নীড় হারা পাখি পর্ব-৩৭

0
318

#নীড়_হারা_পাখি (কপি করা নিষেধ)
#৩৭তম_পর্ব

বসার ঘরে সবাইকে জড়ো করেছে তুরান। হিমা বেগম বড্ড চিন্তিত। গোমড়া মুখো ছেলেটি সবাইকে জড়ো করেছে নিশ্চয়ই ঘটনাটি বড়। শফিক সাহেব তুরানকে ধীর স্বরে শুধালেন,
“হয়েছি কি? বলবে?”
“হ্যা বলব। আগে নিজেদের প্রস্তুত কর”

হিমা বেগম এবং শফিক সাহেব একে অপরের দিকে চাইলেন। তাদের দুজনের কৌতুহল সীমা ছাড়ালো। হিমা বেগম কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই সে গম্ভীর স্বরে বলল,
“আগামী শুক্রবার সুরভীর অপারেশন হবে”

অপারেশনের কথাটি শুনতেই পিলে চমকে উঠলো হিমা বেগমের। শুভ্র মুখশ্রীতে ভেসে উঠলো সূক্ষ্ণ ত্রাশের ছাপ। চটজলদি চাইলেন সুরভীর দিকে। সুরভী দেওয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির মুখে কথা নেই। শফিক সাহেব চিন্তিত স্বরে শুধালেন,
“কিসের অপারেশন?”

তুরান একটু সময় নিলো। তারপর ধীর কন্ঠে বলল,
“সুরভীর জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়েছে। টিউমার গুলো বড় আকারে। সেই অপারেশন আগামী শুক্রবার হবে”

হিমা বেগম ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে আছেন। এতো বড় ঘটনাটি তার ছেলে বউ এতোদিন চেপে গেছে। অপারেশন তো মুখের কথা নয়। মধ্যবিত্ত মানুষের নিকট অপারেশন একটি ত্রাশের অপর নাম। এর কারণ মৃত্যু ভয়। মধ্যবিত্ত মানুষের মাঝে মৃত্যুভয় সবচেয়ে অধিক থাকে। তাদের একটি ভ্রান্ত ধারণা অস্ত্রোপাচার মানেই জীবন মৃত্যুর শীতল যুদ্ধ। হিমা বেগমের কাছেও ব্যাপারখানা অন্যথা নয়। তার ধারণা অ্যানাসথেসিয়া মানেই অনিশ্চিত জীবনকে আহ্বান করা। যদি আর জ্ঞান না ফিরে তখন? সুন্দর জীবনটাকে চিরতরে বিদায় জানাতে হবে। ভয় তো হয়। আর যখন ঘটনাটি সুরভীকে কেন্দ্র করে তখন ভয়ের পরিমান মাত্রা ছাড়ায়। ভীত কন্ঠে বললেন,
“এতো বড় কথা আমাদের আগে বলো নি কেনো তুমি? তার মানে এতোদিন সুরভী এজন্যই অসুস্থ ছিলো। আর আমরা ওর দিকে খেয়াল ও করি নি। আমাদের বললে মেয়েটির উপর এতো ধকল যেতো না। আর বলিহারি তোমার আক্কেল কোথায় ছিলো তুরান?”
“বলার সুযোগ পাই নি। তিমিরের সমস্যা, তুলির বিয়ে সব মিলিয়ে ঘেটে ছিলাম। এখন যখন ঝাড়া হাত তাই এখন অপারেশন করাটাউ ভালো। তোমাদের চিন্তার মাঝেও রাখতে চায় নি”
“তাই বলে জানাবে না? সুরভী, আমরা তোমার বাবা-মা নই। কিন্তু আমরা কি কখনো তোমাকে তুলি বা তিতির থেকে আলাদা করেছি? অবশ্যই চিন্তা হবে, কিন্তু তোমাকে আগলে তো রাখতাম”

কিঞ্চিত অভিমানী কন্ঠে কথাখানা বললেন হিমা বেগম। হ্যা, এই কথাটিতে কোনো দ্বিমত নেই। হিমা বেগমের স্বভাব কিছুটা খিটখিটে হলেও তিনি কখনো তার সাথে ভেদাভেদ করে নি। বকেছেন, কথা শুনিয়েছেন কিন্তু পরমূহুর্তে বুকেও টেনেছেন। তার মাঝে মায়ের প্রতিরুপ ই খুঁজে পেয়েছে সুরভী। আর শফিক সাহেব এক কথায় মাটির মানুষ। মা ছাড়া কখনো কথা নেই তার মুখে। তার মনে আছে এখনো, তখন মাত্র বধুরুপে বাড়িতে প্রবেশ। অচেনা বাড়ি, অচেনা স্থান, অচেনা মানুষ। বর মানুষটিকেও আবদার করতে শত সংকোচ। বরাবর ই বই পড়ার স্বভাব তার। তাও পুরাতন লেখকদের বই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়— এনাদের বই পড়া যেনো তার একটি অনন্য অভ্যাস ছিলো। অথচ এই বাড়িতে বই নেই। কেউ ই বই পড়ে না। তুলিকা যাও পড়তো একটু আধটু, কিন্তু নতুন লেখকদের। ফলে এতো বছরের অভ্যাসটি ছাড়ার পরিকল্পনা করেছিলো সুরভী। কিন্তু কিভাবে যেনো বাবা কথাটি জানতে পারলেন। এক সন্ধ্যায় নিয়ে এলেন মোটামোটা পাঁচ-ছ খানা বই। সুরভী তো অবাক। বিস্ময়ে চোখের পলক অবধি পড়ছিলো না। শফিক সাহেব তখন হাসতে হাসতে বললেন,
“সংকোচ করবে না মা, সংকোচ করলেই লস। আর তোমার এই শ্বশুরের যখন দুটো মেয়ের আবদার পালনের ক্ষমতা আছে, তাহলে আরেকটি মেয়ের শখ পূরণেও আপত্তি নেই”

সুরভীর চোখজোড়া ছলছল করছিলো। দলা পাকানো স্বরে বলেছিলো,
“ধন্যবাদ বাবা”

সেই থেকেই শ্বশুরের সাথে সম্পর্কটি তার খুব ভালো। তাই হিমা বেগমের উক্তিটি অযৌক্তিক নয়। সুরভী ম্লান স্বরে বলল,
“মা, রাগ করবেন না। আমি কখনোই এমন কিছু ভাবি নি। পরিবারের কথা বিবেচনা করেই বলি নি”
“তুমি কি পরিবারের বহির্ভুত?”
“একেবারেই না; কিন্তু তখন এই অপারেশনের কথাটা বলা মানেই আনন্দে ব্যাঘাত। আর তুলিকা এ কথা জানতে পারলে কখনোই ও বাড়ি যেতে চাইতো না। ওর জিদ তো জানেন। আমার পিছুই ছাড়তো না। তাই আর রাগ করবেন না মা। এখানে আপনার ছেলের দোষ নেই। আমি ই ওকে বারণ করেছিলাম“

হিমা বেগম তুরানের দিকে চেয়ে ধীর স্বরে বললেন,
“কোনো ক্ষতি হবে না তো? ঝুকি নেই তো?”

তার কন্ঠ কাঁপছে। মহিলা ভয় পাচ্ছে। সুরভী নিঃশব্দে হাসলো। আজ সত্যি ই যে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ, তিনি এতো সুন্দর একটি পরিবারে তার বিয়ে দিয়েছেন। এখানে অর্থের অভাব হলেও ভালোবাসার কোনো অভাব নেই। তাই তো সে খুব করে চায় বাঁচতে। যেনো এই ভালোবাসাগুলো ফিরিয়ে দিয়ে পারে_______

*********

চৈত্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ। চিপচিপে গরমে অবস্থা নাজেহাল। বাজার করে বহু পথ হেটে এসেছেন। রিক্সা পান নি। রোদ্রস্নাত দুপুরের এটাই বৈশিষ্ট্য, রিক্সা থাকবে না। রোদ মাথায় হেটে আসতে হবে। তরতর করে ঘামবে শরীর। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে যাবে। তখন সামান্য পানিটি হবে অমৃত। বাসায় এসেই ফ্যান ছেড়ে ধপ করে বসে পড়লেন তিনি। ফ্যান ঘুরছে সর্বোচ্চ স্পিডে কিন্তু তার কাছে লাগছে ক্ষীন। হেটে আসার জন্য বুকটা ধরপর করছে। শরীরটা কেমন অসহ্য লাগছে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। বাড়িতে এখন মানুষ বলতে শুধু সে এবং তুলিকাই আছে। মেয়েটিকে তার ভালো লাগে না। বলদ একটি মেয়ে, কথাও বুঝে না। শেফালী বেগমের মনে হয় বিয়ে করিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে বাড়িতে এনেছেন। গোল গোল চোখে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ফলে তাকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না। ঘাড়ে যন্ত্রণা করছে। একটু শুতে পারলে ভালো হতো। খুব কষ্ট করে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো। ধড়াস করে পড়ে গেলেন মেঝেতে। তখন সূক্ষ্ণ মেয়েলী কন্ঠ কানে এলো,
“মা, কি হয়েছে আপনার?”

শেফালী বেগম উত্তর দিতে পারলেন না। তার পূর্বেই জ্ঞান হারালেন। যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেকে আবিষ্কার করলেন সফেদ বিছানায়। হাতে ক্যানোলা। স্যালাইন চলছে…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি