নীড় হারা পাখি পর্ব-৩৮ এবং শেষ পর্ব

0
765

#নীড়_হারা_পাখি (কপি করা নিষেধ)
#অন্তিম_পর্ব

বাড়িতে এখন মানুষ বলতে শুধু সে এবং তুলিকাই আছে। মেয়েটিকে তার ভালো লাগে না। বলদ একটি মেয়ে, কথাও বুঝে না। শেফালী বেগমের মনে হয় বিয়ে করিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে বাড়িতে এনেছেন। গোল গোল চোখে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ফলে তাকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না। ঘাড়ে যন্ত্রণা করছে। একটু শুতে পারলে ভালো হতো। খুব কষ্ট করে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠলো। ধড়াস করে পড়ে গেলেন মেঝেতে। তখন সূক্ষ্ণ মেয়েলী কন্ঠ কানে এলো,
“মা, কি হয়েছে আপনার?”

শেফালী বেগম উত্তর দিতে পারলেন না। তার পূর্বেই জ্ঞান হারালেন। যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেকে আবিষ্কার করলেন সফেদ বিছানায়। হাতে ক্যানোলা। স্যালাইন চলছে। তিনি বিস্মিত হলেন। আশপাশটা নিপুনভাবে পর্যবেক্ষণ করে যা বুঝলেন তিনি এখন হাসপাতালে। যতদূর মনে পরছে তিনি ছিলেন ডাইনিং রুমে। তখন শরীরটাও ভালো ছিলো না। তারপরের স্মৃতিগুলো ঝাপসা, এলোমেলো। তাহলে সে হাসপাতালে আসলো কি করে? বাসায় তখন তার সাথে ছিলো কেবল ই তুলিকা ছিলো। সেই বোকা মেয়ের পক্ষে এমন কিছু করা কখনোই সম্ভব নয়, অসম্ভব। শেফালী বেগমের মস্তিষ্ক কোষগুলো রেষারেষিতে ব্যস্ত। কিছুতেই তার বোধগম্য হচ্ছে না সে এখানে কিভাবে এসেছেন। তিনি যখন চিন্তায় বিভোর তখন দরজা ঠেলে রোদ্দুর কেবিনে প্রবেশ করলো। হাতে থাকা ছোট ফলে ঠোঙ্গা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,
“এখন কেমন লাগছে? কোথাও কি অস্বস্তিবোধ হচ্ছে?

রোদ্দুরের প্রশ্নে সম্বিত ফিরলো শেফালী বেগমের। ফ্যালফ্যালিয়ে চাইলেন ছেলের দিকে। জিজ্ঞাসু কন্ঠে বললেন,
“আমাকে এখানে তুই নিয়েছিস?”
“না”

রোদ্দুরের উত্তরে বিস্ময়ের মাত্রা আকাশ ছুঁইলো। বিমূঢ় দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে হাজারো প্রশ্ন। রোদ্দুর আশপাশ দেখলো। একটি কাঠের টুল রাখা। সেটি টেনে একদম মুখোমুখি বসল শেফালী বেগমের। তার চিন্তায় বিভোর মুখখানা দেখতে ভালো লাগছে। দিনদিন পাষান হয়ে যাচ্ছে, মাকে চিন্তিত দেখে ভালো লাগাটা মোটেই ভালো সন্তানের কাজ নয়। ব্যাপারখানা নিন্দনীয় বটে, তবুও রোদ্দুরের তাতে খুব একটা যায় আসছে না। শরীরটা এলিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“সকালে প্রেসারের ঔষধটা খাওয়া উচিত ছিলো তোমার। প্রেসার বাড়া ছিলো, পালস ও এবনরম্যাল। ভাগ্য ভালো তাই স্ট্রোক বা এট্যাক হয় নি। অবশ্য অভাবে থাকলে হতেও পারতো।“
“আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে কে?”

রোদ্দুরের কথাগুলো সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করে কঠিন কন্ঠে শুধালেন শেফালী বেগম। রোদ্দুর স্মিত হাসলো। মা তার ছটফট করছে। সে কিছুতেই মানতে চাইছে না তুলিকা তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। অবিশ্বাস্যই বটে। কিন্তু ঘটনাখানা সত্যি। শেফালী বেগমকে হাসপাতালে আনার কৃতিত্ব সম্পূর্ণ তার তুলিকার। শেফালী বেগম যখন জ্ঞান হারালেন ঠিক সেই মূহুর্তে সেখানে তুলিকা এসে পৌছায়। শেফালী বেগম তাকে বাহির থেকে তালা দিয়ে গিয়েছিলো। অবুঝ মেয়েটি পুরোটা সময় একা একা বদ্ধ ঘরে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিলো। ফলে দরজার আওয়াজ শুনতেই নিজ ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। শেফালী বেগম তখন চেয়ারে ক্লান্ত শরীরে বসে ছিলেন। তুলিকা তার কাছে যায় নি। দূরেই দাঁড়িয়ে থাকার কারণ মানুষটি তাকে পছন্দ করে না। সেদিন রান্নাঘরের অবস্থা খারাপ করে দিয়েছিলো বিধায় তাকে খুব বকাও শুনতে হয়েছিলো। তাই তার কাছে যেতে ভালো লাগে না তুলিকার। তিনি দূর থেকেই সুন্দর। ঠিক সেই সময়ে শেফালী বেগম ভিড়মি খান। তুলিকা তাকে মেঝেতে লুটিয়ে যেতে দেখে ছুটে যায়। কাঁপা স্বরে বেশ কবার ডাকে। কিন্তু সাড়া নেই। অসাড় দেহটি দেখে প্রচন্ডরকম ঘাবড়ে যায় মেয়েটি। উপায়ন্তর না পেয়ে সে রোদ্দুরকে ফোন করে। বিয়ের পর পর ই রোদ্দুর তাকে একটি মোবাইল কিনে দিয়েছে। যেহেতু তার ডিউটি থাকে, তাই প্রেয়সীর সাথে মুঠোফোনে আলাপ করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। তুলিকার মোবাইলের সবচেয়ে প্রথম নম্বরটি রোদ্দুরের। একটি ট্যাপ আর ফোন রোদ্দুরের কাছে। রোদ্দুর ফোন ধরতেই কাঁপা স্বরে বলে,
“তোমার মা পড়ে গেছেন। আমি কি করবো?”

তুলিকার কথাটি শুনতেই তার পরিস্থিতি বুঝতে বাকি রইলো না রোদ্দুরের। কন্ঠ রীতিমত কাঁপছে। সে আকুল স্বরে বলল,
“তুমি এসে পড়ো না। তাড়াতাড়ি এসো”
“তুলিকা আগে শান্ত হও। কিচ্ছু হবে না। রিল্যাক্স। আমি আছি ফোনে”
“তোমার মা উঠছে না। আমি ডাকছি তাও উঠছে না”
“তুমি শান্ত হও“
“উনি উঠছে না রোদ্দুর। উনি কি মারা গেছেন?”

তুলিকার কন্ঠে আতংক। না দেখেও অনুমান করতে কষ্ট হলো না যে সে কাঁপছে। তুলিকার আতঙ্ক শান্ত করতে উচ্চস্বরে তাকে ডেকে উঠলো রোদ্দুর,
“তুলিকা। শান্ত হও। আমি আছি। সব ঠিক আছে। মা ঠিক আছে। কিন্তু তুমি যদি এখন শান্ত না হও তাহলে বিপদ হবে। শান্ত হও। তুমি কি চাও না মা সুস্থ হোক। তাই নিজেকে সামলাও। ”

রোদ্দুরের পদ্ধতি কাজে দিলো। তুলিকা শান্ত হলো কিঞ্চিত। তার কন্ঠ এখনো কাঁপছে। রোদ্দুর এবার ধীর কন্ঠে বলল,
“এবার মন দিয়ে আমার কথা শোনো। আমি যা যা বলবো, তুমি তাই তাই করবে। ঠিক আছে?”
“কি করবো?”

রোদ্দুর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর তুলিকাকে নির্দেশ দিলো কি কি করতে হবে। তুলিকা রোদ্দুরের কথামত বারান্দা থেকে পাশের বাসার মানুষজনকে ঢাকলো। দিনের বেলা বিধায় মানুষ আসতে সময় লাগলো না। সবাই ধরাধরি করে শেফালী বেগমকে প্বার্শবর্তী হাসপাতালে নিয়ে গেলো। নার্স পালস, প্রেসার মাপতেই তাকে ভর্তি করালো। রোদ্দুর তখন এসে পারে নি। ভয় যে তার হচ্ছিলো না তা নয়। খুব ভয় হচ্ছিল। কিন্তু তুলিকার উপর বিশ্বাস ও ছিলো। সে জানতো তুলিকা তাকে হতাশ করবে না। রোদ্দুর হাসপাতালে পৌছে দেখে মেয়েটি করিডোরের একটি বেঞ্চে বসে আছে। তাকে দেখেই ছুটে তাকে জড়িয়ে ধরলো সে। মুখ লুকালো সুঠাম বক্ষে। শরীর তখনো কাঁপছে কিঞ্চিত। রোদ্দুর দৃঢ় আলিঙ্গনে তাকে বেষ্টিত করলো। মৃদু কন্ঠে শুধালো,
“ডাক্তারের সাথে কথা বলেছো?”
“উনি কি কি বললেন, আমি বুঝি নি”

অপরাধী কন্ঠে কথাটা বলল তুলিকা। রোদ্দুর নিঃশব্দে হাসলো। তারপর তুলিকার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“একদম না, আমার তুলিকার উপর কি আমি রাগ করতে পারি। বরং আজ আমি অনেক খুশি। আই এম প্রাউড অফ ইউ”

তুলিকার চোখ চকচক করে উঠলো। অদম্য উচ্ছ্বাস তার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে। রোদ্দুর তারপর তাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে গেলো। ডাক্তার থেকে জানতে পারলো শেফালী বেগমের জ্ঞান হারাবার কারণ। এও জানলো এখন তাকে স্যালাইন দিয়ে রেস্টে রাখা হয়েছে। আজ তাকে ডিসচার্জ দেওয়া হবে না। ডাক্তার তুলিকার প্রশংসাও করলেন। মেয়েটি সাহস করেছিলো বিধায় আজ বিপদ ঘটে নি। রোদ্দুর গাঢ় নয়নে একবার চাইলো তুলিকার দিয়ে। মানুষ বলে “সময়ের স্রোতে মোহের রঙ ফিকে হয় আর প্রণয়ের রঙ হয় গাঢ়”—– কথাটির প্রমাণ পেয়েছে সে। তুলিকা তার মোহ নয়, বরং সুগাঢ় প্রণয়_____

শেফালী বেগম অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে চোখে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। রোদ্দুর কারণটা বুঝলো। সে কথা বাড়ালো না। একটি আপেল ধুয়ে কেটে সামনে দিলো তার। শেফালী বেগম খাচ্ছেন না। উলটো কঠিন স্বরে বলল,
“মেয়েটি কোথায়?”
“বাহিরে, বসে আছে। আসলে তুমি ওকে পছন্দ করো না তাই রুমে ঢুকে নি। আমি বলেছিলাম, কিন্তু আমার পাগলীটা শুনে নি। আচ্ছা মা, একটা কথা বলোতো; তুমি তুলিকাকে অপছন্দ করো কেন?”

শেফালী বেগম উত্তর দিলেন না। রোদ্দুর বুকেচেপে থাকা দীর্ঘশ্বাসটি ছেড়ে ধীর স্বরে বলল,
“তুমি নিজেও জানো না মা, তুমি ওকে অপছন্দ কেনো কর। শুধুমাত্র তার মানসিক অবস্থার জন্য কাউকে অপছন্দ করা যায় না। তুলিকার ওই একটা সমস্যাকে এড়িয়ে গেলে দেখবে মেয়েটি কতটা নির্মল, স্নিগ্ধ, পবিত্র। আজ কিন্তু সেই আমাকে ফোন করে জানিয়েছে তোমার অবস্থা। ভাবো তো ও না থাকলে কি হত। আজ যে ও এই বাড়িতে আছে সেটাও কিন্তু ওর ই সিদ্ধান্ত। তুমি তাকে অপছন্দ করো বিধায় আমি তাকে নিয়ে দূরে চলে যেতে চেয়েছিলাম। সেই আমাকে বাধা দিয়েছে। আজ উপলব্ধি করছি কত বড় ভুল করছিলাম। ভাগ্যিস আমার তুলিকা জোর করেছিল। একবার চেষ্টা করে দেখোই না মা, আমি বলছি না তাকে ভালোবাসতে হবে। শুধু অপছন্দ করে দূরে ঠেলে দিও না। মেয়েটির যে সংসার করার ভারী শখ। নীড় হারা পাখিটি নীড়ের খোঁজে এসেছে। এতোটুকু ঠাঁই আমার মা দিতে পারবে। আমি জানি তুমি কিপ্টে নও”

কথাটি বলেই উঠে দাঁড়ালো রোদ্দুর। দরজাটি টেনে বেরিয়ে গেলো। শেফালী বেগম আপেলের প্লেটের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তার চোখ ছলছল করছে। হয়তো নিজের কৃতকার্জ নিয়ে বিবেচনা করছেন। বৃদ্ধ মানুষের জন্য এটা খুব স্বাভাবিক। যখন ই তাদের শরীরের উপর ঝড় যায় তখন ই নিজের কৃতকার্জ বিবেচনা করেন। মৃত্যুভয় হয় কি না। তবে এই মৃত্যুভয়ের পাশাপাশি আরোও একটি জিনিস তাদের কাবু করে, অনুতাপ। আজ হয়তো সেই অনুতাপ ই বজ্রকঠিন শেফালী বেগমকে কাবু করছে। হয়তো______

******************

চৈত্রের কড়া রোদ্দুরের মাঝে হুট করেই দক্ষিণ আকাশে মনখারাপের মেলা বসেছে। মিহি বাতাসে উড়ছে সুরভীর অবাধ্য চুল। হাসপাতালের একটি ছয় বাই তিন এর বারান্দাটা এখন তার অবকাশের স্থান। এই তের বাই ছয়ের সাদা রুমটি এই চারদিন যাবৎ তার বাসস্থান। শুধু তার নয়। তার, তুরান এবং তিতিরের বাসস্থান। অপারেশন হয়েছে আজ চারদিন। অবশেষে আজ তাকে বাড়ি দিয়ে যাওয়া হবে। এই চারটে দিনে নিজের সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছে সুরভী।

প্রথম যে তথ্যটি জানতে পেরেছে তা হলো সে বাড়ি নামক স্থানটির প্রতি মারাত্মক দূর্বল। এতোদিন মনে হতো সে শেকলবন্দি পাখি। নীড় খোঁজার জন্য বেড়িয়ে অজান্তেই শেকলে আটকে গেছে। ফলে সুখনীড় পাওয়ার স্বপ্নটি ব্যর্থই রয়ে গেলো। তার এই চিন্তাটি সম্পূর্ণ ভুল। তার ঐ তিনরুমে এটে উটে থাকা আটজনের সংসারটি বহুপ্রতীক্ষিত সুখনীড়। সেই সুখনীড় ব্যাতীত সে অসম্পূর্ণ।

দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, তার পরিবার তাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। আপন করে নেওয়া এবং ভালোবাসা দুটির মাঝে বিরল পার্থক্য। মাঝে মাঝে আপন করে নিলেও হৃদয়ে ঠাঁই দেওয়া বড্ড কঠিন। কিন্তু তার পরিবার শুধু তাকে আপন করেই নেয় নি, তাকে ভালোবাসা দিয়েও মুড়ে রেখেছে। এই যে এই তিনদিন, তিতিরটা মোটেই তার কাধ ছাড়া হয় নি। হিমা বেগম এই বয়সে একা হাতে হেসেল টেনেছেন। অভিলাষা মেয়েটি অসুস্থতা উপেক্ষা করে তাকে দেখতে এসেছে প্রতিদিন। নিজের ক্ষুদ্র উপার্জনের টাকাটি অপারেশনের সময় তুরানের হাতে তুলে দিতেও সে দ্বিধা করে নি। তিমির নতুন চাকরি পেয়েছে। চাকরিটি আটটা থেকে পাঁচটা অবধি। তার পর দুঘন্টা টিউশনি পড়ায় সে। এতোকিছু করেও ভাবির সময় বের করতে ভুলে নি সে। শফিক সাহেব প্রতিদিন তার বউমার জন্য বাদাম আনতে ভুলেন না, কারণ তার বউমার বাদাম খুব প্রিয়। অভাব অনটনের সংসারে ভালোবাসাগুলো দৃশ্যঃত থাকে না। কারণ অভাবের পাটাতনে পিষতে থাকা মানুষগুলো ভালোবাসা প্রদর্শনের অবকাশটি পায় না। তাদের ভালোবাসা পরিলক্ষিত হয় বিপদের সময়।

শেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি যা সে জানতে পেরেছে তা হলো তুরান তাকে ভালোবাসে। মানুষটা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। রোবট স্বভাবের মানুষটির ভালোবাসা পূর্বেও উপলব্ধি করেছিলো সুরভী। তার রিপোর্ট পাবার পর থেকেই তুরানের মাঝে একটি অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করেছিলো সে। তবে সেটাকে গ্লানি থেকে মুক্তির পথ বলেই বিবেচনা করেছিলো সে। কিন্তু তার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত হয়েছে এই চার দিনে। অপারেশন থিয়েটারে যাবার সময় তার অশ্রুসিক্ত চোখজোড়ায় নিজেকে হারানোর ভয় দেখেছিলো সুরভী। যে মানুষটির কাছে কেবল দায়িত্ব ছিলো সে, সেই মানুষটি রাত জেগে তার পাশে বসে ছিলো। নোংরা কাপড় পরিষ্কার করেছে, নিজ হাতে গোসল করিয়েছে। চুল মুছে দিয়েছে। সেই চুল শুকালে তার বেঁধে অবধি দিয়েছে। সুরভীর মনে হচ্ছিলো সে একটি পোর্সেলিনের পুতুল। যার অবহেলা হলেই সে ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে। তুরানের এমন যত্নই তো চেয়েছিলো তৃষ্ণার্ত হৃদয়। এই চারদিনে একটা কথা বেশ ভালো করে উপলব্ধি করেছে সে, জীবন তো উনিশ বিশ হবেই, শুধু সঙী পাশে থাকলেই যথেষ্ট”

ইতোমধ্যে দরজার শব্দ কানে এলো সুরভীর। পেছনে তাকাতেই দেখল তুরান দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় কন্ঠে বলল,
“গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে, যাবে না?”
“যাবো তো। আমার নীড় আমার প্রতীক্ষায় আছে”

****************

সকাল হতেই আজ তুরানের তাড়া বাড়লো। আজ অনেক কাজ। প্রথমত নতুন চাকরি, ফলে কামাই দেবার সুযোগ নেই। উপরন্তু যেহেতু সে ট্রেনি পর্যায়ে জয়েন করেছে ফলে কাজ শেখানোর নামে তাকে দিয়ে খাটানোর কাজটি ই অধিক করা হয়। কিন্তু হাসিমুখে তিমির কাজ করছে। কারণ বেকার মানুষ ই জানে কাজের প্রাধান্য। চাকরিটি পেয়েছে অনেকটা ভাগ্যের জোরে। পরীক্ষার ফলাফল আসতে এখনো অনেক দেরি। তবুও এই চাকরিটি সে পেয়েছে। কলেজের এক স্যার তাকে রিকোমেন্ড করেছে। বেতন পনেরো হাজার। ইন্টারভিউ বোর্ডে খুব ধকল পোহাতে হয়েছিলো তাকে। ইন্টারভিউয়ারের প্রথম প্রশ্ন ছিলো, আপনার পড়াশোনা এখনো শেষ হয় নি কেনো? প্রশ্নটির উত্তর সাজাতে সাজাতেই আরেকজন প্রশ্ন করে বসল, “আপনার তো গ্রেড ভালো তাহলে কি সাসপেন্ড হয়েছিলেন?” তীক্ষ্ণ প্রশ্নের বান পেরিয়ে অবশেষে সে চাকরিটি পেয়েছে এতো সহজে হাতছাড়া করবে না। উপরন্তু সামনেই অভিলাষার ডিউ ডেট। এখন প্রতিটি দিন ই আতংক। টাকা ছাড়া কিভাবে হবে। ভাই এর কাছেও টানাপোড়েন। ভাবির অপারেশনে অনেক টাকা চলে গেছে। সুতরাং এই চাকরি আবশ্যক। অভিলাষা যদিও বেশ টাকা জমিয়েছে, ভাবির চিকিৎসা ব্যতীত সে হাজার আটের মতো জমিয়েছে। কিন্তু পুরুষের দাম্ভিকতা। স্ত্রীর টাকা হাত দিবে না। পুরুষত্বে হানি আসে কি না। তাই তিমির সেই টাকা নিবে না। তাই তো টিউশন টাও ছাড়ে নি। কষ্ট হলেও সব চালাচ্ছে।

টাইটা বাধতে বাধতে বের হবে তখন ই ফোনটা বেজে উঠল তার। অচেনা নম্বর। মনে খটকা লাগলেও ফোনটি ধরলো সে। অপর পাশ থেকে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠ ভেসে আসলো,
“কেমন আছো তিমির?”

কন্ঠটি পরিচিত। শাহাদাত ইসলামের ফ্যাসফ্যাসে গলাটি কোনোমতেই ভুলতে পারে না সে। ঘাড় ঘুরিয়ে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালো সে। আজ কেসের ডেট। সাক্ষী হিসেবে তিমিরের সেখানে যাবার কথা। ঘৃণ্য লোকটি তাকে শেষবারের মতো শাষাতেই ফোন দিয়েছে। শাহাদাত ইসলাম যে তাকে প্রতিনিয়ত নিজের দৃষ্টির আয়ত্তে রেখেছে তা অজানা নয় তিমিরের। তার কাছে দুটো পথ, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মুখ বন্ধ রাখা নয় লোকটিকে কারাগারের ভেতরে নিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার ঝুকি নেওয়া। এবং তিমির মনোস্থির করে ফেলেছে সে কি করবে। তাই স্মিত স্বরে বলল,
“ভালো আছি। তবে আমার মনে হয় আপনি ভালো নেই। যেহেতু আমায় ফোন করেছেন তারমানে আপনি ভালো নেই”
“ভালো থাকবো কি করে, তুমি যে আমার গলার কাঁটা হয়ে গেছো”
“চিন্তা করবেন না। সেই কাঁটা আপনাকে অতিসত্ত্বর মুক্তি দিবে। রাখছি, অফিস যাবো”

বলেই ফোনটি কেটে দিলো তিমির। ঘর থেকে বের হতেই সাব ইন্সপেক্টরের সাথে দেখা হলো তিমিরের। ইন্সপেক্টর তাকে নিতে এসেছে। তিমির তাকে দেখেই বলল,
“আমি ঝুঁকি নিচ্ছি, এবার আমাকে নিরাপত্তা দেবার পালা আপনাদের”
“চিন্তা করবেন না। সবগুলো এখন হাজতে”

তিমিরের ঠোঁটে হাসি ভেসে উঠল। তুরান ও সেখানে উপস্থিত হলো। গাঢ় স্বরে বলল,
“কোর্টে যাবি না?”
“তুমি যাবে আমার সাথে?”
“অবশ্যই, এতো বড় যুদ্ধে তোকে একা ছাড়ি কি করে?”

তিমিরের হাসি প্রসস্থ হলো। বিনা সংকোচে পা বাড়ালো গন্তব্যে।

তিমিরের সাক্ষীর বদৌলতে শাহাদাত ইসলামের দুষ্কর্মের পাহাড় ধুলিস্যাৎ হলো। সে বিশ্বাস ই করতে পারছিলো না তিমির আসবে। ভেবেছিলো ভয় পেয়ে তিমির চুপ করে যাবে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। শাহাদাত ইসলাম তাকে হু/ম/কি দেবার পর পর ই সে থানায় ব্যাপারটি জানায়। এই কেসটি সে অসি হ্যান্ডেল করছিলেন তার সাথে তুরানের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। ফলে তিমিরের কথা শুনতেই তারা ব্যাকাপ প্লান তৈরি করে। শাহাদাত ইসলাম বেইলে ছাড়া পেলেও তাকে পুনরায় আটক করার জন্য তিমিরের সাক্ষ্য জরুরি। ফলে তাকে নিরাপত্তা তো দিতেই হতো। তাইতো শাহাদাত হোসেনের সকল পেয়াদাকে কৌশলে তারা ফলো করতে থাকে। প্রমাণ যোগাড় করে শাহাদাতের হু/ম/কি এবং যাবতীয় কাজের। সেগুলোই তার বিরুদ্ধে ব্যাবহার করবে কোর্টে। তাই ই হলো। একেই বেআইনি দ্রব্যাদি পাঁচার, এবং জীবনের হুমকি দেবার জন্য তাকে চৌদ্দ বছরে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। ক্ষমতাবান ভাই ও বাঁচাতে পারলো না। তাকে। যাবার সময় তিমিরকে পুনরায় ভয় দেখাবার প্রচেষ্টা চালাল,
“কাজ টা ভালো হলো না”
“আবারো ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন? ভুলে যাবেন না যারা নিজের কাছে সৎ থাকে তারা ক্ষণিকের জন্য ভয় পেলেও সারাজীবন ভয়ের চাঁদরে থাকে না। আমার ক্ষেত্রেও তাই। হয়তো ক্ষণিকের জন্য ভয় পাবো। কিন্তু সততার কাছে সেই ভয় বড্ড ফিকে”

শাহাদাত ইসলামের রক্তচক্ষু আজ তিমিরকে ভয় দেখাতে পারলো না। পুলিশ শাহাদাতকে নিয়ে গেলো। যাবার সময় হুংকার ছাড়ছিলো সে। বিশাল অবশেষে চোরাবালি থেকে মুক্তি পেয়েছে। তিমিরকে ধন্যবাদ দিতেই সে বলল,
“আর নিজেকে নোংরামিতে জড়াস না। ভুলে যাস না তোর জন্যও কেউ অপেক্ষা করে”

********

নিগূঢ় রাত, অন্ধকার ঘরটির এক কোন থেকে সোডিয়ামের আলো প্রবেশ করছে। নিস্তব্ধ ঘরটিতে ফ্যানের ক্যাচ ক্যাচ শব্দটি বেশি কানে লাগছে। ফলে এপাশ ওপাশ করেও ঘুমাতে পারছে না তিমির। ঠিক সেই মূহুর্তে অনুভূত হলো তার শার্ট খামচে ধরেছে অভিলাষা। পাশ ফিরতেই দেখলো মেয়েটির মুখশ্রী পাংশুটে বর্ণ ধারণ করেছে। মুখশ্রীতে বিশ্রী যন্ত্রণার ছাপ। কাতর স্বরে বললো,
“তিমির খুব ব্যাথা করছে”

তিমির তড়িৎ গতিতে উঠে বসল। বিছানা ভিজে গিয়েছে। পানি ভাঙছে। অভিলাষা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে যন্ত্রণা সহ্য করতে চাইছে। মেয়েটির চোখ থেকে পানি পড়ছে। চাপা আর্তনাদে ঘরের নিস্তব্ধতায় চির ধরেছে। তিমির ব্যগ্র কন্ঠে বলল,
“একটু অপেক্ষা করো, আমি এখনই ভাবিকে ডাকছি”
“আমার খুব ব্যাথা করছে তিমির। ওমাআআ”

মেয়েটি ছটফট করছে। মেয়েটির এই যন্ত্রণা তীরের মতো বিধছে তিমিরের। ফলে না নড়েই চিৎকার করে ডাকলো সে। এই মূহুর্তে অভিলাষাকে একা রাখা অসম্ভব। অভিলাষার দৃষ্টি ক্ষীন হচ্ছে। ভারীপেটটা ধরে সে কাঁদছে। ভয় হচ্ছে খুব। এতোকাল এই দিনের অপেক্ষায় ছিলো সে। কিন্তু আজ যখন সময় এলো, ভয়ে হাত পায়ে হিম ধরছে। কোনো অঘটন ঘটবে না তো?

**********

হাসপাতালের করিডোরে পুরো পরিবার জড়ো হয়েছে। অভিলাষার সিজারিয়ান করানো হবে। কিন্তু ডাক্তার শহরের বাহিরে। এখন হাসপাতালে সার্জারি করার মতো ডাক্তার ও উপস্থিত নেই। ফলে ঔষধ দিয়ে কোনো মতে তাকে রাখা হয়েছে। ইয়াসমিনের সাথে তিমিরের কথা হয়েছে। তার আসতে আধা ঘন্টা সময় লাগবে। হিমা বেগমের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ভয় হচ্ছে প্রচন্ড। এতোদিন এই বাচ্চার বিরোধিতা সেই করেছিলো। অথচ আজ যখন মা এবং বাচ্চা উভয়ের উপর ঝুঁকির মেঘ গর্জন করছে, তিনি সর্বাধিক আতংকিত হয়ে আছেন। তিনি চান না বাচ্চা কিংবা মায়ের কিছু হোক। ক্ষণে ক্ষণে প্রার্থনা করছেন তিনি। এদিকে তিমিরের অবস্থা সবচেয়ে বিধ্বস্ত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে সে। অভিলাষার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। শুধু মনে হচ্ছে, মেয়েটিকে সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় কি কালগহ্বরে ঠেলে দিয়েছে! খুব আফসোস ও হচ্ছে। ইশ! এতোটাদিন অভিমান পুষে অদৃশ্য দেয়ালটি না গড়লেই হত। মেয়েটির যদি কিছু হয়ে যায় কি করে নিজেকে শান্ত রাখবে সে! থাকতে পারবে তো নিজের শুভ্র গোলাপকে ছাড়া?

সিজার হলো ফজরের আযানের সাথে সাথেই। আযান শেষ হতেই শোনা গেলো মেয়ে হয়েছে। আতংকিত পরিবারের মুখে যেনো হাসির লহর বয়ে গেলো। সদ্য জন্মানো শিশুটিকে কোলে দেওয়া হলো হিমা বেগমের। কি সুন্দর মুখশ্রী! আদুরে আদুরে মুখ, লাল ঠোঁট, ছোট ছোট হাত পা, নরম দেহ। হিমা বেগমের চোখ থেকে সুখঅশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এতোকাল যাকে নিয়ে ছেলের সাথে দ্বন্দে জড়াতেন আজ তাকে কোলে নিয়ে অনুভব হলো যেনো স্বর্গ পেয়ে গেছেন। তিমির অনিমেষ চাহনীতে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। এই মেয়ে যেনো তার সকল দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে। একেবারে অভিলাষার মুখের আদল। হাত কাঁপছে তার। এতদিনের এত যতন আজ তার সম্মুখে ক্ষুদ্র জীবনের রুপে উপস্থিত। বাচ্চাকে কোলে নেবার পূর্বে নার্সকে শুধালো,
“অভিলাষা কেমন আছে?”
“জি ভালো, পোস্ট অপারেটিভ রুমে আছে। এনেস্থ্যাশিয়া কাটলেই রুমে শিফট করা হবে”

বুক থেকে যেনো পাথর নেমে গেলো তিমিরের। এতোসময় পর যেনো প্রান ফিরে পেলো তিমির। দমবন্ধ অনুভূতিগুলো পিছু ছাড়লো। এবার যেনো একটু নিঃশ্বাস নিতে পারবে সে। আকুতি করে বলল,
“আমি একটু ওকে দেখবো”

***********

শুভ্র বিছানায় শুয়ে আছে অভিলাষা। মুখখানা শুকনো। ধকল যে গিয়েছে তা তার শুষ্ক মুখখানা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। স্যালাইন চলছে। চোখখানা ক্লান্তিতে ঢাকা। তবুও তিমিরকে দেখে ঠোঁট প্রসস্থ হলো তার। প্রথম প্রশ্ন ছিলো,
“মেয়েকে দেখেছো?”

তিমির মাথা দোলালো। তার নির্জীব হাতখানা নিজ হাতের মুঠোয় নিলো তিমির। কপাল ঠেকালো সে। অভিলাষা ভাঙ্গা স্বরে আবারো বলল,
“তুমি এখনো আমার উপর অভিমান করে আছো?”

অভিলাষার কথায় অশ্রু ছেড়ে দিলো তিমির। গাঢ় কন্ঠে বলল,
“তোমাকে হারানোর ভয় এতটা ভয়ংকর হবে জানা ছিলো না”

অভিলাষা হাসলো। স্বচ্ছ সেই হাসির ঝলক তার ক্লান্ত চোখেও ফুটে উঠলো। ঠিক সেই সময় দুধ খাওয়ানোর জন্য হিমা বেগম এলেন। আলতো করে উঠে বসালেন অভিলাষাকে। কোলে দিলেন ছোট্ট সন্তানকে। অভিলাষা প্রাণভরে দেখলো। হিমা বেগম তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“মেয়ে তোমার মতোই হয়েছে। আমি নাম দিয়েছে আকাঙ্খা। কেমন হয়েছে নামটা?”

অভিলাষা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তার দিকে। চোখ অশ্রুতে টুইটুম্বুর। হিমা বেগম অবাক কন্ঠে বলল,
“পছন্দ হয়নি?”
“খুব হয়েছে মা”

অভিলাষার কন্ঠ কাঁপছে। হিমা বেগম দুধ খাওয়ানো শেষে নাতনীকে কোলে তুলে নিলেন। খানিকটা ভারাক্রান্ত কন্ঠে বললেন,
“এতোদিন তোমাকে যা তা বলেছি। চেয়েছিলাম যেনো বাচ্চাটি না আসে পৃথিবীতে। কিন্তু আজ যখন এই শিশুটিকে কোলে নিলাম আমার মনে হচ্ছিলো আমাকে যেনো পৃথিবীটা কেউ এনে দিয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দিও অভিলাষা। এই সুখ থেকে তোমাকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিলাম। কি নিষ্ঠুরতাই না দেখিয়েছিলাম”
“এভাবে বলবেন না মা। মা সন্তানকে বকবে এটাই স্বাভাবিক। মায়ের শাসন খুব একটা পাই নি, তাই আপনার মাঝে মাকে খুঁজি আমি। তাই ক্ষমার কথাটি ছেড়ে দিন”

হিমা বেগম আর কিছু বললেন না। অভিলাষার মুখে হাসি আটছে না। অবশেষে নীড় হারা পাখিটি তার নীড় খুঁজে পেলো। এর থেকে আনন্দের কি হতে পারে।

কেবিনে সোরগোল। তুলিকা গোল গোল চোখে দেখছে বাচ্চাকে। রোদ্দুর মিটিমিটি হাসছে। মেয়েটিকে চমকে দিলে মন্দ হবে না। তাই ফিসফিসিয়ে বলল,
“তুমি চাইলে আমি তোমাকেও এমন একটা বাবু এনে দিতে পারবো”
“কিভাবে?”
“অনেক ভাবে, কিন্তু সেগুলো জনসম্মুখে বলা যাবে না। রাতের বেলায় চুপি চুপি বলবো কেমন?”

মেয়েটি ভীত চোখে তাকিয়ে রইলো রোদ্দুরের দিকে। রোদ্দুরের মুখে এখনো দুষ্টু হাসি। সুরভী খুব যত্ন করে কোলে নিয়ে রেখেছে আকাঙ্খাকে। তার নজর যেনো সরছে না। তুরান ব্যাপারটা লক্ষ করলো। ফলে তার কাছে ঘেষে দাঁড়ালো। বাচ্চাটির কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“ইনশাআল্লাহ একদিন আমাদের কোলেও এমন একটি ছোট্ট প্রাণ থাকবে”
“সত্যি?”
“সত্যি”

তিতির এখনো মোবাইলে ব্যাস্ত। একের পর এক বাবুর ছবি তুলে যাচ্ছে সে। ইতোমধ্যে মোবাইলে শ খানেক ছবি তোলা শেষ। এমন সময় হুট করে হোয়াটস এপে একটি বিদেশী নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এলো। ম্যাসেজে লেখা,
“এটা আমার নাম্বার। যদি হৃদয়হীনার মন চায় তবে ম্যাসেজ করতে পারে”

ম্যাসেজটি পড়তেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। সে জানে মানুষটি কে। যতই হোক, ছা/গলের কান মুলে বন্ধুকে বগলদাবা করা আহা/ম্ম/ককে কি ভোলা যায়!

হিমা বেগম দুচোখে নিজের পরিবারকে দেখছেন। বিক্ষিপ্ত, অভাবে জর্জরিত, নানা ঝামেলায় পৃষ্ট পরিবারটিতে আজ খুশির জোয়ার। নীড় হারা পাখিদের গল্পটা আজ যেনো পরিপূর্ণ। প্রতিটি পাখিই তার প্রতীক্ষিত সুখনীড় খুঁজে পেয়েছে। আর কি চাই বৃদ্ধার। শফিক সাহেব তার পাশে বসে বাদাম এগিয়ে বললেন,
“বুঝলে তুরানের মা, অভাব থাকবেই। সেই অভাবের মধ্যেই সুখ খুঁজতে হবে। নীড় হারা পাখি বলে কিছুই নেই। সব পাখির ই নিজস্ব সুখনীড় থাকে, শুধু খুঁজে পাওয়ার দেরি এই যা”

হিমা বেগম বাদাম নিলেন। আজ আর ঝগড়া করবেন না। থাকুক না বৃদ্ধের কথা না হয় একটু শুনলেন ই। কি হবে তাতে!

||সমাপ্ত||

মুশফিকা রহমান মৈথি