নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-০৬

0
64

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-৬]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

সমস্ত সাক্ষী ও প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে নির্মল ভৌমিক সুরেশ ভৌমিককে খু”ন করেছেন সম্পত্তির লোভে। এরজন্য আদালত নির্মল ভৌমিকের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁ-সি ঘোষণা হয়েছে।
পুষণের রাগান্নিত চেহারার দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি হাসলো কল্যাণী। সত্যর সাথে থেকে আজ অব্দি সব কেসেই জয়ী হয়েছেন। বিজয়ের হাসি হাসলেও মনের মধ্যে ঝড় বিদ্যমান কল্যাণীর। কখনো ওনার কোনো কেসের প্রভাব ওনার পরিবারের উপর পরেনি, এই প্রথম এই কেসটার প্রভাব পরেছে তাও ওনার মেয়ের উপর। বাচ্চা মেয়েটা, সবে সতেরোর ঘরে পদার্পন করেছে। প্রাণবন্ত হয়ে বেড়ানোর সময়ে মেয়েটা এতো বড় নির্মম অন্যায়ের শিকার হয়েছে।
ওনার মনে হচ্ছে একজন উকিল হিসেবে উনি আজকে জয় অর্জন করলেও প্রকৃত পক্ষে উনি হেরে গিয়েছেন।

সুরেশ ভৌমিকের স্ত্রীর দিকে তাকালেন তিনি, বাচ্চা মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন,,

“অবশেষে সত্যর জয় হয়েছে, সুরেশ ভৌমিক ওনার বিচার পেয়েছেন। জীবনে কতকিছুর শিকার হই আমরা, তবে এতে আমাদের ভেঙে পরা উচিৎ না। মনে রাখবেন আপনি সত্য হলে জয় আপনারই হবে। মনকে শক্ত করুন, মেয়েটাকে শক্ত করে গড়ে তুলবেন। আশা রাখি ভবিষৎ উজ্জ্বল হবে আপনাদের।”(শান্ত স্বরে)

সুরেশ ভৌমিকের স্ত্রী নীরবে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন কল্যাণীর দিকে। নীরবতা ভেঙে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলেন,,

“আ.. আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো মুখ আমার নেই ম্যাডাম। আমাকে ও আমার স্বামীকে বিচার পাইয়ে দিতে আপনার মেয়েটাকে এতো বড় অন্যায়ের শিকার হতে হলো। কী করলে ক্ষ.. ক্ষমা করতে পারবেন আমাদের?”(কাঁপা কাঁপা স্বরে)

কল্যাণী থেমে গেলেন, শান্ত দৃষ্টিতে সুরেশ ভৌমিকের স্ত্রীয়ের মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করলেন। কল্যাণী ওনার মুখে স্পষ্ট আক্ষেপ দেখতে পেলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,,

“এখানে আপনাদের কোনো ভূমিকা নেই। সবটাই ভাগ্যর ভূমিকা। ক্ষমা চাইবেন না, আশীর্বাদ করবেন আমার মেয়ের জন্য।”

কল্যাণী আর কিছু বললেন না। শেরহামকে ইশারা করলেন বেরোনোর জন্য। শেরহামের পাশে অফিসার এস কে আহাজীব দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওনাকে দেখে মৃদু হেসে বললেন,,

“অভিনন্দন ম্যাডাম। আমি আশাবাদী সবসময় আপনি সত্যর পাশে থাকবেন এবং জয়ী হবেন। আশা করি ওই রে’পি’স্টও সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে।”(মৃদু হেসে)

কল্যাণী ক্লান্তির হাসি হাসলেন। গায়ের কালো পোশাকটা খুলে হাতে নিলেন। ধীর পায়ে হেঁটে বেরোলেন কোর্ট থেকে। বেরোতেই মুখোমুখি হলেন প্রেস মিডিয়ার। বিচলিত হলেন তিনি। শেরহাম পাশে এসে দাঁড়ালো কল্যাণীর।
রিপোর্টারদের নানা প্রশ্ন। কল্যাণী ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত। মানুষের গুঞ্জন ওনার মস্তিস্ক অচল ও ব্যাথাতুর করে তুলছে ক্রমশ।

“অভিনন্দন ম্যাডাম, অবশেষে এতদিন পর এই কেস সমাপ্ত হলো। জয় বরাবরের মতো আপনারই হয়েছে, এই বিষয়ে আপনার কী মতামত?”

কল্যাণী জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন। বললেন,,

“সত্যর সবসময় জয় হয়। আমি সত্যর পক্ষে ছিলাম তাই জয় অর্জন করতে পেরেছি।”

“আপনার কী মনে হয় ম্যাডাম আপনার মেয়ের রে’ই’প এই কেসের সাথে জড়িত? ইতমধ্যে লোকজন গুঞ্জন সৃষ্টি করছে যে এই কেস রুখে দিতেই আপনার মেয়েকে রে’ই’প করা হয়েছে যাতে আপনি এই কেস না লড়েন। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?”

রিপোর্টারের এমন প্রশ্নে বুকটা ভারী হয়ে উঠলো কল্যাণীর। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ওনার। নিজেকে যথাসম্ভব সামলানোর চেষ্টা করে ভাঙা গলায় বললেন,,

“দুঃখিত, আপাতত এই বিষয়ে কোনো প্রকার কিছু বলতে চাইছিনা।”(ভাঙা গলায়)

শেরহাম ভিড় ঠেলে কল্যাণীকে গাড়িতে এনে বসালো। নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালানো শুরু করলো, উদ্দেশ্যে হসপিটাল।

~~

হসপিটালে প্রবেশ করে কল্যাণী সর্বপ্রথম ডাক্তার শাফানের কেবিনে প্রবেশ করলেন নক করে।
সবেমাত্র ডাক্তার শাফান পেসেন্ট এপয়েন্ট করে এসেছেন।

“আমার মেয়ে কেমন আছে ডাক্তার শাফান?”(ধীর কণ্ঠে)

ডাক্তার শাফান তাকালেন কল্যাণীর দিকে। নিচু স্বরে বললেন,,

“ব্লি’ডিং বন্ধ হয়েছে, আগের চেয়ে ঠিক আছে। কেবিনে শিফ্ট করা হয়েছে, আপাতত ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে।”

কল্যাণী কিছু বললেন না। যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন, যাওয়ার আগে ছোট করে ‘ধন্যবাদ’ বলে গেলেন।
স্নিগ্ধাকে যেই কেবিনে রাখা হয়েছে সেই কেবিনের সামনে গেলেন। সারু ও সারুর শশুর অর্থাৎ নেহাল রায় দাঁড়িয়ে আছেন।

“এভাবে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো তোমরা?”(ধীর কণ্ঠে)

কল্যাণীর কণ্ঠস্বর পেয়ে সারু ও নেহাল রায় দুজনেই চমকে উঠলো যেন। কল্যাণী ভ্রু কুঁচকালেন। সারু আমতা আমতা করে বললো,,

“অ.. অভিনন্দন তোমাকে জেঠিমণি। না মানে এমনি দাঁড়িয়ে আছি, ভ..ভালো লাগছেনা তাই আরকি।”(আমতা আমতা করে)

“তোতলাচ্ছ কেনো?”(শান্ত স্বরে)

সারু কিছু বলতে নিয়েও বললোনা নেহাল রায়ের ইশারায়। নেহাল এবার নিজেই বললেন,,

“এসব বাদ দাও বৌদি, স্নিগ্ধার সাথে দেখা করে এসো। মেয়েটা তোমাকে খুঁজেছিলো, অবশ্য এখন ও ঘুমাচ্ছে।”

কল্যাণী কিছু বললেন না, এতক্ষন শক্ত স্বাভাবিক থাকলেও এখন আর থাকতে পারছেন না। কিভাবে মেয়েকে ওইরকম অবস্থায় দেখবেন তিনি। ওনার মনে আবারো তুমুল ঝড় সৃষ্টি হচ্ছে।
কেবিনে যাওয়ার জন্য উদ্যোত হলেন তিনি, এর আগে সারুর উদ্দেশ্যে বললেন,,

“পরশু থেকে তো তোমার এইচএসএসি পরীক্ষা। বাড়ি চলে যাও তোমরা। শেরহাম আর আমি এখানে আছি স্নিগ্ধার কাছে।”

বলেই তিনি কেবিনে প্রবেশ করলেন।কেবিনের মধ্যে প্রবেশ করতেই থেমে গেলেন কল্যাণী। নজর স্থির করে সামনে তাকালেন। মুহূর্তের মাঝেই অস্থিরতা জেঁকে ধরেছেন ওনাকে। নিজেকে সামলে কঠোরতা মুখে ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন। পারলেন কিনা ওনার বোধগম্য হলোনা, এর আগেই সামনে থাকা ব্যক্তিটি তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে অস্পষ্ট স্বরে বলল,,

“ম.. মা!”

কল্যাণী এক হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন ব্যাক্তিটাকে। পাশ কাটিয়ে স্নিগ্ধার কাছে গেলেন। কণ্ঠস্বর খানিকটা শক্ত করে বললেন,,

“বললে সৎ মা বলুন।”

ব্যাক্তিটা থমকালো, দৃষ্টি স্থির করে চেয়ে রইলো থম মেরে।

“উহু, মা, আমাকে ক্ষমা করা যায়না?(নিচু স্বরে)

কল্যাণী স্নিগ্ধার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে উঠলেন,,

“আমি আপনার সৎ মা, সবসময় আপনার প্রতি আমি অন্যায় করে এসেছি। ক্ষমা তো আমার আপনার কাছে চাওয়া উচিৎ, ক্ষমা করবেন আমাকে আদিত রায়?”

আদিত কী বলবে খুঁজে পেলোনা। আজকে তো এমনটা হওয়ার কথা ছিলোনা। তাহলে এমন কেনো হচ্ছে? আদিত আর কিছু বুঝুক আর না বুঝুক সামনে থাকা নারীটি যে তার উপর ভীষণ অভিমান ও রাগ করে আছে বেশ বুঝতে পারছে।

“এভাবে বলোনা মা..”

কল্যাণী আদিতকে থামিয়ে দিলেন। কণ্ঠস্বর আরও কঠোর করে বলে উঠলেন,,

“কল্যাণী রায় এক কথা দুইবার বলেনা, তবুও আমি আপনার সাথে সবসময় অন্যায় করে এসেছি এবং আমি অনুতপ্ত তাই এর জন্য আমি আপনাকে আরও একবার বলছি মা নয়, সৎ মা।”(কঠোর কণ্ঠস্বরে)

আদিত অনুভব করলো তার বুকের মধ্যে ভারী কিছু একটা বিঁধে গেছে। চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু নামতে চাইলো। পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই, এটা ভেবেই নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
কল্যাণী স্নিগ্ধার করুন চেহারার দিকে তাকিয়ে পুরোনো স্মৃতি চারণ করলেন।

স্নিগ্ধা সবে মাত্র সপ্তম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণীতে উঠেছে। বার্ষিক ফলাফল নিয়ে স্কুলে প্যারেন্টস মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। কল্যাণী স্নিগ্ধার সাথে স্কুলে গিয়েছেন। মিটিং এটেন্ড করে সবেমাত্র বাড়িতে পা রেখেছেন তিনি।
বাড়িতে আসতে না আসতেই ওনার স্বামী বিপুল রায় তেড়ে এসে ওনার গালে স্বজোরে একটা চড় মা’রলেন। রাগান্নিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,,

“আমার আগেই বুঝা উচিৎ ছিল তুমি হচ্ছ আদিতের সৎ মা। তুমি কখনোই ওর ভালো চাইতে পারোনা। তোমার জন্য আজকে আমার ছেলেটাকে ড্রাগস স্মাগলিনের সাথে জড়িয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তুমি তোমার সেই পার্টনার পুলিশ অফিসারকে বলেছো আমার ছেলেকে মিথ্যা ঘটনায় ফাঁসিয়ে জেলে আটকাতে। আজকে তুমি ভালো করেই বুঝালে সৎ কখনো আপন হয়না।”(রাগান্নিত স্বরে)

কল্যাণী অবাক নয়নে স্বামীর দিকে চাইলেন। কী থেকে কী হচ্ছে ওনার বোধগম্য হচ্ছেনা, তবুও একটা কথাই ওনার কানে প্রতিফলিত হচ্ছে বারবার “সৎ কখনো আপন হতে পারেনা”
কল্যাণী হতভম্ব মিশ্রিত কণ্ঠস্বরে বললেন,,

“কিসব বলছো তুমি! আমি আদিতের ভালো চাইবোনা? ওকে আমি ড্রাগস স্মাগলিন ঘটনায় ফাঁসিয়ে জেলে পাঠিয়েছি? কিসব বলছো! আমি ওর মা, ওর নিজের মা। ওর পাঁচ মাস বয়স থেকে এই অব্দি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। আমি ওকে কেনো ফাঁসাবো?”

বিপুল রায় কল্যাণীর কথায় আরও রেগে গেলেন। পুনরায় কল্যাণীর গালে স্বজোরে চড় মা’রলেন। স্নিগ্ধা তখন পাশে দাঁড়িয়ে কান্না করে দিলো। বাবার হাত জড়িয়ে কান্না করতে করতে বললো,,

“বাবা তুমি মাকে এভাবে মা’রছো কেনো? মা কিছু করেনি। মা তো আমার সাথে স্কুলে গিয়েছিলো।”

রাগের মাথায় বিপুল রায় মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন, ফল স্বরূপ স্নিগ্ধা ফ্লোরে গিয়ে পরলো। মাথায় আ’ঘাত পেলো, কপালের কিনারা ফে’টে গিয়ে র’ক্ত গড়াতে লাগলো।
কল্যাণী অস্থির হয়ে পরলেন। দ্রুত মেয়েকে উঠিয়ে আঁচল দিয়ে কপাল চেপে ধরলেন। শক্ত গলায় বিপুল রায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,,

“আমার সাথে তুমি যাই করোনা কেনো আমার মেয়ের সাথে তুমি এমন আচরণ করতে পারোনা। তোমার জন্য ওর আজকে র’ক্ত’ক্ষ’রণ হচ্ছে, যে মেয়েকে আমি কোনোদিন ফুলের টোকা অব্দি লাগতে দেইনি সেখানে তুমি বাবা হয়ে ওর রক্ত ঝরিয়েছো। এর জন্য তো তোমাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করবোনা। আমি কোনোদিন তোমার ছেলেকে নিজের সতীনের ছেলে মনে করিনি। নিজের পেটের সন্তান মনে করেছি, তোমার ছেলের সেই পাঁচ মাস থেকে এই অব্দি বড় করেছি ভালোবেসে। সেখানে তুমি কত সহজে বলে দিলে সৎ কখনো আপন হয়না, আমি ওর সৎ মা, আমার দ্বারা ওর কখনো ভালো হবেনা। বলে রাখছি, তুমি যেই দোষারোপ আমাকে করেছো সেটা আমি ভুল প্রমাণ করবো।”

কল্যাণী আর কিছু বললেন না, মেয়েকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। যাওয়ার সময় ফিরেও তাকালেন না।
হসপিটালে গিয়ে স্নিগ্ধার মাথায় ব্যান্ডেজ করলেন। স্নিগ্ধা দুর্বল হয়ে পরেছে, ভালোই ব্লি’ডিং হয়েছে। কল্যাণী নিজের মাকে কল করে হসপিটালে ডাকলেন। তিনি আসতেই স্নিগ্ধার কাছে ওনাকে রেখে কল্যাণী থানার দিকে রওনা হলেন। শাড়িতে এখনো ওনার স্নিগ্ধার র’ক্ত লেগে আছে, এই অবস্থাতেই উনি থানায় গেলেন। থানার প্রবেশ করে অফিসার মুজিব সিকদারের কাছে গেলেন। কল্যাণীকে দেখে অফিসার মুজিব সিকদার বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,,

“ম্যাডাম আপনি যে ড্রাগ স্মাগলিনের সাথে জড়িত চক্রের কথা বলেছিলেন, আমরা আজকে সেই চক্রকে এরেস্ট করেছি। সেখানে আপনার ছেলেও জড়িত।”

কল্যাণী থমকালেন, কিছুক্ষন যেতেই বললেন,,

“ও আমার আদর্শে বড় হয়েছে অফিসার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার ছেলে এমন কিছুই করতে পারেনা। কোথাও একটা ভুল ভ্রান্তি হচ্ছে। আদিত ড্রাগ স্মাগলিনের সাথে জড়িত নয়।”(দৃঢ় স্বরে)

অফিসার মুজিব সিকদার হাসলেন। বললেন,

“আজকালকার ছেলে মেয়েরা দেখায় যে তারা মা বাবার আদর্শে বড় হয়েছে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা ভেতরে ভেতরে অনেক অনৈতিক কাজ করে।”

কল্যাণী শক্ত কণ্ঠে বললেন,,

“অন্য ছেলে মেয়েরা করতে পারলেও আমার আদিত এমন কিছুই করেনি আমি জানি।”

কল্যাণী ভেতরে গেলেন। ভেতরে গিয়ে দেখতে পেলেন কতগুলো ছেলের সাথে আদিত দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে জেলের ভেতরে। তিনি আদিত কে অস্পষ্ট স্বরে ডাকলেন,,

“আদিত!”

আদিত নজর তুললো। ওনার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে কাঠকাঠ স্বরে বলে উঠলো,,

“নাটক করবেন না দয়া করে। আপনাকে তো নিজের মা মনে করেছিলাম কিন্তু আপনি! সৎ ছেলে দেখে আমাকে এই ড্রাগ স্মাগলিন চক্রের সাথে জড়িয়ে ফাঁসিয়ে দিলেন। আজকে বুঝিয়ে দিলেন সৎ মা কখনো নিজের মায়ের মতো হয়না। আমার জন্মের সময় আমার মা মা’রা গিয়েছে যদি আমিও মা’রা যেতাম তাহলে আজকে আপনার মতো এক মহিলার না দর্শন পেতাম আর না আপনার জন্য আমাকে জেলে মিথ্যা আরোপে আসতে হতো।”

কল্যাণী অবিশ্বাস্য নয়নে আদিতের দিকে চেয়ে আছেন। যেই ছেলেকে নিজের পেটের ছেলের মতো আগলে রেখে মানুষ করেছেন, এতো বড় করেছেন সেই ছেলে কিনা আজকে তাকে এসব বলছে! ভাবতেই কল্যাণীর নিতে শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। কোনোমতে কল্যাণী বললেন,,

“কিসের জন্য তুমি আমাকে এসব বলছো আমার জানা নেই। যাই হোক এতো বছর তোমার সাথে অনেক অন্যায় করে এসেছি এবং আজকে আমার মতো মহিলার জন্য তুমি জেলের মধ্যে আছো, পারলে দয়া করে আমাকে ক্ষমা করো।”

কল্যাণী আর কিছু বলতে পারলেন না। নীরবে অফিসারের কাছে আসলেন। অফিসারের অপর প্রান্তের চেয়ারে বসলেন। অফিসার মুজিব সিকদার চুপচাপ কল্যাণীকে পর্যবেক্ষণ করছেন। কিছুক্ষন নীরবতা পালনের পর, কল্যাণী নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন,,

“ড্রাগ স্মাগলিন চক্রের সাথে ওকে সরাসরি দেখে এরপর এরেস্ট করেছেন?”

অফিসার মুজিব সিকদার ভ্রু কুঁচকালেন। বললেন,,

“উহু, যখন এই ড্রাগ স্মাগলিনের চক্রকে ধরেছিলাম তখন আপনার ছেলে ওদের সাথে ছিলোনা। এই চক্রের প্রধান আপনার ছেলের কথা বলেছে এবং এটাও বলেছে আপনি নাকি ওই প্রধানকে বলেছেন যদি ওরা ধরা পরে যায় তাহলে আপনার ছেলের কথাও বলতে যে আপনার ছেলেও এটার সাথে জড়িত।”

কল্যাণী ভ্রু কুঁচকালেন এরপর ভাবুক হওয়ার ভান ধরলেন। কিছুক্ষন যেতেই হেসে উঠলেন,,

“আপনাকে এতো বোকা ভাবিনি অফিসার। আমি যদি জানতামই যে কারা ড্রাগস স্মাগলিনের সাথে জড়িত তাহলে ওদের কথা আরও আগে আপনাকে বলতাম। আপনার ভালো করেই জানা আছে আমি আইনের লোক, সত্যর পক্ষে থাকি। সেখানে নিজের ছেলে অন্যায় কাজের সাথে জড়িত দেখে আমি চুপ কেনো থাকবো? ওই প্রধানকে থার্ড ডিগ্রী দিন, সত্যটা কী বেরিয়ে আসবে। ওই ছেলের বলা প্রতিটা কথা রেকর্ড করবেন।”

অফিসার মুজিব সিকদার কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে কল্যাণীর দিকে চেয়ে রইলেন। এরপর দুইজন মহিলা কনস্টেবল ও দুইজন পুরুষ কনস্টেবল নিয়ে জেলের সামনে গেলেন। ড্রাগ স্মাগলিন চক্রের প্রধান ও তার সহকারী দুইজনকে বের করে খালি একটা জেলের মধ্যে নিয়ে গেলেন। কল্যাণীও তাদের পিছু পিছু গেলেন।
অফিসার মুজিব সিকদার শান্ত ভাবে ওদের জিজ্ঞাসা করলেন,,

“নিজেরা ফেঁসেছিস ভালো কথা নির্দোষ একজনকে কেনো ফাঁসাতে চাচ্ছিস?”

প্রধান অর্থাৎ আহান নামের ছেলেটা বলে উঠলো,,

“এই চক্রের সাথে যারা জড়িত ছিল তাদের সবাইকেই তো এরেস্ট করেছেন। ফাঁসালাম কোথায়?”

“কল্যাণী রায়কে তো ভালো মতোই চিনিস, ওনার ছেলেকে কেনো ফাঁসাতে চাচ্ছিস?”

আহান ভ্রু কুঁচকে মাথা বাঁকা করে কল্যাণীকে দেখলো। এরপর বললো,,

“ওনার ছেলে এটার সাথে জড়িত, এতে আমি ফাঁসানোর কে? এইতো দুদিন আগেও একসাথে বসে ড্রাগস নিয়েছিলাম। মেয়ে নিয়েও ফুর্তি করেছিলাম।”

কল্যাণী চোয়াল শক্ত করে ফেললেন। রাগী স্বরে বলে উঠলেন,,

“অফিসার আমার ছেলে কালকে তার বাবার সাথে রাজশাহী থেকে এখানে এসেছে আজ একমাস পর সেখানে এই ছেলে এসব ভিত্তিহীন কথা বলে কিভাবে?”

অফিসার মুজিব সিকদার আর শান্ত হয়ে প্রশ্ন করতে পারলেন না। উঠে গিয়ে আহান ও সেই দুইজন ছেলেকে বেধড়ক মা’রা শুরু করলেন। এক পর্যায়ে অফিসার থামলেন। আহানের অবস্থা প্রায় খারাপ, তিনি আহানকে জিজ্ঞাসা করলেন,,

“সত্যটা এখন বলবি নাকি আরেকবার আদর যত্ন করবো?”

আহান আগে শক্ত হয়ে কথা বললেও এখন আর পারলোনা। অফিসার কনস্টেবলকে ইশারা করলেন রেকর্ড অন করতে। আহান নিভু নিভু শক্তিতে চুল টেনে ধরে ধীরে ধীরে বললো,,

“প্রায় দেড় বছর আগের ঘটনা। কল্যাণী রায়ের জন্য আমার বড় ভাইয়ের ফাঁ’সি হয় একটা মেয়েকে রে’ই’প করার জন্য। তখন আমি এখানে ছিলাম না, দেশের বাহিরে ছিলাম। ভাইটাকে শেষবারের জন্য দেখতেও পারিনি। কল্যাণী রায়ের প্রতি তীব্র ক্ষোভ জন্মায়, রাগে অন্ধ হয়ে বিপথে পা বাড়াই এবং কল্যাণী রায়কে কিভাবে জব্দ করা যায় সেটা ভাবতে থাকি। যখন জানলাম ওনার একটা ছেলে আছে তখন ওনার ছেলেকে খু’ন করতে চাইলাম। পরে ভাবলাম কল্যাণী রায়ের অনেক আত্মসম্মান, ওনার আত্মসম্মান ভাঙা দরকার। ভাবলাম কোনোদিন এই বিপথে থেকে যদি পুলিশের কাছে ধরা পরি ঐদিন ওনার ছেলেকেও ফাঁসিয়ে দিবো। মানুষের সামনে ওনার অপমান করাবো ওনার ছেলেকে দিয়ে। আজকে সেই সুযোগ আসলো। এতক্ষনে আশা রাখি টিভির হেডলাইন হচ্ছে ‘ড্রাগস স্মাগলিন চক্রের সাথে জড়িত সদ্য জনপ্রিয় উকিল কল্যাণী রায়ের ছেলে আদিত রায়’ আহ শান্তি।”

আহান আর কিছু বলবে এর আগেই অফিসার মুজিব সিকদার আহানের গালে স্বজোরে চড় মা’রলেন। আহান হাসলো, ঠোঁট ফেটে র’ক্ত পরছে আহানের।
পুলিশ অফিসার বেরিয়ে আসলেন। কল্যাণীর সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,,

“দুঃখিত ম্যাডাম, এভাবে আপনার ছেলেকে তুলে আনা উচিৎ হয়নি সবটা না জেনে। মিডিয়ার সামনেও আপনার ছেলেকে দাঁড় করিয়ে চিহ্নিত করাও উচিৎ হয়নি যে ও ড্রাগ স্মাগলিন চক্রের সাথে জড়িত একজন অপরাধী। আপনি টেনশন করবেন না, প্রেস কনফারেন্সে প্রমাণ করে দিবো এই রেকর্ড দ্বারা আপনার ছেলে নির্দোষ, ওকে ফাঁসানো হয়েছে।”(নিচু স্বরে)

কল্যাণী আর কিছু বললেন না। অফিসার মুজিব সিকদার আদিতকে জেল থেকে বের করে আনলেন। কল্যাণী আদিতের দিকে এক নজর তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন থানা থেকে। আদিত কল্যাণীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলো। অফিসারের থেকে সবটা শুনে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষন সে।
থমথমে মুখ নিয়ে সে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। সেদিন কল্যাণী মেয়েকে নিয়ে রায় বাড়িতে যায়নি। নিজের বাবার বাড়িতেই ছিল, একটা সময় আসলো নেহাল রায়ের জোড়াজুড়িতে ওনাকে আবার রায় বাড়িতে যেতে হলো। কিন্তু গিয়ে উনি জানতে পেরেছেন বিপুল রায় আদিতকে নিয়ে সুদূর কানাডা পাড়ি দিয়েছেন।


হুট্ করেই আদিত কল্যাণীকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরায় হতচকিত হয়ে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলেন কল্যাণী। আদিত কান্না করছে। কল্যাণীর মনে এমনিতেই স্নিগ্ধার মুখখানি দেখে ঝড় উঠেছে এর উপর আদিতের কান্নায় বেগতিক অবস্থা হচ্ছে মনের।

চলবে..?