নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-১০

0
166

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-১০]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

শেরহাম সারুর চোখের পাতায় আলতো করে চু’মু খেয়ে সরে এলো। মৃদু হেসে বলে উঠলো,,

“কাপড় চেঞ্জ করে ফেলো, পুরো ভিজে আছো তুমি। নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে, বেডশিট পাল্টে ফেলো। কিছুক্ষন পর আসছি।”(মৃদু হেসে)

শেরহাম বলেই আর দাঁড়ালোনা, বেরিয়ে গেলো। কক্ষ থেকে বেরোতেই শেরহামের মুখোভঙ্গি পাল্টে গেলো, রাগ উপচে পরছে শেরহামের। আদিতের মতো কথার বাণ ছুড়ে মাকে কোনোদিন মানসিক আ’ঘা’ত করতে চায়নি শেরহাম। শেরহাম কল্যাণীকে অসহায়ের মতো কাঁদতে দেখেছে আদিতের জন্য। শেরহাম কখনই চায়নি তার মাও কাঁদুক কল্যাণীর মতো। তাই এতদিন মাকে কিছু বলেনি, কিন্তু আজ তার মা সকল সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে।
রাগান্নিত মুখশ্রীতে বড় বড় পা ফেলে শেরহাম এগিয়ে গেলো তার মায়ের ঘরে।
মায়ের ঘরের সামনে এসে দেখতে পেলো তার মা মিতালি কাপড় চোপড় গুছিয়ে ওয়ারড্রবে রাখছেন। শেরহাম শক্ত কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“মা, তোমার কি মনে হচ্ছেনা তুমি আজকে সব সীমা অতিক্রম করে ফেলেছো?”(শক্ত কণ্ঠস্বরে)

হঠাৎ শেরহামের আগমন, অতঃপর শেরহামের এহেন কথা শুনে ভ্রু কুঁচকালেন মিতালি। বললেন,,

“কি হয়েছে? এতো রেগে আছিস কেনো?(ভ্রু কুঁচকে)

“কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করছো? আদেও তোমার কি এটা জিজ্ঞাসা করা সাজে? আজকে সারু সিঁড়ি থেকে পরে গিয়েছিলো আর তুমি সেখানেও ওকে কথা শুনিয়েছো! ওর মাতৃত্ব নিয়ে কথা শুনিয়েছো। ও হুটহাট পরে গিয়ে বাচ্চা নষ্ট করে ফেলবে তার জন্য ওর বাচ্চা হচ্ছেনা এটা তুমি কিভাবে বলতে পারলে? আজ অব্দি ওকে অনেক কথাই শুনিয়েছো আমি কিছু বলিনি কারণ আমি চাইনি আদিতের মতো করে তোমাকে কথার বাণ দিয়ে আ’ঘা’ত করতে, চাইনি তুমিও জেঠিমণির মতো কান্না করো। তাই কোনোদিন তোমাকে কিছু বলিনি, কিন্তু আজকে তুমি সীমা অতিক্রম করে ফেলেছো। সারু সিঁড়ি থেকে পরে গিয়েছিলো, কত বড় ক্ষতি হতে পারতো বুঝতে পারছো? সেখানে তুমি ওকে যা নয় তাই বলেছো! কথাটা না বললেই নয়, আমাদের মধ্যে আজ পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হয়নি সেখানে ও কিভাবে মা হবে? আশা রাখি এরপর সারুকে তুমি আর একটাও কটু কথা বলে আমাকে বাধ্য করবেনা তোমার বিরুদ্ধে যেতে।”( রাগান্নিত স্বরে)

শেরহাম নিজের কথাগুলো ব্যক্ত করেই আর দাঁড়ালোনা, প্রস্থান করলো। শেরহামের বলা প্রতিটা কথা শুনে মিতালি নিশ্চুপ, থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন। শেরহাম সারুর বিয়ের তিন বছর চলছে, তবুও ওদের মধ্যে কোনো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হয়নি আজ অব্দি। আর এতদিন মিতালি কতই না অপমান করে এসেছেন সারুকে, কটু কথা বলেছেন।মাতৃত্বে আঙ্গুল তুলেছেন, অবজ্ঞা করে এসেছেন। সব কিছু আরও একবার স্মরণ করতেই গা শিউরে উঠলো মিতালির। কোথাও একটা অপরাধ বোধ কাজ করছে ওনার। সারু তখনো অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল, সবে মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ছিলো। ননসের ছেলের বিয়েতে গিয়েছিলেন, সেখানেই সারু ও তার পরিবারের সাথে দেখা হয়েছিল ওনার। ননসের ছেলে বউয়ের জেঠাতো বোন হয় সম্পর্কে সারু। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরেছিল সারু, খুলে যাওয়ার ভয়ে বারবার শাড়ি চেপে ধরছিল সারু। মুখশ্রীতে অদ্ভুত এক মায়া খেয়াল করেছিলেন তিনি। তখনি ভেবে নিয়েছিলেন সারুকেই শেরহামের স্ত্রী করবেন। সারুর বাবা মা নারাজ ছিলেন মেয়েকে এতো অল্প বয়সে বিয়ে দিতে, কিন্তু মিতালি নিজের মতে অটল ছিলেন, সারুকেই ওনার পুত্রবধূ করবেন। সারুর বাবা মাকে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সারুকে নিজের মেয়ের মতো করে রাখবেন, পড়ালেখা বাকিটুকু এবাড়িতে করাবেন। কিন্তু আজকে ওনার মনে হচ্ছে উনি ওনার প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন, পড়ালেখার প্রতিশ্রুতি পালন করলেও মেয়ের মতো করে রাখার প্রতিশ্রুতি উনি রাখতে পারেননি। ক্রমশ সারুকে আঘাত দিয়ে কথা বলেছেন, মাতৃত্ব নিয়ে কথা শুনিয়েছেন। অপরাধবোধ কাজ করছে মিতালির মনে।


ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস অনুভূত হতেই কেঁপে উঠলো সারু। সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গিয়েছে এক সেকেন্ডের মধ্যে। শেরহাম ঘোর লাগা কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“আজকে পরীক্ষা কেমন দিলে?”(ঘোর লাগা কণ্ঠস্বরে)

সারুর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। কোনোমতে টেনে টেনে বলে উঠলো,,

“ভ.. ভালোই।”(টেনে টেনে)

“উমম.. এতো কাঁপছো কেনো?”

“ক.. কই নাতো।”

শেরহাম হুট্ করেই হেসে উঠলো। সারুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো পেছন থেকে। ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলে উঠলো,,

“ভয় পাচ্ছ? তুমি না চাইতে এমন মুহূর্ত তাহলে আজ যখন এমন মুহূর্তে আছো তাহলে এমন ভয়ে কাঁপছো কেন? বরকে সিডিউজ করা অঙ্গনার শোভা পায়না ভালোবাসার মুহূর্তে ভয়ার্ত হরিণী মতো কাঁপা।”(ঘোর লাগা স্বরে)

সারু কি বিপাকেই না পরলো। শাশুড়ি মায়ের কটুকথা না শোনার জন্য রাগের মাথায় আবেগের বশবর্তী হয়ে সেদিন সন্ধ্যায় শেরহামকে সিডিউজ করতে চেয়েছিলো যার পরিনাম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল অনেকক্ষন। ভাবতেই সারুর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। নিঃশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে সারুর। মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস আটকে এখনই মৃ’ত হয়ে যাবে। শেরহাম সারুকে আরও গভীর ভাবে ধরিয়ে ধরলো।

“চলো বাচ্চা হওয়ার প্রসেস শুরু করি।”(ধীর কণ্ঠে)

সারু হতচকিত হলো, শেরহামের কাছ থেকে নিজেরকে ছাড়নোর চেষ্টা করতেই শেরহাম বলে উঠলো,,

“ছুটাছুটি কেনো করছো? নিজেকে আমার থেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই, আমি এতদিন তোমার থেকে দূরে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেছি তাই দূরেই ছিলাম। আজ কাছে আসতে ইচ্ছে পোষণ করছি তাই কাছে আসবই। আজকে তোমাকে কোনো ছাড় প্রকার দিচ্ছিনা।”

সারু থেমে গেলো, শিরদাড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। সারুর অনুভূত হলো তার হৃদপিন্ড তড়িৎ গতিতে ছুটছে। শেরহামের তপ্ত স্পর্শ পেয়ে নিভে গেলো সারু। শেরহামের বুকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। শেরহাম মৃদু হাসলো, গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো,,

“একটা গান মেঘের মতো আকাশজুড়ে ইতস্তত ভাসে,
হাজার কাঁটাতার পেরিয়ে অনেক ঘুরে তোমার কাছে আসে।”

“একটা গান গুনগুনিয়ে গুনগুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে যায়,
তেমনি আবার আবার ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়।”

সারু শেরহামের মুখশ্রী পানে চাইলো। শেরহাম ঘোর লাগা নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সারু মৃদু হাসলো, শেরহামের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে শেরহামের গলা পেঁচিয়ে ধরলো। শেরহাম আলতো হাতে সারুর কোমর জড়িয়ে ধরলো। সারু শেরহামের গালে গভীর চুম্বন করলো। শেরহাম বিরস কণ্ঠে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,,

“চু’মু খেলে ভালো কথা, গালে কেনো? ঠোঁটে কেন নয়?”(বিরস কণ্ঠে)

শেরহামের বিরস কণ্ঠে এহেন কথা শুনে সারু ফিক করে হেসে দিলো। অতঃপর শেরহামের ঠোঁটে চু’মু খেলো। শেরহাম সারুকে নিজের সাথে আরও গভীর ভাবে জড়িয়ে নিলো।
তিন বছরের বৈবাহিক জীবনে এই প্রথম সারু শেরহাম এঁকে অপরের এতো কাছে এসেছে। ভালোবাসায় এঁকে অপরকে রাঙিয়ে তুলছে।


হসপিটালে,,

আচমকা গালে প্রচুর ব্যথা অনুভব করলো আদিত। সেই সাথে পুরো কক্ষ জুড়ে থা’প্প’ড়ের শব্দ প্রতিফলিত হলো। আদিত গালে হাত দিয়ে সামনে থাকার অঙ্গনার দিকে চেয়ে আছে। রাগী মুখশ্রী, ফোলা ফোলা ভাব।

আদিত পাশে থাকা কল্যাণীর দিকে তাকালো। কল্যাণী হতভম্ব হয়ে একবার ছেলের মুখশ্রী পানে তাকাচ্ছে মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,,

“ও’কে থা’প্প’ড় কেনো মারলে?”(বিস্ফোরিত কণ্ঠে)

কল্যাণীর বাক্য বচনে রাগান্নিত স্বরে মেয়েটি বলে উঠলো,,

“শুধু থা’প্প’ড়? ওনাকে গলা টি’পে মে’রে দেওয়া উচিৎ! আমার সাথে বেঈমানি করেছে, এর শাস্তি তো ওনাকে পেতেই হবে।”(রাগান্নিত স্বরে)

কল্যাণী কিছুই বুঝলেন না, ফের বলে উঠলেন,,

“বেঈমানি মানে? কি করেছে?”

“জিজ্ঞাসা করুন এই বেঈমানকে, দুই বছরের প্রেমকে অস্বীকার করে চার বছর আগে এই লোক আমার সাথে বেঈমানি করে কানাডা চলে গিয়েছিলো। সেদিন এই লোকের বিরহে আমার খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিলো, আপনি জানেন সেদিন আমাদের বাড়িতে বিরিয়ানি রান্না করা হয়েছিল। এই লোকটার জন্য আমি সেই বিরিয়ানি টুকুও খেতে পারিনি।”(আফসোসের স্বরে)

কল্যাণী অবাক হয়ে আদিতের দিকে চাইলেন। আদিত এখনো গালে হাত দিয়ে মেয়েটির দিকে চেয়ে আছে। আদিত কল্যাণীর চোখের দিকে একনজর তাকিয়ে নজর সরিয়ে ফেললো। কল্যাণী অবাক স্বরে বলে উঠলেন,,

“আদি! এসব কি শুনছি?”(অবাক কণ্ঠস্বরে)

আদিত নিশ্চুপ হয়ে ফ্লোরের দিকে চেয়ে আছে। আদিতের এমন নিশ্চুপ থাকাটায় মেয়েটা আরও রেগে গেলো। এগিয়ে এসে আদিতের শার্টের কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,,

“উনি আর কিই বা বলবেন, কানাডা থেকে মুখে আয়রনের লেপন দিয়ে এসেছে। কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। এই লোকের বিরহে আজ চার চারটা বছর অব্দি কান্নাকাটি করছি, দিন দুনিয়া ভুলে গেছি। বউ বানাবে আমাকে, বাবুর মাম্মি বানাবে আমাকে! এসব প্রতিশ্রুতি দিয়েও বেঈমানি করে কানাডা চলে গেছে আমাকে একা ফেলে। বেঈমান লোক, এখন যখন হাতের কাছে পেয়েছি এতো সহজে আপনাকে ছাড়ছিনা।”(চিবিয়ে চিবিয়ে)

আদিত শান্ত চোখে মেয়েটির চোখে চোখ রেখে হাত চেপে ধরলো, শান্ত স্বরে বললো,,

“আমার বিরহে তোমাকে কে কান্নাকাটি করতে বলছে? আমার মনে পরছেনা আমি কখন তোমায় বলেছিলাম তোমাকে আমার অপেক্ষায় দিন দুনিয়া ভুলে যেতে ইলা?”(শান্ত স্বরে)

আদিতের শান্ত স্বরে বলা কথায় ইলা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো আদিতের চক্ষুর দিকে। কিয়ক্ষন তাকিয়ে রইলো নির্বাক অশ্রুসিক্ত আঁখিতে।

“আ..আমি ভালোবাসি আপনাকে আ.. আদিত!”(ক্রন্দনরত স্বরে)

চলবে..?