নীরদ ক্লেশের অন্ত পর্ব-১৩+১৪

0
60

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-১৩]
লেখিকা- নামীরা অন্তিকা

সময়টা সূর্যোদয়ের, সমুদ্র ধারে মানুষজন ভিড় লাগিয়েছে তাদের প্রিয় মানুষদের সাথে সূর্যোদয় দেখার জন্য।
কতই না উচ্ছাস, আনন্দে প্রিয় মানুষটার হাত আঁকড়ে কাঁধে মাথা দিয়ে সূর্যোদয় দেখছে জোড়া কবুতর অর্থাৎ দম্পতিরা।
এতো মানুষের মাঝে স্নিগ্ধা একা দাঁড়িয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে সূর্যোদয় হওয়া দেখছে।
বর্তমানে সে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আছে। শুধু সে নয়, পুরো ফ্যামিলিই এখানে এসেছে।
সেদিন রাতের ঘটনার প্রায় দু মাস কেটে গেছে। এতদিন স্নিগ্ধা চার দেয়ালের মাঝে নিজেকে আটকে রেখেছিলো, প্রয়োজন ছাড়া একটাও কথা বলেনি কারো সাথে এমনকি নিজের মায়ের সাথেও। কক্সবাজার ঘুরতে তারা আরও আগে আসতো কিন্তু সারুর পরীক্ষার জন্য আসা হয়নি। সারুর পরীক্ষা কিছুদিন আগে শেষ হয়েছে তাই সবাই মিলে ঠিক করে এখানে এসেছে ঘুরতে। অবশ্য সবার মাঝে স্নিগ্ধা ছিলোনা, সবাই কতই না জোরাজুরি করেছিল কোথায় আসা যায় তা বলার জন্য। কিন্তু স্নিগ্ধা, সে একটাও কথা বলেনি। নির্বাক থেকেছিল। সব ভেবে স্নিগ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
চারদিকে একবার নজর বুলালো। চারদিকে সব অচেনা মানুষের ভিড়। রিসোর্ট থেকেও আসার সময় কাউকে বলে আসেনি স্নিগ্ধা যে সে বাহিরে যাচ্ছে।
অদূরে অথৈ জলরাশি বারবার স্নিগ্ধাকে আকর্ষণ করছে। বহুদিন পর স্নিগ্ধার ইচ্ছে করছে পানি ছোড়াছুড়ি করতে।
ধীর পায়ে স্নিগ্ধা এগিয়ে যাচ্ছে জলের দিকে। অনেকদিন তো নিজেকে বিষণ্ণ রেখেছে আজকে নাহয় পাখির মতো একটু উড়ুক, নিজেকে একটু ভালো লাগার রেশে ছোঁয়াক।


“তোমার ক্লাসমেটসরা সবাই এক দু বাচ্চার বাবা মা হয়ে গেছে, সেখানে তুমি একত্রিশ বছরে পা দিয়েও বিয়ে অব্দি করছোনা! আমার কি তোমার ছেলে মেয়েকে নিয়ে খেলার স্বাধীনতা দিবেনা? সমস্যাটা কি তোমার?”

সূর্যোদয় উপভোগ করতে এসে মায়ের এমন প্রশ্নে ভ্রু, চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো উৎস চৌধুরী। গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,,

“বলেছিলে হয় কক্সবাজার আনতে নাহয় বিয়ে করতে। বেস্ট অপশন হিসেবে কক্সবাজার নিয়ে এসেছি তোমাকে। সূর্যোদয় হচ্ছে, মনোমুগ্ধকর পরিবেশে তুমি সেই আবারো বিয়ে বিয়ে করে পরিবেশটা অনুপভোগী করছো? এসবের মানে কি? বিয়ের কথা যখন বলবেই তাহলে কক্সবাজার কেনো এসেছি হসপিটাল থেকে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে?”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

উৎসের গম্ভীর কণ্ঠস্বরের বাণী শুনে মুখ ফুলিয়ে ফেললেন উৎসের মা কানন দেবী। মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলো,,

“কক্সবাজার এসেছি যাতে এখান থেকে তোকে বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে বাড়িতে যেতে পারি।”( মুখ ফুলিয়ে)

উৎস ভ্রুকুটি করলো, অ’গ্নি’পি’ন্ডের ন্যায় জ্ব’ল’ন্ত হয়ে অম্বরে নিজের রাজত্ব বিস্তার করছে সূর্য। উৎস সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,,

“বিয়ে অর্থ কি? দুটো মানুষ একসাথে থাকা এরপর দু তিনটা বাচ্চা জন্ম দেওয়া। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ঝগড়া করা এরপর অজুহাত দেখিয়ে আরেকজনের হাত ধরে চলে যাওয়া। তাইতো?”

কানন দেবীর মুখ ছোট হয়ে এলো। পুরোনো কিছু স্মৃতি মুহূর্তের মাঝে অবলোকন করলেন আঁখি বন্ধ করে। মিনিট কয়েক অতিবাহিত হতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,,

“বিয়ে বিশাল পবিত্র অর্থ বহন করে। কিন্তু কিছু কালো রঙা মনের কলুষিত মানুষ বিয়ে অর্থটাকে এমন ভাবে উপস্থাপিত করে যে এর পবিত্রটা ঢাকা পরে যায় অদৃশ্য এক পর্দা দিয়ে। বিয়ে হচ্ছে একটা পবিত্র বন্ধন, এই বন্ধন পালন করা স্বামী স্ত্রী উভয়ের কর্তব্য। এই কর্তব্য পালনের জন্য স্বামীর স্ত্রী উভয়ের মধ্যে সম্মান থাকাটা জরুরি। সম্মান না থাকলে সম্পর্কটা টেকানো যায়না, বিয়ের পবিত্রতা বিনষ্ট হয়। মানুষ তো আজকাল বিয়েটাকে ছেলেখেলা পেয়েছে, কিছু হলেই বিয়ে ভেঙে দিচ্ছে। পবিত্রতা ন’ষ্ট করছে। তবে তাদের জন্য তো আর বিয়েটাকে ফিকে ভাবতে পারিনা। এটা অনুচিত। তুমি বিয়েটাকে যেমন ভাবছো, তেমন কিছুই নয়। সম্পর্কে সম্মান থাকলে ভালোবাসা জন্মাবে। ভালোবাসা জন্মালে আজন্ম থেকে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা জন্ম নেবে। অতঃপর যতই বাঁধা আসুক কেউ কাউকে ছেড়ে যাবেনা।”

উৎস নিশ্চুপ হয়ে পুরোটা শুনলো, কিয়ক্ষন নীরবতা পালন করলো। শক্ত কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো,,

“তোমার আর বাবার তো ভালোবেসে বিয়ে হয়েছিল, ভালোবাসা থাকলে আজন্ম থেকে যাওয়ার প্রতিজ্ঞার জন্ম হয়। তাহলে বাবা তোমাকে ছেড়ে কেনো চলে গেলো আরেক মহিলাকে বিয়ে করে?”(শক্ত কণ্ঠে)

কানন দেবী নিরুত্তর ও নির্বাক হলেন। ছেলের এমন প্রশ্ন অবশ্য ছেলের প্রশ্ন করার সময়ই বুঝেছিলেন।

“সম্পর্কের ভার স্বামী স্ত্রী উভয়ের উপরে থাকে, সেখানে উভয়কেই এঁকে অপরকে সম্মান করতে হবে। যদি একজন একটুও খামতি রাখে সম্মান করাতে তাহলে সেই সম্পর্কে ফাটল ধরা শুরু করে যার ফলাফল দু খন্ড হয়ে যাওয়া।”

কানন দেবীর এমন মন্তব্যয় উত্তর করলোনা উৎস। চারদিকে মানুষের কোলাহল, আনন্দ উল্লাস করছে মানুষজন। কিছুক্ষন যেতে কানন দেবী পুনরায় বললেন,,

“তোমার জন্য বেস্ট লাইফ পার্টনার চুজ করবো। বিয়েটা করে ফেলো, আর কত একা থাকবে? আমার তো বয়স হয়ে যাচ্ছে, আর কবে নাতি নাতনির মুখ দেখবো, তাদের সাথে খেলবো?”

কানন দেবী কি বললেন কিছুই শুনলোনা উৎস। খুব মনোযোগ সহকারে কিছু পর্যবেক্ষণ করছে উৎস। উৎসর মুখোভঙ্গি দেখে ভ্রু কুচকালেন কানন দেবী।

“মা, একটু অপেক্ষা করো এখানে আমি বউ নিয়ে আসছি।”(মৃদু কণ্ঠে)

উৎস আর অপেক্ষা করলোনা কানন দেবীর কথা শুনার জন্য। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সমুদ্র ধারে। উৎসর নজর স্থির এক রমণীর বাচ্চামোর দিকে। দুহাত ভরে জল তুলছে আর উপরের দিকে ছুঁ’ড়ছে। মাঝে মধ্যে স্নিগ্ধ এক হাসি দিচ্ছে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণা রমণীকে বেশ লাগলো উৎসর কাছে।
লজ্জা, শরম সব জলাঞ্জলি দিয়ে উৎস এক কান্ড বাধিয়ে ফেললো। এগিয়ে গিয়ে রমণীটিকে কোলে তুলে নিলো।
দূর থেকে কানন দেবী ছেলের এহেন কাণ্ডে চোখ বড়োবড়ো করে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলে যে এমন কান্ড বাধিয়ে ফেলবে কস্মিনকালেও কল্পনা করেননি। এই ছেলে একটা অজানা অচেনা মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছে এতো লোকজনের মাঝে!
উৎস রমণীটিকে কোলে তুলে নিতেই চারদিকের কিছু মানুষ হৈহৈ করে উঠলো এই ভেবে তারা নতুন কাপল।
উৎস মেয়েটিকে কোলে তুলে এনে কানন দেবীর সামনে দাঁড় করালো।

“তোমার বউমাকে নিয়ে আসলাম। এখনই বিয়ে করিয়ে দাও। হানিমুনও কক্সবাজার হয়ে যাবে।”(মৃদু হেসে)

কানন দেবী মেয়েটিকে লক্ষ্য করলেন। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের, কোমর অব্দি কেশ বেণী করা। চেহারায় আলাদা একটা মায়াবি ভাব রয়েছে, যদিও বর্তমানে মেয়েটি কাঁদো কাঁদো মুখ করে রয়েছে। মেয়েটির মনের অবস্থা টের পেটে কানন দেবী উৎসকে ধমকে উঠলেন,,

“উৎস! এটা কোন ধরণের অসভ্যতামি? এতো গুলো লোকের মাঝে তুমি অচেনা অজানা একটা মেয়েকে কোলে তুলে নিলে! মেয়েটার মনের কি অবস্থা হচ্ছে বুঝতে পারছো?”(ধমকে)

উৎস ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো,,

“বিয়ে করতে বললে, ওকে আমার ভালো লেগেছে তাই কোলে করে নিয়ে আসলাম বিয়ে করবো বলে। আমি থাকতে আমার বউ কষ্ট করে হেঁটে তোমার কাছে আসবে তা কি করে হয়, তাই কোলে করে নিয়ে আসলাম। বউ আবার অচেনা হয় নাকি? আর লোকজন উল্টাপাল্টা কিছুই ভাবেনি। ভেবেছে আমারা নিউ কাপল, তাই হৈচৈ করে হাত তালি দিয়েছে।”

কানন দেবী পুনরায় ছেলের কথা শুনে ছেলেকে ধমকে উঠলেন। এদিকে স্নিগ্ধার মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অচেনা একটা লোক সবার সামনে এভাবে তাকে ছুঁয়েছে, কোলে তুলেছে। লোকজন আবার হাততালিও দিচ্ছে, সবটা দেখে স্নিগ্ধা বেশ ভয় ও উত্তেজিত হয়ে উঠলো। অচেনা মানুষের এমন স্পর্শে স্নিগ্ধায় শরীরে কাঁ’টা দিয়ে উঠেছে। সেই হিংস্র মুহূর্তের কথা মনে পরে গেলো স্নিগ্ধার, আশেপাশে পরিবারের কেউ নেই। স্নিগ্ধার নিজেকে অনেক অসহায় মনে হলো, ভয়ে বুক ফে’টে কান্না আসতে লাগলো স্নিগ্ধার। উৎস হুট করেই স্নিগ্ধার হাত আলতো করে ধরে বলে উঠলো,,

“কাঁদলে এখনি কেঁদে নাও, এরপর আর কখনো কাঁদার সুযোগ পাবেনা। শুনো পারলে এখনই তোমার হৃদয়ে আমার নাম গেঁথে নাও “উৎস চৌধুরী”। যদি গাঁথতে না পারো তাহলেও সমস্যা নেই। কার্ডিওলজিস্ট হই, হার্ট সার্জারি করে ওখানে আমার নাম গাঁথবো।”(মৃদু হেসে)

স্নিগ্ধা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো। কিয়ক্ষন পর অনুভব করলো কার্নিশ বেয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে। স্নিগ্ধা উৎসের হাত ঝা’ড়া দিয়ে সরিয়ে ফেললো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, উৎসের স্পর্শ করা স্থান ঘষতে ঘষতে উল্টো হয়ে ছুটতে লাগলো। পুনরায় কোনো পুরুষ মানুষের ছোঁয়া স্নিগ্ধাকে অস্বাভাবিক করে তুলেছে।

চলবে..?

#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-১৪]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা

[প্রাপ্তমনস্কদের জন্য উন্মুক্ত]
“তোমায় বিয়ে করার কথা বলেছি বলে অতগুলো লোকজনের মাঝে একটা অপরিচিত মেয়েকে কোলে তুলে তাকে বিব্রত করবে?”(রাগান্নিত স্বরে)

কানন দেবীর রাগান্নিত স্বরের বাক্যবচন শুনে মৃদু হাসলো উৎস, কানন দেবী রাগান্নিত ভাব দেখালেও ছেলের এমন স্নিগ্ধ হাসি দেখে চিত্ত খুশি হয়ে উঠলো ওনার। উৎস মৃদু হেসে বলে উঠলো,,

“নাতি নাতনির মাম্মাকে তো খুঁজে দিলাম, এখন তোমার নাতি নাতনির মাম্মাকে আমার বউ বানানোর ব্যবস্থা করো। আমার বউ ও তোমার নাতি নাতনির মাম্মা যদি কেউ হয় তাহলে এই মেয়েটাই হবে।”(মৃদু হেসে)

কানন দেবী কপট রাগ দেখালেন। নাক মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলেন,,

“চেনা নাই জানা নেই, হুট করে একটা অচেনা মেয়েকে বিয়ে করবে, আমার নাতি নাতনির মাম্মা বানাবে বলছো! লজ্জা শরম কি সব সূর্যোদয়ের সাথে সাথে কর্পূরের ন্যায় উবে গেছে নাকি তোমার?”(নাক মুখ ফুলিয়ে)

উৎস ভাবলেশহীন হলো, কিয়ক্ষন কি যেন একটা ভাবলো। গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,,

“অচেনা? উহু। তোমার স্বামী আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে যে মহিলার জন্য তোমাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলো সমাজের কাছ থেকে দুশ্চরিত্রা উপাধি পাওয়ার জন্য, সে স্বামী ও ওই মহিলার দাম্পত্য জীবনে এক মেয়ে আছে। ইলা ওর নাম, তোমার স্বামীকে ঘৃণা করলেও ওই মেয়েটাকে কেনো জানি ঘৃণা করতে পারিনা। আফটার অল আমার চরিত্রহীন “বা-বা”রই তো মেয়ে। মেয়েটার মুখ দেখলে কেনো জানি ঘৃণা করতে মন চায়না। ইলা এক ছেলেকে ভালোবাসে, আদিত রায়। ঢাকার বর্তমান জনপ্রিয় উকিল কল্যাণী রায় ও বিপুল রায়ের ছেলে, যদিও কল্যাণী রায়ের সৎ ছেলে। আদিত রায়ের একটা হিডেন পরিচয় রয়েছে, হিটম্যান। টাকার জন্য মানুষকে খু’ন করা ওর শখের মধ্যে একটা। এছাড়া ওর পরিচয় হচ্ছে লন্ডনের একটা কলেজের টিচার। যেই মেয়েটাকে বউ বানানোর কথা বলছি সেই মেয়ে হচ্ছে আদিত রায়ের সৎ বোন, স্নিগ্ধা। যাকে প্রায় দু মাস আগে রে’ই’প করা হয়েছে।”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

কানন দেবী বাকরুদ্ধ হয়ে বিস্ফোরিত চক্ষুতে চেয়ে রইলেন উৎসের দিকে। নিঃশ্বাসটুকু নিতে ভুলে গেলেন কানন দেবী। প্রথমত তিনি বাকরুদ্ধ হয়েছেন এটা ভেবে উৎস তার বাবার খোঁজ কিভাবে পেলো? পেলেও সেটা ওনাকে কেনো বলেনি উৎস! দ্বিতীয়ত, যার ভাই একজন হিটম্যান, যে কিনা রে’ই’পের শিকার হয়েছে সেই মেয়েকে নিজের স্ত্রী বানানোর কথা বলছে উৎস! ভাবতেই শিউরে উঠলেন কানন দেবী। বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,,

“তোমার বাবার কথা তুমি জানতে? উনি কোথায় আছেন, খুঁজে কিভাবে পেলে?”(বিস্ফোরিত কণ্ঠে)

“তিনমাস আগে একটা পেসেন্টের হার্ট সার্জারি করেছিলাম, সেই পেসেন্ট হচ্ছে তোমার অযোগ্য স্বামী। ভাবছো ওনাকে কিভাবে চিনেছি, এতটা বছর যে প্রতিরাতে অযোগ্য স্বামীর বেঈমানির জন্য কাঁদো ওনার ছবি দেখে তা কি আমি জানিনা? যেখানে ওই লোকটার ছবি লুকিয়ে রাখো সেখান থেকেই কৌতূহলে অনেকবারই দেখেছিলাম। সামনাসামনি না হোক, ছবিকে আঁকড়ে ধরে অন্তত “বাবা” শব্দটা উচ্চারণ করার অধিকার পেয়েছি। যদিও ওনার মতো লোককে বাবা ডাকতে আমার বিবেকে বাধে কিন্তু কি করবো বলো, কতকাল সরাসরি বাবা ডাকতে পারিনা তাই ওভাবেই ডেকেছিলাম। সেদিন যদি আমার পরিচয় ওনার ছেলে ভাবতাম তাহলে হার্ট সার্জারিটা করতাম না, আমি তখন নিজেকে একজন দায়িত্ববান কার্ডিওলজিস্ট ভেবেছিলাম তাই হার্ট সার্জারিটা করেছিলাম।”(কঠোর কণ্ঠস্বর)

কানন দেবী আগের মতোই বিস্ফোরিত আঁখিতে চেয়ে রইলেন উৎসর দিকে। ছেলেটার জন্য ভারী খারাপ লাগে কানন দেবীর, সেই সাত বছর বয়সের পর ছেলেটা আজ অব্দি বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারেনি। কানন দেবীর চোখের কার্নিশ ভিজে উঠলো, কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠতেই উৎস কানন দেবীর গালে হাত রেখে হালকা হেসে বলে উঠলো,,

“ওহ মাই সুইটি, ডোন্ট ক্রাই। অযোগ্য লোকটার কথা বাদ দাও, আমার বউ আর তোমার নাতি নাতনির মাম্মার কথা ভাবো। আমি বিয়ে করলে ওকেই করব আই মিন স্নিগ্ধাকেই করবো।”(হালকা হেসে)

কানন দেবীর হঠাৎ কি হলো, হুট্ করে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন,,

“রে’ই’প হয়েছে মেয়েটার! তুমি কিভাবে ওকে বিয়ে করার কথা বলো? হিতাহিত জ্ঞান ঠিক আছে তোমার?”(ভ্রু কুঁচকে)

উৎস মায়ের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে কিয়ক্ষন তাকিয়ে রইলো। গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলো উঠলো,,

“তুমি ভুলে গেছো মা, কোনো মেয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজের মান সম্মান জলাঞ্জলি দেয়না। অনিচ্ছাকৃত ভাবে জোরজবরদস্তি করে মেয়েটার সম্মানহানি করা হয়েছে। এতে মেয়েটার তো হাত নেই, এটা জাস্ট একটা অপ্রত্যাশীত ইনসিডেন্ট ছিল। মেয়েটা মানসিক ভাবে ঠিক নেই, দেখলে না আমি ওকে স্পর্শ করেছি বলে ভয়ার্ত মুখে কান্না করে দিয়েছে। ওর পাস্ট নিয়ে আমার কোনো প্রব্লেম নেই মা, সবচে বড় কথা হচ্ছে আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। উৎস চৌধুরীকে আজ অব্দি এতবার বিয়ের কথা বলেও বিয়ে দিতে পারলেনা সেখানে একটা মেয়েকে নিজ থেকে বিয়ে করার কথা বলছি, ভেবে দেখো কতটা ভালোবাসলে নিজ থেকে ওকে বিয়ে করার কথা তোমাকে বলছি। ভালো যখন বেসেছি বিয়ে আমি ওকেই করবো, বয়স বিবেচনা করে যদি ওর পরিবার নাকচ করে দেয় তাহলে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো। যত যাই হোক, বিয়ে তো আমি স্নিগ্ধাকেই করবো।”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

কানন দেবী অবাক চোখে উৎসকে দেখছেন, আসলেই তো মেয়েটা তো নিজ ইচ্ছেতে রে’ই’প হয়নি। কানন দেবী এটা ভেবে আরও অবাক হচ্ছেন এতো বছর উৎসকে এতো করে বলেও কখনো বিয়ের কথা বলেনি, সে উৎস নিজ থেকে একটা মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলছে। কানন দেবী উৎসকে চেনেন ভালো করে, বাবা বিহীন ছেলেটা বড় হয়েছে। কাউকে ভালোবাসতে বা বিশ্বাস করতে হাজারবার ভেবেছে। সবসময় গম্ভীর ও কঠোর হয়ে থেকেছে। নারীলোক থেকে যে ছেলে সর্বদা দূরত্ব বজায় ছিল সে আজ নিজ থেকে একটা মেয়েকে বিয়ের কথা মুখ ফুটে বলছে, সেহেতু নিশ্চয়ই উৎসর মতো গম্ভীর ও কঠোর স্বভাবের ছেলেটি ভালোবেসে ফেলেছে সেই মেয়েকে। কানন দেবী ছেলে সম্পর্কে অবগত। ছেলে একবার যা বলে তাই করে দেখায়। তিনি ভাবছেন যদি স্নিগ্ধার সাথে উৎসর বিয়ে দিতে স্নিগ্ধার পরিবার নাকচ করে তাহলে উৎস নির্ঘাত স্নিগ্ধাকে তুলে নিয়ে এসে বিয়ে করবে।

“এখন এতকিছু না, আমার বউ ও তোমার নাতি নাতনির মাম্মা স্নিগ্ধাই হবে। দ্যাট’স ফাইনাল।”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

কানন দেবী মাথা দুপাশে নাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই ছেলে এতো গম্ভীর, কঠোর ও এতো জিদ্দি কিভাবে হলো ভেবে পাচ্ছেন না কানন দেবী।


“আপনার জন্য কি আমি শান্তিতে থাকতে পারবোনা? বিরক্তিকর, এই সারাদিন এতো কিসের প্রেম প্রেম করেন! আপনার লজ্জা শরম হয়না একটা বাচ্চা মেয়েকে প্রেমের কথা বলতে? (রাগান্নিত স্বরে)

সারুর চিৎকার দিয়ে রাগান্নিত স্বরে বলা বাক্যবচনে ভড়কে গেলো শেরহাম। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে শেরহাম কক্ষের কোথাও দেখতে পেলোনা শেরহাম। কোমরে টাওয়াল পেঁচিয়ে বেলকনিতে গেলো। দেখলো সারু বেলকনির রেলিং ধরে সমুদ্রের দিকে চেয়ে আছে। চারদিকে কত মানুষজন আনন্দ উল্লাস করছে আপনজনদের নিয়ে। খুব মনোযোগ দিয়ে তা দেখছিলো সারু, মুখে তার মৃদু হাসি লেপ্টে ছিল। শেরহামের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। পেছন থেকে শক্ত করে সারুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,,

“তোমায় দেখলেই খালি খালি প্রেমনেশা পায় আমার, উফ কি যে করি! আমি তো নোবেল আশা করি, বিয়ের তিন বছরেও নিজেকে কিভাবে তুমি নামক প্রেমনেশা থেকে দূরে ছিলাম! ভাবতেই অবাক লাগে ম্যাডাম।”

ব্যাস হয়েছে, বিরক্তিতে চিৎকার করে সারু উপরোক্ত কথাটা বলেছে। শেরহাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তব্দা মে’রে দাঁড়িয়ে রইলো স্থির আঁখিতে সারুর দিকে চেয়ে। এদিকে সারু নাক মুখ ফুলিয়ে শেরহামের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে।
শেরহামও ভ্রু কুঁচকালো, চোখ দিয়ে সারুকে শাসানোর ভঙ্গিতে বলে উঠলো,,

“আমার বউ আমার প্রেম, তোমার কি তাতে? আমি বউকে আমি প্রেমের কথা বলবো নাকি কিসের কথা বলবো সেটা নিয়ে কথা বলার তুমি কে? আমার বউকি আজীবন বাচ্চা থাকবে নাকি? তাই প্রেমের কথা বলে আমার বউকে বড় করে চেষ্টা করছি এতে তুমি কথা বলার কে হও?”(গম্ভীর কণ্ঠে)

সারু হতভম্ব হলো, রাগন্নিত স্বরে বললো কি আর শেরহাম সেই কথার প্রতি উত্তরে বললো টা কি! সারু শকড হয়ে হা করে চেয়ে রইলো শেরহামের দিকে। শেরহাম টুপ করে সারুর গালে চু’মু খেয়ে বেলকনি থেকে রুমে চলে আসলো। এদিকে সারু গালে আঙ্গুল স্পর্শ করে হা হয়ে শেরহামের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো। কিয়ক্ষন পর বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো “অসভ্য”।


“তোমার থেকে পিছু ছাড়াতে বিরক্ত হয়ে কক্সবাজার চলে এসেছি আর সেই তুমি আমায় পিছু করতে করতে কক্সবাজার অব্দি এসে উঠলে!”(ধমকের স্বরে)

আদিতের ধমকের সাথে ইলা ভ্রু কুঁচকে দ্বিগুন ধমকানোর স্বরে বলে উঠলো,,

“একদম গলা নামিয়ে কথা বলুন, দুই বছর আমাকে আপনার বউ, আপনার বেবির মাম্মি বানানোর স্বপ্ন দেখিয়ে প্রেম করে এখন আমাকে ঢং দেখাচ্ছেন? মজা মনে হচ্ছে সবটা? গত দু মাস কতভাবে আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছি এমনকি আপনার বাড়ি অব্দি গেছি, ফলস্বরূপ অতগুলো মানুষের মাঝে আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন। এই অপমানের বদৌলতে আমি কিচ্ছু বলিনি, ভেবেছি বাচ্চা মানুষ ভুল করে করে ফেলেছেন। কিন্তু না আপনিতো তো আস্ত একটা ধা’ম’রা, তা প্রমাণ করেই ছাড়লেন! এতদিন চুপচাপ থাকলেও এখন চুপচাপ থাকবোনা, এই আমি যাচ্ছি শাশুড়ি মাকে আপনার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য বলতে। একেবারে বিয়ে করে হানিমুন করে তবেই কক্সবাজার থেকে যাব।”(দ্বিগুন রেগে)

আদিত ইলার কথা শুনে হতভম্ব হয়েও প্রকাশ করলোনা তা, দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো,,

“এক থা’প্প’ড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো অসভ্য মেয়ে মানুষ। তোমার কি নূন্যতম সেন্স নেই? বেহায়ার মতো আচরণ করো। সবসময় তো ভালোবাসি ভালোবাসি বলো, তোমার এই ভালোবাসা কোথায় ছিল তখন? স্বার্থপরের মতো আমাকে ভাঙিয়ে তুমি বিয়ের পিঁড়িতে বসে গিয়েছিলে যখন জানতে পেরেছিলে আমি ড্রাগস্ স্মাগলিন চক্রের সাথে জড়িত বলে আখ্যায়িত হয়ে জেলে গিয়েছি, তবে সত্যটা হচ্ছে এটাই যে আমি কোনো ড্রাগস্ স্মাগলিনের সাথে জড়িত ছিলাম না, ফাঁসানো হয়েছিল আমাকে।”(রাগান্নিত স্বরে)

আদিতের কথা শুনে অবাকের শেষ চূড়ায় পৌঁছালো ইলা! ইলা জানে আদিত ড্রাগস্ স্মাগলিন চক্রের সাথে জড়িত বলে তাকে জেলে নেওয়া হয়েছিল যদিও পরবর্তীতে পুলিশ অফিসার প্রেস কনফারেন্সে সত্যটা প্রমাণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন আদিত এই চক্রের সাথে জড়িত নেই। ইলা তখন আদিতের জন্য খুব কান্না করেছিল, বাবাকে বলেছিলো সে আদিতকে ভালোবাসে এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। বাবা নিরুত্তর থাকলেও আঁখির চাহনি দিয়ে বার্তা দিয়েছিলেন উনি এটাতে মোটেও খুশি হননি।

“বিয়ে? আপনার কি মাথার তার ছিঁ’ড়ে গেছে? ভালো যখন আপনাকে বাসি তাহলে আরেকজনকে বিয়ে করার জন্য কেনো পিঁড়িতে বসে যাবো?”(অবাক স্বরে)

আদিতের রাগ আউট অফ কন্ট্রোল হচ্ছে, বহু কষ্টে নিজেকে দাবিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,,

“নাটক একদম করবেনা আমার সামনে, জেল থেকে বেরোনোর পর তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম। তোমার বাবা সরাসরি আমার সাথে দেখা করে বলেছেন আমি টাকার জোরে বেরিয়ে এসেছি জেল থেকে, তোমার লাইফ থেকে সরে যেতে বলেছিলেন। সেদিন নাকি তোমার বিয়ে ছিল, আর বিয়েটা তোমার ইচ্ছেতেই হচ্ছে। তুমি নাকি বুঝতে পেরেছিলে আমার মতো একটা ড্রাগস স্মাগলার তোমার লাইফে কখনো শোভা পায়না। তোমায় আমি ভালোবাসতাম, তোমার বিশ্বাসঘাতকতা আমায় এতটাই আঘাত করেছিল তোমার জীবন থেকে সরে গিয়েছি। এখন, এখন কি হয়েছে? তোমার স কল্ড হাসব্যান্ড ছেড়ে গিয়েছে তোমায়? বেহায়ার মতো আমার পিছনে কেনো পরে আছো?”(চিবিয়ে চিবিয়ে)

চলবে..?