নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-০১

0
72

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-১]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

“বিয়ের তিন বছরেও আমি মা হতে পারিনি কেনো জানেন? আমার স্বামী আমার সাথে কখনো ফিজিক্যাল রিলেশন করেনি।”(কাঠকাঠ স্বরে)

সারুর কাঠকাঠ স্বরের বাক্যবচন শুনে থমথমে মুখশ্রীতে সারুর ভাবভঙ্গি অবলোকন করলেন কল্যাণী। পাশে রাখা টিস্যুর বাক্স থেকে টিস্যু নিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে উঠলেন,,

“সম্পর্কে তোমার জেঠি শাশুড়ি হই, এখন শেরহাম আর তোমার ডিভোর্স করালে বিষয়টা কেমন দৃষ্টিকটু লাগবেনা?”

সারু কঠিন দৃষ্টিপাত করলো কল্যাণীর দিকে। কণ্ঠে কঠিনতা বজায় রেখে বলে উঠলো,,

“আপনাদের বংশবৃদ্ধি করতে পারছিনা দেখে কম কটু কথা তো আমাকে শুনাচ্ছেন না! অথচ সমস্যা যে আপনাদের ছেলের মধ্যে রয়েছে তা আপনাদের বোধগম্য হচ্ছেনা। আপনাদের ছেলে আমার সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন না করলে আমি কিভাবে আপনাদের সুখবর দিবো আশ্চর্য!”

কল্যাণী ভ্যা’বা’চ্যা’কা খেয়ে গেলেন। হাঁসফাঁস করতে করতে কল্যাণী মিনমিনে স্বরে বলে উঠলেন,,

“তুমি শেরহামকে কিছু বলছোনা এ বিষয়ে?”

“আলাদা করে বলার প্রয়োজনবোধ করছিনা, বাড়িতে প্রতিদিন আমার বাচ্চা হওয়া নিয়ে খোঁ’টা শুনতে হয় আপনার জায়ের কাছ থেকে, কেনো? কতভাবে শেরহামকে সিডিউজ করার চেষ্টা করেছি ফল হিসেবে বেলকনিতে রাত্রিযাপন করা ছাড়া আর কিছুই পাইনি। অনেক হইছে আর না, মানুষ আমাকে অক্ষম বলছে! যে যেভাবে পারছে কথা শুনাচ্ছে। আমার দ্বারা আর সহ্য হচ্ছেনা এসব, আমার ডিভোর্স চাই আর ডিভোর্স পেপার আপনি রেডি করে দিবেন।”

কল্যাণী কি বলবেন বুঝতে পারছেন না, এতদিন বাড়িতে সবাই সারুর মা না হওয়া নিয়ে হাজারটা কথা শুনতে হয়েছে সারুকে। সবাই ভাবছে সারুর মা হওয়ার অক্ষমতা রয়েছে। অথচ সমস্যা সারুর না শেরহামের। কল্যাণী এখন সারুকে এর কি সমাধান দিবেন বুঝতে পারছেন না। কল্যাণী একজন উকিল, সারু হচ্ছে কল্যাণীর জা’য়ের পুত্রবধূ। জেঠি শাশুড়ি হয়ে কিভাবে বাড়ির ছেলে আর পুত্রবধূর ডিভোর্স করাবেন ভেবে পাচ্ছেন না কল্যাণী।

“তুমি শান্ত হও সারু, শেরহামের সমস্যা কি ওর থেকে জানার চেষ্টা করো। ওর কি বাহিরে অ্যাফেয়ার চলছে বিধায় তোমার সাথে সম্পর্ক করছেনা এটা জানার চেষ্টা করো। বৈবাহিক জীবনে ঝামেলা হবেই তাই বলে ডিভোর্স দিলেই যে ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে তা নয় কিন্তু। একটা ডিভোর্সি মেয়েকে কতটা সাফার করতে হয় লাইফে তা নিশ্চয়ই জানো। তাই বলছি ভেবে দেখো শেরহাম কেনো এমন করছে। এখন বাড়ি যাও, ঠান্ডা মাথায় ভাবো।”

সারু নিশ্চুপ হয়ে আছে। বৈবাহিক জীবনে একটা নারীর কাছে সবচে বড় পাওনা হচ্ছে একটা সন্তান। শেরহাম তার হাসবেন্ড। তাদেরকে বৈবাহিক জীবনের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে, তবে এই তিন বছরে শেরহাম কখনো সারুর ধারে কাছেও আসেনি। রূপ সৌন্দর্য এর কারণে যে কাছে আসছেনা তা নয়, সারু যথেষ্ট সুন্দরী। তবুও শেরহামের কখনো মন টানেনি তার এই সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যেতে। বিয়ের দেড় বছর অব্দি ঠিক ছিল, কেউ সারুকে বাচ্চা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। তবে সেই দেড় বছরে কখনো শেরহাম তার দিকে ফিরেও চায়নি, এক বিছানায় ঘুমালেও কখনই সারুর সংস্পর্শে আসেনি শেরহাম। সারুর কাছে বিষয়টা অতীব আশ্চর্যজনক লাগলেও কারো সাথে লজ্জায় শেয়ার করতে পারেনি। কতভাবে শেরহামকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে তার মোহে। প্রথম প্রথম শেরহাম তার দিকে এক নজর তাকিয়ে তাকে অবজ্ঞা করে চলে যেত। এরপর তো সারুকে বেলকনিতে রাত্রিযাপন করাতো। এমনি এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যার কথা, বাড়ির লোকজন সবাই দাওয়াতে গিয়েছে। সারুর খারাপ লাগছিলো দেখে সে যায়নি, সারু যাচ্ছেনা দেখে সারুর শাশুড়ি শেরহামকেও যেতে মানা করলো।
সেদিন সন্ধ্যায় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁ’ক’ছিলো শেরহাম।
সারুর কি যেন হলো হুট্ করে শেরহামকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। সারু ভেবেছিলো আজকে হয়তো শেরহাম তাকে আপন করে নিবে। সারু শেরহামের ঠোঁটের দিকে অগ্রসর হয়েছিল ভালোবাসার আশায় তবে তাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে শেরহাম ঘর কাঁপানো ধমক দিয়েছিলো সারুকে। সেদিন সারু পারছিলোনা সেখানে চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে। শেরহামকে চুমু খাওয়ার বাসনা পোষণ করাতে সেদিন শেরহাম সারুকে সেই সন্ধ্যা থেকে রাতের আটটা অব্দি প্রবল বৃষ্টির মাঝে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো। শেষে সারুর অবস্থা বেশিই খারাপ হতেই শেরহাম তাকে ঘরে আসাতে বলেছিল। সারু জ্ঞান হারাবে এমন হয়ে পড়ছিলো, সে শুধু টলছিলো। তবুও শেরহামে তাকে ছুঁয়ে অব্দি ঘরে আনেনি।

পুরোনো কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সারু। গম্ভীর কণ্ঠে কল্যাণীকে বলে উঠলো,,

“ঠিকাছে ভেবে দেখবো বড়মা। তবে আজকের পর থেকে যদি আমি আমার নামে বা’জে কিছু শুনি তাহলে এক মুহূর্তেও ওই বাড়িতে থাকবোনা। আপনাদের ছেলের মুখের উপর ডিভোর্স পেপার ছুঁ’ড়ে মে’রে চলে আসবো। আসছি। ”

বলেই সারু উঠে গেলো। কল্যাণী সারুর যাওয়ার পানে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলো। অবাক লাগছে এক ছাদের নিচে, এক বিছানায় ঘুমিয়েও একটা পুরুষের মন বাসনা কিভাবে জাগে না পাশে থাকা রমণীর প্রতি! তিনি মাথা ঝাকালেন। অন্যান্য ফাইল হাতে নিয়ে মনোযোগ সেখানে দিলেন।


গম্ভীরতার সাথে ঘরে প্রবেশ করলো সারু। ঢুকতেই দেখলো শেরহাম মাত্র শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। সারুর নজর গেলো শেরহামের হালকা লোম যুক্ত বক্ষের দিকে। কিছু একটা ভাবতেই মাথা ঝাকিয়ে অন্যদিকে তাকালো। পুনরায় আড়চোখে তাকালো শেরহামের দিকে। পুরুষ হিসেবে শেরহাম পারফেক্ট হয়েও পারফেক্ট না। নারীর প্রতি তার কোনো আগ্রহ দেখায় না সে। মাঝে মাঝে সারু ভাবে বাবা মা ভুল করে ওই জেন্ডারের লোকের সাথে তার বিয়ে দিয়েছে নাকি!
এদিকে সারুর এমন চাহনি খেয়াল করলো শেরহাম। একবার পূর্ণ দৃষ্টি দিলো সারুর দিকে অতঃপর টিশার্ট গায়ে দিতে দিতে বলে উঠলো,,

“এইচএসসির বাকি তো অল্পদিন। প্রিপারেশন কেমন তোমার?”

হঠাৎ আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে শেরহামের প্রশ্নে ভ্যা’বা’চ্যা’কা খেয়ে গেলো সারু। ভড়কে যাওয়া গলায় হুট্ করে বলে দিলো,,

“চু’মু খাবো।”

শেরহাম পারফিউম দিচ্ছিলো শরীরে। পরীক্ষার কথা জিজ্ঞাসা করতে চু’মুর কথা বলায় ব্রু কুঁচকালো শেরহাম। পেছন ফিরে সারুর দিকে চাইতে, সারু আরও ভড়কে মিনমিনে স্বরে বলে উঠলো,,

“ন.. না মানে ভালোই।”

বলেই আর এক মুহুর্ত দেরি না করে ছুট লাগালো বেলকনির দিকে। শেরহাম মুখ গম্ভীর করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
এদিকে বেলকনিতে এসে নিজেকে নির্লজ্জর উপাধি দিচ্ছে সারু। সারু যখনি শেরহামকে কিছু বলতে যায় ভুলে হুট্ করে অপ্রীতিকর কিছু বলে ফেলে। এই নিয়ে সারুর আফসোসের শেষ নেই। আজ যদি শেরহাম বাকিদের মতো হতো তাহলে এই কথা বলার সাথে সাথেই চু’মু দিয়ে দিতো।

দুপুরে..

সবার শেষে খেতে বসেছে শেরহাম, সারু আর সারুর শাশুড়ি। শেরহাম আর সারুর শাশুড়ি খেতে বসেছে সারু চুপচাপ তাদেরকে পরিবেশন করছে। খাওয়ার এক মাঝে সারুর শাশুড়ি হতাশ কণ্ঠে হুট্ করেই বলে উঠলেন,,

“পাশের বাসার রায়ার ছেলের বিয়ে হয়েছে মাত্র তিনমাস, অথচ এই তিন মাসের মধ্যেই রায়া সুখবর পেয়ে গেলো। আর আমি! আমি তিন বছরেও পেলাম না।”

শাশুড়ি মায়ের এমন কথা শুনে ব্রু কুঁচকে নাক ফুলিয়ে জোরে জোরে দুবার শ্বাস ফেললো। মাঝে শেরহাম একবার তার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে ফেললো। সারুর শাশুড়ি মা বলতে বলতেই বি’ষ’ম খেলেন। সারু শব্দ করে জলের গ্লাস টেবিলে রাখলো। সারুর শাশুড়ি একবার তার দিকে চেয়ে জলের গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিলেন।
শেরহাম চুপচাপ নিজের খাবার খাচ্ছে, মুখ দিয়ে টু শব্দও করছেনা। এরই মাঝে সারুর শাশুড়ি মিতালি আবারো বলে উঠলেন,,

“আমি বলি কি শেরহাম, সারুকে নিয়ে তুই বিকেলে হাসপাতালে যাস। ডাক্তার দেখিয়ে আসিস সারুর কোনো সমস্যা আছে কিনা।”

সারু এবার তেলে বেগুনে লাল লাল হয়ে জ্ব’লে উঠলো। এসব খোঁ’চা মা’রা কথা তার সহ্য হচ্ছেনা। এই হয়েছে এক শাশুড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার মাতৃত্বের দিকেই আঙ্গুল তুলবে। অথচ ছেলের যে সমস্যা আছে মহিলা কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না।
সারু কিছু বলবে তার আগেই শেরহাম উঠে দাঁড়ালো। গম্ভীর স্বরে সারুকে বলে উঠো,,

“ঘরে এসো তাড়াতাড়ি।”

সারুর মনে লাড্ডু ফুটলো কেনো জানি। চু’মু টুমু খেতেই তো জামাইরা বউকে বলে ঘরে এসো তাড়াতাড়ি। শাশুড়ির কথা শুনে আজকে হয়তো শেরহাম তাকে ভালোবাসা দিবে।

চলবে..