#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-২৫]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা
রাত প্রায় দুটোর কাছাকাছি, স্নিগ্ধার চিত্তে কেনো জানি ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে। এপাশ ওপাশ করেও কিছুতেই নিদ্রা আসছেনা স্নিগ্ধার।
উঠে এক গ্লাস পানি খেলো ঢোক ঢোক, কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পরেও চিত্তকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছেনা স্নিগ্ধা।
পরিবারের কথা বারবার মনে পড়ছে। মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে ভীষণ ইচ্ছে করছে স্নিগ্ধার। উৎস বেহুদাই তাকে এখানে আটকে রেখেছে। স্নিগ্ধা কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারবেনা, অন্তত অপবিত্র হওয়ার পর তো না-ই।
চিত্তে চাপা রাগের সৃষ্টি হলো স্নিগ্ধার। দরজা খুলে উৎসের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালো।
একরাশ অস্বস্তি ও চাপা রাগ নিয়ে বার কয়েক টোকা দিলো দরজায়। উৎস দরজা খুলছেনা, হয়তো ঘুমে। স্নিগ্ধা কণ্ঠে রাগ মিশ্রিত করে উৎসকে ডাকলো,,
“দরজা খুলুন।”
স্নিগ্ধার বলার সেকেন্ড দুয়েকের মধ্যেই উৎস দরজা খুললো। স্নিগ্ধা উৎসের চোখের দিকে তাকালো, চোখ লাল হয়ে আছে, চুল উস্কোখুস্ক দেখাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে এখনো অব্দি উৎস ঘুমায়নি। রাশভারী স্বরে উৎস বললো,,
“কি হয়েছে? কিছু লাগবে?”(রাশভারী স্বরে)
“আমি.. আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে। মায়ের সাথে কথা বলব।”(নিচু স্বরে)
স্নিগ্ধা কথাটা নিচু স্বরে বললেও উৎসের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। উৎসের চোখ দুটো লাল হলেও শান্ত দেখাচ্ছে। তবুও এই শান্ত চোখদ্বয় দেখে স্নিগ্ধার শরীরে কাঁ’টা দিচ্ছে। উৎস নিশ্চুপ হয়ে স্নিগ্ধার মুখশ্রী পানে তাকিয়ে আছে। মিনিট দুয়েক এভাবে যেতেই উৎস বিছানার পাশের টেবিল থেকে নিজের ফোন এনে স্নিগ্ধার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
“কথা বলো।”
দুইটা শব্দই বললো উৎস, সেই দুইটা শব্দ বেশ করুন ও অদ্ভুত শোনালো। স্নিগ্ধা চেয়ে আছে উৎসের মুখশ্রী পানে। উৎসের বাড়িয়ে দেওয়া ফোন হাত বাড়িয়ে নিলো। উৎস ফিরে গেলো, দেয়ালের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিছানার প্রান্তে বসে রইলো।
স্নিগ্ধার অদ্ভুত লাগলো, ভীষণ অদ্ভুত লাগলো উৎসকে। কিয়ৎক্ষণ নির্লিপ্ত, নিশ্চুপ হয়ে উৎসের দিকে চেয়ে রইলো। হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকালো। মায়ের সাথে কথা বলতে পারবে ভেবে ফোন অন করলো। সাথে স্নিগ্ধার নজরে আসলো ওয়ালপেপারে তার ছবি সেট করা। অবাক হলো স্নিগ্ধা, কক্সবাজার পৌঁছানোর পরদিন সকালে স্নিগ্ধা যখন সূর্যোদয় দেখছিলো মৃদু হেসে তখনই ছবিটা তোলা হয়েছে।
অবাক আঁখিতে চেয়ে রইলো ওয়ালপেপারের নিজের মৃদু হেসে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা ছবিটার দিকে।
উৎসের ফোনে লক দেওয়া নেই, স্নিগ্ধা সব উপেক্ষা করে মায়ের নাম্বার ডায়াল করলো। দু একবার ঢুকতেই পরক্ষণে সুইচড অফ দেখালো।
স্নিগ্ধা অস্থির হয়ে বার কয়েক চেষ্টা করলো। কিন্তু নাম্বার বন্ধ। স্নিগ্ধা এবার কি করবে বুঝতে পারলোনা। স্নিগ্ধা ভাবলো শেরহামকে কল দিবে, কিন্তু এই মুহূর্তে হয়তো ঘুমাচ্ছে তারা। এখন ডির্স্টাব না করাই না ভালো। স্নিগ্ধা ভেবে পাচ্ছেনা মায়ের নাম্বার কেন বন্ধ বলছে, হতে পারে ফোনে চার্জ শেষ উনি ঘুমাচ্ছেন।
স্নিগ্ধা কল করা বাদ দিলো, চিত্তকে বোঝানোর পরেও স্নিগ্ধার চিত্তে অস্থিরতা বিরাজমান। নিঃশ্বাস আটকে যাবে যাবে অবস্থা। ঢোক দিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে স্নিগ্ধা থেমে থেমে উৎসের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,,
“আ.. আপনার ফোন।”
উৎস তৎক্ষণাৎ তাকালোনা। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর নিশ্চুপভাবে উঠে এগিয়ে আসলো স্নিগ্ধার দিকে। হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধার হাত থেকে নিজের ফোনটা নিলো। স্নিগ্ধা উৎসের মুখশ্রী পানে তাকাতে খানিক চমকালো। উৎসের কার্নিশ ভেজা! উৎস কাঁদছে!
স্নিগ্ধা হতভম্ব হয়ে উৎসের দিকে তাকিয়ে আছে। উৎস স্নিগ্ধার দিকে তাকালোনা চক্ষু নিচু করে রাখলো। স্নিগ্ধার থেকে ফোন নিয়ে উৎস ফিরে গেলো বিছানার দিকে। দরজা অব্দি আটকালোনা, ওভাবেই শুয়ে পড়লো ওপাশ ফিরে। এদিকে স্নিগ্ধা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ অব্দি স্নিগ্ধা কোনোদিন পুরুষ মানুষকে কান্না করতে দেখেনি। এই প্রথম দেখলো তাও আবার উৎসকে। ভাবতেই স্নিগ্ধার মাথায় আকাশ মিনিটে মিনিটে ঠাস ঠাস করে ভেঙে পড়ছে!
স্নিগ্ধার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছেনা উৎসের মতো পুরুষ মানুষ কান্না করছে! কিন্তু কেনো কান্না করছে? কি হয়েছে? স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসা করবে কি করবেনা করতে করতে এগিয়ে গেলো উৎসের বিছানার দিকে।
মৃদু কাঁপা স্বরে থেমে থেমে জিজ্ঞাসা করলো,,
“শ.. শুনছেন! কাঁদছেন কেনো? কি হয়েছে?”(থেমে থেমে)
উৎস নিরুত্তর। স্নিগ্ধার জিজ্ঞাসা করার পরেও উৎসের নিরুত্তর ভাবটায় স্নিগ্ধা কি বলবে খুঁজে পেলোনা। তবুও বললো,,
“কাঁদছেন কেনো? কিছু হয়েছে?”(থেমে থেমে)
উৎস নিরুত্তর থাকলেও উঠে বসলো। স্নিগ্ধার দিকে না তাকিয়ে স্নিগ্ধার হাতের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে ছোট স্বরে বললো,,
“তোমার হাত দুটো একটু দিবে।”(থেমে থেমে)
বলেই উৎস হাত বাড়ালো স্নিগ্ধার দিকে এই আশায় তার হাতের উপর স্নিগ্ধা তার হাত রাখবে। স্নিগ্ধা এদিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে উৎসের দিকে। উৎসের কান্না, এখন হাত চাওয়া সবটাতেই অবাক হচ্ছে স্নিগ্ধা। কি হয়েছে উৎসের! হুট করে এমন আচরণ কেনো করছে কিছুই বুঝে আসছেনা স্নিগ্ধার।
স্নিগ্ধার ভাবনার মাঝেই উৎস আবারো বলে উঠলো।
“একটু হাত রাখবে আমার হাতে? একটু, ব্যথা পাবেনা আই প্রমিস।”
এবার যেন উৎসের কণ্ঠস্বর অনেক করুন শোনালো, উৎস যেন নিজেকে সামলানোর জন্য ভরসার হাত খুঁজছে। সে হাত স্পর্শ করলে উৎস নিজেকে দমাতে পারবে, সামলে নিতে পারবে। স্নিগ্ধার কিঞ্চিৎ খারাপ লাগলো, স্নিগ্ধার হাত এগিয়ে দিতে ইচ্ছে করলোনা কিন্তু স্নিগ্ধার চিত্ত বলল “একটু হাতই তো দিবি, দে না, দেখ তোর হাত একটু স্পর্শ করার জন্য কতটা করুন স্বরে অনুরোধ করছে!”
অগত্যা স্নিগ্ধা নিজেকে হারিয়ে চিত্তের কথা শুনলো। দুহাত বাড়িয়ে রাখলো উৎসের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের উপর। উৎস স্নিগ্ধার দুহাত আলতো করে জড়িয়ে ধরলো নিজের হাতের বাঁধনে। স্নিগ্ধার দুহাত উৎস তার চোখের সাথে আলতো করে স্পর্শ করালো। মুহূর্তেই দিশেহারা ভাবে কান্না করা শুরু করলো উৎস। হুট্ করে উৎসের এহেন কান্নায় স্নিগ্ধার বুকে উত্তাল ঢেউয়ের সৃষ্টি হলো। চিত্ত অশান্ত হয়ে উঠলো, সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো।
“এ.. একি আপনি.. আপনি কাঁদছেন কেনো? কাঁদবেন না, আ..আমার অস্থির লাগছে। উৎস.. কা.. কাঁদবেন না। কি হয়েছে বলুন না?”(কাঁপা কাঁপা অস্থির কণ্ঠে)
উৎস নিরুত্তর, শুধু কাঁদতেই লাগলো। উৎসের চোখের মৃদু গরম জল স্নিগ্ধার হাত স্পর্শ করতেই স্নিগ্ধা বারবার কেঁপে উঠছে, অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিয়ৎক্ষণ এভাবে যেতেই উৎস কিছুটা শান্ত হলো। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো, এলোমেলো স্বরে বলল,,
“আমি যতবার সবটা ঠিক করতে চাই ততবার কেনো সবটা বিচ্ছিন্ন, এলোমেলো হয়ে যায়? ভালোবাসা কি আমার প্রাপ্য নয়?”(এলোমেলো স্বরে)
উৎসের এলোমেলো স্বরের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝলোনা স্নিগ্ধা। সে শুধু হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো উৎসের দিকে। উৎস উঠে দাঁড়ালো, ব্যস্ত ভঙ্গিতে বিছানার পাশে থাকা টেবিলের ড্রয়ার থেকে কি যেন একটা খুঁজলো। ওষুধের পাতা, দুটো টেবলেট মুখে নিয়ে উৎস পানি খেলো।
বিছানায় গিয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়লো নীরবে।
উৎসের কাজে প্রচুর হতভম্ব হলো স্নিগ্ধা। কি থেকে কি হলো? বোধগম্য হলোনা তার। অবাক নয়নে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো উৎসের দিকে চেয়ে।
।
।
“আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি শেরহাম রায়। যদি আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফেরে তাহলে কোমায় যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মহিলাটা ঠিক আছে, মাথা ফেটে যাওয়া আর বিভিন্ন জায়গাতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি ওনার দ্রুতই জ্ঞান ফিরবে। তবে মেয়েটা আর লোকটা রিস্কে আছে। প্রে করুন।”(মৃদু স্বরে)
ডাক্তারের কথা শুনে শেরহাম মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। পাশে চেয়ারে কল্যাণী আর নেহাল রায় নীরব হয়ে বসে আছেন। কল্যাণী ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলেন ডাক্তারের কথা শুনে। নেহাল রায় পাথরের মতো বসে রইলেন মেঝের দিকে চেয়ে।
ঘন্টা দুয়েক আগে,,
আদিতকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিয়ে দু পরিবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। পথিমধ্যে শেরহামদের গাড়ির ডিজেল শেষ হয়ে যাওয়ায় গাড়ি থেমে গেলো। ইলাদের গাড়িটা শেরহামদের সামনে থাকায় তারা লক্ষ্য করলোনা শেরহমদের গাড়িটা পিছে থেকে গিয়েছে। এদিকে শেরহামদের গাড়িতে পর্যাপ্ত ডিজেল ছিল বিধায় কোনো ঝামেলা পোহাতে হলোনা শেরহামকে। গাড়ি থেকে নেমে গাড়িতে ডিজেল ভরলো শেরহাম। অতঃপর গাড়ি পুনরায় স্টার্ট দিলো। ততক্ষনে ইলাদের গাড়ি অনেক দূরে চলে গিয়েছে। শেরহাম দ্রুত গালি চালিয়ে বেশ দূরে এসে ব্রেক কষলো। সামনে সাদা রঙের একটা গাড়ি ভেঙে চুঁড়ে পড়ে আছে আর কিছু দূরত্বে একটা ড্রাইভারবিহীন ট্রাক দাঁড় করানো। শেরহাম দ্রুত গাড়ি থেকে বেরোলো সেই সাথে কল্যাণী আর নেহাল রায়। শেরহাম দৌড়ে সেই গাড়ির কাছে গিয়ে দেখতে পেলো সেটা ইলাদের গাড়ি। শেরহাম হতভম্ব হয়ে ভাঙা জানালায় দেখলো ড্রাইভিং সিটে কৌশিক চৌধুরী ও পাশে ইলা র’ক্তা’ক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। পিছের সিটে প্রমীলা চৌধুরী নেই, শেরহাম আশেপাশে চোখ বুলালো, তাদের গাড়ির আলোয় রাস্তার পাশে দেখতে পেলো প্রমীলা চৌধুরী উল্টে পড়ে আছে। শেরহাম দৌড়ে ওনার কাছে গিয়ে দেখলো ওনার মাথা ফেটে র’ক্ত গড়াচ্ছে দ্রুত গতিতে। কল্যাণী আর নেহাল রায় ইলাদের এমন অবস্থা দেখে হতভম্ব হলেন। এইতো কিছুক্ষন আগেও তো ইলারা ঠিক ছিল, মুহূর্তেই ট্রাক একসিডেন্ট ঘটে গেলো!
শেরহাম দ্রুততার সহিত প্রমীলা চৌধুরী উঠিয়ে তাদের গাড়িতে বসালো। নেহাল রায়ের সাহায্যে বহু কষ্টে ভাঙা গাড়িটা থেকে ইলা আর কৌশিক চৌধুরীকে বের করে গাড়িতে উঠালো। কল্যাণী কান্না করে একাকার অবস্থার সৃষ্টি করে ফেলেছেন। শেরহামের মাথা শূন্য হয়ে গেলো, বারবার ইলাদের র’ক্তা’ক্ত দৃশ্য চোখে ভাসতে লাগলো তার।
সম্ভবত প্রমীলা চৌধুরী গাড়ির সাথে ট্রাকের সংঘর্ষ হতেই ছিটকে বাহিরে পড়ে গিয়েছেন তাই ওনার শুধু মাথা আর হাত পায়ের কিছু অংশ ছিলে গিয়েছে। কিন্তু ইলা আর কৌশিক চৌধুরী সামনে থাকায় মারাত্মক ভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে।
শেরহাম মনোবল শক্ত রেখে গাড়ি স্টার্ট দিলো। যতই দ্রুত পারা যায় হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
ভাবনা থেকে বেরোলো শেরহাম। হাত পা শীতল হয়ে আসছে তার। পকেটে থাকা ফোনটা বারবার বেজে উঠছে। শেরহাম ধীর গতিতে ফোন বের করে দেখলো সারুর নাম্বার। একদৃষ্টিতে শেরহাম সারুর নাম্বারের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো সারু তাদের বাড়ি না ফেরা নিয়ে টেনশন করছে কিন্তু এদিকে যে ইলা আর কৌশিক চৌধুরীর জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা! চক্ষু ঘোলাটে হয়ে উঠলো শেরহামের। ঘোলাটে চোখে চেয়ে দেখলো বাবা হাঁটুর উপর হাত ঠেকিয়ে হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে মেঝের দিকে চেয়ে আছেন। কল্যাণী ফুঁপিয়ে কান্না করছেন। এইতো কয়েক ঘন্টা আগের ব্যাপার। দু পরিবার আদিত ইলার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন সুস্থ সবল ভাবে। আর এখন! এখন তাদের জীবন বিপন্ন প্রায়। প্রমীলা চৌধুরীর জ্ঞান ফেরার ও সুস্থতার আশঙ্কা থাকলেও ইলা আর কৌশিক চৌধুরীর লাইফ রিস্কে রয়েছে। জ্ঞান না ফিরলে
চলবে..?
#নীরদ_ক্লেশের_অন্ত
[পর্ব-২৬]
লেখিকা-নামীরা অন্তিকা
ভোরের মৃদু আলো ফুটেছে। হসপিটালের বাহিরে মেইনরোডের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে শেরহাম। মেইনরোডে আপাতত ভারী কোনো গাড়ির অস্তিত্ব নেই। পেট চালানোর তাগিদে রিকশাওয়ালারা ধীরে ধীরে চলাচল শুরু করেছে মেইনরোডে। শেরহাম একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে, দেখছে মানুষগুলোর আজকের দিনের পরিকল্পনা। আর ভাবছে, হুট্ করে কি থেকে কি হয়ে গেলো।
একরাশ দুঃখ নিয়ে আদিত কানাডা পাড়ি দিলো অপরদিকে ইলা, কৌশিক রায়ের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি। শেরহামের গলায় যেন পাথর বিঁধে আছে। হাঁসফাঁস লাগা শুরু হয়েছে, সারারাত সে, কল্যাণী আর নেহাল রায় হাসপাতালেই ছিল।
দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছেন তারা, সারু রাত প্রায় তিনটা অব্দি তাকে ফোন দিয়েছে তবে একরাশ বিতৃষ্ণায় শেরহাম ফোন রিসিভ করেনি। কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করছিলো না, তখন যেমন মুখ তেঁতো হয়ে ছিল এখনও তাই হয়ে আছে।
জীবন ভারী অদ্ভুত! এই জীবনে মুহূর্তেই এই পৃথিবী সুখ পাওয়া যায় আর মুহূর্তেই এক পৃথিবী শোক পাওয়া যায়।
এটা সৃষ্টির নিয়ম, এটাকে অগ্রাহ্য করার কারো সাধ্য নেই। এটা মেনে নিয়েই মানবজীবন অতিবাহিত হয়েছিল, হচ্ছে এবং হবেও।
শেরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আদিত যদি জানে সুস্থ সবল যে ইলাকে সে এয়ারপোর্ট দেখে পাড়ি জমিয়েছে কানাডায় সে ইলা এখন অচল প্রায়। তাহলে আদিতের রিএকশন কি হবে? পাগল প্রেমিকের মতো হাঁসফাঁস করবে? উড়াল দিয়ে কানাডা থেকে বাংলাদেশ আসতে চাইবে? শেরহাম জানে আদিত ভালোবাসে ইলাকে, ভীষণ ভালোবাসে। শেরহাম লক্ষ্য করেছিল আদিতের চক্ষুতে ইলার জন্য এক সমুদ্র প্রেম আছে, যার কোনোদিন অন্ত হবেনা। এখন যদি ভগবান কৃপা করেন তাহলে ইলা ও কৌশিক চৌধুরীর জ্ঞান ফিরবে। অন্যথায় কোমায় যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
কাঁধে কারো হাত রাখায় শেরহাম পাশ ফিরে চাইলো। নেহাল রায় দাঁড়িয়েছেন তার পাশে। শেরহাম মৃদু হাসার চেষ্টা করলো তবে হাসি আসলোনা। নেহাল রায় ভারী কণ্ঠে বলে উঠলো,,
“একা দাঁড়িয়ে কি ভাবছো? সারুকে ফোন করেছো? এই সময়ে মেয়েটাকে টেনশনে ফেলা উচিৎ নয়।” (ভারী কণ্ঠে)
“টেনশনে কেউ কাউকে ইচ্ছে করে ফেলেনা বাবা, ভাগ্য নিজ থেকেই মানুষকে বাধ্য করে তাকে দিয়ে অপর একটা মানুষকে টেনশনে ফেলতে। আমিও ভাগ্যর এই খেলার শিকার। ভাবছি কি এখন জানো? পরবর্তীতে এসবের পরিণতি কি হবে!”(রাশভারী স্বরে)
নেহাল রায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কথার পিঠে কথা বললেন না। নিঃশব্দে শেরহামের পাশাপাশি চেয়ে রইলেন মেইনরোডের দিকে। সময় যতই অতিবাহিত হচ্ছে হসপিটালে মানুষজনের আনাগোনা বাড়ছে, মেইনরোডে বাড়ছে যানবাহন সেই সাথে যানবাহনের শব্দ।
“আপাতত বাড়ি চল, ফ্রেশ হয়ে আসবো। সারাটা রাত চিন্তায় বিভোর ছিলাম। ভোরের দিকে চোখ লেগে আসলেও আর ঘুমাইনি। মাথা ব্যথা করছে।” (মৃদু স্বরে)
নেহাল রায়ের উক্তিতে ফোঁস করে একটা ছোট শ্বাস ছাড়লো শেরহাম। নেহাল রায়কে সাথে আসতে বলে সে হসপিটালের ভেতরে ঢুকলো।
ইলা, কৌশিক চৌধুরী ও প্রমীলা চৌধুরীর কেবিনের সামনের চেয়ারে নির্লিপ্ত ভাবে দেয়ালের দিকে চেয়ে থম মেরে বসে আছেন কল্যাণী।
শেরহামের খারাপ লাগলো জেঠিমণির এই করুন চেহারাটা। ভালোবেসে আগলে রাখা মেয়েটা সাথে নেই, ছেলে বাবাকে বাঁচানোর তাড়নায় ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছে শেষে যাকে নিজের আরেক মেয়ে মনে করে ভালোবাসলেন সেও আজ প্রায় অচল। জ্ঞান আসলে তো আসলোই আর না আসলে জীবন্ত লাশ হয়ে থাকবে ইলা আর কৌশিক চৌধুরী।
“জেঠিমণি, বাড়িতে যাওয়া উচিৎ আমাদের। বাড়ি ফিরিনি বলে মা আর সারু হয়তো টেনশন করছে। ফোন দিয়েছিলো রিসিভ করতে পারিনি, সেই মন মানসিকতা ছিলোনা তখন।”(থমথমে স্বরে)
কল্যাণী সময় নিয়ে শেরহামের দিকে চাইলেন। শেরহামের বুক ধ্বক করে উঠলো জেঠিমণির এই বিবর্ণ মুখশ্রী দেখে। শেরহাম অনুভব করলো তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলো।
কল্যাণী উঠে দাঁড়ালেন তবে দাঁড়ানো আয়ত্ব করতে পারলেন না, পড়ে যেতে নিলেন। শেরহাম আঁকড়ে নিলো জেঠিমণিকে। শেরহামের আঁকড়ে ধরাতে কল্যাণী যেন ভরসায় কাঁদার স্থান পেলেন। মৃদু আওয়াজে ফুঁপিয়ে উঠলেন। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,,
“সুখ! কখনো কি পরিপূর্ণ হয়ে দেখা দিবেনা শেরহাম? সবটা থেকেও কেনো অদৃশ্য! এই অদৃশ্যর খেলা শেষে কবে, কখন দৃশ্যমান হবে সবটা?” (অস্পষ্ট স্বরে)
“জেঠিমণি! তুমি আমাদের সবার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। সবটা বুঝো তুমি, এটাও বুঝো আকাশ মেঘলা হয়ে বর্ষণের পরে সবটা মিষ্টি মধুর হয়। এমনি এক প্রহর আমাদের অপেক্ষায়, আমরা এখন আকাশের মেঘলা পরিবেশে আছি। শীঘ্রই সেই মিষ্টি প্রহর আমাদের হবে। কষ্টের পরেই সুখ, মিষ্টির দেখা মিলে। সুখ, দুঃখ মিলিয়েই তো মানবজীবন। ধরতে গেলে এক অর্থে #নীরদ_ক্লেশের_অন্ত বলাই যায় পুরো মানবজীবনকে। ধৈর্য ধরো, সবটা ঠিক হয়ে যাবে।”
“দুঃখের পরেই আমরা সুখের আভাস পাই,
সে আভাসে নিজেদের রাঙাই”
▫️নামীরা অন্তিকা
।
।
স্নিগ্ধার ঘুম ভেঙেছে অনেক সকালেই। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁ পাশে উৎসের কক্ষের দিকে তাকাতেই স্নিগ্ধার গতকাল রাতের কথা মনে পড়লো। অজান্তেই অস্থিরতা জেঁকে বসলো চিত্তে। উৎসের কক্ষের দরজা খোলা, সেদিকে পা বাড়াতে নিয়েও স্নিগ্ধা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বাগানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। বাড়িটার চারদিকে অনেক উঁচু প্রাচীর দেওয়া। বাড়ির মূল দরজা বাহির থেকে আটকানো। বাহিরে দারোয়ান পাহারা দেন, উৎসের আদেশে গেইট খুলেন আবার আটকে দেন। উৎসের মামা মামি এখনো ফিরেনি, ফিরতে তাদের আরও তিন চারদিন দেরী আছে।
স্নিগ্ধার পালানোর কোনো পথ নেই দেখেই উৎস বাড়ির দরজা খোলা রাখে, খোলা রাখে বলতে ভেতর থেকে আটকানো থাকে। স্নিগ্ধার যখন ইচ্ছে তখন বাগান পরিদর্শনে বেরোয়।
ঠিক তেমনি ভোরেও স্নিগ্ধা বাগানের ফুলেদের সাথে ভাব বিনিময় করে নিজের অস্থিরতায় পরিপূর্ণ চিত্ত শান্তিপূর্ণ করতে বাগান পরিদর্শনে এসেছিলো।
ফুলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতটাই মুগ্ধকর স্নিগ্ধা ফুলের সৌন্দর্যে হারিয়ে গিয়েছিলো। ঘন্টা দুয়েকের মতো এই বাগানেই এই ফুল তো ওই ফুলের কাছে ঘুরে বেড়ালো। তাদের সৌন্দর্য কাছ থেকে দেখলো, মন চাইলো তো ডান হাতের দু আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো। গোলাপ ফুলের ঘ্রাণ শুকলো প্রাণ ভরে। এতকিছুর মাঝেও স্নিগ্ধার চিত্তে ওই কান্নারত, অসহায়ত্ব ফুটে উঠা মুখশ্রীর কথাই ভেসে বেড়াতে লাগলো।
উৎস মন্দ নয়, ভাবলো খানিকটা স্নিগ্ধা। পরক্ষণেই ভাবলো এসব ভাবনা ভিত্তিহীন। বয়সের ক্ষেত্রে আকাশ পাতাল পার্থক্য তাদের। তেরো বছরের! স্নিগ্ধা মুখে কয়েকবার আওড়ালো “তেরো বছর”। কোনোভাবেই এই লোককে ভালোবাসা সম্ভব নয়। তুলে এনেছে তাকে, পরিবার থেকে আলাদা করে এনেছে এই এতদূর।
এরজন্য হলেও এই লোককে ভালোবাসা উচিৎ নয়।
এমনিতে উৎসকে যে কোনো নারীই ভালোবাসবে, তবে স্নিগ্ধা পারবেনা। এটা স্নিগ্ধার মস্তিষ্কের কথা হলেও স্নিগ্ধা উপলব্ধি করছে মন ভিন্ন কথা বলছে।
এসব ভাবা বাদ দিলো স্নিগ্ধা। আশেপাশে পাখিরা কিচিরমিচির করছে। পরিবেশটা ভালোই উপভোগ করছে স্নিগ্ধা। কিন্তু না চাইতেও চিত্ত উৎসের কথা তুলছে বারবার। স্নিগ্ধা ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লো। অপবিত্র হয়ে এসব ভাবাও তো হাস্যকর দেখায়। ভেবেই তাচ্ছিল্যর হাসলো স্নিগ্ধা। সামনে সদ্য ফোঁটা গোলাপ ফুলটাকে যেই ছুঁয়ে দিতে যাবে অমনি পেছন থেকে উৎসের গম্ভীর কণ্ঠস্বরের বাক্য বচন শুনতে পেলো স্নিগ্ধা।
“তৈরী হও, তোমাকে তোমার আপন নীড়ে দিয়ে আসবো।”(গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)
স্নিগ্ধার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো, চমকানো দৃষ্টিতে উৎসের দিকে ফিরে চাইলো। নির্বোধ হয়ে বলে উঠলো,,
“হঠাৎ বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছেন? সুস্থ আপনি?”(নির্বোধ কণ্ঠে)
উৎস প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। রাশভারি কণ্ঠে বলে উঠলো,,
“ভালোবাসা আমার প্রাপ্য নয় স্নিগ্ধা। আমার বোঝা হয়ে গেছে দারুন ভাবে। পাখিকে উড়তে দেওয়া উচিৎ, তারা স্বাধীন। তাদের স্বাধীনতায় ব্যাঘাত করা উচিৎ নয়। তাদের জোর করে খাঁচায় ভরে রাখলে তারা একটু একটু করে বিলীন হয়ে যায়। তুমি আমার না হও তবুও বিলীন হয়ো না। মুক্তি চেয়েছিলে না? আজ তোমার মুক্তি। গত দুইদিনের জন্য ক্ষমা করো আমায়।” (রাশভারি স্বরে)
স্নিগ্ধা থমকালো, একধাপ অবাক হলো। রাতারাতি কি এমন হলো আগের উৎস আর আজকের উৎসের মাঝে এতো বিস্তর ফারাক! উৎস তাকে মুক্তি দিবে, খুশি হলো স্নিগ্ধা। তবে হলোনা এটা ভেবে শুধু খুশি? তার তো ভীষণ খুশি হওয়া উচিৎ সেখানে শুধু খুশি কেনো যেন মানতে পারছেনা স্নিগ্ধা। সে এতো অল্প খুশি চায়না, সে ভীষণ খুশি চায়। তবে কি কিছু অনুভব করছে স্নিগ্ধা।
।
।
দীর্ঘ একটা জার্নির পর অবশেষে কানাডার মাটিতে পা রাখলো আদিত। এয়ারপোর্ট এসে দাঁড়িয়েছে কাঙ্খিত ব্যাক্তির আশায়। ফোন অন করতেই তব্দা খেলো আদিত। অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে মেসেজ ও একটা ভিডিও এসেছে। ইংরেজিতে মেসেজ দেওয়া, মেসেজটা ঠিক এমন,,
“ওয়েলকাম ব্যাক। দুই তীরেই সব হারানোর জন্য তৈরী থেকো আদিত রায় উড়ফে হিটম্যান। একুলে বাবাকে হারানোর বেদনা ঐকূলে গোটা পরিবার। অভিনন্দন ধ্বংসকে আপন করে নেওয়ার জন্য।”
আদিত থ হয়ে ভিডিওটা অন করলো। প্রায় সবকিছুই আঁধার, হুট্ করে নজরে আসলো ইলা, কৌশিক চৌধুরী ও প্রমীলা চৌধুরীর র’ক্তা’ক্ত দেহ। হৃদমাঝারে ধ্বক করে উঠলো আদিতের। নিজের বিনাশ চাইলেও প্রেয়সীর এমন রক্তিভ অবস্থা তো কখনোই দেখতে চায়নি আদিত। হৃদয়ে ঝড় উঠেছে আদিতের। চারদিকে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছে সে, বুক ফেটে কান্নারা বেরিয়ে আসতে চাইছে।
চলবে..?