নীড় হারা পাখি পর্ব-৩৬

0
305

#নীড়_হারা_পাখি (কপি করা নিষেধ)
#৩৬তম_পর্ব

রোদ্দুরের ঘরটি ছোট গোছের। একটি খাট, একটি আলমারি, একটি টেবিল। দক্ষিণে বড় একটি জানালা। জানালাটি দিয়ে তুলিকার ঘরের বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। রোদ্দুর প্রতিরোজ এখান থেকেই দেখতো উদাসীন মেয়েটিকে। তুলিকা খাটে বসতে নিলেই রোদ্দুর লাগেজ থেকে কাপড় বের করল। তুলিকার হাতে দিয়েই বলল,
“চেঞ্জ করে নাও। তারপর আমার সাথে যাবে”
“কোথায় যাবো?”

আতংকিত কন্ঠে শুধালো তুলিকা। রোদ্দুর দুষ্টু হাসি হেসে বলল,
“বাহ রে! গু’ম করবো না?”

বলেই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো সে। নাহ গু’ম সে করে নি। তুলিকাকে নিয়ে গিয়েছিলো ছাঁদে। কারণ তার বহুদিনের শখ ছিলো তার বাসর হবে জ্যোৎস্নাবিলাসে।

কৃষ্ণ আকাশের নিচে বসে আছে রোদ্দুর এবং তুলিকা। মাথার উপর জেদী কিশোরীর ন্যায় পূর্ণ চন্দ্র নিজেকে বিকাশিত করছে। বাতাসে সদ্য ফোটা গোলাপের মিষ্টি সুবাস। কালচে আধারের মাঝে দূর ল্যাম্পপোস্টের আলো আঁছড়ে পড়ছে তুলিকার উন্মুক্ত পায়ে। মৃদু বাতাসে উড়ছে তার কৃষ্ণ চুল। ঘোলাটে চোখে অধীর আগ্রহে দেখছে খোলা আকাশ, চন্দ্রমার সৌন্দর্য্য তাকে মুগ্ধ করছে। এমন জ্যোৎস্না ভরা আকাশ আগেও দেখেছে কিন্তু এতোটা মুগ্ধ করেনি তাকে। আজ করেছে। নিরীহ চোখজোড়া তাই পলকহীন নজরে দেখছে। আর অন্যদিকে প্রেমিক ব্যস্ত তার প্রেয়সীকে দেখতে। প্রেমিকার উন্মুক্ত অবাধ্য চুল বাতাসের উন্মাদনায় মুখে এসে পড়ছে। যা মোটেই তার দৃঢ়তা ভঙ্গ করছে না। রোদ্দুরের গাঢ় নয়নে চাঁদের সৌন্দর্য্য থেকে তার একান্ত চাঁদটি বেশি সুন্দর। নিজের কাজে নিজেও অবাক হচ্ছে। নারীর লম্বা চুল এককালে তার অপছন্দের এবং গা গুলানোর বিষয় ছিলো। কোনো দিন যদি চুল খাবারে পড়েছে তো সে ঘর মাথায় করেছে। অথচ আজ তার মুখে বারবার সেই চুল দোলা খাচ্ছে, অথচ তার মন্দ লাগছে না। বরং অবাধ্য হাত বারবার ছুঁয়ে দিতে চাইছে। বর্তমানে রোদ্দুর এবং তুলিকার অবস্থান ছাঁদের একদম পেছন দিকে। যেখানে আলো খুব একটা নেই। শুধু ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়ামের আলো একটু আধটু পৌছাচ্ছে। এদিকটায় বাড়িঘর কম। ফলে নিরিবিলি। নীরবতা ছাউনির মতো ঘিরে আছে দুজনকে। কারোর মুখে কথা নেই। হঠাৎ তুলিকা দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালো রোদ্দুরের দিকে। তার সুডৌল মুখে নিখাঁদ হাসি। কোমলমনা প্রসন্নচিত্তে বলল,
“এটাই তোমার গু’ম করা?”
“পছন্দ হয় নি”
“হয়েছে। জানো আমার বারান্দা থেকে ভালো করে আকাশ দেখা যায় না। সিলিং পড়ে। অর্ধেক আকাশ দেখতে কি ভালো লাগে?”

রোদ্দুর হাসল। আলতো হাতে তার হাতখানা নিজের হাতের ফাঁকে পুরলো। অন্য হাত বুলিয়ে দিলো তার উন্মুক্ত অবাধ্য চুলে। চুলগুলো কানের ফাঁকে গুজে দিলো পরম যত্নে। তারপর গাঢ় কন্ঠে বলল,
“তোমার মনে আছে তুলিকা, একদিন মুক্ত আকাশ চেয়েছিলে আমার কাছে। আমি তোমাকে মুক্ত আকাশ দেবার প্রস্তুতিতে আছি। সেখানে তোমাকে কেউ শিকল ব’ন্দি করবে না। কেউ কটুক্তি করবে না। কেউ তোমার কাছে খারাপ আচারণ করবে না। যাবে তো মায়াবন বিহারিনী?”
“কোথায় নিয়ে যাবে আমায়?”
“আমাদের ছোট্ট মায়ানগরীতে”

তুলিকা কিছুসময় চেয়ে রইল। তার প্রসন্ন মুখখানায় নেমে এলো আষাঢ়ের মেঘমেদুর। চিন্তিত, ভীত কন্ঠে বলল,
“আমি কি আর বাবা-মাকে দেখতে পাব না। ভাবিকেও না?”
“দেখতে পাবে না কেনো? আমরা তো দূরে কোথাও যাবো না”
“না যাবো না”

অকপটে উত্তর দিল তুলিকা। রোদ্দুরের কপালে ভাজ পড়ল। অবাক কন্ঠে শুধাল,
“কেনো? তোমার তো আমার মাকে পছন্দ নয়”
“হ্যা, উনাকে আমার ভালো লাগে না। উনারো আমাকে ভালো লাগে না। কিন্তু ভাবী বলেছে আমি এখন এই বাড়ির বউ। বউরা তো বাড়িতেই থাকে। বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবো?”

তুলিকার কথায় ভীষন অবাক হল। এমন কিছু বলবে সেটা কল্পনাতীত ছিলো রোদ্দুরের। কিছুসময় নিষ্পলক চোখে দেখলো কোমল মুখশ্রী, অবুঝ নিষ্পাপ চোখজোড়া। তুলিকা ও গোল গোল চোখে দেখছে তাকে। হুট করেই আবদার মিশ্রিত কন্ঠে রোদ্দুর বলে উঠল,
“আমার বুকে একটু মাথা রাখবে মায়াবন বিহারিনী? বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে অন্তরখানা”

তুলিকাও বাধ্য মেয়ের মতো তার বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। বাতাসের বেগ বাড়লো। ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। তবুও সৌম্যপুরুষের হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তুলিকা মন দিয়ে তার হৃদস্পন্দন শুনছে। রোদ্দুর তাকে আলতো করে আগলে রেখে, পকেটে থাকা কিঞ্চিত মুর্ছানো গোলাপফুলটি কানে গুজে দিলো। তারপর মিহি স্বরে বলল,
“আমার নিঃস্ব হৃদয়খানা আজ পূর্ণতা পেয়েছে মায়াবন বিহারিনী। সবাই বলছিলো তুমি সৌভাগ্যবতী, কারন আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। সবাই মিথ্যে বলছিল। সৌভাগ্যবান তো আমি। কারণ তুমি আমার হয়েছো”

কথাখানা বলেই আলতো হাতে মুখখানা তুললো তুলিকার। কপালে ছোঁয়াল উষ্ণ পরশ। স্পর্শে নেই কোনো কলুষতা, নেই কোনো নোংরামি। শুধু নিখাদ প্রণয়ের বহিঃপ্রকাশ

*********

আজ প্রথমবার টিউশন কামাই করেছে তিতির। একটি কথার বড্ড বেশি প্রচলন রয়েছে। যে মেয়েরা লেখাপড়া না করে ইঁচড়ে পাকা হয়ে প্রেম করে তারাই টিউশন কামাই করে। আজ সেই তালিকায় নিজের নামখানাও জুড়লো তিতির। না সে প্রেম করতে আসে নি। তার কোনো প্রেমিক নেই। সে তার দেখা অ’স’হ্য মানবটিকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে এসেছে। সে অনেক ভেবেছে। এই কদিন টানা দ্বন্দ চলেছে। মন এবং মস্তিষ্কের প্রচন্ড যু’দ্ধ, তর্ক, বিতর্ক। কিন্তু সেই দ্বন্দে হৃদয় ভারী নম্বরে জিতে গিয়েছে। মস্তিষ্কের এক একখানা দাগী দাগী যুক্তির কাছে তার একটি ই যুক্তি ছিলো, “মানুষটি আর এই দেশে থাকছে না। আর দেখতে পাবে না তাকে”। এই কদিনে একটি বার ও সৌভিকের দর্শন মিলে নি তিতিরের। সে টিউশনে যাক বা কলেজে কোথাও বান্দার ছায়া ছিলো না। তিতির ঘুরেফিরে আড়চোখে রাস্তায় তাকাত। কিন্তু মানুষটির দেখা পেতো না। ফলে এক অদ্ভুত শুন্যতা তাকে জেকে বসতো। কি অদ্ভুত, একদিন এই লোকটির উপস্থিতি তাকে বিরক্ত করতো। অথচ আজ বিরক্ত হচ্ছে না বিধায় সে বিরক্ত হচ্ছে। তাই মস্তিষ্কের যুক্তিগুলোকে মুড়িভাজা করে সে এসেছে শেষবারের মতো সৌভিকের সাথে দেখা করতে। সরসরি বাস স্ট্যান্ডে। সৌভিক তখন বাসে উঠছিল। সে ঢাকা যাচ্ছে। ঢাকায় তাকে কদিন থাকতে হবে। তারপর সপ্তাহের আগামী বুধবার রাতে তার ফ্লাইট। বিষন্ন মুখে যখন লিটন, রশীদ, আনওয়ারকে বিদেয় দিয়ে বাসে উঠছিল তখনই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। ব্যাগ দু কাধে ঝুলিয়ে কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা অবাক এবং অগাধ প্রসন্নতা তার মুখশ্রীতে ভেসে উঠলো। বাস ছাড়তে বাকি এখনো পনেরো মিনিট। তাই তিতিরকে নিয়ে গেলো নিরিবিলি একটি বেঞ্চের কাছে। লিটন কন্ডাকটরকে খাওয়ালো ঘুষ। এখন বাস পনেরো নয় আধা ঘন্টা পর ছাড়বে।

পাশাপাশি বসে আছে তিতির এবং সৌভিক। কিঞ্চিত অস্বস্তি হচ্ছে বটে তিতিরের। এই প্রথম কোনো পুরুষের পাশে একাকীত্বে বসেছে উপরন্তু লোকেরা তাদের দিকে কেমন দৃষ্টিতে যেনো তাকিয়ে আছে, এবং এই দৃষ্টি ই অস্বস্তির কারণ। কোলাহলের মাঝেও তাদের মাঝে শুধু নীরবতা। মদির দৃষ্টি শুধু দেখছে কিশোরীকে। দু হাতে যখন ওড়নাটা দলামচা করতে ব্যস্ত সে তখন সৌভিক নীরবতা ভেঙ্গে বলল,
“অবশেষে দেখা পেলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না। আমাকে অবাক করে তুমি এলে। এতক্ষণ তোমাকে না দেখার আফসোস হচ্ছিলো। এখন যেতে হবে ভেবে আফসোস হচ্ছে। কি অদ্ভুত এই আফসোস”
“আপনি জানতেন আমি আসবো। তাই বারবার পেছনে দেখছিলেন”
“সত্যি বলতে একটা অনুমান ছিলো। কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না”
“তা কবে ফিরবেন?”

অন্যদিকে তাকিয়ে প্রশ্নটি করলো তিতির। সৌভিক তখন দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে তাকালো। গাঢ় কন্ঠে শুধাল,
“তুমি কি চাও আমি ফিরি? আমার অপেক্ষায় থাকবে?”
“বয়েই গেছে অপেক্ষা করতে”

তিতিরের নির্বিকার উত্তরে শব্দ করেই হাসলো সৌভিক। খুব ইচ্ছে হলো তার হাতখানা ধরতে। কিন্তু সেটা করলো না। উলটো গাঢ় করন্ঠে বলল,
“আমি জানি তুমি অপেক্ষা করবে। অপেক্ষা কর না, জানি না কবে ফিরবো”

কথাটা বুকে তীরের মতো লাগলো। হুট করেই মন খারাপ হলো তিতিরের। অদ্ভুত বিষন্নতা তাকে ঘিরে ধরল। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সৌভিকের দিকে। কোমল কন্ঠে শুধাল,
“কতদিন?”
“এই ধরো দু তিন বছর। হিসেব করলে অনেক দিন। আমার মত আ’হা’ম্ম’কের জন্য এতোদিন অপেক্ষা কেনো করবে?”

তিতির চুপ করে রইল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাটল। তত সময়ে বিদায় ঘন্টা বাজলো। আধা ঘন্টা কোথায় চলে গেল টেরও পায় নি। বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো সৌভিকের। উঠে দাঁড়ালো সে। তিতির তখন ও বসে রয়েছে। হাতটা বাড়িয়ে বলল,
“যেতে হবে উঠুন ম্যাডাম”
“আমাকে মনে রাখবেন?”
“অংকে আমাকে কুপোকাত করেছিলে, সেই হারে হৃদয় হারিয়েছি। ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারবো না”

তিতির মুখ তুলে চাইলো। তার চোখে অশ্রুর মুক্তদানা। সৌভিক নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটিকে রাগতে দেখেছে, হাসতে দেখেছে। এই প্রথম কাঁদতে দেখলো। মৃদু কন্ঠে বলল,
“আমাদের গল্পের কখনো সূচনা ঘটে নি, তার আগেই ইতি টানা হচ্ছে। তাই আগামীবার যখন দেখা হবে তখন আমাদের গল্পের সূচনাটি লিখবো। বিনা ঝগড়া, বিনা কলহে মিষ্টি সূচনা”

বাস ছেড়ে দিয়েছে। তিতির তাকিয়ে আছে বাসটির যাবার পানে। সৌভিক একটি কথা ভুল বলেছে, তাদের গল্পের যেমন সূচনা লেখা হয় নি, তেমনি তাদের গল্পের ইতিও টানা হয় নি। সূচনাহীন গল্পগুলোর সমাপ্তি টানা যায় না। এই অসমাপ্ত গল্পগুলোই সর্বাধিক মিষ্টি হয়৷ কারণ তাদের মিষ্টতা প্রতীক্ষার মাঝে নিহিত। প্রতীক্ষা, সূচনার প্রতীক্ষা।
________________________________

বসার ঘরে সবাইকে জড়ো করেছে তুরান। হিমা বেগম বড্ড চিন্তিত। গোমড়া মুখো ছেলেটি সবাইকে জড়ো করেছে নিশ্চয়ই ঘটনাটি বড়। শফিক সাহেব তুরানকে ধীর স্বরে শুধালেন,
“হয়েছি কি? বলবে?”
“হ্যা বলব। আগে নিজেদের প্রস্তুত কর”

হিমা বেগম এবং শফিক সাহেব একে অপরের দিকে চাইলেন। তাদের দুজনের কৌতুহল সীমা ছাড়ালো। হিমা বেগম কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই সে গম্ভীর স্বরে বলল,
“আগামী শুক্রবার সুরভীর অপারেশন হবে”……………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি