নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-১১

0
56

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-১১]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

প্রেমময় এক প্রহর কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রাতের বৃষ্টিপাতের পর ভোরের আলোতে সবটা স্নিগ্ধ লাগছে। চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। পাখিরা মনের সুখে ডাকছে, আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। সারু শেরহামের উন্মুক্ত বুকে চোখ মুখ খিচে শুয়ে আছে, প্রচন্ড পেটে ব্যথা শুরু হয়েছে তার।
শেরহাম সারুর অবস্থা টের পেলো। নিচু স্বরে বলে উঠলো,,

“পেটে ব্যথা করছে?”(নিচু স্বরে)

সারু মুখে কিছু বললোনা, মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝালো। শেরহাম সারুর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।

“উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও, ভালো লাগবে।”

“আরেকটু পর উঠি।”

শেরহাম উঠে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুম চলে গেলো। এদিকে সারু চোখ মুখ খিচে ওভাবেই শুয়ে রইলো। পেটে ব্যথার সাথে সাথে সারুর প্রচন্ড মাথা ব্যথাও করছে। জানালা ভেদ করে আসা আলো সারুর চোখে মুখে পড়তেই ভীষণ মাথা ব্যথা অনুভব হচ্ছে সারুর। দ্রুত চাদর দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে ফেললো সারু।

শেরহাম ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে সারু সম্পূর্ণ নিজেকে ঢেকে শুয়ে আছে। শেরহাম সারুর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,,

“সারু, উঠো। ফ্রেশ হয়ে আসলে ভালো লাগবে একটু। সারু, উঠো।”

শেরহামের ডাকাডাকিতে না চাইতেও সারু উঠে বসলো, পেটের ও মাথার ব্যথায় অসহ্য লাগছে তার কাছে সবকিছু। সারু উঠে দাঁড়ালো, উঠে দাঁড়াতেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি একটা অনুভব হলো সারুর। শেরহাম এক দৃষ্টিতে সারুর দিকে চেয়ে আছে। মিনিট দুয়েক যেতে সারুর নজর ঘুরিয়ে তাকালো বিছানার দিকে। বিছানার দিকে নজর যেতেই গলা শুকিয়ে এলো সারুর। বিছানায় র’ক্ত লেগে আছে, সারুর শেরহামের দিকে ঘুরে তাকানোর মতো সাহস হচ্ছেনা। কি করবে বুঝতে পারছেনা সারু। লজ্জায় সারুর গালে লাল আভা দেখা দিলো। বিচলিত হলো সারু, এমতাবস্তায় কি করবে ভেবে পেলোনা। সারু বিছানার দিকে চেয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে শেরহাম বিছানার দিকে তাকালো। বিছানায় র’ক্ত দেখতে পেয়ে শেরহাম গম্ভীর হয়ে উঠলো, গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“এটা কমন একটা ব্যাপার, প্রথমবার ব্লি’ডিং হয়। এতো বিচলিত হওয়ার কি আছে? বেডশিট খুলে ধুয়ে ফেললেই হবে।”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

সারু বেডশিটটা খুলে ভ্রু কুঁচকে শেরহামের দিকে তাকালো। গমগমে স্বরে বলে উঠলো,,

“লজ্জা লাগছেনা আপনার একবারও?”(গমগমে স্বরে)

“না, একটুও না। লজ্জা কেনো লাগবে? তুমি সিডিউজ করেও লজ্জা পাওনি, তাহলে আমি আ’দ’র করার পর লজ্জা কেনো পাবো?”

কান গরম হয়ে উঠলো সারুর। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,,

“ভুল হয়েছে আমার আপনাকে সিডিউজ করে।”(দাঁতে দাঁত চেপে)

বলেই সারু হনহন করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। সারু যেতেই শেরহাম মুখের গম্ভীরতা কাটিয়ে মিটমিট করে হাসলো।


“ম.. মা আমি বাড়ি যাবো।”(কাঁপা কাঁপা স্বরে)

স্নিগ্ধার কণ্ঠস্বরে কল্যাণীর চিত্ত শীতল হয়ে গেলো। কতটা দিন পর মেয়েটার কণ্ঠস্বর শুনেছে। আগের চেয়ে স্নিগ্ধা অনেকটাই ভালো আছে। কল্যাণী স্নিগ্ধার উদ্দেশ্যে ধীর কণ্ঠে বললেন,,

“ঠিক আছে মা, আমরা আজকেই বাড়িতে যাবো।”

কল্যাণী কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালেন না। কেবিন থেকে বেরিয়ে ডাক্তার শাফানের কক্ষ উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলেন।

“আসবো ডাক্তার শাফান?”

ডাক্তার শাফান সবেমাত্র এসে বসেছিলেন কেবিনে। কল্যাণীকে দেখে মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলেন,,

“জী আসুন।”

“আমার মেয়ে আগের চেয়ে ভালো আছে অনেকটাই, ও এখন বাড়ি যেতে চাচ্ছে। আমাকে ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।”

ডাক্তার শাফান ভাবুক হলেন। মেয়েটা চলে যাবে, কিছুক্ষন আকাশ পাতাল ভেবে বলে উঠলেন,,

“ওনার কন্ডিশন দেখলাম ভালো আছেন, এবার যদি পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন তাহলে ওনাকে নিয়ে যেতে পারেন।”

“ধন্যবাদ ডাক্তার শাফান।”

কল্যাণী আর কিছু বললেন না। কল্যাণী হসপিটালের সকল ফর্মালিটিস পূরণ করে স্নিগ্ধাকে নিয়ে বের হলেন হসপিটাল থেকে। স্নিগ্ধা অনুভূতিহীনদের মতো হাটছে, তবুও এতদিন পর হসপিটালের চার দেয়াল থেকে বেরোতে পেরে মন ভরে নিঃশ্বাস নিলো। নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে স্নিগ্ধার সেই বীভৎস স্মৃতি গুলো মনে পরে গেলো। কি হিংস্র ভাবে পুষণ ভৌমিক নামক চরিত্রহীন, লম্পট হায়নাটা স্পর্শ করেছে তাকে। স্নিগ্ধা এখন অপবিত্র, কলঙ্কিনী। ভাবতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো স্নিগ্ধা, এদিকে হুট করে স্নিগ্ধার ডুকরে কেঁদে উঠায় ভরকালেন কল্যাণী। দু হাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ব্যাস্ত স্বরে শান্তনা দিলেন,,

“স্নিগ্ধা মা, কি হয়েছে কান্না করছো কেনো? কি হয়েছে?”(ব্যাস্ত স্বরে)

স্নিগ্ধা অস্পষ্ট স্বরে, ক্রন্দনরত অবস্থায় বললো,,

“আ..আমি অপবিত্র, কলঙ্কিনী! তোমাদের সংস্পর্শে আ.. আসার অধিকার হারিয়ে ফেলেছি তাইনা?”(অস্পষ্ট স্বরে)

কল্যাণী থমকালেন। মেয়ের এহেন প্রশ্নে ওনার গোটা পৃথিবীটা থমকে গেলো। কল্যাণীর বুক ফেটে কান্না আসছে, মেয়ে যে ওই হিংস্র, জঘন্য মুহূর্ত গুলো মনে করেই এহেন আচরণ করছে বেশ বুঝতে পারলেন।
কল্যাণীর অনুভূত হলো ওনার গলায় পাথর আটকে গিয়েছে, বুকে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলেন। দ্রুত স্বরে বললেন,,

“স্নিগ্ধা মা, এভাবে বলেনা। তুমি পবিত্র, কলঙ্কিত নও। নিজেকে শক্ত করো মা। এভাবে কাঁদেনা, তুমিনা স্ট্রং মায়ের স্ট্রং মেয়ে? তাহলে এভাবে কাঁদছো কেনো? মনকে শক্ত করো, জীবনের ওই কালো অধ্যায় মুছে ফেলার চেষ্টা করো মা। নয়তো সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ কষ্টকর হবে।”(দ্রুত স্বরে)

স্নিগ্ধা কিচ্ছু বললোনা, মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকলো। কিছুক্ষনের মধ্যে কান্নার বেগ কমে আসলে, নাক টানতে টানতে স্নিগ্ধা বলে উঠলো,,,

“আ.. আমার সবটা অসহ্য লাগছে মা। বাড়ি চ.. চল।”

কল্যাণী মেয়েকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে গাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। বাড়ির ড্রাইভারকে কল করে তিনি আসতে বলেছিলেন।

“শুনেছিলাম মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে মোটা হয়। তুমি এতদিন বাঁ’শের ক’ঞ্চি ছিলে এখন আমার ভালোবাসায় মুটি হয়ে গেছো। কি পাওয়ার দেখেছো?”

পি’রি’য়’ডের ব্যথায় নিশ্চুপ হয়ে বিছানায় বসে আছে সারু। এতোই ব্যথা করছে যে সারু নড়তেও পারছেনা। স্থির হয়ে বসে আছে। শেরহাম সবেমাত্র নাস্তা করে ঘরে ঢুকেছে। সারুকে এভাবে নিশ্চুপ থাকতে দেখে শেরহামের সহ্য হলোনা। শেরহামের ভীষণ ভালো লাগে সারুর রাগান্নিত টকটকে মুখশ্রীর ওই “অসভ্য” সম্মোধন। সারুকে রাগাতে শেরহাম উক্ত কথাটি ব্যক্ত করেছে। তবে সারু নির্বাক, নিশ্চুপ দৃষ্টিতে অবলোকন করছে শেরহামের মুখশ্রী। মুখশ্রীতে দুষ্টুমির ছাপ। অন্যসময় হলে সারু রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে “অসভ্য” বলতো। কিন্তু সারুর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছেনা কোনো প্রকার শব্দ করতে না নড়তে। পিরিয়ডকালীন সময়ে কোনোদিনও সারুর পেটে এতো বেশি ব্যথা অনুভব হয়নি, এই প্রথম এতো ব্যথা অনুভব হচ্ছে সারুর।
এদিকে সারুকে নিশ্চুপ দেখে শেরহাম ভ্রু কুঁচকে সারুর দিকে চেয়ে আসে। সারুর মুখশ্রীর ভাবখানা নিরপেক্ষ, পেটে হাত চেপে পাথরের মতো বসে আছে।
শেরহাম দু কদম এগিয়ে গিয়ে সারুর সামনে দাঁড়ালো। হাটু ভেঙে সারুর পায়ের কাছে বসলো। স্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,,

“কি হয়েছে? পেটে ব্যথা করছে বেশিই?”

সারু জবাব দেওয়ার মতো শক্তি পেলোনা। শেরহামের “কি হয়েছে” জিজ্ঞাসা করাতে কেনো জানি সারুর প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে শেরহামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে। সারু ঢোক গিলে, কাঁদো কাঁদো হয়ে নিচু স্বরে বলে উঠলো,,

“হ্যা, পি’রি’য়’ড হয়েছে আমার। পেটে অনেক বেশি ব্যথা করছে।”(নিচু স্বরে)

সারুর বাক্য বচনে শেরহাম অনুভব করলো তার গলা শুকিয়ে আসলো। শুকনো ঢোক গিলে জিভ ভিজিয়ে বলে উঠলো,,

“বেশি ব্যথা করলে চলো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।”

একপ্রকার তড়িঘড়ি শেরহাম সারুকে কোলে তুলে নিলো। শেরহামের এমন তড়িঘড়ি দেখে সারু শেরহামের গলা শক্ত জড়িয়ে ধরে একপ্রকার ক্রন্দনরত স্বরে বলে উঠলো,,

“ডাক্তারের কাছে যাবোনা, জড়িয়ে ধরে চু’মু খান। তাহলে ব্যথা কমে যাবে।”(ক্রন্দনরত স্বরে)

শেরহামের তড়িঘড়ি ভাব থমকে গেলো। শেরহাম আচ করতে পারছে সারুর অনেক বেশিই পেটে ব্যথা করছে। প্রথমত এই প্রথম সারু আর শেরহামের মাঝে স্বামী স্ত্রী এর সম্পর্ক হয়েছে আর এখন সারুর পি’রি’য়’ড হয়েছে এর জন্যই বেশি ব্যথা করছে সারুর পেটে।
সারু শেরহামকে শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে ফোঁপাচ্ছে। শেরহাম অনুভব করলো সারুর শরীর গরম। শেরহাম সারুকে বিছানায় বসিয়ে নিজের থেকে ছাড়িয়ে কপালে হাত দিলো। কপালে হাত স্পর্শ করাতে বুঝলো সারুর জ্বর এসেছে। শেরহাম সারুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বারকয়েক সারুর কপালে অধর স্পর্শ করালো গভীর ভাবে।
সারু ফুঁপিয়ে কান্না করছে। শেরহাম অনুভব করলো সারুর শরীর গরম হচ্ছে তো হচ্ছেই। জ্বরের মাত্রা বাড়ছে। শেরহাম সারুকে শুইয়ে দিয়ে গায়ে জড়ানোর জন্য আলমিরা থেকে কম্বল বের করে সারুর গায়ে জড়ালো। কপালে জলপট্টি দেওয়ার জন্য ছুটে নিচে চলে গেলো। একটা বাটিতে করে জল নিয়ে রুমে আসলো, রুমাল বাটিতে ভিজিয়ে সারুর কপালে রাখলো। সারুর মুখশ্রী পানে তাকিয়ে শেরহাম বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,,

“এক রাতের ভালোবাসায় জ্বর উঠে গেছে, দিন তো এখনো আরও অনেক বাকি আছে!”(বিড়বিড়িয়ে)

চলবে..?