়েটি বড্ড ভীতু। আর তার ভয় মিশ্রিত চোখের চাহনী সর্বাধিক আদুরে ঠেকে। ফলে ভয়ের মাত্রা বাড়াতে ধীর কন্ঠে বলল,
“আজ রাতের জন্য প্রস্তুত তো?”
“রাতে কি হবে?”

আতংকিত কন্ঠে তুলিকা শুধালে উত্তরে রোদ্দুর স্মিত হেসে বলে,
“সময় এলেই জানতে পারবে”

কথাটা শুনতেই ভয়ের কুয়াশা গাঢ় হলো তুলিকার। ফট করে বলে উঠল,
“যাবো না তোমার সাথে”
“সে তো বলতে হবে না। এখন আমার সাথেই তোমাকে যেতে হবে। পালানোর উপায় নেই কিন্তু”
“তুমি কি আমাকে গু’ম করে দিবে?”
“হ্যা?”
“হ্যা, কাল তুলিকার সাথে একটা সিনেমা দেখেছি। ওখানে ছেলেটি বিয়ে করে মেয়েটিকে গু’ম করে ফেলেছে”

তুলিকার কথা শুনে শব্দ করেই হেসে উঠল রোদ্দুর। হাসির দাপটে শরীর কাপছে তার। মেয়েটি যে সিনেমাটি বুঝে তার উপর প্রয়োগ করেছে এটাই ঢের। খুব কষ্টে হাসি থামাল রোদ্দুর। তারপর গাঢ় কন্ঠে শুধাল,
“তোমার কি মনে হয়?”

প্রশ্নটা ভাবাল তুলিকাকে। সে ভ্রু কুঞ্চিত করে গভীর মনোযোগ সহকারে চিন্তা করল। আড়চোখে একবার তাকাল শ্যাম মুখশ্রীর দিকে। ছেলেটির মাঝে গু’ম করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং ঝিলের মতো স্বচ্ছ চোখজোড়ায় নিজের নিখাদ প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। যেকানে অন্য কারোর ঠাঁই নেই। তুলিকা মাথা নত করে নিলো। বিড়বিড় করে বলল,
“আমাকে গু’ম করতে আসলে আমিও ছেড়ে দিব না”
“অপেক্ষায় রইলাম”

তুলিকার বিদায়ের প্রস্তুতি চলছে। ঔষধ, কাপড় সব একটি ব্যাগে গুছিয়ে দিয়েছে সুরভী। কাল অবধি সুরভীর মনটি খুব ভালো ছিলো, কিন্তু আজ নেই। তুলিকা চলে যাচ্ছে। মেয়েটির চাঞ্চল্য পুরো ঘর জুড়ে বিস্তৃত থাকলো। সারাক্ষণ ভাবি ভাবি করে মাথার পোকা বের করে নেওয়া মেয়েটি এখন শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে। ভাবতেই হৃদয়ে এক শূন্যতার আবির্ভাব হচ্ছে। সুরভীর কাছে সে নিজ সন্তান থেকে কম নয়। এখন আর শুনবে না, “ভাবি আমাকে খেতে দাও না কেনো?”, “ভাবি আমি হাসপাতালে যাবো না”, “ভাবি আমার ঝ’গ’রু’টে মাকে বল না আমাকে বাহিরে যেতে দিতে”, “ভাবি ওই খ’চ্চ’র মহিলা আমাকে পা’গ’ল বলেছে, ওকে বকে দিবে না?” কথাগুলো মনে পড়তেই চোখজোড়া ঝাপসা হল সুরভীর। খাটের উপর পা দোলাতে থাকা তুলিকার দিকে একবার চাইলো সে। মুচকি হেসে বলল,
“ওই বাড়িতে গিয়ে আমাদের ভুলে যাবি তুলি?”
“ভুলবো কেনো? আমি কি তিতিরের মতো ভুলোমনা নাকি?”
“তাহলে আমার কিছু কথাও মন দিয়ে শোন, ভুলে যাবি না কিন্তু”
“কি?”
“ওখানে কোনো বেয়াদবি করবি না, কেউ কিছু বললে গায়ে মাখাবি না। লক্ষী মেয়ে হয়ে থাকবি, জিদ করবি না। উনি কিছু বলবে উনাকে মা’রতে যাবে না। এখানে যেমন করো ওখানে তেমন কিছুই করবে না। ওটা তোমার শ্বশুরবাড়ি মনে থাকবে? রোদ্দুরের মাকে মা বলবি”
“আমার মাকি মরে গেছে নাকি, ওই খ’চ্চ’র মহিলাকে মা বলব কেনো?”
“এটাই নিয়ম। আমি আর অভিলাষাও তো মাকে মা বলি। বিয়ের পর স্বামীর বাবাকে বলতে হয় বাবা আর স্বামীর মা হলেন মা। মনে থাকবে?”
“থাকবে। শ্বশুরবাড়ি কি আমার বাড়ি হবে কখনো?”

তুলিকার অবুঝ প্রশ্ন অবাক হল সুরভী। কখনো কল্পনাতেও এই প্রশ্ন তার মস্তিষ্কে আসে নি। কিছুক্ষণ ভেবে স্মিত হেসে বলল,
“বানিয়ে নিলেই হবে, তুমি এখন একজনের মেয়ে, একজনের বোনের সাথে সাথে একজনের স্ত্রী এবং বউ মাও। তাই তোমাকে সবটা মানিয়ে নিতে হবে। প্রথমে প্রথমে খুব মন খারাপ হবে, নিজের বিছানা, নিজের বালিশ, নিজের ঘর, নিজের মানুষদের খুব মনে পড়বে। একটা সময় দেখবে অভ্যাস হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে স্মৃতি ঝাপসা হবে এবং অভ্যাস গাঢ়। তখন নতুন মানুষদের মাঝেই নিজেকে খুঁজে পাবে। বুঝলে বোকা?”

তুলিকা চেয়ে রইল। সে বুঝে নি। কিন্তু তার মনে এখন কোনো ভয় নেই। কারণ জানে অচেনা মানুষের একটা চেনা মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছে।
********

তুরানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রোদ্দুর। বউ নিয়ে এখন ই রওনা হবে তারা। কিন্তু তার পূর্বে তুরান একাকিত্বে তার সাথে কথা বলতে চায়। সেও বাধা নেয় নি। সকলের আড়ালে নিরিবিলি দাঁড়াতেই তুরান খবরের কাগজ তার দিকে এগিয়ে দিলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“এই কাজটি তোমার?”

খবরের কাগজের তৃতীয় পাতায় বড় করে লেখা “দুবছর পূর্বের খু/নের শাস্তি পেতে চলেছে পাঁচ জন খু/নী। অবশেষে বিচার পাবে বৃদ্ধ পিতামাতা”। রোদ্দুর হেডলাইনটা দুবার পরলো। ঠোঁটের কোনে ভেসে উঠল তৃপ্তির হাসি। বিনা ভনীতায় বলল,
“বিচার এতো তাড়াতাড়ি হবে ভাবতেও অবাক লাগছে। ইকরামকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। ওর বুদ্ধি কাজে লেগেছে”
“আমি তোমাকে বাধা দিবো না। কারণ তুলিকা এখন তোমার দায়িত্ব। কিন্তু কেঁচো খুড়তে সাপ যেনো না বের হয়। তুলিকা অনেক সহ্য করেছে। সুতরাং যদি ওকে নরকে ঠেলে দাও আমিও চুপ থাকবো না”
“আমি দায়সারা মানুষ নই, দায়িত্ব যখন বুঝে নেই তা মৃত্যু অবধি তা পালন করার চেষ্টা করি। আর এখানে তো আমার সর্বস্ব জড়িত। ওকে নরকে ঠেলে দেওয়া মানে নিজেকে সর্বশান্ত করা। নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে। তাই নিশ্চিন্তে থাকো তুরান ভাই। তুলিকাকে মুক্ত আকাশ দিব কথা দিয়েছি। কথাটা যে রাখতে হবে”

তুরান কথা বাড়ালো না। রোদ্দুর ছেলেটির প্রতি তার বিশ্বাস আছে। ইতোমধ্যে বরযাত্রী যাবার জন্য প্রস্তুত। তাই আর সময় নষ্ট করলো না কেউ। শুরু হল বিদায় যাত্রা।

অশ্রুসিক্ত মুখে বিদায় দিলো তুলিকার। হিমা বেগম মেয়ের মুখশ্রীতে অসজ্র চুমু আকলেন। মেয়েটিকে একদিন তার পাগলামির জন্য মে’রেছিলেন। আজ সেই মেয়েটি ঘরশূন্য করে চলে যাচ্ছে। শফিক সাহেব কাঁদলেন না। পুরুষদের কাঁদতে নেই। তাই তিনি মেয়েকে হাসি মুখের বিদায় দিলেন। তিমির যাবার কালে বোনের কানে কানে বলল,
“ওখানে কেউ কিছু বললেই চলে আসবি”

তুলিকা মাথাও নাড়ালো। অধিক কান্না করলো তিতির। তার সতেরো বছরের রুমমেট তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। হয়তো খাটটি সম্পূর্ণ ভোগের সুযোগ পাবে কিন্তু বোনটিকেতো পাবে না। গাড়িতে উঠার সময় তুলিকাও কাঁদছিল। রোদ্দুর তখন রুমালটা বের করে গাঢ় কন্ঠে বলল,
“এই শেষবার, আর কাঁদবে না। তোমাকে কাঁদতে দেখতে ভালো লাগে না”

**********

শেফালী বেগম মিষ্টি নিয়ে বরণ করলেন তুলিকাকে। কিন্তু তাকে মোটেই প্রসন্ন লাগছিল না। রাগের চোটে নিজের আত্নীয়দের ও খবর দেন নি তিনি। কি বলবেন, “ছেলে পাগল মেয়ে বিয়ে করে এনেছে”! ছেলের বিয়ে নিয়ে তার সকল পরিকল্পনা ধুলিসাৎ হয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলেন স্বামী তার সঙ্গ দিবেন, কিন্তু সে উলটো লাফাচ্ছে আনন্দে। যেনো কত বড় তোপের ন্যায় কার্যসাধন করেছেন। রোদ্দুরের বাসায় এই প্রথম আসল তুলিকা। এই বাড়িতে আসতে পাঁচ-ছয় জোড়া চোখ তার দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। অপরিচিত মানুষের মাঝে এর পূর্বে কখনো থাকা হয় নি তার। এই প্রথম এই অভিজ্ঞতা। এখানে সুরভী, অভিলাষা, তিতির কেউ নেই। আছে শুধু অপরিচিত মানুষ। মেয়েটি চুপসে গেলো। তার হাত ঘামছে। ফলে কোমল হাতটা আলতো করে নিজের হাতের ফাঁকে পুরলো রোদ্দুর। ঘটনাটি সরু চোখে পর্যবেক্ষণ করলেন শেফালি বেগম। ইতোমধ্যে হাসির রোল পড়ল,
“রোদ্দুর তো বউ ছাড়া চলতেই পারে না। আরে ওকে কি আমরা খেয়ে ফেলব নাকি?”

রোদ্দুর গায়ে মাখলো না। উলটো তাদের বিদ্রুপকে উপেক্ষা করে বলল,
“মা ঘরে যাব। তোমার হয়ে গেলে আমরা যাই?”

রোদ্দুর জিজ্ঞেস করলেও উত্তরের অপেক্ষায় থাকলো না। নিজের বউ কে নিয়ে ঘরে চলে গেলো। শেফালী বেগম বিনাবাক্যে সহ্য করলেন।

****

রোদ্দুরের ঘরটি ছোট গোছের। একটি খাট, একটি আলমারি, একটি টেবিল। দক্ষিণে বড় একটি জানালা। জানালাটি দিয়ে তুলিকার ঘরের বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। রোদ্দুর প্রতিরোজ এখান থেকেই দেখতো উদাসীন মেয়েটিকে। তুলিকা খাটে বসতে নিলেই রোদ্দুর লাগেজ থেকে কাপড় বের করল। তুলিকার হাতে দিয়েই বলল,
“চেঞ্জ করে নাও। তারপর আমার সাথে যাবে”
“কোথায় যাবো?”

আতংকিত কন্ঠে শুধালো তুলিকা। রোদ্দুর দুষ্টু হাসি হেসে বলল,
“বাহ রে! গু’ম করবো না?”

বলেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো সে। নাহ গু’ম সে করে নি। তুলিকাকে নিয়ে গিয়েছিলো ছাঁদে। কারণ তার বহুদিনের শখ ছিলো তার বাসর হবে জ্যোৎস্নাবিলাসে………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি